অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের দুর্বলতা দূর করতে হবে by ধীরাজ কুমার নাথ
ভারত-পাকিস্তান
যুদ্ধ হয়েছিল ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ দিন অবধি, যার পরিসমাপ্তি
ঘটেছিল তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব
খান তখন পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অধ্যাদেশ এবং পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বিধি জারি
করেন। তদানীন্তন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের অতিশয় বুদ্ধিমান কর্মকর্তাদের
পরামর্শে এবং ভূমি প্রশাসনের কর্মচারীদের প্ররোচনায় সংখ্যালঘুদের
জায়গা-সম্পত্তিগুলো শত্র“সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণার মাধ্যমে আইন করে এবং
রাতারাতি ইজারা নিয়ে দখল করে ফেলা হয়। এ দখলকারীরা ছিল বেশিরভাগ সরকারি
উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং কানুনগো, তহসিলদার ইত্যাদি। তবে রাজনৈতিক কর্মীরাও
বিভিন্ন সময়ে কখনও বন্ধু হিসেবে, আবার কখনও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে এসব
সম্পত্তির মালিক বনে যান। সংক্ষেপে বলা যায়, এ কালাকানুন পাকিস্তানে
বসবাসরত সংখ্যালঘুদের জীবনে এক অন্ধকার যুগের সূচনা করে, যা গত ৪৮ বছর ধরে
সমান তেজে ও তৎপরতায় বহাল আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এ ক্ষেত্রে
বিশেষ কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি, বিভেদ ও হিংসাকে দীর্ঘায়িত করেছে ও
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। ড. আবুল বারকাতের গবেষণালব্ধ প্রকাশনা
‘বাংলাদেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের অবিরাম বঞ্চনার কাহিনী’তে (উবঢ়ৎরাধঃরড়হ ড়ভ
ঐরহফঁ গরহড়ৎরঃু : ধ ংঃড়ৎু ড়ভ ঢ়বৎঢ়বঃঁধষ ফরংপৎরসরহধঃরড়হ) উল্লেখ আছে, ১৯৬৫
থেকে ২০০৬ সাল অবধি ১২ লাখ গৃহস্থালী পরিবার এবং ৬০ লাখ লোক শত্র“/অর্পিত
সম্পত্তি আইনের মাধ্যমে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারা ২৬ লাখ একর জমি
হারিয়েছেন। সবচেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি তিনি উল্লেখ করেছেন তা হচ্ছে, এ
অবিরাম বঞ্চনা একটি সাম্প্রদায়িক মানসিকতাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে, যা এ
জনপদের ঐতিহাসিক ভাবধারার পরিপন্থী। গত ২৮ ফেব্র“য়ারির পর হিন্দু মন্দির
ভাঙার যে অবিরাম ঘটনা ঘটছে, তার অন্যতম একটি কারণও এ অর্পিত সম্পত্তি
প্রত্যর্পণ আইনের পরিণতি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই আইন সংশোধন করে সংখ্যালঘুদের ওয়ারিশদের, যারা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছে, তাদের সম্পত্তি ফেরত দানের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু উদ্যোগটি মনোযোগ অথবা সদ্দিচ্ছার অভাবে ২০০১ সাল অবধি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এ দলটি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সংখ্যালঘুদের দাবির মুখে আবার বিষয়টি বিবেচনায় আনে। তবে ৪ বছর সময় লাগে এ কাজ শুরু করতে। অবশেষে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০১১ এবং ২০১২ সালে এর সংশোধনী জারি করে । এ আইনে ‘ক’ ও ‘খ’ তফসিল সৃষ্টি করে অর্পিত সম্পত্তি চিহ্নিত করে এবং পৃথক ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে। ইতিমধ্যে ৬ লাখের বেশি মামলা হয়েছে এসব ট্রাইব্যুনালে। নিষ্পত্তির সংখ্যা ১ শতাংশের কম। অনেকে মনে করেন, তাও হয়েছে মূলত রাজনৈতিক কারণে। হাইকোর্টের এক রায়ে ১৯৭৪ সালে শত্র“সম্পত্তি আইনের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের রায়ে বলা হয়েছে যে, সেই সময়ের পর নতুন করে কোনো সম্পদকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তফসিলভুক্ত করা যাবে না। ভুক্তভোগীরা আশা করেছিল, ১৯৭৪ সালের রায় মেনে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতার অবসান হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন অর্পিত সম্পত্তি নামে একটি ‘খ’ তফসিল সৃষ্টি করে যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে নতুন নতুন