নির্বাচনী রাজনীতিতে পেন্ডুলামের দুলুনি by একেএম শাহনাওয়াজ
মাস
দুই আগে এক কলামে আমি আমাদের রাজনৈতিক বড় দুই দলের অবস্থা বোঝাতে তেলতেলে
বাঁশের গল্পের উদাহরণ টেনেছিলাম। আমার অনেক পাঠক বন্ধুর মনে ধরেছিল
ব্যাখ্যাটি। তারা ই-মেইলে, টেলিফোনে সমর্থন দিয়েছিলেন। এখন চলমান রাজনীতির
প্রসঙ্গ টানতে গেলে এ ব্যাখ্যাটিই সামনে চলে আসে। আসলে প্রজ্ঞা ও রাজনৈতিক
অভিলাষের দিক থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে তফাত খুব কম বলেই
বোধহয় তেলতেলে বাঁশের উদাহরণ বারবার ব্যবহার করা যায়। ব্যাখ্যাটি অসাধারণ
কিছু নয়। সচেতন মানুষ সবাই হয়তো এভাবেই ভাবেন। আমি শুধু এর লিখিত রূপ
দিয়েছি। আসলে রাজনীতিতে বর্তমানে দু’দল নম্বরের বিচারে খুব কাছাকাছি
অবস্থান করছে। শুধু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিচারে তাদের দল অনেক বেশি
নম্বরে এগিয়ে আর বিএনপির নেতাকর্মীদের বিচারে তাদের দল। তবে নির্বাচনের
মাঠে এখন স্থির নয় কোনো দল। পেন্ডুলামের দুলুনিতে অস্থির। বিষয়টি আর কিছু
নয়, নির্বাচনের রাজনীতিতে কোনো দল কর্মভূমিকায় এগিয়ে যাচ্ছে অথবা পিছু
হটছে। দুটি ঘটনাই কোনো দলের জন্য একরৈখিকভাবে ঘটছে না। এক দল কর্মভূমিকা ও
সময়ের সুবিধায় কখনও মনে হচ্ছিল তেলতেলে বাঁশ বেয়ে অনেকটা উপরে ওঠে পড়েছে।
কিন্তু পরক্ষণেই একটি-দুটি ভুলে আবার এক ঝটকায় নেমে এসেছে নিচে। অন্য দলের
ক্ষেত্রেও অবস্থা অভিন্ন। দুলুনি চলছেই।
বিগত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় এবং বিএনপির অপশাসনের স্মৃতি থেকে মনে হয়েছিল, আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই বাঁশের উঁচুতে ওঠে যাবে। এ জন্য দলটিকে বিশেষ কিছু করতে হবে না। মানুষ যেসব আচরণে কষ্ট পেয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটকে বর্জন করেছিল, সেসব পঙ্কিল পথ থেকে আওয়ামী লীগকে দূরে সরে থাকতে হবে। অর্থাৎ সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটতে হবে। ছাত্রদলের সন্ত্রাসী ভূমিকার শিক্ষা ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। কার্যকর ভূমিকা রাখবে প্রশাসনিক দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে। কঠিন দলীয়করণের বলয় ভেঙে বন্ধু বাড়াবে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। মানুষ বিশ্বাস করেছিল, ১/১১-এর শিক্ষার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আলোকিত পথেই হাঁটবেন। ফলে বিধ্বস্ত বিএনপির কোমর সোজা করে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।
কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটল না। আওয়ামী লীগ ও সরকার ঘুরে দাঁড়াল না। হাঁটতে থাকল গতানুগতিক পথেই। ছাত্রলীগ সন্ত্রাস আর অনাচারে ছাত্রদলের কালো অধ্যায়কেও যেন অতিক্রম করতে থাকল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কার্যত এর কোনো প্রতিবিধান করতে পারলেন না। জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকল। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষণ ফুটে উঠল না আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনায়। প্রশাসনিক দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত ভুক্তভোগী মানুষদের হতাশ করে তুলল। গণতন্ত্র বিকাশের স্বাভাবিক পথ কেবল বন্ধুর হতে থাকল। এভাবেই ক্ষমতার চার বছরের মাথায় তেলতেলে বাঁশ থেকে পিছলে নেমে এলো তলানিতে।
