শিকাগোর ঝকঝকে রোদ, কার্বন বাণিজ্য by কামরুল ইসলাম চৌধুরী
যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে গ্রীষ্মের
ঝকঝকে রোদ। সেই সাত-সকালে জুলাইয়ের নরম রোদ মাখিয়ে লেক মিশিগানের তীর ধরে
আমাদের ট্যাক্সি ছুটে চলেছে হোটেল হায়াত রিজেন্সি ম্যাকর্নি প্লেস অভিমুখে।
সঙ্গে ১৭ বছরের কিশোর দূত শাহ মিম রাফায়াত চৌধুরী। নেপালি স্মার্ট তরুণ
ট্যাক্সিচালকের প্রশ্ন : ‘তোমরা কি নোবেলজয়ী আল গোরের জলবায়ু সম্মেলনে
যাচ্ছো?’ কানাডার টরন্টো নগরী লাগোয়া লেক মিশিগানের নদী জলরাশি ফুঁড়ে
ততক্ষণে লাল আভা ছড়িয়ে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি তাড়িয়ে আকাশজুড়ে সূর্য উঠেছে।
ট্যাক্সিচালককে বললাম, ‘হ্যাঁ, ৭টার আগে ওখানে পৌঁছতে হবে।’ আল গোরের
সঙ্গে প্রাতঃরাশ বৈঠক। রাফা আর আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক
হয়ে শিল্পনগরী শিকাগো পৌঁছেছি। এখনও দু’দিনের টানা জেট ল্যাগ কাটেনি। আল
গোরের নিমন্ত্রণ বলে কথা। কত হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে ছুটে আসা হল এই সুদূর
মার্কিন মুল্লুকে। ছেলে তার ছোটবেলার আইডল আল গোরের একটুখানি সান্নিধ্য
পাবে এ আশায়। কাঁটায় কাঁটায় দিনের কর্মসূচি প্রাতঃরাশ দিয়ে শুরু। সাতটার
আগেই সবাই হাজির। রসকষহীন বিষয় জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ, বিরূপ প্রভাব,
বিপন্নতা, স্লাইড শো, ভিডিও ক্লিপ, তথ্য-উপাত্তসহ উদাহরণ দিয়ে অসাধারণ
বাগ্মিতায়, হাসি-কৌতুকের ব্যঞ্জনায়, অনন্য প্রাঞ্জলতায় আল গোর তার ভাষণ
দিয়ে চলেছেন। প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার মোড়
ঘোরানো শিক্ষকের কথা উঠল, কী করে তিনি সদ্য তরুণ আল গোরকে জলবায়ু পরিবর্তন
বিজ্ঞানের সঙ্গে পরবর্তী গোটা জীবন জড়িয়ে দিলেন। জলবায়ু পরিবর্তন যে হচ্ছে,
তা যে ধ্র“ব সত্য, ইনকনভেনিয়েন্ট ট্র–থ, সে কথা নানাভাবে বৈজ্ঞানিক
বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বুঝিয়ে চললেন তিনি। বাবা-ছেলে আমরা দু’জন কত
কাছ থেকে তার সম্মোহনী ভাষণ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছি। হƒদয়ঙ্গম করছি।
রাফায়াত সেই ২০০৬ সালে গোরের ‘ইনকনভেনিয়েন্ট ট্র–থ’ ছবিটি দেখেছে অতি কাঁচা
বয়সে। বইটির প্রতিটি পৃষ্ঠা ওর মুখস্থ।
আল গোর তার জীবনের ভুল-শুদ্ধ, চড়াই-উৎরাই সবকিছু ক্লাইমেট রিয়েলিটি লিডারশিপ প্রশিক্ষণে আসা সবার সঙ্গে অকপটে শেয়ার করলেন। তার জলবায়ু ভাবনার কথা জানালেন। বারবার কৃতজ্ঞতা জানালেন আমরা তার ডাকে সাড়া দিয়েছি বলে। জলবায়ুতাড়িত বিপন্নতা, সর্বগ্রাসী সংকটের চিত্র আঁকলেন। তার আশংকার কথা জানালেন। সমাধানের পথ বাতলালেন। হারিকেন স্যান্ডি, সিডর-আইলার কথা বললেন। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত ও দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জলবায়ুতাড়িত বিপর্যয়ের কথা বললেন বিস্তারিত ও বিরামহীনভাবে। ওবামার সাম্প্রতিক জলবায়ু ভাষণের প্রশংসা করে বললেন, জলবায়ু সংকট সমাধানের জন্য এখন কার্বন ট্যাক্স চালু করা জরুরি। নইলে কার্বণ দূষণ থামানো যাবে না। জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলার সুবর্ণ সুযোগ হেলাফেলায় হারানো যাবে না। রাষ্ট্রনায়কদের চটজলদি সমঝোতায় পৌঁছতে হবে, জরুরিভাবে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক কার্যক্রম নিতে হবে।
