এডিপি বাস্তবায়নে যা করা দরকার by ড. মিহির কুমার রায়
অর্থনীতির ভাষায় উন্নয়ন মানেই ইতিবাচক
পরিবর্তন। এ পরিবর্তন যদি সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে জনকল্যাণমুখী
ভূমিকা রাখে, তাকেই বলা হয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা সার্বিক উন্নয়ন। নোবেল
বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেন তার আয় ও ব্যয় গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
কেবল আয় বাড়লেই উন্নয়ন হবে না, তার সঙ্গে সঙ্গে সমাজে আয়ের সুষম বণ্টন
থাকতে হবে, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে, সুশাসনের সুযোগ অবশ্যই সবার
কাছে পৌঁছাতে হবে, আÍসম্মান বোধ নিয়ে বেঁচে থাকার পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
তখনই হবে সত্যিকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন। বিগত সাড়ে চার বছরে সরকার যে রাষ্ট্র
পরিচালনার কাজ করেছে, তাতে কয়েকটি অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচক ঊর্ধ্বমুখী
হয়েছে সত্য যেমন- দারিদ্র্যের হার কমা, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস
পাওয়া, সবার জন্য বিশেষত মহিলাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া,
মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি। এসব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে উন্নয়ন খাতে
বাজেট বৃদ্ধির কারণে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় (২০১২) উল্লেখ আছে,
২০০৯-১০ অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ছিল ২৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং ব্যয়
হয়েছে ২৫ হাজার ৯১৭ কোটি টাকা, যা শতকরা হারে ৯১ শতাংশ। এর পরবর্তী বছরে এ
বরাদ্দ বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা এবং ব্যয় হয় ৩৩ হাজার ৭ কোটি
টাকা, যা শতকরা হারে ৯২ শতাংশ। একইভাবে ২০১২-১৩ অর্থবছরে উন্নয়ন খাতে
সংশোধিত বরাদ্দ দাঁড়ায় ৫২ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা এবং ধরা যাচ্ছে, এই
নির্বাচনী বছরে প্রায় শতভাগের কাছাকাছি উন্নয়ন বরাদ্দের ব্যবহার চলে আসবে।
এবারের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা এবং এই প্রথমবারের মতো উন্নয়ন বাজেটের অংশ হিসেবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব অর্থায়নে ৮ হাজার ১১৪ কোটি টাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের বরাদ্দ থেকে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। এডিপির অর্থের ৬৩ ভাগ সরকারের নিজস্ব তহবিল এবং বাকি ৩৭ ভাগ প্রকল্প সাহায্য থেকে পাওয়া যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে আগামী বছর মোট ১০৪৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫০টি নতুন প্রকল্প এবং বাকিগুলো চলমান প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। নতুন অর্থবছরের এডিপির আরেকটি চকমপ্রদ দিক হল, নিজস্ব অর্র্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ৬ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ এবং এর ফলে পরিবহন খাতে মোট উন্নয়ন বরাদ্দ দাঁড়ায় মোট এডিপির ২৩.৩৪ শতাংশ। এই যাতায়াত খাতে পদ্মা সেতুর অংশ দাঁড়ায় ৪৫ শতাংশ। এই সেতুর উন্নয়ন বরাদ্দ নিয়ে সরকারের ভেতর-বাইরে, সুশীল সমাজ, গবেষক, অর্থনীতিবিদ- সবার মধ্যে একটি আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, এভাবে বছরওয়ারি বাজেট বরাদ্দ দিয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হাস্যস্পদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, পদ্মা সেতুর মতো বৃহদাকার নির্মাণ কাজ অবশ্যই আন্তর্জাতিক নির্মাণ সংস্থার দ্বারা সম্পন্ন করতে হবে, যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার উপস্থিতি অপরিহার্য এবং সার্বিক ব্যয়ের অর্থ একসঙ্গে জোগান দিতে হবে, যা বর্তমান সরকারি ব্যবস্থায় সম্ভব কি-না তাও প্রশ্নের দাবি রাখে। এ ছাড়া ওই সেতুতে নিজস্ব অর্থায়নের ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ঘাটতি দেখা দিতে বাধ্য, যা সরকার ঘোষিত ৭.২ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