এ বাস্তবতা বিএনপিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার শক্তিও তৈরি হতে লাগল। এ সময় জামায়াতের বন্ধুত্ব বর্জন করে সাধারণ মানুষের আস্থায় আসা জরুরি ছিল বিএনপির জন্য। কিন্তু মানসিক জোর না থাকায় সাহসী হতে পারল না বিএনপি। বিএনপির বিশ্বাস করা উচিত ছিল, ক্ষমতায় থাকাকালীন কৃতকর্মের কারণে জনগণের একটি বড় অংশ দলটিকে ভোটের মাঠে বর্জন করেছিল। তাই গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে জনমতকে শ্রদ্ধা করা উচিত ছিল। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক পথে না হেঁটে বিএনপি কঠিন ইস্যু না পেয়েও জনদুর্ভোগ বাড়ানোর হরতাল-অবরোধের দিকে হাঁটতে চাইল। খুব জমাতে পারল না, তবুও বাস্তব উপলব্ধি থেকে দূরে রইল। জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট রাখার জন্য অবলীলায় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রশ্নে জামায়াতের পক্ষাবলম্বন করল। জামায়াত-শিবিরের হরতাল ও অমানবিক পিকেটিংয়ের সমর্থক ও সঙ্গী হয়ে নিজের অবস্থানকে আবার প্রশ্নবিদ্ধ করল।
সরকার পরিচালনায় এসে নানা ব্যর্থতায় জর্জরিত আওয়ামী লীগ বিএনপির বেসুরো পথ চলাকে সুযোগ হিসেবে নিতে পারত। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুশাসন ও সুস্থিরতার জন্য ইতিবাচক রাজনীতির পথে হাঁটতে পারত। রাজনৈতিক প্রয়োজনেই মহাজোটকে শক্তিশালী করতে পারত। কিন্তু পুরনো স্বভাব মতো আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিশাল বিজয়ে দিকহারা হয়েছিল। মহাজোটের শরিকদের প্রত্যাশিত সম্মান দেখাল না। ভোটের রাজনীতিতে এরশাদকে প্রয়োজন ছিল বলে নির্বাচনের আগে তার সমর্থন পেতে অনেক শ্রম ব্যয় করেছিল। বিজয়ের পর তেমন পাত্তা পায়নি জাতীয় পার্টি। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে যখন আওয়ামী লীগ সংকটে, তখন আবার মূল্য বেড়ে গেল এরশাদের। শুরু হল ধরনা দেয়া। এসবে হয়তো রাজনৈতিক কূটনীতির লাভ-ক্ষতি আছে, তবে সুস্থ রাজনীতির মাঠে একটি বড় দলের জনআস্থা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির বিশাল বিজয় স্বাভাবিক ধারায় প্রত্যাশা মতো হয়নি। কারণ নির্বাচনে দাঁড়ানো আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা সবাই (গাজীপুর ছাড়া) সাবেক মেয়র ছিলেন। সিটি কর্পোরেশন পরিচালনায় খুব একটা খারাপ ভূমিকা রাখেননি। বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা প্রতিপক্ষকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো বিশাল পরিচিতি নিয়ে মাঠে নামেননি। তারপরও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় একটি গভীর মূল্যায়নের বিষয়। তবে এ বিজয়ের পর বিএনপি নেতৃত্ব যতটা সংযত হয়ে হাঁটবে বলে মনে হয়েছিল, তেমনভাবে হাঁটতে পারছে না। বিএনপি বিজয়কে যদি নিজ দলের জনপ্রিয়তা ভাবে, তবে বড় ভুল করবে। উল্লিখিত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলো স্থানীয় নির্বাচনের বলয়ে থাকেনি। থাকলে ফলাফল হয়তো অন্যরকম হতে পারত। এটি জাতীয় নির্বাচনের আদল পেয়েছিল। অর্থাৎ জাতীয় ইস্যুগুলো সামনে চলে আসে। তাই সরকারের নানা ব্যর্থতা এবং সরকারি দল ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নানা অনাচার সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। সুতরাং বলা যায়, আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা বা দুর্বলতার কারণে সুযোগের সুবিধা পেয়ে যায় বিএনপি। এ প্রেক্ষাপট বিএনপিকে আবার বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু পতাকা দিলেই হবে না, তা বহন করার শক্তি যদি বিধাতা না দেন তবে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হয় না। তাই এবার অসময়ে বিএনপি নেতৃত্বের যেন পায়াভারি হয়ে গেল। সংসদে নিজ দলের বাক-অসংযত নারী সংসদ সদস্যদের থামানোর চেষ্টা করল না বিএনপি। বাজেট পাসের আগে ছল ছুতোয় ওয়াকআউট করে নিজেদের দীনতা প্রমাণ করল।
সাধারণ মানুষের সামনে বিএনপি সবচেয়ে বেকায়দা দশায় এখন ওয়াশিংটন টাইমসে প্রকাশিত লেখা নিয়ে। লেখক হিসেবে সেখানে নাম ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার। জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ার পর সরকারি দল এজন্য খালেদা জিয়ার লেখাকে অংশত দায়ী করে। মহান সংসদে প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হল কুশলী শব্দে দায় এড়ানো যেত। কিন্তু সে পথে হাঁটলেন না বিএনপি নেত্রী। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে সরাসরি অস্বীকার করলেন এ লেখাটি তিনি পাঠাননি বলে। অবশ্য এখানে একটি কৌশল ছিল। তিনি বলেননি যে, তিনি লেখেননি। বলেছেন পাঠাননি! তার পক্ষ থেকে কেউ পাঠালেও বক্তব্যটিকে অসত্য বলা যাবে না। যাই হোক, বিএনপি নেত্রীর এ সাফাই মেনে নেয়া সচেতন মানুষের জন্য সহজ নয়। কারণ কয়েক মাস আগে লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিতর্ক উঠেছিল। তখন কিন্তু খালেদা জিয়া বা বিএনপি নেতারা বিষয়টি অস্বীকার করেননি। বরঞ্চ প্রকাশিত লেখাটি যথার্থ হয়েছিল বলে তাদের কেউ কেউ বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলেছিলেন। সত্যি সত্যি জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়ে এখন অস্বীকার করাটা কি শোভন বা নৈতিকভাবে ঠিক হল? আবার হাটে হাঁড়ি ভেঙে ওয়াশিংটন টাইমসের সম্পাদকও নিশ্চিত করলেন, লেখাটি স্বয়ং খালেদা জিয়ারই।
এ ঘটনাটি বিএনপির জন্য বড় রাজনৈতিক ও নৈতিক স্খলন। অন্য কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য রাজনীতির দেশ হলে এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অমন নেতা-নেত্রী দায় মাথায় নিয়ে (যদি সত্যতা প্রমাণিত হয়) রাজনীতি ছেড়ে অবসরে যেতেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে অমন শোভন সংস্কৃতি নেই। তাই আবার সদম্ভে নানা কথার ফুলঝুরি হতে থাকবে বক্তৃতার মঞ্চে। তবে পেন্ডুলামের দুলুনি থামবে না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর তরতর করে বাঁশের অনেকটা উপরে ওঠে গেছে বিএনপি। শাসন দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি জোয়ার তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এ সুবিধাটি বিএনপির ঘরে আসবে বলে অনেকের বিশ্বাস। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে নিজ দলের পক্ষে বিজয় আনতে পারবে এমন বিশ্বাস তৈরি করেছে। এ অবস্থা ধরে রাখতে চাইলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নৈতিকতার বিষয়ে তাদের সজাগ থাকতে হবে।