সম্পত্তিও অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় যুক্ত হয়েছে। ফলে এটি এক ভয়াবহ পরিস্থিতি ও নতুনভাবে বিবাদের সূচনা করেছে। তালিকাটি দিনের পর দিন বড় হচ্ছে। অনেকের মতে, এ নতুন তফসিল একদিকে যেমন বেআইনি, অপরদিকে সম্পূর্ণ ত্র“টিপূর্ণ, যা বিভেদের সূত্রপাত করেছে নতুনভাবে। দৈনিক সংবাদ পত্রিকা তাদের ৭ আগস্ট প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেছে, ‘‘যেহেতু তথাকথিত অর্পিত সম্পত্তি একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলে আছে এবং এর সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তাও জড়িত, সেহেতু ‘খ’ তফসিলের উদ্ভাবন করা হয়েছে। আর এ প্রভাবশালী দখলদারদের বেশিরভাগই হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।’’ অনেকে মনে করেন, সরকার একটি দুর্বল আইন প্রণয়ন করেছে ইচ্ছাকৃতভাবে, তহসিলদারদের প্ররোচনায় বা প্রভাবে। কর্তাব্যক্তিরা বুঝতেই পারেননি কোনটির অর্থ কী বা এর ফল কী হতে পারে। তাদের অজ্ঞতার সুযোগে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ভুক্তভোগীদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। এছাড়া অনেকের বদ্ধমূল ধারণা, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বিষয়ে আদালতের রায় অনুযায়ী এখনই বিহিত করা না হলে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল দূর করা সহজ হবে না।
কিভাবে সৃষ্ট এ সমস্যার সমাধান করা যায় তা নিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং ভুক্তভোগীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। পরীক্ষা করে দেখতে হবে, কেন ট্রাইব্যুনালগুলো কাজ করতে পারছে না বা করছে না। কোথায় দুর্বলতা? এ ধরনের দুর্বলতা উদ্দেশ্যমূলক অথবা আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা কি-না, বিশেষ পর্যবেক্ষণ দল তা পরীক্ষা করে দেখতে পারে। অবশ্যই অর্পিত সম্পত্তিবিষয়ক বিচারিক কার্যক্রমকে দ্রুত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, হাইকোর্টের রায়ে অর্পিত সম্পত্তি আইনটির মৃত্যু হয়েছে ১৯৭৪ সালে। তাই ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পর যেসব সম্পত্তি ‘ক’ তফসিলভুক্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গেজেট করা হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে। সরকারের ভেতর থেকে সরকারি আইনকে যারা উপেক্ষা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তৃতীয়ত, বেআইনিভাবে তৈরি করা ‘খ’ তফসিল বাতিল করতে হবে। চতুর্থত, অর্পিত সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণে যে জটিলতা রয়েছে, তা কোর্টের নজির বা অতীতের রায়ের আলোকে সুরাহা করতে হবে। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পর থেকে শত্র“ সম্পত্তির মালিককে যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে তার মৃত্যু হয়েছে বলে গণ্য করা যেতে পারে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১০৮ ধারা মতে ৭ বছরের অধিককাল কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া না গেলে তার মৃত্যু (সিভিল ডেথ) হয়েছে বলে ধরা হয়। হিন্দু আইনে ১২ বছর অবধি কোনো ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া না গেলে ধরে নেয়া হয় তিনি মৃত। স্বামীর খোঁজ ১২ বছর না পেলে হিন্দু মহিলারা শাঁখা ভাঙে এবং সিঁদুর মুছে ফেলে। এ আইনে এ ব্যাপারে যে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে তার নিরসন অবশ্যই করতে হবে।
পরিশেষে বলতে হয়, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি ২০০১ সালের মধ্যে। এবারও ২০১১ সালে এসে কাজটি হাতে নিয়েছে। আগামী ২৫ অক্টোবরের আগে কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। যদি দলটি আবার ক্ষমতাসীন হয়, তাহলেও ২০১৯ সালের আগে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে বলে মনে হয় না। যদি অন্য কোনো দল বা জোট ক্ষমতাসীন হয়, তবে তারা নতুন করে ভেবে দেখবে কী করা যায়। তাতেও হয়তো ২০১৯ সাল এসে যাবে। অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে মাত্র ৭ দিনে যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তার কুফল ভোগ করবে ৭০ বছর এবং কয়েক প্রজন্ম ধরে। এজন্যই বোধ হয় কবি বলেছেন ‘জন্মই তোমার আজন্ম পাপ’। বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মতো প্রিয় হচ্ছে ‘ভূমি’। অথচ এ দেশে কোনো সরকার ভূমি সংস্কার বা মালিকানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুর্নীতি পরিহারের মাধ্যমে ব্যাপক সংস্কার সাধনে মনোনিবেশ করেনি। কারণ তাদের অনেকেই এর সুবিধাভোগী এবং উকিল-মোক্তার শ্রেণীর লোকজন। এ ধরনের মামলা না থাকলে তাদের আয়-রোজগার চলবে না বা তারা নিজেরাও মাতব্বরি করতে পারবে না। দেশে প্রায় প্রত্যেক সভা-সমিতিতে সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণের স্পন্দন বক্তৃতামালায় প্রকাশ পায় অবারিতভাবে, সাবলীল কথামালায়। কিন্তু ভেতরে-বাইরে তাদের ব্যাপক পার্থক্য। এটা জাতির দুর্ভাগ্য। অর্পিত সম্পত্তির সমস্যার সমাধান অত্যন্ত জরুরি। এ সমস্যা জাতীয় সংহতি ও সহমর্মিতার পথে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে অবস্থান করছে। রাজনৈতিক মতভেদের ঊর্ধ্বে উঠে এ সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান করা হলে তা অগ্রগতির পথে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব, কলাম লেখক
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর এই আইন সংশোধন করে সংখ্যালঘুদের ওয়ারিশদের, যারা স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছে, তাদের সম্পত্তি ফেরত দানের উদ্যোগ নেয়। কিন্তু উদ্যোগটি মনোযোগ অথবা সদ্দিচ্ছার অভাবে ২০০১ সাল অবধি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এ দলটি ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে সংখ্যালঘুদের দাবির মুখে আবার বিষয়টি বিবেচনায় আনে। তবে ৪ বছর সময় লাগে এ কাজ শুরু করতে। অবশেষে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইন ২০১১ এবং ২০১২ সালে এর সংশোধনী জারি করে । এ আইনে ‘ক’ ও ‘খ’ তফসিল সৃষ্টি করে অর্পিত সম্পত্তি চিহ্নিত করে এবং পৃথক ট্রাইব্যুনাল তৈরি করে। ইতিমধ্যে ৬ লাখের বেশি মামলা হয়েছে এসব ট্রাইব্যুনালে। নিষ্পত্তির সংখ্যা ১ শতাংশের কম। অনেকে মনে করেন, তাও হয়েছে মূলত রাজনৈতিক কারণে। হাইকোর্টের এক রায়ে ১৯৭৪ সালে শত্র“সম্পত্তি আইনের মৃত্যু হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের রায়ে বলা হয়েছে যে, সেই সময়ের পর নতুন করে কোনো সম্পদকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে তফসিলভুক্ত করা যাবে না। ভুক্তভোগীরা আশা করেছিল, ১৯৭৪ সালের রায় মেনে অর্পিত সম্পত্তি সংক্রান্ত জটিলতার অবসান হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন অর্পিত সম্পত্তি নামে একটি ‘খ’ তফসিল সৃষ্টি করে যে তালিকা প্রকাশ করেছে, তাতে নতুন নতুন সম্পত্তিও অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় যুক্ত হয়েছে। ফলে এটি এক ভয়াবহ পরিস্থিতি ও নতুনভাবে বিবাদের সূচনা করেছে। তালিকাটি দিনের পর দিন বড় হচ্ছে। অনেকের মতে, এ নতুন তফসিল একদিকে যেমন বেআইনি, অপরদিকে সম্পূর্ণ ত্র“টিপূর্ণ, যা বিভেদের সূত্রপাত করেছে নতুনভাবে। দৈনিক সংবাদ পত্রিকা তাদের ৭ আগস্ট প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেছে, ‘‘যেহেতু তথাকথিত অর্পিত সম্পত্তি একশ্রেণীর প্রভাবশালী ব্যক্তির দখলে আছে এবং এর সঙ্গে ভূমি মন্ত্রণালয়ের কতিপয় অসৎ কর্মকর্তাও জড়িত, সেহেতু ‘খ’ তফসিলের উদ্ভাবন করা হয়েছে। আর এ প্রভাবশালী দখলদারদের বেশিরভাগই হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী।’’ অনেকে মনে করেন, সরকার একটি দুর্বল আইন প্রণয়ন করেছে ইচ্ছাকৃতভাবে, তহসিলদারদের প্ররোচনায় বা প্রভাবে। কর্তাব্যক্তিরা বুঝতেই পারেননি কোনটির অর্থ কী বা এর ফল কী হতে পারে। তাদের অজ্ঞতার সুযোগে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে ভুক্তভোগীদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। এছাড়া অনেকের বদ্ধমূল ধারণা, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ বিষয়ে আদালতের রায় অনুযায়ী এখনই বিহিত করা না হলে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক প্রবর্তিত সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত ছোবল দূর করা সহজ হবে না।