এখন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অন্যান্য খাতওয়ারি বিভাজন নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রাধিকার অনুসারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৯০৫৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই খাতের বরাদ্দের চেয়ে ১৪ ভাগ বেশি। এর পরই রয়েছে শিক্ষা খাতের ৮ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ, যা আগের বছরের একই খাতের চেয়ে ১৮ ভাগ বেশি। এছাড়াও বরাদ্দের ক্রমানুসারে বিভিন্ন খাতওয়ারি বিভাজন হল- পল্লী উন্নয়ন (৬ হাজার ৬২২ কোটি টাকা), স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা (৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা), কৃষি খাত (৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা)।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি হল বাজেটের অলংকার এবং এর সফল বাস্তবায়ন কাম্য বিশেষত দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতার জন্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা যায় না। ফলে এডিপির বরাদ্দ ফেরত চলে যায়, যা বিশেষ করে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে। এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এডিপি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর অদক্ষতা ও নিষ্ঠা। প্রকল্প বাস্তবায়নের যে কৃষ্টি রয়েছে তাতে দেখা যায়, প্রকল্পের শুরুর ও শেষ বছরটি অত্যন্ত সংকটাপন্ন বছর। এক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যবস্থাপক বা প্রকল্প পরিচালকের ভূমিকা থাকে মুখ্য এবং কর্তৃপক্ষের আগে থেকেই উচিত সেসব ব্যক্তিকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়া, যারা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক থেকে জ্ঞানসম্পন্ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেদের আগে থেকেই খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে সরকারি কাঠামোতে, যা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূরণ করা জরুরি। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে অনেক জাতীয় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন- পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি (এপিডি), বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি) ইত্যাদি।
পরিকল্পনা কমিশনকে বলা হয় প্রকল্পের বাজার, যেখানে বছরের একটা নির্দিষ্ট মৌসুমে (মার্চ থেকে মে) প্রকল্পের কেনাবেচা হয়। এ বাজারে ক্রেতা হল এডিপিভুক্ত বিভিন্ন সংস্থার প্রকল্প এবং বিক্রেতা হল অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা কমিশন। এ প্রক্রিয়ায় কেনাবেচা শেষে কমিশন থেকে প্রকল্পের চূড়ান্ত তালিকা বই আকারে বরাদ্দসহ প্রকাশ করা হয়, যা একটি বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপ। পরবর্তীকালে এটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার পরিকল্পনা কোষে প্রেরণ করা হয়। এ কাঠামোগত পদ্ধতির বাস্তবায়ন একদিকে যেমন সহজ অন্যদিকে ঠিক ততটুকুই কঠিন, যদিও তুলনামূলক বিচারে কঠিন বলে কোনো কিছুই নেই।
এ পরিপ্রেক্ষিতে এটা সহজেই অনুমেয় যে, অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে এডিপির বাস্তবায়ন বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রগত দিক থেকে কিছুটা ভিন্নতর হবে। এর কারণ, বর্তমান সরকারের এটি শেষ বছর এবং নতুন অর্থবছরে সরকারের সময় আছে সর্বোচ্চ ছয় মাস (যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতি চালু না হয়)। এ সময়টা নির্বাচনের জন্য একটি প্রস্তুতিমূলক সময় এবং এডিপির বাস্তবায়ন সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের কোনো অগ্রাধিকার বিষয় নয়। তার পর শুরু হবে জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচনের ফলাফল যদি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায় তা হলে এক ধরনের চিত্র, আর যদি বিপরীতমুখী হয়, তা হলে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এডিপি বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার আসবে, সরকার যাবে এটাই নিয়ম। কিন্তু সরকারি প্রশাসনিক কাঠামো, যারা এডিপি বাস্তবায়নের সঙ্গে থাকবে, তাদের অবস্থান থাকবে অপরিবর্তিত। তাহলে এডিপির সফল বাস্তবায়ন নিয়ে আশংকা কেন? এ পরিস্থিতির একটা নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ হল, যারা সরকারি কাঠামো (সচিবালয়কেন্দ্রিক প্রশাসন যন্ত্র) পরিচালনা করে, তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত (যদিও কাজটি সংবিধান পরিপন্থী)। এটার ফলে প্রশাসনিক কাজের গতি এবং তার সঙ্গে এডিপি বাস্তবায়নের গতি একই সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে প্রতীয়মান হয়, যা আসলেই একটি সমস্যা। এর সমাধান একদিনে সম্ভব নয়, যেহেতু সমস্যাটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এর স্বল্পমেয়াদি একটি সমাধান হতে পারে, মন্ত্রণালয়ের সচিবরা সব রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে এই সংকটাপন্ন সময়ে তাদের দাফতরিক কাজ পরিচালনা করবেন। আর এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার সরকারি প্রশাসন তথা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে। তাহলেই কেবল নতুন অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্য অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব হবে।
ড. মিহির কুমার রায় : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
এবারের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা এবং এই প্রথমবারের মতো উন্নয়ন বাজেটের অংশ হিসেবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব অর্থায়নে ৮ হাজার ১১৪ কোটি টাকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা, যা আগের বছরের বরাদ্দ থেকে প্রায় ১৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। এডিপির অর্থের ৬৩ ভাগ সরকারের নিজস্ব তহবিল এবং বাকি ৩৭ ভাগ প্রকল্প সাহায্য থেকে পাওয়া যাবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে আগামী বছর মোট ১০৪৬টি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে, যার মধ্যে ৫০টি নতুন প্রকল্প এবং বাকিগুলো চলমান প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। নতুন অর্থবছরের এডিপির আরেকটি চকমপ্রদ দিক হল, নিজস্ব অর্র্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ৬ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ এবং এর ফলে পরিবহন খাতে মোট উন্নয়ন বরাদ্দ দাঁড়ায় মোট এডিপির ২৩.৩৪ শতাংশ। এই যাতায়াত খাতে পদ্মা সেতুর অংশ দাঁড়ায় ৪৫ শতাংশ। এই সেতুর উন্নয়ন বরাদ্দ নিয়ে সরকারের ভেতর-বাইরে, সুশীল সমাজ, গবেষক, অর্থনীতিবিদ- সবার মধ্যে একটি আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, এভাবে বছরওয়ারি বাজেট বরাদ্দ দিয়ে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন হাস্যস্পদ ও ঝুঁকিপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, পদ্মা সেতুর মতো বৃহদাকার নির্মাণ কাজ অবশ্যই আন্তর্জাতিক নির্মাণ সংস্থার দ্বারা সম্পন্ন করতে হবে, যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার উপস্থিতি অপরিহার্য এবং সার্বিক ব্যয়ের অর্থ একসঙ্গে জোগান দিতে হবে, যা বর্তমান সরকারি ব্যবস্থায় সম্ভব কি-না তাও প্রশ্নের দাবি রাখে। এ ছাড়া ওই সেতুতে নিজস্ব অর্থায়নের ফলে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের ঘাটতি দেখা দিতে বাধ্য, যা সরকার ঘোষিত ৭.২ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
এখন বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির অন্যান্য খাতওয়ারি বিভাজন নিয়ে আলোচনা করা যাক। প্রাধিকার অনুসারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাদ্দ দেখানো হয়েছে ৯০৫৩ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই খাতের বরাদ্দের চেয়ে ১৪ ভাগ বেশি। এর পরই রয়েছে শিক্ষা খাতের ৮ হাজার ৭৬৬ কোটি টাকা বরাদ্দ, যা আগের বছরের একই খাতের চেয়ে ১৮ ভাগ বেশি। এছাড়াও বরাদ্দের ক্রমানুসারে বিভিন্ন খাতওয়ারি বিভাজন হল- পল্লী উন্নয়ন (৬ হাজার ৬২২ কোটি টাকা), স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা (৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা), কৃষি খাত (৩ হাজার ৭২১ কোটি টাকা)।