শিক্ষকদের বেতনভাতা নিশ্চিত করুন by ড. ইকবাল হোসেন
শিক্ষা
যদি হয় জাতির মেরুদণ্ড, একজন সুশিক্ষক হবে সেই শিক্ষার মেরুদণ্ড। এক
প্রবীণ শিক্ষক নেতা কোনো এক সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। প্রায় সময়ই
স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পত্রিকায় লিখে থাকেন। যখনই চোখ
পড়ে, লেখাগুলো একটু ভিন্ন গুরুত্বের সঙ্গে পড়ার আগ্রহ জন্মে। একটি লেখা
আমাকে শুধু ভাবিয়েই তোলেনি, রীতিমতো আঁতকে দিয়েছিল। তিনি তুলে ধরেছিলেন
তারই এক সময়ের ছাত্র ও বর্তমান সময়কার এক স্কুল শিক্ষকের একটি করুণ আবেদন।
তুলে ধরেছিলেন মানবেতরভাবে দিন কাটানো একটি পরিবারের চিত্র। কোনো এক ঈদের
ঠিক কিছুদিন আগের ঘটনা। শিক্ষক নেতাকে ফোন করলেন সেই স্কুল শিক্ষক। বললেন,
স্যার, আপনি আমার শিক্ষক ছিলেন, শিক্ষা দিয়েছিলেন, ‘সততাই সর্বোৎকৃষ্ট
পন্থা’। আমি আপনার সেই শিক্ষা গ্রহণ করেছিলাম। আজ অবধি প্রায় প্রতিটি
ক্ষেত্রে অন্ততপক্ষে কিছুটা হলেও সৎ থাকার চেষ্টা করেছি। নিজের আদর্শগত
অবস্থান, সৎ থাকার আকাক্সক্ষা ও অবশেষে নিজের যোগ্যতা- সবকিছু মিলিয়েই আজ
শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছি। নিজের অর্জিত শিক্ষার ওপর ভিত্তি করে পেশাগত
দায়িত্ব পালন করে আসছি। আপনি ছোটবেলায় আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন- ‘লেখাপড়া
করে যে গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ে সে।’ আপনার কথা মনে রেখে লেখাপড়া করেছিলাম আমি,
স্বপ্নও দেখেছিলাম একদিন গাড়ি-ঘোড়ায় চড়ার। স্যার, আমার ভাগ্যে গাড়ি-ঘোড়া
আসেনি। সামান্য রিকশায় চড়ার ভাগ্যও আমার হয়নি। আমাকে চৈত্রের প্রখর রোদের
মাঝেও হেঁটে হেঁটে কর্মস্থল স্কুল থেকে বাসায় ফিরতে হয়। বাসায় ঢোকার ঠিক
আগে কৌশলে আমার ঘর্মাক্ত মুখখানি ভালো করে মুছে নিতে হয় আমাকে। আমার ছোট্ট
মেয়েটিকে আমার ঘর্মাক্ত মুখ দেখিয়ে দেখিয়ে আর কষ্ট দিতে পারি না। মাস শেষে
সময়মতো বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে পারি না আমি। প্রায় নিয়মিতভাবেই বাড়িওয়ালার
শক্ত শক্ত কথা শুনতে হয় আমাকে। এতে করে এক রকম অভ্যস্তই হয়ে পড়েছি আমি।
কিন্তু ব্যথিত হই, যখন আমার মেয়েটিকে এ যন্ত্রণা থেকেও রক্ষা করতে পারি না।
ঈদ আসছে। নিজের সাধ্যমতো বাজেট নিয়ে সপরিবারে গিয়েছিলাম ঈদের কেনাকাটায়।
মেয়ে আমার হয়তো তার বাবার আর্থিক অবস্থা ভুলেই গিয়েছিল বাজারের চাকচিক্য
দেখে। পছন্দ করে বসল নিজের মতো করে একটি ড্রেস। দাম শুনে পরক্ষণেই মুখখানি
মলিন হয়ে এলো তার, হয়তো বাবার আর্থিক-অক্ষমতা বুঝতে পেরে। সন্তানের মলিন
মুখ দেখার কষ্ট অনেক ভারি। চেয়েছিলাম পুরো পরিবারের জন্য রাখা অর্থ দিয়ে
হলেও মেয়ের ইচ্ছা পূরণ করতে। কিন্তু কোনোভাবেই তা সম্ভব হয়ে উঠল না। সমাজের
আর পাঁচ-দশটা পরিবারের মতো স্বাভাবিকভাবে ঈদ করাটাও আমাদের ভাগ্যে জোটে
না। লোকটি ফোনে সশব্দে কাঁদতে থাকেন।
কী নির্মম বাস্তবতা, যা যে কোনো স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষের দু’চোখ আর্দ্র করে তোলে। ভদ্রলোক কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, স্যার যদি সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জাতীয়করণ করে নেয়া হতো, হয়তো আমাদের দুঃখ-দুর্দশার অনেকটাই লাঘব হতো। না হয় আপনার একজন ছাত্র হিসেবেই আমাদের কথাগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরুন। প্রবীণ সেই শিক্ষক নেতা তার ছাত্রের কথাগুলো লিখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে আদৌ কোনো কাজ হয়েছিল কি-না জানা হয়নি।
