ফেসবুক দেশে কী ভূমিকা রাখছে by রাজীন অভী মুস্তাফিজ
একটু
ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আমাদের জীবনে বিনোদনের উৎস খুবই সীমিত!
পুরো বাংলাদেশের কথা না হয় বাদই দিলাম, রাজধানী ঢাকাতেই একটা ভালো পার্ক
খুঁজে পাওয়া যায় না। কোনো একটা পাবলিক পার্কে যদি আপনি ভুল করে ঢুকে পড়েন,
তাহলে পদে পদে আপনাকে বিব্রত হতে হবে। প্রথমত, নোংরা আর্বজনা সরিয়ে সরিয়ে
এগোতে হবে। তারপর ভাগ্য আরও খারাপ হলে আপনাকে পড়তে হতে পারে চাঁদাবাজ বা
ছিনতাইকারীর খপ্পরে! আর যদি চিড়িয়াখানায় কিছু সময়ের জন্য বেড়িয়ে আসতে চান,
উৎকট দুর্গন্ধ, অব্যবস্থাপনা আর মুমূর্ষু প্রাণীগুলো দেখে কখন সেখান থেকে
বের হতে পারবেন, তা নিয়ে চিন্তিত থাকবেন আপনি। যদি আপনি খেলা দেখে বিনোদন
পেতে চান সেখানেও অবিশ্বাস- আপনার দেখা সেই ম্যাচটি পাতানো কি-না! আর যদি
টেলিভিশনের অনুষ্ঠান দেখে নির্মল বিনোদন নিতে চান, তাহলে অতিরিক্ত
বিজ্ঞাপনের যন্ত্রণায় কিছু সময় পরই আপনি ভুলে যাবেন বিরতির আগে আপনি আসলে
ঠিক কী দেখেছিলেন। আসলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নিজস্ব বিনোদনের ওপর
আমাদের তেমন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। হয়তো সেজন্যই যখন ইন্টারনেটের ভেতর দিয়ে
আমরা সামাজিক যোগাযোগের একটা মাধ্যম খুঁজে পেলাম, খুব সহজেই সেটার প্রতি
আকৃষ্ট হয়ে গেলাম। ফেসবুক হচ্ছে সেই সোস্যাল নেটওয়ার্ক, যার ওপর দিন দিন
আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি। কেউ কেউ হয়তো টুইটারের জনপ্রিয়তার কথাও বলবেন।
কিন্তু সমীক্ষা বলছে, পশ্চিমা দেশগুলোর মতো বাংলাদেশে টুইটার ততটা জনপ্রিয়
হয়ে ওঠেনি এখনও। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে বিশ্বের এক নম্বর
জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক আসলে কী ধরনের ভূমিকা রাখছে? আমার
কিছু পরিচিত মানুষের ভাষ্য হচ্ছে, ফেসবুক বা এ ধরনের সামাজিক যোগাযোগ
মাধ্যমের আসলে কোনো প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি হচ্ছে, যাদের
সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে, তাদের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখার
কোনো প্রয়োজন নেই। আর যাদের সঙ্গে বহু বছর ধরে যোগাযোগ নেই, বুঝতে হবে সেসব
মানুষের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ রাখা বা না রাখার তেমন কোনো গুরুত্ব বা
দরকার নেই। কিন্তু বাস্তবতার বিচারে তাদের এ বক্তব্যের সঙ্গে একাÍ হওয়ার
সুযোগ নেই। বিশ্বায়নের এ যুগে নিজের মুক্তচিন্তার পরিধি, স্বাধীন
মতপ্রকাশের গণতান্ত্রিক অধিকার এবং যে কোনো বিষয়ে ভালো লাগা বা মন্দ লাগার
অনুভূতি বিস্তৃত করার পাশাপাশি সমাজের অন্য মানুষদের মতাদর্শ জানতে
চাওয়াটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে ফেসবুক একটি প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করে।
ইতিমধ্যেই আমরা দেখেছি ফেসবুকের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক ও সামাজিক
আন্দোলনের ইতিবাচক ফলাফল। একই সঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতার পাশাপাশি অরাজনৈতিক
অনেক সফলতাও চোখে পড়ে ফেসবুকের মাধ্যমে। আর পারস্পরিক যোগাযোগের মাধ্যমে
সামাজিক যোগাযোগের বিস্তৃতির কথা তো উল্লেখ না করলেই নয়।