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি হল বাজেটের অলংকার এবং এর সফল বাস্তবায়ন কাম্য বিশেষত দেশের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতার জন্য উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা যায় না। ফলে এডিপির বরাদ্দ ফেরত চলে যায়, যা বিশেষ করে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে বেশি হয়ে থাকে। এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এডিপি বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংস্থাগুলোর অদক্ষতা ও নিষ্ঠা। প্রকল্প বাস্তবায়নের যে কৃষ্টি রয়েছে তাতে দেখা যায়, প্রকল্পের শুরুর ও শেষ বছরটি অত্যন্ত সংকটাপন্ন বছর। এক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যবস্থাপক বা প্রকল্প পরিচালকের ভূমিকা থাকে মুখ্য এবং কর্তৃপক্ষের আগে থেকেই উচিত সেসব ব্যক্তিকে এ কাজের দায়িত্ব দেয়া, যারা তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক দিক থেকে জ্ঞানসম্পন্ন এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিজেদের আগে থেকেই খাপ খাইয়ে নিতে পারেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশে প্রকল্প বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত কাজে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ জনশক্তির যথেষ্ট অভাব রয়েছে সরকারি কাঠামোতে, যা প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূরণ করা জরুরি। বাংলাদেশে সরকারি পর্যায়ে অনেক জাতীয় প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেমন- পরিকল্পনা ও উন্নয়ন একাডেমি (এপিডি), বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমি (বার্ড), বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি) ইত্যাদি।
পরিকল্পনা কমিশনকে বলা হয় প্রকল্পের বাজার, যেখানে বছরের একটা নির্দিষ্ট মৌসুমে (মার্চ থেকে মে) প্রকল্পের কেনাবেচা হয়। এ বাজারে ক্রেতা হল এডিপিভুক্ত বিভিন্ন সংস্থার প্রকল্প এবং বিক্রেতা হল অনুমোদনকারী প্রতিষ্ঠান পরিকল্পনা কমিশন। এ প্রক্রিয়ায় কেনাবেচা শেষে কমিশন থেকে প্রকল্পের চূড়ান্ত তালিকা বই আকারে বরাদ্দসহ প্রকাশ করা হয়, যা একটি বছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পের চূড়ান্ত রূপ। পরবর্তীকালে এটি বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বাস্তবায়নকারী সংস্থার পরিকল্পনা কোষে প্রেরণ করা হয়। এ কাঠামোগত পদ্ধতির বাস্তবায়ন একদিকে যেমন সহজ অন্যদিকে ঠিক ততটুকুই কঠিন, যদিও তুলনামূলক বিচারে কঠিন বলে কোনো কিছুই নেই।
এ পরিপ্রেক্ষিতে এটা সহজেই অনুমেয় যে, অন্যান্য বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে এডিপির বাস্তবায়ন বৈশিষ্ট্য ও চরিত্রগত দিক থেকে কিছুটা ভিন্নতর হবে। এর কারণ, বর্তমান সরকারের এটি শেষ বছর এবং নতুন অর্থবছরে সরকারের সময় আছে সর্বোচ্চ ছয় মাস (যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতি চালু না হয়)। এ সময়টা নির্বাচনের জন্য একটি প্রস্তুতিমূলক সময় এবং এডিপির বাস্তবায়ন সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের কোনো অগ্রাধিকার বিষয় নয়। তার পর শুরু হবে জাতীয় নির্বাচন এবং নির্বাচনের ফলাফল যদি বর্তমান ক্ষমতাসীনদের পক্ষে যায় তা হলে এক ধরনের চিত্র, আর যদি বিপরীতমুখী হয়, তা হলে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে এডিপি বাস্তবায়নের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকার আসবে, সরকার যাবে এটাই নিয়ম। কিন্তু সরকারি প্রশাসনিক কাঠামো, যারা এডিপি বাস্তবায়নের সঙ্গে থাকবে, তাদের অবস্থান থাকবে অপরিবর্তিত। তাহলে এডিপির সফল বাস্তবায়ন নিয়ে আশংকা কেন? এ পরিস্থিতির একটা নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ হল, যারা সরকারি কাঠামো (সচিবালয়কেন্দ্রিক প্রশাসন যন্ত্র) পরিচালনা করে, তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত (যদিও কাজটি সংবিধান পরিপন্থী)। এটার ফলে প্রশাসনিক কাজের গতি এবং তার সঙ্গে এডিপি বাস্তবায়নের গতি একই সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে প্রতীয়মান হয়, যা আসলেই একটি সমস্যা। এর সমাধান একদিনে সম্ভব নয়, যেহেতু সমস্যাটি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। এর স্বল্পমেয়াদি একটি সমাধান হতে পারে, মন্ত্রণালয়ের সচিবরা সব রাজনৈতিক মতাদর্শের ঊর্ধ্বে থেকে এই সংকটাপন্ন সময়ে তাদের দাফতরিক কাজ পরিচালনা করবেন। আর এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হতে পারে, গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার সরকারি প্রশাসন তথা প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকবে। তাহলেই কেবল নতুন অর্থবছরের এডিপি বাস্তবায়নের লক্ষ্য অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব হবে।
ড. মিহির কুমার রায় : অর্থনীতিবিদ ও গবেষক, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা
No comments