সংলাপ, তত্ত্বাবধায়ক ও একদলীয় নির্বাচন by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
বর্তমান সরকার সম্প্রতি কিছুটা বেদিশা হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। সরকারের
ভেতরে নীতিগত সমন্বয় আছে বলেও মনে হয় না। একেক জন একেক কথা বলছেন।
সম্প্রতি ঢাকায় সমাবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ঘোষণার কথাই
ধরা যাক। তিনি বললেন, ঢাকায় সভা-সমাবেশ এক মাসের জন্য নিষিদ্ধ। তাঁর
আইজিপি বললেন, ‘তিনি এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না।’ আওয়ামী লীগের মুখপাত্র
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বললেন, ‘রিলিফের কাজের জন্য (ঢাকা কিন্তু পটুয়াখালী
নয়) সভা-সমাবেশ বন্ধ করতে বলেছে।’ সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী,
মোহাম্মদ নাসিম ও আরও অনেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে এ জন্য ক্ষোভ
প্রকাশ করেছেন। (সূত্র: সংবাদপত্র)
সরকার কে চালাচ্ছে? কীভাবে চালাচ্ছে? মন্ত্রীরা কেন এত বেদিশা হয়ে উঠেছেন, তা অনুমান করা কঠিন নয়। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী নির্বাচন হবেই—এমন নিশ্চয়তা মন্ত্রীরা পাচ্ছেন না। তাহলে? যদি অন্য রকমভাবে নির্বাচন হয়, তাহলে কি তাঁদের দল জিততে পারবে? জিততে না পারলে কী হবে, তা অনুমান করতে মন্ত্রীদের বেশি সময় লাগার কথা নয়। এ মুহূর্তে রাজনীতির অঙ্গনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সংলাপ। অথচ সেই সংলাপ নিয়েও নানা রকম কথা বলছেন মন্ত্রীরা। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক পরিবেশ সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত করেছেন পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এক মানববন্ধনে তিনি এসে ঘোষণা করেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনা ছাড়া নির্বাচনকালীন কোনো সরকার হবে না। শেখ হাসিনার প্রশ্নে আপস নেই।’ এর মাধ্যমে তিনি তাঁর নেত্রীকে তাঁর ব্যক্তিগত আনুগত্যের বার্তাও দিয়ে দিলেন। বেচারা! সরকার একদিকে শর্তহীন সংলাপের কথা বলছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনাকে রেখেই অন্তর্বর্তী সরকার হবে।’ সর্বশেষ আবার সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনাকে রাখতে হবে এমন কোনো শর্ত তাঁরা দেননি। এই পদ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’ প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছেন, ‘যেকোনো স্থানে আলোচনা হতে পারে।’ এখন বলছেন, ‘যা কিছু বলার শুধু সংসদে এসে বলতে হবে।’
বিগত সাড়ে চার বছরের শাসনকালের কথা মনে পড়লে মন্ত্রীদের উল্টাপাল্টা কথা বলাই স্বাভাবিক। কারণ, তাঁরা জানেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাঁদের পরিণতি কী হবে। এক পার্সেন্ট ঝুঁকি নিতেও তাঁরা রাজি নন। কিন্তু মনে হয় নিজেদের ব্লুপ্রিন্ট মতো নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। দেশে তো বটেই, বিদেশিদেরও ধারণা, নির্দলীয় সরকার ছাড়া উপায় নেই। সরকার এ কথা বুঝতে পেরেছে যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির পক্ষে তারা সবাই বিএনপির সমর্থক, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রথম আলো সম্প্রতি যে মতামত জরিপ প্রকাশ করেছে (পরিচালনা করেছে একটি পেশাদারি সংস্থা), সেখানেও ৯০ শতাংশ লোকের মত তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে। অনেকে এই মতামত জরিপ নিয়ে নানা সমালোচনা করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সারা বিশ্বে যে পদ্ধতিতে মতামত জরিপ পরিচালিত হয়, এখানেও তাই হয়েছে। ব্যতিক্রম কিছু নয়। প্রথম আলোর মতামত জরিপের পদ্ধতি নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেননি। সাধারণ আলোচনায়ও দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ মানুষ এবং ১৪ দলের বাইরে সব রাজনৈতিক দলই তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে। আমাদের ধারণা, সবাই নির্বাচনে একটা লেভেল প্লেয়িং মাঠ চায়। দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে সেই লেভেল প্লেয়িং মাঠটি পাওয়া যাবে না।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতা শেখ হাসিনাকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান রাখার ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ। নেত্রীকে খুশি করার এটা কৌশল। তাঁরা ভালোই জানেন, তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। তবু নেত্রী তো জানতে পারলেন, তিনি (ওই নেতা) নেত্রীর কত অনুগত! আমাদের বড় দুই দলে নেত্রীর প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য প্রদর্শনের লড়াই রাজনীতির অনেক ক্ষতি করেছে। আমাদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতেও এই আনুগত্যের সংস্কৃতি অব্যাহত থাকতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনাকে রেখে সংসদ নির্বাচনের যে বক্তব্য আওয়ামী লীগ দিয়ে যাচ্ছে, তাতে মনে হয় আলোচ্য ইস্যু নিয়ে কোনো গঠনমূলক আলোচনায় তারা আগ্রহী নয়। আমাদের মনে হয়, আওয়ামী লীগ ও সরকার ধারণা করছে, বিএনপির ওপর জেলজুলুম চালানোর পর তারা এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তাদের পক্ষে বড় মাপের কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। এই ধারণা খুব ভুল, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। বর্তমান সরকার নানা কৌশলে বিএনপির প্রথম সারির অনেক নেতাকে কারাবন্দী করে রেখেছে। অনেকের নামে মামলা ঝুলছে। সব মিলিয়ে বিএনপি প্রায় কোণঠাসা অবস্থায়। তবু একটা কথা আছে, ‘হাতি মরলেও লাখ টাকা।’ বিএনপি বড় একটি দল। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে তাদের কর্মী ও সমর্থক রয়েছেন। নয়াপল্টনে তাদের সমাবেশ দেখলে বোঝা যায় তাদের শক্তি কত। সরকার বিএনপিকে ছোট করে দেখলে ভুল করবে।
কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি বড় মাপের আন্দোলন করতে পারবে না, এমন মনে করা ঠিক হবে না। তবে আন্দোলনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হোক, তা আমরা চাই না। তাতে দেশের অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হবে। অনেক মানুষের প্রাণহানিও হতে পারে। আমরা আশা করব, সরকার বিলম্বে হলেও সংলাপের জন্য এজেন্ডাসহ চিঠি দেবে সব বিরোধী দলকে। এজেন্ডাসহ চিঠি না দেওয়া পর্যন্ত বল কিন্তু সরকারের কোর্টেই থেকে যাচ্ছে। চিঠি না দিয়ে সরকারের মন্ত্রী বা আওয়ামী লীগ নেতারা সংলাপ নিয়ে যত কথাই বলুন, তাতে সরকারের আন্তরিকতার প্রতিফলন হয় না।
অনেকে সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন। এটা একেবারেই অসার কথা। সংবিধান জনগণের জন্য। সংবিধানের জন্য জনগণ নয়। সরকার জনগণের ইচ্ছাকেই সব সময় অগ্রাধিকার দেবে। এটাই বাস্তবতা। সরকার যদি জনগণের মনের কথা পড়তে পারেন, তাহলে সংবিধান সংশোধন করে ‘যা জনগণের দাবি’ সেটাই সংবিধানে সংযোজন করবে। এটা এক ঘণ্টার কাজ। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে সংবিধানের দোহাই যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরা জনগণকে ‘হাইকোর্ট’ দেখানোর চেষ্টা করছেন।
ইদানীং আরেক রকম চালাকির কথা শোনা যাচ্ছে। সরকারপন্থী কেউ কেউ বলছেন, ‘নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনার বদলে স্পিকারকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিতে পারেন।’ এই কথার মধ্যে একটা আপাত-নিরপেক্ষতার কৃত্রিম আভাসও পাওয়া যায়। এটা আরেক ধরনের চালাকি। ভাবটা এ রকম, ‘শেখ হাসিনার ব্যাপারে তোমাদের আপত্তি তো, ঠিক আছে স্পিকারকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হলো। এবার রাজি হও।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল দর্শনটা হলো নির্দলীয় সরকার। স্পিকার কি নির্দলীয় ব্যক্তি? সরকার পরিচালনায় তিনি নেপথ্যে কার কাছ থেকে নির্দেশ বা পরামর্শ গ্রহণ করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। কাজেই দলীয় কোনো ব্যক্তিই নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকতে পারবেন না—এটাই বিরোধী দলের দাবি। শেখ হাসিনার বদলে স্পিকারের প্রস্তাব তারা মানবে না।
একটা কথা বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মনে রাখা দরকার। নির্বাচনের সময় এমন একটা সরকার থাকতে হবে, যে সরকার ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে অসংখ্য সরকারি পদে রদবদল ঘটাতে পারেন। আগের সরকারের কোনো ছক যেন নির্বাচনের সময় বাস্তবায়িত না হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এভাবেই কাজ শুরু করতে হবে। এই রদবদল কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষের জন্য নয়। আগের সরকারের ছক নষ্ট করার জন্য এটা খুবই প্রয়োজন। অনেকে এমনও মনে করছেন, ‘বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল অংশ না নিলেও বর্তমান সরকার নির্বাচন করে ফেলবে।’ হ্যাঁ, করে ফেলতে পারে। এটা কষ্টকর, কিন্তু অসম্ভব কাজ নয়। এ ধরনের নির্বাচনে একটি গৃহপালিত বিরোধী দলও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু জেনারেল এরশাদ বলেছেন, তিনি এ ধরনের নির্বাচনে যাবেন না। তাহলে তো এই পার্লামেন্টে বিরোধী দলই পাওয়া যাবে না। ৩০০ আসনেই ১৪-দলীয় জোট জয়ী হবে। এটা বিশ্ব রেকর্ড হতে পারে। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ রকম একদলীয় নির্বাচনের সরকার টিকতে পারে না। দেশে বা বিদেশে কারও সমর্থন পায় না। সরকার কাজ করতে পারে না। বিরোধী দল প্রথম দিন থেকে শুরু করবে আন্দোলন। সেই আন্দোলনে একদলীয় নির্বাচনের সরকার টিকতে পারবে কি? টিকতে না পারলে এক বছরের মাথায় আবার সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ১৪-দলীয় জোটের অবস্থা কী হতে পারে, তা কি শেখ হাসিনা একবার ভেবে দেখেছেন?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ওউন্নয়নকর্মী।
সরকার কে চালাচ্ছে? কীভাবে চালাচ্ছে? মন্ত্রীরা কেন এত বেদিশা হয়ে উঠেছেন, তা অনুমান করা কঠিন নয়। সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী নির্বাচন হবেই—এমন নিশ্চয়তা মন্ত্রীরা পাচ্ছেন না। তাহলে? যদি অন্য রকমভাবে নির্বাচন হয়, তাহলে কি তাঁদের দল জিততে পারবে? জিততে না পারলে কী হবে, তা অনুমান করতে মন্ত্রীদের বেশি সময় লাগার কথা নয়। এ মুহূর্তে রাজনীতির অঙ্গনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সংলাপ। অথচ সেই সংলাপ নিয়েও নানা রকম কথা বলছেন মন্ত্রীরা। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক পরিবেশ সবচেয়ে বেশি উত্তপ্ত করেছেন পরিবেশমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। এক মানববন্ধনে তিনি এসে ঘোষণা করেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনা ছাড়া নির্বাচনকালীন কোনো সরকার হবে না। শেখ হাসিনার প্রশ্নে আপস নেই।’ এর মাধ্যমে তিনি তাঁর নেত্রীকে তাঁর ব্যক্তিগত আনুগত্যের বার্তাও দিয়ে দিলেন। বেচারা! সরকার একদিকে শর্তহীন সংলাপের কথা বলছে, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা বলছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনাকে রেখেই অন্তর্বর্তী সরকার হবে।’ সর্বশেষ আবার সৈয়দ আশরাফ বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনাকে রাখতে হবে এমন কোনো শর্ত তাঁরা দেননি। এই পদ নিয়ে আলোচনা হতে পারে।’ প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছেন, ‘যেকোনো স্থানে আলোচনা হতে পারে।’ এখন বলছেন, ‘যা কিছু বলার শুধু সংসদে এসে বলতে হবে।’
বিগত সাড়ে চার বছরের শাসনকালের কথা মনে পড়লে মন্ত্রীদের উল্টাপাল্টা কথা বলাই স্বাভাবিক। কারণ, তাঁরা জানেন, নির্দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাঁদের পরিণতি কী হবে। এক পার্সেন্ট ঝুঁকি নিতেও তাঁরা রাজি নন। কিন্তু মনে হয় নিজেদের ব্লুপ্রিন্ট মতো নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। দেশে তো বটেই, বিদেশিদেরও ধারণা, নির্দলীয় সরকার ছাড়া উপায় নেই। সরকার এ কথা বুঝতে পেরেছে যে দেশের বেশির ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতির পক্ষে তারা সবাই বিএনপির সমর্থক, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রথম আলো সম্প্রতি যে মতামত জরিপ প্রকাশ করেছে (পরিচালনা করেছে একটি পেশাদারি সংস্থা), সেখানেও ৯০ শতাংশ লোকের মত তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে। অনেকে এই মতামত জরিপ নিয়ে নানা সমালোচনা করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে সারা বিশ্বে যে পদ্ধতিতে মতামত জরিপ পরিচালিত হয়, এখানেও তাই হয়েছে। ব্যতিক্রম কিছু নয়। প্রথম আলোর মতামত জরিপের পদ্ধতি নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেননি। সাধারণ আলোচনায়ও দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ মানুষ এবং ১৪ দলের বাইরে সব রাজনৈতিক দলই তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে। আমাদের ধারণা, সবাই নির্বাচনে একটা লেভেল প্লেয়িং মাঠ চায়। দলীয় সরকার ক্ষমতায় থাকলে সেই লেভেল প্লেয়িং মাঠটি পাওয়া যাবে না।
আওয়ামী লীগের কিছু নেতা শেখ হাসিনাকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান রাখার ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ। নেত্রীকে খুশি করার এটা কৌশল। তাঁরা ভালোই জানেন, তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে না। তবু নেত্রী তো জানতে পারলেন, তিনি (ওই নেতা) নেত্রীর কত অনুগত! আমাদের বড় দুই দলে নেত্রীর প্রতি ব্যক্তিগত আনুগত্য প্রদর্শনের লড়াই রাজনীতির অনেক ক্ষতি করেছে। আমাদের আশঙ্কা, ভবিষ্যতেও এই আনুগত্যের সংস্কৃতি অব্যাহত থাকতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধানমন্ত্রী পদে শেখ হাসিনাকে রেখে সংসদ নির্বাচনের যে বক্তব্য আওয়ামী লীগ দিয়ে যাচ্ছে, তাতে মনে হয় আলোচ্য ইস্যু নিয়ে কোনো গঠনমূলক আলোচনায় তারা আগ্রহী নয়। আমাদের মনে হয়, আওয়ামী লীগ ও সরকার ধারণা করছে, বিএনপির ওপর জেলজুলুম চালানোর পর তারা এত দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তাদের পক্ষে বড় মাপের কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। এই ধারণা খুব ভুল, তা মনে করার কোনো কারণ নেই। বর্তমান সরকার নানা কৌশলে বিএনপির প্রথম সারির অনেক নেতাকে কারাবন্দী করে রেখেছে। অনেকের নামে মামলা ঝুলছে। সব মিলিয়ে বিএনপি প্রায় কোণঠাসা অবস্থায়। তবু একটা কথা আছে, ‘হাতি মরলেও লাখ টাকা।’ বিএনপি বড় একটি দল। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে তাদের কর্মী ও সমর্থক রয়েছেন। নয়াপল্টনে তাদের সমাবেশ দেখলে বোঝা যায় তাদের শক্তি কত। সরকার বিএনপিকে ছোট করে দেখলে ভুল করবে।
কাজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপি বড় মাপের আন্দোলন করতে পারবে না, এমন মনে করা ঠিক হবে না। তবে আন্দোলনের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হোক, তা আমরা চাই না। তাতে দেশের অর্থনীতির অনেক ক্ষতি হবে। অনেক মানুষের প্রাণহানিও হতে পারে। আমরা আশা করব, সরকার বিলম্বে হলেও সংলাপের জন্য এজেন্ডাসহ চিঠি দেবে সব বিরোধী দলকে। এজেন্ডাসহ চিঠি না দেওয়া পর্যন্ত বল কিন্তু সরকারের কোর্টেই থেকে যাচ্ছে। চিঠি না দিয়ে সরকারের মন্ত্রী বা আওয়ামী লীগ নেতারা সংলাপ নিয়ে যত কথাই বলুন, তাতে সরকারের আন্তরিকতার প্রতিফলন হয় না।
অনেকে সংবিধানের দোহাই দিচ্ছেন। এটা একেবারেই অসার কথা। সংবিধান জনগণের জন্য। সংবিধানের জন্য জনগণ নয়। সরকার জনগণের ইচ্ছাকেই সব সময় অগ্রাধিকার দেবে। এটাই বাস্তবতা। সরকার যদি জনগণের মনের কথা পড়তে পারেন, তাহলে সংবিধান সংশোধন করে ‘যা জনগণের দাবি’ সেটাই সংবিধানে সংযোজন করবে। এটা এক ঘণ্টার কাজ। কাজেই তত্ত্বাবধায়ক প্রশ্নে সংবিধানের দোহাই যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁরা জনগণকে ‘হাইকোর্ট’ দেখানোর চেষ্টা করছেন।
ইদানীং আরেক রকম চালাকির কথা শোনা যাচ্ছে। সরকারপন্থী কেউ কেউ বলছেন, ‘নির্বাচনের সময় শেখ হাসিনার বদলে স্পিকারকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিতে পারেন।’ এই কথার মধ্যে একটা আপাত-নিরপেক্ষতার কৃত্রিম আভাসও পাওয়া যায়। এটা আরেক ধরনের চালাকি। ভাবটা এ রকম, ‘শেখ হাসিনার ব্যাপারে তোমাদের আপত্তি তো, ঠিক আছে স্পিকারকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হলো। এবার রাজি হও।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মূল দর্শনটা হলো নির্দলীয় সরকার। স্পিকার কি নির্দলীয় ব্যক্তি? সরকার পরিচালনায় তিনি নেপথ্যে কার কাছ থেকে নির্দেশ বা পরামর্শ গ্রহণ করবেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে বেশি বুদ্ধির প্রয়োজন হয় না। কাজেই দলীয় কোনো ব্যক্তিই নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় থাকতে পারবেন না—এটাই বিরোধী দলের দাবি। শেখ হাসিনার বদলে স্পিকারের প্রস্তাব তারা মানবে না।
একটা কথা বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মনে রাখা দরকার। নির্বাচনের সময় এমন একটা সরকার থাকতে হবে, যে সরকার ক্ষমতা গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে ঢাকাসহ সারা দেশে অসংখ্য সরকারি পদে রদবদল ঘটাতে পারেন। আগের সরকারের কোনো ছক যেন নির্বাচনের সময় বাস্তবায়িত না হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে এভাবেই কাজ শুরু করতে হবে। এই রদবদল কোনো দলের পক্ষে বা বিপক্ষের জন্য নয়। আগের সরকারের ছক নষ্ট করার জন্য এটা খুবই প্রয়োজন। অনেকে এমনও মনে করছেন, ‘বিএনপিসহ বেশির ভাগ বিরোধী দল অংশ না নিলেও বর্তমান সরকার নির্বাচন করে ফেলবে।’ হ্যাঁ, করে ফেলতে পারে। এটা কষ্টকর, কিন্তু অসম্ভব কাজ নয়। এ ধরনের নির্বাচনে একটি গৃহপালিত বিরোধী দলও পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু জেনারেল এরশাদ বলেছেন, তিনি এ ধরনের নির্বাচনে যাবেন না। তাহলে তো এই পার্লামেন্টে বিরোধী দলই পাওয়া যাবে না। ৩০০ আসনেই ১৪-দলীয় জোট জয়ী হবে। এটা বিশ্ব রেকর্ড হতে পারে। তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, এ রকম একদলীয় নির্বাচনের সরকার টিকতে পারে না। দেশে বা বিদেশে কারও সমর্থন পায় না। সরকার কাজ করতে পারে না। বিরোধী দল প্রথম দিন থেকে শুরু করবে আন্দোলন। সেই আন্দোলনে একদলীয় নির্বাচনের সরকার টিকতে পারবে কি? টিকতে না পারলে এক বছরের মাথায় আবার সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে ১৪-দলীয় জোটের অবস্থা কী হতে পারে, তা কি শেখ হাসিনা একবার ভেবে দেখেছেন?
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ওউন্নয়নকর্মী।
No comments