আমাদের তরুণ সমাজের কাছে ফেসবুক এখন অত্যন্ত পরিচিত একটি শব্দ। কম্পিউটার বা সেলুলার ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যেসব তরুণ ‘ফেসবুকিং’ করছে না, তাদের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু ঠিক কী ধরনের সুফল এ তরুণরা পাচ্ছে ফেসবুক থেকে? এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তাদের সামাজিক যোগাযোগের পরিধি বেড়েছে। এখন তারা খুব দ্রুতই কোনো বিষয় নিয়ে নিজেদের ভেতর যোগাযোগ করতে পারছে। যেমন ধরা যাক, কোনো মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ফেসবুকের অন্য বন্ধুদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরলে তারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারে, কিংবা তারাও তাদের বন্ধুদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করে বৃহত্তর একটি যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও এখন ফেসবুকে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বেশিরভাগ গণমাধ্যম, রেস্তোরাঁ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির নিজস্ব ফ্যান পেইজ আছে, যেখানে মতামত দেয়ার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ করা যায়, যা নিঃসন্দেহে পারস্পরিক যোগাযোগের এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আর বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির অনুসারী হয়ে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত জানার সুবিধাটুকু তো আছেই। এছাড়াও আরও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক খুঁজে পাওয়া যায় এ ফেসবুক দুনিয়ায়।
অন্যদিকে এটাও মিথ্যা নয় যে, আমাদের দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীরা বিশেষত তরুণরা ঠিক যে ধরনের কাজে ফেসবুক ব্যবহার করছে, তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়ের অপচয় হচ্ছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে বোধহয় ব্যাপারটা আরেকটু সহজ হবে। আমি লক্ষ্য করেছি, দেশের অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী একটু পরপরই তাদের স্ট্যাটাস আপডেট করছে অর্থাৎ চলমান ধারাভাষ্যের মতো তাদের প্রতিমুহূর্তের অনুভূতি অন্য ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তারা হয়তো তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে যা অন্যদের জানার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে আর ব্যক্তিগত রাখছে না, যা নিঃসন্দেহে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণও হতে পারে। এছাড়াও লক্ষ্য করা যায়, কেউ কেউ প্রায় প্রতিমুহূর্তেই তাদের ছবি প্রকাশ (আপলোড) করছে, যা তার অন্য ফেসবুক বন্ধুরা দেখতে পারছে। কারও কারও ক্ষেত্রে এর সংখ্যা এত বেশি যা তার অন্য বন্ধুদের করছে বিব্রত। ফেসবুকে ঘন ঘন ছবি আপলোড নিয়ে যুক্তরাজ্যের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়- ওয়েস্ট অফ ইংল্যান্ড, এডিনবারা ও বার্মিংহামের গবেষকরা উপসংহারে পৌঁছেছেন, ঘন ঘন ছবি প্রকাশ বাস্তব জীবনে ঘনিষ্ঠতা কমিয়ে আনার পাশাপাশি জনবিচ্ছিন্ন করে এবং ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফেসবুকে লক্ষ্যহীন সময় অপচয়কারীদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত দিয়েছে আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তারা বলেছেন, ফেসবুকে অনেক বেশি সময় অপচয়কারীরা একটা সময় উপলব্ধি করতে পারে যে, তারা অকারণেই জীবনের অনেক মূল্যবান সময় ফেসবুকে ব্যয় করে ফেলেছে, যা তাদের হতাশ ও অসুখী করে তোলে। তারপরও কেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছি আমরা? এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় আন্তঃসম্পর্কিত। প্রথমত, ফেসবুক ব্যবহার আমাদের অহংবোধের (বা ইগো) স্ফুরণ ঘটায়। যেমন, যে কোনো একটি অনুভূতি বা ছবি প্রকাশ করেই একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী আশা করতে থাকে, তার ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা অন্য ব্যবহারকারীরা এ বিষয়ে তাদের ইতিবাচক মতামত দেবে এবং ‘লাইক’ বাটনটি ক্লিক করে তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে। এভাবে আমরা প্রতিমুহূর্তে সামাজিক স্বীকৃতির আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুক ব্যবহার করে চলেছি। কখনও নিজের স্ট্যাটাস আপডেট, কখনোবা অন্য বন্ধুদের স্ট্যাটাস বা প্রকাশিত ছবিতে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে প্রতিনিয়ত নিজের অস্তিত্ব¡ জানান দিতে ব্যস্ত আমাদের তরুণ সমাজ। দ্বিতীয়ত, ফেসবুকের প্রোফাইলের মাধ্যমে আমরা আমাদের সামাজিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চাই। আমরা চেষ্টা করি আমাদের ফেসবুক প্রোফাইলটা ঠিক সেভাবে সাজাতে, যা সেই শ্রেণীর কাছে খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য হয় যাদের সঙ্গে আমরা নিজেদের একাত্ম করতে চাই।
বাংলাদেশে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট পরবর্তী যুগ আমাদের সমাজকে সূক্ষ্মভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে। এক পক্ষ হচ্ছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সম্পর্কে স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন ও প্রায় অব্যবহারকারী অভিভাবকরা। অন্যপক্ষ হচ্ছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট জ্ঞানসম্পন্ন ও ব্যবহারকারী তারুণ্য। এমন নয় যে, আমাদের অভিভাবকরা চাইলে কম্পিউটার বা ইন্টারনেট বিষয়ে দক্ষ হতে পারবেন না। কারণ এগুলো এমন কোনো জটিল বিষয় নয় যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শেখার দক্ষতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু যেহেতু তারা জীবনের বেশিরভাগ সময় কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ছাড়াই সব কাজ সমাধা করেছেন, সেহেতু তারা এতে দক্ষ হওয়ার তেমন কোনো তাগিদ অনুভব করেন না। তবে চাইলেই তারা তা করতে পারেন।
আমাদের সমাজে একটি মহল আছে যারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে অস্বীকার করতে চায়, শুধুই এর নেতিবাচক দিক খুঁজে বের করতে চায়। তাদের ধারণা, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক এসব যোগাযোগের মাধ্যম আমাদের সমাজে শুধুই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করি। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে অনলাইন/ইন্টারনেট বা নিউ মিডিয়াকে অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই। নিউ মিডিয়ার প্রভাব ও এর ইতিবাচক ভূমিকাকে খাটো করে দেখারও কোনো উপায় নেই। এটা যেমন সত্য যে, পুলিশ কর্মকর্তা-দম্পতির হত্যায় অভিযুক্ত মেয়েটি তার অপর হত্যা-সহযোগীদের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছে, তেমনি এটাও সত্য, মিসরে হোসনি মোবারক সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট লাখ লাখ মানুষ তাহরির স্কয়ারে এসেছিল ফেসবুকের একটা ছোট্ট যোগাযোগের সূত্র ধরেই। সেক্ষেত্রে বলা যায়, যে কোনো একটি বিষয় থেকে আমরা ঠিক কী ধরনের সেবা নেব বা ঠিক কিভাবে কাজে লাগাব, সেটা নির্ভর করছে আমাদের ওপরই। তাই ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফেসবুক আমাদের সামনে যে এক নতুন দুনিয়া উন্মোচন করেছে, তা কাজে লাগিয়ে সমাজে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি।
রাজীন অভী মুস্তাফিজ : ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক
আমাদের তরুণ সমাজের কাছে ফেসবুক এখন অত্যন্ত পরিচিত একটি শব্দ। কম্পিউটার বা সেলুলার ফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যেসব তরুণ ‘ফেসবুকিং’ করছে না, তাদের সংখ্যা খুবই কম। কিন্তু ঠিক কী ধরনের সুফল এ তরুণরা পাচ্ছে ফেসবুক থেকে? এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, তাদের সামাজিক যোগাযোগের পরিধি বেড়েছে। এখন তারা খুব দ্রুতই কোনো বিষয় নিয়ে নিজেদের ভেতর যোগাযোগ করতে পারছে। যেমন ধরা যাক, কোনো মুমূর্ষু রোগীর রক্তের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে ফেসবুকের অন্য বন্ধুদের কাছে বিষয়টি তুলে ধরলে তারা সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসতে পারে, কিংবা তারাও তাদের বন্ধুদের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করে বৃহত্তর একটি যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও এখন ফেসবুকে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় বেশিরভাগ গণমাধ্যম, রেস্তোরাঁ, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদির নিজস্ব ফ্যান পেইজ আছে, যেখানে মতামত দেয়ার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক যোগাযোগ করা যায়, যা নিঃসন্দেহে পারস্পরিক যোগাযোগের এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। আর বিখ্যাত কোনো ব্যক্তির অনুসারী হয়ে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত জানার সুবিধাটুকু তো আছেই। এছাড়াও আরও বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক দিক খুঁজে পাওয়া যায় এ ফেসবুক দুনিয়ায়।
অন্যদিকে এটাও মিথ্যা নয় যে, আমাদের দেশের ফেসবুক ব্যবহারকারীরা বিশেষত তরুণরা ঠিক যে ধরনের কাজে ফেসবুক ব্যবহার করছে, তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়ের অপচয় হচ্ছে। একটা ছোট্ট উদাহরণ দিলে বোধহয় ব্যাপারটা আরেকটু সহজ হবে। আমি লক্ষ্য করেছি, দেশের অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী একটু পরপরই তাদের স্ট্যাটাস আপডেট করছে অর্থাৎ চলমান ধারাভাষ্যের মতো তাদের প্রতিমুহূর্তের অনুভূতি অন্য ফেসবুক বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে তারা হয়তো তাদের ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলো অনেকের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে যা অন্যদের জানার কোনো প্রয়োজন নেই। এটি তাদের ব্যক্তিগত জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলোকে আর ব্যক্তিগত রাখছে না, যা নিঃসন্দেহে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণও হতে পারে। এছাড়াও লক্ষ্য করা যায়, কেউ কেউ প্রায় প্রতিমুহূর্তেই তাদের ছবি প্রকাশ (আপলোড) করছে, যা তার অন্য ফেসবুক বন্ধুরা দেখতে পারছে। কারও কারও ক্ষেত্রে এর সংখ্যা এত বেশি যা তার অন্য বন্ধুদের করছে বিব্রত। ফেসবুকে ঘন ঘন ছবি আপলোড নিয়ে যুক্তরাজ্যের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়- ওয়েস্ট অফ ইংল্যান্ড, এডিনবারা ও বার্মিংহামের গবেষকরা উপসংহারে পৌঁছেছেন, ঘন ঘন ছবি প্রকাশ বাস্তব জীবনে ঘনিষ্ঠতা কমিয়ে আনার পাশাপাশি জনবিচ্ছিন্ন করে এবং ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফেসবুকে লক্ষ্যহীন সময় অপচয়কারীদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত দিয়েছে আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। তারা বলেছেন, ফেসবুকে অনেক বেশি সময় অপচয়কারীরা একটা সময় উপলব্ধি করতে পারে যে, তারা অকারণেই জীবনের অনেক মূল্যবান সময় ফেসবুকে ব্যয় করে ফেলেছে, যা তাদের হতাশ ও অসুখী করে তোলে। তারপরও কেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুকে সময় কাটাচ্ছি