কিভাবে সৃষ্ট এ সমস্যার সমাধান করা যায় তা নিয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এবং ভুক্তভোগীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। পরীক্ষা করে দেখতে হবে, কেন ট্রাইব্যুনালগুলো কাজ করতে পারছে না বা করছে না। কোথায় দুর্বলতা? এ ধরনের দুর্বলতা উদ্দেশ্যমূলক অথবা আইনি প্রক্রিয়ার জটিলতা কি-না, বিশেষ পর্যবেক্ষণ দল তা পরীক্ষা করে দেখতে পারে। অবশ্যই অর্পিত সম্পত্তিবিষয়ক বিচারিক কার্যক্রমকে দ্রুত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, হাইকোর্টের রায়ে অর্পিত সম্পত্তি আইনটির মৃত্যু হয়েছে ১৯৭৪ সালে। তাই ১৯৭৪ সালের ২৩ মার্চের পর যেসব সম্পত্তি ‘ক’ তফসিলভুক্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে গেজেট করা হয়েছে, তা বাতিল করতে হবে। সরকারের ভেতর থেকে সরকারি আইনকে যারা উপেক্ষা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
তৃতীয়ত, বেআইনিভাবে তৈরি করা ‘খ’ তফসিল বাতিল করতে হবে। চতুর্থত, অর্পিত সম্পত্তির মালিকানা নির্ধারণে যে জটিলতা রয়েছে, তা কোর্টের নজির বা অতীতের রায়ের আলোকে সুরাহা করতে হবে। ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের পর থেকে শত্র“ সম্পত্তির মালিককে যদি খুঁজে পাওয়া না যায়, তাহলে তার মৃত্যু হয়েছে বলে গণ্য করা যেতে পারে। ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনের ১০৮ ধারা মতে ৭ বছরের অধিককাল কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাওয়া না গেলে তার মৃত্যু (সিভিল ডেথ) হয়েছে বলে ধরা হয়। হিন্দু আইনে ১২ বছর অবধি কোনো ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া না গেলে ধরে নেয়া হয় তিনি মৃত। স্বামীর খোঁজ ১২ বছর না পেলে হিন্দু মহিলারা শাঁখা ভাঙে এবং সিঁদুর মুছে ফেলে। এ আইনে এ ব্যাপারে যে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে তার নিরসন অবশ্যই করতে হবে।
পরিশেষে বলতে হয়, ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিল, তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি ২০০১ সালের মধ্যে। এবারও ২০১১ সালে এসে কাজটি হাতে নিয়েছে। আগামী ২৫ অক্টোবরের আগে কোনো উল্লেখযোগ্য অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। যদি দলটি আবার ক্ষমতাসীন হয়, তাহলেও ২০১৯ সালের আগে কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে বলে মনে হয় না। যদি অন্য কোনো দল বা জোট ক্ষমতাসীন হয়, তবে তারা নতুন করে ভেবে দেখবে কী করা যায়। তাতেও হয়তো ২০১৯ সাল এসে যাবে। অর্থাৎ ১৯৬৫ সালে মাত্র ৭ দিনে যে আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তার কুফল ভোগ করবে ৭০ বছর এবং কয়েক প্রজন্ম ধরে। এজন্যই বোধ হয় কবি বলেছেন ‘জন্মই তোমার আজন্ম পাপ’। বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মতো প্রিয় হচ্ছে ‘ভূমি’। অথচ এ দেশে কোনো সরকার ভূমি সংস্কার বা মালিকানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে দুর্নীতি পরিহারের মাধ্যমে ব্যাপক সংস্কার সাধনে মনোনিবেশ করেনি। কারণ তাদের অনেকেই এর সুবিধাভোগী এবং উকিল-মোক্তার শ্রেণীর লোকজন। এ ধরনের মামলা না থাকলে তাদের আয়-রোজগার চলবে না বা তারা নিজেরাও মাতব্বরি করতে পারবে না। দেশে প্রায় প্রত্যেক সভা-সমিতিতে সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণের স্পন্দন বক্তৃতামালায় প্রকাশ পায় অবারিতভাবে, সাবলীল কথামালায়। কিন্তু ভেতরে-বাইরে তাদের ব্যাপক পার্থক্য। এটা জাতির দুর্ভাগ্য। অর্পিত সম্পত্তির সমস্যার সমাধান অত্যন্ত জরুরি। এ সমস্যা জাতীয় সংহতি ও সহমর্মিতার পথে অন্যতম অন্তরায় হিসেবে অবস্থান করছে। রাজনৈতিক মতভেদের ঊর্ধ্বে উঠে এ সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান করা হলে তা অগ্রগতির পথে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে।
ধীরাজ কুমার নাথ : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা, সাবেক সচিব, কলাম লেখক
No comments