বিকালের চা বিরতির ফাঁকে আল গোর প্রতিষ্ঠিত ক্লাইমেট রিয়েলিটি প্রোগ্রামের বোর্ড সদস্য অস্ট্রেলিয়ান ডন হেনরি কাছে এসে অনুযোগের সুরে বলল, ‘তুমি আল গোরের সঙ্গে কিয়োটো প্রটোকল তৈরির সময় কাজ করেছ, তা বলনি তো? তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমি খুবই সৌভাগ্যবান। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তুমি আসায় আল গোর খুবই খুশি হয়েছেন। আরও আনন্দিত হলাম তোমার ছেলে এ প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে বলে। তোমাদের পিতা-পুত্রের সঙ্গে আল গোর একান্ত বিশেষভাবে কথা বলতে চাইছেন।’
শুনে তো রাফা তখনই ছটফট শুরু করেছে। মিনিট বাদে আরও দু’জন কর্মকর্তা এসে জানালেন, দিনজুড়ে ভাষণ উপস্থাপনা শেষে সন্ধ্যায় আমাদের দু’জনকে একান্তে কথা বলার সময় দিয়েছেন সাবেক আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর রাতে অতি অল্পসংখ্যক আমন্ত্রিত ভিআইপি ডিনার রিসেপশনে বাপ-বেটাকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগে আমাদের দু’জনকে এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়া হল বেসমেন্টের সিঁড়ির পাশে জলবায়ু তথা শান্তিতে নোবেলজয়ীর অস্থায়ী ক্যাম্পের সামনে। রাফা তার ‘বর্ণ টু স্মাইল’ আল গোরের হাতে তুলে দিল। দেখলাম কী নিবিড়ভাবে প্রতিটি পৃষ্ঠায় তিনি চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন। আমার ছেলের কাজ দেখছেন কী অবাক বিস্ময়ে। ১৭ বছরের এক কিশোরের লেখা, সম্পাদনা, তথ্য-উপাত্ত চিত্র। রাফার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ব্যক্তিগত আলোকচিত্রীদের বললেন। আমি আল গোরকে বললাম, ‘তুমি ওর ছোটবেলার আইডল।’ আল গোর তার হাতের মায়াবী পরশ আমার ছেলের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘না, তুমি ওর বড় আইডল। তুমি এখনও জলবায়ু নেগোসিয়েশন নিয়ে সেই আগের মতোই লেগে আছ। আই এডমায়ার ইওর টেনাসিটি অ্যান্ড গ্রেট কমিটমেন্ট।’
ডিনার রিসেপশনে আল গোর আবার রাফার সঙ্গে ছবি তুললেন। ঠিকভাবে ছবি উঠেছে কি-না পরখ করে দেখলন। বললাম, ‘আগামী নভেম্বরে ওয়ারশ জলবায়ু সম্মেলনে যেতে হবে। ওবামা ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলো। নইলে জলবায়ু নেগোসিয়েশনে সমঝোতায় পৌঁছানো কঠিন হবে।’ বললেন, ‘আমি বদলেছি, তুমি কিন্তু একদম বদলাওনি হে আমার বন্ধু। কথা দিলাম কথা বলব। তোমরাও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাও।’
২ আগস্ট শিকাগো থেকে নিউইয়র্ক ফেরার পথে বারবার মনে হচ্ছিল, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বৈশ্বিক প্রয়াস কতটা সফল হবে নিকট-আগামীই তা বলে দেবে। কার্বন বাণিজ্য লবির অর্থ ও ক্ষমতা বৃত্ত ভেদ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর সবুজ অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়ন নির্ভর করবে তার ওপর।
কামরুল ইসলাম চৌধুরী : উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অন্যতম শীর্ষ জলবায়ু নেগোসিয়েটর, জাতিসংঘ অভিযোজন কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান
আল গোর তার জীবনের ভুল-শুদ্ধ, চড়াই-উৎরাই সবকিছু ক্লাইমেট রিয়েলিটি লিডারশিপ প্রশিক্ষণে আসা সবার সঙ্গে অকপটে শেয়ার করলেন। তার জলবায়ু ভাবনার কথা জানালেন। বারবার কৃতজ্ঞতা জানালেন আমরা তার ডাকে সাড়া দিয়েছি বলে। জলবায়ুতাড়িত বিপন্নতা, সর্বগ্রাসী সংকটের চিত্র আঁকলেন। তার আশংকার কথা জানালেন। সমাধানের পথ বাতলালেন। হারিকেন স্যান্ডি, সিডর-আইলার কথা বললেন। যুক্তরাষ্ট্রের চেয়েও বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত ও দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জলবায়ুতাড়িত বিপর্যয়ের কথা বললেন বিস্তারিত ও বিরামহীনভাবে। ওবামার সাম্প্রতিক জলবায়ু ভাষণের প্রশংসা করে বললেন, জলবায়ু সংকট সমাধানের জন্য এখন কার্বন ট্যাক্স চালু করা জরুরি। নইলে কার্বণ দূষণ থামানো যাবে না। জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলার সুবর্ণ সুযোগ হেলাফেলায় হারানো যাবে না। রাষ্ট্রনায়কদের চটজলদি সমঝোতায় পৌঁছতে হবে, জরুরিভাবে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক কার্যক্রম নিতে হবে।