আমরা? এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় আন্তঃসম্পর্কিত। প্রথমত, ফেসবুক ব্যবহার আমাদের অহংবোধের (বা ইগো) স্ফুরণ ঘটায়। যেমন, যে কোনো একটি অনুভূতি বা ছবি প্রকাশ করেই একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী আশা করতে থাকে, তার ফ্রেন্ড লিস্টে থাকা অন্য ব্যবহারকারীরা এ বিষয়ে তাদের ইতিবাচক মতামত দেবে এবং ‘লাইক’ বাটনটি ক্লিক করে তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করবে। এভাবে আমরা প্রতিমুহূর্তে সামাজিক স্বীকৃতির আশায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফেসবুক ব্যবহার করে চলেছি। কখনও নিজের স্ট্যাটাস আপডেট, কখনোবা অন্য বন্ধুদের স্ট্যাটাস বা প্রকাশিত ছবিতে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে প্রতিনিয়ত নিজের অস্তিত্ব¡ জানান দিতে ব্যস্ত আমাদের তরুণ সমাজ। দ্বিতীয়ত, ফেসবুকের প্রোফাইলের মাধ্যমে আমরা আমাদের সামাজিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চাই। আমরা চেষ্টা করি আমাদের ফেসবুক প্রোফাইলটা ঠিক সেভাবে সাজাতে, যা সেই শ্রেণীর কাছে খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য হয় যাদের সঙ্গে আমরা নিজেদের একাত্ম করতে চাই।
বাংলাদেশে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট পরবর্তী যুগ আমাদের সমাজকে সূক্ষ্মভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছে। এক পক্ষ হচ্ছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সম্পর্কে স্বল্প জ্ঞানসম্পন্ন ও প্রায় অব্যবহারকারী অভিভাবকরা। অন্যপক্ষ হচ্ছে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট জ্ঞানসম্পন্ন ও ব্যবহারকারী তারুণ্য। এমন নয় যে, আমাদের অভিভাবকরা চাইলে কম্পিউটার বা ইন্টারনেট বিষয়ে দক্ষ হতে পারবেন না। কারণ এগুলো এমন কোনো জটিল বিষয় নয় যা বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শেখার দক্ষতাকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু যেহেতু তারা জীবনের বেশিরভাগ সময় কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ছাড়াই সব কাজ সমাধা করেছেন, সেহেতু তারা এতে দক্ষ হওয়ার তেমন কোনো তাগিদ অনুভব করেন না। তবে চাইলেই তারা তা করতে পারেন।
আমাদের সমাজে একটি মহল আছে যারা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে অস্বীকার করতে চায়, শুধুই এর নেতিবাচক দিক খুঁজে বের করতে চায়। তাদের ধারণা, ইন্টারনেটের মাধ্যমে সামাজিক এসব যোগাযোগের মাধ্যম আমাদের সমাজে শুধুই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণ দ্বিমত পোষণ করি। একবিংশ শতাব্দীর এ সময়ে অনলাইন/ইন্টারনেট বা নিউ মিডিয়াকে অগ্রাহ্য করার কোনো উপায় নেই। নিউ মিডিয়ার প্রভাব ও এর ইতিবাচক ভূমিকাকে খাটো করে দেখারও কোনো উপায় নেই। এটা যেমন সত্য যে, পুলিশ কর্মকর্তা-দম্পতির হত্যায় অভিযুক্ত মেয়েটি তার অপর হত্যা-সহযোগীদের সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচিত হয়েছে, তেমনি এটাও সত্য, মিসরে হোসনি মোবারক সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট লাখ লাখ মানুষ তাহরির স্কয়ারে এসেছিল ফেসবুকের একটা ছোট্ট যোগাযোগের সূত্র ধরেই। সেক্ষেত্রে বলা যায়, যে কোনো একটি বিষয় থেকে আমরা ঠিক কী ধরনের সেবা নেব বা ঠিক কিভাবে কাজে লাগাব, সেটা নির্ভর করছে আমাদের ওপরই। তাই ইন্টারনেটের মাধ্যমে ফেসবুক আমাদের সামনে যে এক নতুন দুনিয়া উন্মোচন করেছে, তা কাজে লাগিয়ে সমাজে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারি।
রাজীন অভী মুস্তাফিজ : ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক শিক্ষক
No comments