এই তো সেদিন শুনলাম এক হারিছ ভাইয়ের কথা। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বহিরাগত পরিদর্শক হিসেবে ছয়-ছয়টি ভর্তি পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করে পাওয়া যাবে তিন হাজার টাকা। খবরটি জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই যথানিয়মে আবেদন করেন কলেজ-শিক্ষক হারিছ সাহেব। হারিছ সাহেব জানতে পারেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবনের তারই এক পরিচিত জুনিয়র। যথানিয়মে আবেদন করা সত্ত্বেও বেশ কয়েকবার কথা বলেন সেই পরিচিত জুনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে, কাজটির ব্যাপারে। বিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে একদিন সরাসরি হাজির হন হারিছ সাহেব সেই শিক্ষকের অফিসে। উদ্দেশ্য, বহিরাগত পরিদর্শকের তালিকা থেকে তার নামটি যাতে কোনোভাবে বাদ না পড়ে, তা নিশ্চিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন লোক, যিনি কিনা এক কলেজে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন, মাত্র তিন হাজার টাকার একটি কাজের জন্য এমন করে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। বিষয়টি সেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ভাবিয়ে ও কৌতূহলী করে তোলে। তিনি জানতে চান হারিছ সাহেবের এত আগ্রহী ও ব্যস্ত হয়ে ওঠার কারণ। জানতে পারেন, হারিছ সাহেব এক কলেজে শিক্ষকতা করছেন, কিন্তু বিগত দশ বছর ধরে কোনো বেতন পাচ্ছেন না। এটাও কি সম্ভব হতে পারে? এক নয়, দুই নয়, দশ-দশটি বছর ধরে একজন শিক্ষক বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে চলেছেন! তিনি জানতে পারেন, কিছু শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিগতভাবে পড়িয়ে এবং এ ধরনের অনিয়মিত কিছু কাজ থেকে প্রাপ্ত ‘সামান্য’ উপার্জন দিয়েই কোনোভাবে চলছে হারিছ সাহেবের পরিবার। সুতরাং হারিছ সাহেব আগ্রহী ও ব্যস্ত না হয়ে পারবেন কী করে? বরং তিনি তো মুখিয়েই থাকবেন এ ধরনের সুযোগের আশায়; হোক না তা ‘তিন-হাজার’ বা ‘তিনশ’ টাকার কাজ। হারিছ সাহেব বলছিলেন, কাজটি পেলে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক দিয়ে মেয়ের কোনো এক ‘বড় আবদার’ পূরণ করবেন তিনি। মেয়ে যদি জানতেন, তার পিতা নিজ ব্যক্তিত্ব উপেক্ষা করে বিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তারই এক জুনিয়রকে অনুরোধ করে কাজ নিয়ে সেই অর্থে তার আবদার পূরণ করবেন; হয়তো তার সেই আবদার কখনও সে পিতাকে জানাতেন না।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজও এমন ঘটনা থেকে খুব একটা মুক্ত নয়। শিক্ষকতা অনেকটাই ভিন্ন আদর্শের এক পেশা। শিক্ষকরা যতই কষ্ট আর সমস্যায় থাকেন না কেন, নিজেদের বিষয়গুলো চেপে যেতেই চেষ্টা করে থাকেন। তথাপি দু’চোখ আর্দ্র করে তোলার মতো অনেক ঘটনাই আজ প্রকাশ পাচ্ছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সর্বকনিষ্ঠ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, অনেকটা বর্তমান সরকারের হাতেই গড়া। তথ্যমতে, বিগত তিন মাস ধরে প্রায় ৯০ জন শিক্ষক সেখানে কোনোরকম বেতন পাচ্ছেন না। ভাবা যায়, কী অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে সেই পরিবারগুলো?