বিকালের চা বিরতির ফাঁকে আল গোর প্রতিষ্ঠিত ক্লাইমেট রিয়েলিটি প্রোগ্রামের বোর্ড সদস্য অস্ট্রেলিয়ান ডন হেনরি কাছে এসে অনুযোগের সুরে বলল, ‘তুমি আল গোরের সঙ্গে কিয়োটো প্রটোকল তৈরির সময় কাজ করেছ, তা বলনি তো? তোমার সঙ্গে পরিচিত হতে পেরে আমি খুবই সৌভাগ্যবান। এত ব্যস্ততার মধ্যেও তুমি আসায় আল গোর খুবই খুশি হয়েছেন। আরও আনন্দিত হলাম তোমার ছেলে এ প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে বলে। তোমাদের পিতা-পুত্রের সঙ্গে আল গোর একান্ত বিশেষভাবে কথা বলতে চাইছেন।’
শুনে তো রাফা তখনই ছটফট শুরু করেছে। মিনিট বাদে আরও দু’জন কর্মকর্তা এসে জানালেন, দিনজুড়ে ভাষণ উপস্থাপনা শেষে সন্ধ্যায় আমাদের দু’জনকে একান্তে কথা বলার সময় দিয়েছেন সাবেক আমেরিকান ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর রাতে অতি অল্পসংখ্যক আমন্ত্রিত ভিআইপি ডিনার রিসেপশনে বাপ-বেটাকে তিনি আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নির্ধারিত সময়ের কয়েক মিনিট আগে আমাদের দু’জনকে এসকর্ট করে নিয়ে যাওয়া হল বেসমেন্টের সিঁড়ির পাশে জলবায়ু তথা শান্তিতে নোবেলজয়ীর অস্থায়ী ক্যাম্পের সামনে। রাফা তার ‘বর্ণ টু স্মাইল’ আল গোরের হাতে তুলে দিল। দেখলাম কী নিবিড়ভাবে প্রতিটি পৃষ্ঠায় তিনি চোখ বুলিয়ে যাচ্ছেন। আমার ছেলের কাজ দেখছেন কী অবাক বিস্ময়ে। ১৭ বছরের এক কিশোরের লেখা, সম্পাদনা, তথ্য-উপাত্ত চিত্র। রাফার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য ব্যক্তিগত আলোকচিত্রীদের বললেন। আমি আল গোরকে বললাম, ‘তুমি ওর ছোটবেলার আইডল।’ আল গোর তার হাতের মায়াবী পরশ আমার ছেলের মাথায় বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ‘না, তুমি ওর বড় আইডল। তুমি এখনও জলবায়ু নেগোসিয়েশন নিয়ে সেই আগের মতোই লেগে আছ। আই এডমায়ার ইওর টেনাসিটি অ্যান্ড গ্রেট কমিটমেন্ট।’
ডিনার রিসেপশনে আল গোর আবার রাফার সঙ্গে ছবি তুললেন। ঠিকভাবে ছবি উঠেছে কি-না পরখ করে দেখলন। বললাম, ‘আগামী নভেম্বরে ওয়ারশ জলবায়ু সম্মেলনে যেতে হবে। ওবামা ও অন্যদের সঙ্গে কথা বলো। নইলে জলবায়ু নেগোসিয়েশনে সমঝোতায় পৌঁছানো কঠিন হবে।’ বললেন, ‘আমি বদলেছি, তুমি কিন্তু একদম বদলাওনি হে আমার বন্ধু। কথা দিলাম কথা বলব। তোমরাও সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাও।’
২ আগস্ট শিকাগো থেকে নিউইয়র্ক ফেরার পথে বারবার মনে হচ্ছিল, জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় বৈশ্বিক প্রয়াস কতটা সফল হবে নিকট-আগামীই তা বলে দেবে। কার্বন বাণিজ্য লবির অর্থ ও ক্ষমতা বৃত্ত ভেদ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানিনির্ভর সবুজ অর্থনীতি ও টেকসই উন্নয়ন নির্ভর করবে তার ওপর।
কামরুল ইসলাম চৌধুরী : উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অন্যতম শীর্ষ জলবায়ু নেগোসিয়েটর, জাতিসংঘ অভিযোজন কমিটির সদস্য এবং বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের চেয়ারম্যান
No comments