নির্বাচনের আগে ঠাণ্ডা মাথায় দুই বড় দলকেই নির্মোহভাবে বাস্তব অবস্থার মূল্যায়ন করতে হবে। হাম্বরা ভাব, মিথ্যার বেসাতি, জনদুর্ভোগ বাড়ানো, জনগণকে মূল্যায়ন না করা- এসব কিছু ভোটারের বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এসব অস্বীকার করা বর্তমান বাস্তবতায় যে কোনো দলের জন্যই আত্মহত্যার শামিল।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বিগত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় এবং বিএনপির অপশাসনের স্মৃতি থেকে মনে হয়েছিল, আওয়ামী লীগ কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই বাঁশের উঁচুতে ওঠে যাবে। এ জন্য দলটিকে বিশেষ কিছু করতে হবে না। মানুষ যেসব আচরণে কষ্ট পেয়ে বিএনপি-জামায়াত জোটকে বর্জন করেছিল, সেসব পঙ্কিল পথ থেকে আওয়ামী লীগকে দূরে সরে থাকতে হবে। অর্থাৎ সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে হাঁটতে হবে। ছাত্রদলের সন্ত্রাসী ভূমিকার শিক্ষা ছাত্রলীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে। কার্যকর ভূমিকা রাখবে প্রশাসনিক দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে। কঠিন দলীয়করণের বলয় ভেঙে বন্ধু বাড়াবে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে। মানুষ বিশ্বাস করেছিল, ১/১১-এর শিক্ষার পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আলোকিত পথেই হাঁটবেন। ফলে বিধ্বস্ত বিএনপির কোমর সোজা করে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।
কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে তেমন কিছুই ঘটল না। আওয়ামী লীগ ও সরকার ঘুরে দাঁড়াল না। হাঁটতে থাকল গতানুগতিক পথেই। ছাত্রলীগ সন্ত্রাস আর অনাচারে ছাত্রদলের কালো অধ্যায়কেও যেন অতিক্রম করতে থাকল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কার্যত এর কোনো প্রতিবিধান করতে পারলেন না। জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকল। সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষণ ফুটে উঠল না আওয়ামী লীগের সরকার পরিচালনায়। প্রশাসনিক দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত ভুক্তভোগী মানুষদের হতাশ করে তুলল। গণতন্ত্র বিকাশের স্বাভাবিক পথ কেবল বন্ধুর হতে থাকল। এভাবেই ক্ষমতার চার বছরের মাথায় তেলতেলে বাঁশ থেকে পিছলে নেমে এলো তলানিতে।