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মূলত একটি অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক খাতে সরকারের বরাদ্দ নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ সুফলের এক কার্যকর বিনিয়োগ। কাজেই চেষ্টা থাকতে হবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করার। নিয়মিতভাবেই প্রদান করতে হবে সবস্তরের শিক্ষকদের বেতনভাতা। এটা বোধগম্য, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে অনেকটাই সম্পর্কিত। আমাদের অর্থনীতি আদৌ কি পারবে বঞ্চিত সেই শিক্ষকদের বেতনভাতার ভার বহন করতে? খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করব, আমাদের অর্থনীতি কি বিশাল বিশাল দুর্নীতি আর অদূরদর্শী অলাভজনক ব্যয়বহুল সিদ্ধান্তগুলোর ভার বছরের পর বছর বহন করে এগিয়ে চলছে না? আমাদের অর্থনীতি কি অনাবশ্যকীয় রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের ভার বহন করে করছে না? আমাদের অর্থনীতি কি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ‘বাণিজ্যিক’ প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ভর্তুকির ভার বছরের পর বছর বহন করে আসছে না?
যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২২টি রাষ্ট্রীয় ‘বাণিজ্যিক’ প্রতিষ্ঠানকে ৩৭ হাজার ১৮৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ইতিমধ্যে ৬২৬ কোটি টাকা খেলাপির হিসাবে চলে এসেছে। এহেন ২২টি প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই বছর বছর ধরে চলছে লোকসান দিয়ে। এদের মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩১৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সেই ভর্তুকি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৮১ কোটি ৮৩ লাখ টাকায়। রাষ্ট্রীয় এসব প্রতিষ্ঠানে যথাযথ সততা, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা না থাকাকেই এহেন হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির পেছনের কারণ হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ আমরা রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই কেবল আমাদের যথাযথ সততা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে প্রতিবছর রক্ষা করতে পারি হাজার হাজার কোটি রাষ্ট্রীয় অর্থ। যার সামান্য অংশই হয়তো বাঁচাতে পারে হাজারও শিক্ষক পরিবারকে, মানবেতর জীবনের এক কঠিন বোঝা থেকে। সংশ্লিষ্টদের প্রতি সবিনয়ে অনুরোধ থাকবে বিষয়টির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতি কিছুটা হলেও মনোযোগী হওয়ার।
শিক্ষায় গুণগত উন্নয়ন-অগ্রগতি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের অংশ হিসেবে সর্বস্তরের শিক্ষকদের বেতনভাতা রাষ্ট্রকেই আজ নিশ্চিত করতে হবে; যা সহজেই হতে পারে রাষ্ট্রীয় অর্থের সুব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে।
ড. ইকবাল হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, কেমিকৌশল বিভাগ, বুয়েট
কী নির্মম বাস্তবতা, যা যে কোনো স্বাভাবিক বোধসম্পন্ন মানুষের দু’চোখ আর্দ্র করে তোলে। ভদ্রলোক কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, স্যার যদি সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জাতীয়করণ করে নেয়া হতো, হয়তো আমাদের দুঃখ-দুর্দশার অনেকটাই লাঘব হতো। না হয় আপনার একজন ছাত্র হিসেবেই আমাদের কথাগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরুন। প্রবীণ সেই শিক্ষক নেতা তার ছাত্রের কথাগুলো লিখেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে আদৌ কোনো কাজ হয়েছিল কি-না জানা হয়নি।
এই তো সেদিন শুনলাম এক হারিছ ভাইয়ের কথা। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বহিরাগত পরিদর্শক হিসেবে ছয়-ছয়টি ভর্তি পরীক্ষায় দায়িত্ব পালন করে পাওয়া যাবে তিন হাজার টাকা। খবরটি জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গেই যথানিয়মে আবেদন করেন কলেজ-শিক্ষক হারিছ সাহেব। হারিছ সাহেব জানতে পারেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা জীবনের তারই এক পরিচিত জুনিয়র। যথানিয়মে আবেদন করা সত্ত্বেও বেশ কয়েকবার কথা বলেন সেই পরিচিত জুনিয়র শিক্ষকের সঙ্গে, কাজটির ব্যাপারে। বিশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে একদিন সরাসরি হাজির হন হারিছ সাহেব সেই শিক্ষকের অফিসে। উদ্দেশ্য, বহিরাগত পরিদর্শকের তালিকা থেকে তার নামটি যাতে কোনোভাবে বাদ না পড়ে, তা নিশ্চিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া একজন লোক, যিনি কিনা এক কলেজে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন, মাত্র তিন হাজার টাকার একটি কাজের জন্য এমন করে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। বিষয়টি সেই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে ভাবিয়ে ও কৌতূহলী করে তোলে। তিনি জানতে চান হারিছ সাহেবের এত আগ্রহী ও ব্যস্ত হয়ে ওঠার কারণ। জানতে পারেন, হারিছ সাহেব এক কলেজে শিক্ষকতা করছেন, কিন্তু বিগত দশ বছর ধরে কোনো বেতন পাচ্ছেন না। এটাও কি সম্ভব হতে পারে? এক নয়, দুই নয়, দশ-দশটি বছর ধরে একজন শিক্ষক বিনা পারিশ্রমিকে আমাদের সন্তানদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে চলেছেন! তিনি জানতে পারেন, কিছু শিক্ষার্থীকে ব্যক্তিগতভাবে পড়িয়ে এবং এ ধরনের অনিয়মিত কিছু কাজ থেকে প্রাপ্ত ‘সামান্য’ উপার্জন দিয়েই কোনোভাবে চলছে হারিছ সাহেবের পরিবার। সুতরাং হারিছ সাহেব আগ্রহী ও ব্যস্ত না হয়ে পারবেন কী করে? বরং তিনি তো মুখিয়েই থাকবেন এ ধরনের সুযোগের আশায়; হোক না তা ‘তিন-হাজার’ বা ‘তিনশ’ টাকার কাজ। হারিছ সাহেব বলছিলেন, কাজটি পেলে প্রাপ্ত পারিশ্রমিক দিয়ে মেয়ের কোনো এক ‘বড় আবদার’ পূরণ করবেন তিনি। মেয়ে যদি জানতেন, তার পিতা নিজ ব্যক্তিত্ব উপেক্ষা করে বিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তারই এক জুনিয়রকে অনুরোধ করে কাজ নিয়ে সেই অর্থে তার আবদার পূরণ করবেন; হয়তো তার সেই আবদার কখনও সে পিতাকে জানাতেন না।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আজও এমন ঘটনা থেকে খুব একটা মুক্ত নয়। শিক্ষকতা অনেকটাই ভিন্ন আদর্শের এক পেশা। শিক্ষকরা যতই কষ্ট আর সমস্যায় থাকেন না কেন, নিজেদের বিষয়গুলো চেপে যেতেই চেষ্টা করে থাকেন। তথাপি দু’চোখ আর্দ্র করে তোলার মতো অনেক ঘটনাই আজ প্রকাশ পাচ্ছে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সর্বকনিষ্ঠ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, অনেকটা বর্তমান সরকারের হাতেই গড়া। তথ্যমতে, বিগত তিন মাস ধরে প্রায় ৯০ জন শিক্ষক সেখানে কোনোরকম বেতন পাচ্ছেন না। ভাবা যায়, কী অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছে সেই পরিবারগুলো?
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মূলত একটি অবাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক খাতে সরকারের বরাদ্দ নিঃসন্দেহে ভবিষ্যৎ সুফলের এক কার্যকর বিনিয়োগ। কাজেই চেষ্টা থাকতে হবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে জাতীয়করণ করার। নিয়মিতভাবেই প্রদান করতে হবে সবস্তরের শিক্ষকদের বেতনভাতা। এটা বোধগম্য, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির সঙ্গে অনেকটাই সম্পর্কিত। আমাদের অর্থনীতি আদৌ কি পারবে বঞ্চিত সেই শিক্ষকদের বেতনভাতার ভার বহন করতে? খুব স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করব, আমাদের অর্থনীতি কি বিশাল বিশাল দুর্নীতি আর অদূরদর্শী অলাভজনক ব্যয়বহুল সিদ্ধান্তগুলোর ভার বছরের পর বছর বহন করে এগিয়ে চলছে না? আমাদের অর্থনীতি কি অনাবশ্যকীয় রাষ্ট্রীয় ব্যয়ের ভার বহন করে করছে না? আমাদের অর্থনীতি কি রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ‘বাণিজ্যিক’ প্রতিষ্ঠানকে দেয়া ভর্তুকির ভার বছরের পর বছর বহন করে আসছে না?
যুগান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২২টি রাষ্ট্রীয় ‘বাণিজ্যিক’ প্রতিষ্ঠানকে ৩৭ হাজার ১৮৯ কোটি ৯৪ লাখ টাকা ঋণ দিয়ে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর ইতিমধ্যে ৬২৬ কোটি টাকা খেলাপির হিসাবে চলে এসেছে। এহেন ২২টি প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশই বছর বছর ধরে চলছে লোকসান দিয়ে। এদের মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠানের জন্য ২০১১-১২ অর্থবছরে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৩১৯ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে সেই ভর্তুকি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৮১ কোটি ৮৩ লাখ টাকায়। রাষ্ট্রীয় এসব প্রতিষ্ঠানে যথাযথ সততা, জবাবদিহিতা ও দক্ষতা না থাকাকেই এহেন হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির পেছনের কারণ হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। অর্থাৎ আমরা রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেই কেবল আমাদের যথাযথ সততা, দক্ষতা ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে প্রতিবছর রক্ষা করতে পারি হাজার হাজার কোটি রাষ্ট্রীয় অর্থ। যার সামান্য অংশই হয়তো বাঁচাতে পারে হাজারও শিক্ষক পরিবারকে, মানবেতর জীবনের এক কঠিন বোঝা থেকে। সংশ্লিষ্টদের প্রতি সবিনয়ে অনুরোধ থাকবে বিষয়টির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতি কিছুটা হলেও মনোযোগী হওয়ার।
শিক্ষায় গুণগত উন্নয়ন-অগ্রগতি নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের অংশ হিসেবে সর্বস্তরের শিক্ষকদের বেতনভাতা রাষ্ট্রকেই আজ নিশ্চিত করতে হবে; যা সহজেই হতে পারে রাষ্ট্রীয় অর্থের সুব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে।
ড. ইকবাল হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, কেমিকৌশল বিভাগ, বুয়েট
No comments