এ বাস্তবতা বিএনপিকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল। বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার শক্তিও তৈরি হতে লাগল। এ সময় জামায়াতের বন্ধুত্ব বর্জন করে সাধারণ মানুষের আস্থায় আসা জরুরি ছিল বিএনপির জন্য। কিন্তু মানসিক জোর না থাকায় সাহসী হতে পারল না বিএনপি। বিএনপির বিশ্বাস করা উচিত ছিল, ক্ষমতায় থাকাকালীন কৃতকর্মের কারণে জনগণের একটি বড় অংশ দলটিকে ভোটের মাঠে বর্জন করেছিল। তাই গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলে জনমতকে শ্রদ্ধা করা উচিত ছিল। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক পথে না হেঁটে বিএনপি কঠিন ইস্যু না পেয়েও জনদুর্ভোগ বাড়ানোর হরতাল-অবরোধের দিকে হাঁটতে চাইল। খুব জমাতে পারল না, তবুও বাস্তব উপলব্ধি থেকে দূরে রইল। জামায়াতের সঙ্গে বন্ধুত্ব অটুট রাখার জন্য অবলীলায় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রশ্নে জামায়াতের পক্ষাবলম্বন করল। জামায়াত-শিবিরের হরতাল ও অমানবিক পিকেটিংয়ের সমর্থক ও সঙ্গী হয়ে নিজের অবস্থানকে আবার প্রশ্নবিদ্ধ করল।
সরকার পরিচালনায় এসে নানা ব্যর্থতায় জর্জরিত আওয়ামী লীগ বিএনপির বেসুরো পথ চলাকে সুযোগ হিসেবে নিতে পারত। জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সুশাসন ও সুস্থিরতার জন্য ইতিবাচক রাজনীতির পথে হাঁটতে পারত। রাজনৈতিক প্রয়োজনেই মহাজোটকে শক্তিশালী করতে পারত। কিন্তু পুরনো স্বভাব মতো আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিশাল বিজয়ে দিকহারা হয়েছিল। মহাজোটের শরিকদের প্রত্যাশিত সম্মান দেখাল না। ভোটের রাজনীতিতে এরশাদকে প্রয়োজন ছিল বলে নির্বাচনের আগে তার সমর্থন পেতে অনেক শ্রম ব্যয় করেছিল। বিজয়ের পর তেমন পাত্তা পায়নি জাতীয় পার্টি। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে যখন আওয়ামী লীগ সংকটে, তখন আবার মূল্য বেড়ে গেল এরশাদের। শুরু হল ধরনা দেয়া। এসবে হয়তো রাজনৈতিক কূটনীতির লাভ-ক্ষতি আছে, তবে সুস্থ রাজনীতির মাঠে একটি বড় দলের জনআস্থা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিএনপির বিশাল বিজয় স্বাভাবিক ধারায় প্রত্যাশা মতো হয়নি। কারণ নির্বাচনে দাঁড়ানো আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা সবাই (গাজীপুর ছাড়া) সাবেক মেয়র ছিলেন। সিটি কর্পোরেশন পরিচালনায় খুব একটা খারাপ ভূমিকা রাখেননি। বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থীরা প্রতিপক্ষকে ছাপিয়ে যাওয়ার মতো বিশাল পরিচিতি নিয়ে মাঠে নামেননি। তারপরও আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের পরাজয় একটি গভীর মূল্যায়নের বিষয়। তবে এ বিজয়ের পর বিএনপি নেতৃত্ব যতটা সংযত হয়ে হাঁটবে বলে মনে হয়েছিল, তেমনভাবে হাঁটতে পারছে না। বিএনপি বিজয়কে যদি নিজ দলের জনপ্রিয়তা ভাবে, তবে বড় ভুল করবে। উল্লিখিত সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনগুলো স্থানীয় নির্বাচনের বলয়ে থাকেনি। থাকলে ফলাফল হয়তো অন্যরকম হতে পারত। এটি জাতীয় নির্বাচনের আদল পেয়েছিল। অর্থাৎ জাতীয় ইস্যুগুলো সামনে চলে আসে। তাই সরকারের নানা ব্যর্থতা এবং সরকারি দল ও অঙ্গসংগঠনগুলোর নানা অনাচার সাধারণ মানুষকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। সুতরাং বলা যায়, আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা বা দুর্বলতার কারণে সুযোগের সুবিধা পেয়ে যায় বিএনপি। এ প্রেক্ষাপট বিএনপিকে আবার বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার সুযোগ এনে দেয়। কিন্তু পতাকা দিলেই হবে না, তা বহন করার শক্তি যদি বিধাতা না দেন তবে ফসল ঘরে তোলা সম্ভব হয় না। তাই এবার অসময়ে বিএনপি নেতৃত্বের যেন পায়াভারি হয়ে গেল। সংসদে নিজ দলের বাক-অসংযত নারী সংসদ সদস্যদের থামানোর চেষ্টা করল না বিএনপি। বাজেট পাসের আগে ছল ছুতোয় ওয়াকআউট করে নিজেদের দীনতা প্রমাণ করল।
সাধারণ মানুষের সামনে বিএনপি সবচেয়ে বেকায়দা দশায় এখন ওয়াশিংটন টাইমসে প্রকাশিত লেখা নিয়ে। লেখক হিসেবে সেখানে নাম ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার। জিএসপি সুবিধা স্থগিত হওয়ার পর সরকারি দল এজন্য খালেদা জিয়ার লেখাকে অংশত দায়ী করে। মহান সংসদে প্রসঙ্গটি উত্থাপিত হল কুশলী শব্দে দায় এড়ানো যেত। কিন্তু সে পথে হাঁটলেন না বিএনপি নেত্রী। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে সরাসরি অস্বীকার করলেন এ লেখাটি তিনি পাঠাননি বলে। অবশ্য এখানে একটি কৌশল ছিল। তিনি বলেননি যে, তিনি লেখেননি। বলেছেন পাঠাননি! তার পক্ষ থেকে কেউ পাঠালেও বক্তব্যটিকে অসত্য বলা যাবে না। যাই হোক, বিএনপি নেত্রীর এ সাফাই মেনে নেয়া সচেতন মানুষের জন্য সহজ নয়। কারণ কয়েক মাস আগে লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর বিতর্ক উঠেছিল। তখন কিন্তু খালেদা জিয়া বা বিএনপি নেতারা বিষয়টি অস্বীকার করেননি। বরঞ্চ প্রকাশিত লেখাটি যথার্থ হয়েছিল বলে তাদের কেউ কেউ বক্তৃতা-বিবৃতিতে বলেছিলেন। সত্যি সত্যি জিএসপি সুবিধা স্থগিত হয়ে যাওয়ায় বিপদে পড়ে এখন অস্বীকার করাটা কি শোভন বা নৈতিকভাবে ঠিক হল? আবার হাটে হাঁড়ি ভেঙে ওয়াশিংটন টাইমসের সম্পাদকও নিশ্চিত করলেন, লেখাটি স্বয়ং খালেদা জিয়ারই।
এ ঘটনাটি বিএনপির জন্য বড় রাজনৈতিক ও নৈতিক স্খলন। অন্য কোনো গণতান্ত্রিক সভ্য রাজনীতির দেশ হলে এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অমন নেতা-নেত্রী দায় মাথায় নিয়ে (যদি সত্যতা প্রমাণিত হয়) রাজনীতি ছেড়ে অবসরে যেতেন। আমাদের দেশের রাজনীতিতে অমন শোভন সংস্কৃতি নেই। তাই আবার সদম্ভে নানা কথার ফুলঝুরি হতে থাকবে বক্তৃতার মঞ্চে। তবে পেন্ডুলামের দুলুনি থামবে না। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর তরতর করে বাঁশের অনেকটা উপরে ওঠে গেছে বিএনপি। শাসন দুর্বলতার কারণে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে একটি জোয়ার তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এ সুবিধাটি বিএনপির ঘরে আসবে বলে অনেকের বিশ্বাস। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে নিজ দলের পক্ষে বিজয় আনতে পারবে এমন বিশ্বাস তৈরি করেছে। এ অবস্থা ধরে রাখতে চাইলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নৈতিকতার বিষয়ে তাদের সজাগ থাকতে হবে।
নির্বাচনের আগে ঠাণ্ডা মাথায় দুই বড় দলকেই নির্মোহভাবে বাস্তব অবস্থার মূল্যায়ন করতে হবে। হাম্বরা ভাব, মিথ্যার বেসাতি, জনদুর্ভোগ বাড়ানো, জনগণকে মূল্যায়ন না করা- এসব কিছু ভোটারের বিবেচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এসব অস্বীকার করা বর্তমান বাস্তবতায় যে কোনো দলের জন্যই আত্মহত্যার শামিল।
ড. একেএম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments