বাংলাদেশ কোন পথে? by আলী রীয়াজ
জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের
সাম্প্রতিক তৎপরতার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতির গতি-প্রকৃতি
বিশ্লেষণ করেছেন ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আলী রীয়াজ। এতে
ভারতীয় উপমহাদেশে কীভাবে ধর্মভিত্তিক দলগুলো প্রসার লাভ করেছে এবং
গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার দলগুলো কী ভূমিকা রেখেছে, তারও ব্যাখ্যা রয়েছে।
তিন পর্বের নিবন্ধের প্রথম পর্ব আজ প্রকাশিত হলো। সাম্প্রতিক কালে
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসঙ্গটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ
বিষয়ে পরিণত হয়েছে, তা এর আগে আমরা কখনোই প্রত্যক্ষ করিনি। স্বাধীন
বাংলাদেশে তো নয়ই, এমনকি সম্ভবত গত প্রায় এক শ বছরেও আমরা এই আকারে এই
প্রপঞ্চের মুখোমুখি হইনি। এর কারণ কী? এই পরিস্থিতিকে আমরা কীভাবে ব্যাখ্যা
করব? রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের করণীয় কী? আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের
ভবিষ্যৎ পথরেখায় তার কী প্রভাব পড়বে? এ ধরনের প্রশ্ন আমাদের সবার মনের
ভেতরেই যে কেবল ঘুরপাক খাচ্ছে তা নয়, আমরা সবাই কমবেশি এ নিয়ে আলোচনা
করছি। আমরা এ বিষয়ে বেশি করে উৎসাহী হয়েছি সাম্প্রতিক কালে জামায়াতে
ইসলামীর সহিংস আচরণ ও তার নিষিদ্ধকরণের দাবির পটভূমিকায়, পাশাপাশি হেফাজতে
ইসলাম বলে একটি সংগঠনের উত্থানের কারণে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ক্রমাগত
শক্তি সঞ্চয়, ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বিষয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর
আপসমুখী অবস্থান, এই সব দলকে আশু স্বার্থে ব্যবহারের জন্য মরিয়া ভাব,
ধর্মভিত্তিক দলের আড়ালে ও নামে সহিংসতার ব্যাপক বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির চেহারা বিষয়ে উদ্বেগ নিঃসন্দেহে যৌক্তিক।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে বুঝতে চাইলে, তার বর্তমান অবস্থাকে উপলব্ধি করতে
চাইলে কেবল স্বাধীন বাংলাদেশের গত ৪২ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকানো যথেষ্ট
নয় বলে আমার ধারণা। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয়ের
প্রশ্নটি যখন তৎকালীন বাংলার সমাজজীবনে আলোড়ন তুলেছিল, তখনো আমরা
রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলের বিষয় নিয়ে কোনো রকম বিতর্ক দেখতে পাই না।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি তখনো এই বিবেচনার মধ্যে আসেনি। কেননা সমাজে ধর্মের
উপস্থিতি, ব্যক্তিজীবনে ধর্মাচরণের সঙ্গে রাজনীতির একটা দূরত্ব বজায়
থেকেছে। আর তা ছাড়া বিষয়টি বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় একভাবে নিষ্পত্তিও হয়ে
গিয়েছিল; বাঙালির ভাষাভিত্তিক পরিচয়ের মধ্যে। বিংশ শতাব্দীর তিরিশের
দশকে পাকিস্তান দাবির পেছনে ধর্মের বিবেচনা সত্ত্বেও এবং এ বিষয়ে চল্লিশের
দশকে বাঙালি মুসলমানের অকুণ্ঠ সমর্থন সত্ত্বেও মনে রাখা দরকার, মুসলিম
লিগকে কখনোই ধর্মভিত্তিক দল বলে বিবেচনা করা হয়নি, বাঙালি মুসলমান
ধর্মরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান আন্দোলনে যোগ দেয়নি। পাকিস্তান
প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ২৫ বছরের ইতিহাসেও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রশ্ন কখনোই
বাংলাদেশের রাজনীতির মূল প্রশ্ন হয়নি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত
ধর্মভিত্তিক দল গঠনের সুযোগ ছিল না; সাংবিধানিকভাবেই বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক
রাজনীতির প্রশ্ন ওঠেনি।
কিন্তু ইতিহাস হচ্ছে একটা কূপের মতো, আপনি কতটা গভীর পর্যন্ত খুঁড়তে চান তার ওপর নির্ভর করবে আপনি শেষ পর্যন্ত কী ধরনের প্রমাণ সংগ্রহ করতে সক্ষম হচ্ছেন। ধর্মভিত্তিক দল ও রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান প্রশ্ন ছিল না মানে কি এই যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কখনোই আমাদের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেনি?
১৯৪৭ সালে বাংলা প্রদেশ ভাগ হবে কি না সে প্রশ্ন নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে সংগঠনের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো হিন্দু মহাসভা। ইতিহাসের সনিষ্ঠ পাঠকেরা জানেন যে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল হাশিম এবং শরৎ বসু স্বাধীন-সার্বভৌম যুক্তবাংলা গঠনের যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি সে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ২ মে ১৯৪৭ সালে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘একটি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা সম্বন্ধে কিছু এলোমেলো কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এর ভাবার্থ আমাদের কাছে একেবারেই বোধগম্য নয় এবং আমরা এর সমর্থন কোনোভাবেই করি না। হিন্দুদের কাছে এই পরিকল্পনা কোনো উপকারে আসবে না। স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা প্রকৃতপক্ষে একটি পাকিস্তানের রূপ নেবে... আমরা কোনোভাবেই ভারতের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না (দেখুন, মাউন্ট ব্যাটেন পেপারস, নিকোলাস মানসার্গ ও অন্যান্য, দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, ১৯৪২-৪৭, ভলিউম ১০, পৃ. ৫৫৭। তা ছাড়া হিন্দু মহাসভার ভূমিকা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন জয়া চ্যাটার্জি তাঁর বেঙ্গল ডিভাইডেড বইয়ে)। বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই যে হিন্দু মহাসভাই কালক্রমে ভারতে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বলে পরিচিত ভূখণ্ডে ইসলামপন্থী রাজনীতির উপস্থিতি আরও পুরোনো। কার্যত, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে, বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্যেই তার উদ্ভব। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় হাজী শরীয়তউল্লাহ্র নেতৃত্বে সংঘটিত ফারায়েজি আন্দোলন, বিশেষত দুদু মিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন এবং তিতুমীরের নেতৃত্বে তারিক-ই-মুহাম্মাদিয়ার প্রভাবে ‘বাঁশের কেল্লা’ বলে পরিচিত আন্দোলন এই ধারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। সমাজসংস্কারের এসব আন্দোলন কালক্রমে রাজনৈতিক রূপ লাভ করেছিল। পরে কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের শক্তি সঞ্চয় হলে, তারাই প্রধান দলে পরিণত হলে এসব আন্দোলন হারিয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ মানসে, প্রচলিত লোককথায়, সংস্কৃতিতে তার প্রভাব একেবারে অবসিত হয়ে যায়নি। এখানে এটাও জোর দিয়ে বলতে চাই যে এই ধারার সঙ্গে অতিসমপ্রতি জামায়াতে ইসলামীর যোগাযোগ এবং ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলেও জামায়াত এই ধারার রাজনীতির প্রতিনিধি নয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, তা হলো—আমরা কি এখন বহুধা বিভক্ত ইসলামপন্থী রাজনীতিকে একটি কেন্দ্রে সম্মিলিত হতে দেখছি?
আমরা এখানে এলাম কীভাবে?
ইসলামি রাজনীতির ধারা যদি মুসলিম লিগ আর কংগ্রেসের সাফল্যের কারণে ১৯৪৭ সালে নাগাদ দুর্বল ও প্রায়-নিঃশেষিত হয়ে গিয়ে থাকে, তবে আমরা আজকে কেন তার এই শক্তি দেখতে পাই—এ বিষয়টি বোঝা খুব জরুরি। বাংলাদেশের লোককথায় যে ইসলামি আন্দোলন, সেই ধারাটি পাকিস্তানি শাসনামলে (১৯৪৭-১৯৭১) আর বেগ লাভ করতে পারেনি, তার কারণ বহুবিধ। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ, পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, আর্থসামাজিক পরিবর্তন ও জামায়াতে ইসলামীর আবির্ভাব। জামায়াতের নেতারা, এমনকি তাঁদের দীক্ষাগুরু আবুল আলা মওদুদী, প্রচলিত অর্থে মাদ্রাসায় শিক্ষিত নয়। পাকিস্তান আমলে জামায়াতে ইসলামী ইসলামপন্থীদের নতুন রাজনীতির জন্ম দেয়, যা নগরকেন্দ্রিক, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের নেতৃত্বাধীন এবং যার লক্ষ্য মানুষের আধ্যাত্মিক মুক্তি নয়, এমনকি সমাজে ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত নয়, কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। পাকিস্তান আমলে ইসলামপন্থী রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর আধিপত্য ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে ও রাজনীতির প্রধান ধারায় তারা কোনো আবেদন রাখতে পারেনি; তার অন্যতম কারণ হলো সাধারণ শিক্ষার প্রসার, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ, নগরায়ণ, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব এবং পাকিস্তানিদের শোষণ।
বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালের পর জামায়াতে ইসলামী এবং ১৯৮১ সালে মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহর (হাফেজ্জি হুজুর) রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার মধ্য দিয়ে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ইসলামপন্থীরা রাজনীতিতে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করেছে। জিয়া ও এরশাদের আমলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য, সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান, রাষ্ট্রধর্মের ঘোষণা এবং একই সময়ে প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আশ্রয়-প্রশ্রয় যেমন জামায়াতে ইসলামীকে শক্তিশালী করেছে, তেমনি কওমি মাদ্রাসার প্রসারের কারণে মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামপন্থী দলগুলোর ভিত্তি জোরালো হয়েছে। সামরিক শাসকেরা তাঁদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির শরণাপন্ন হয়েছেন, অন্যদিকে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে নির্বাচনী রাজনীতির অতিসরলীকৃত অঙ্কের বিবেচনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে। দলগুলোর আচরণ থেকে মনে হয়, তাদের এই ধারণা হয়েছে যে সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার প্রমাণ দিতে হলে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সব সময় তাদের সঙ্গে রাখা দরকার।
দেশের ইতিহাস এবং অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসারের কারণ সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়; কিন্তু তা সম্পূর্ণ চিত্রটি তুলে ধরে না। কেননা দেশের বাইরের ঘটনাপ্রবাহও এর পেছনে কাজ করেছে। তা ছাড়া প্রশ্ন থাকছে ধর্মভিত্তিক দল শক্তিশালী হয়ে উঠলে তার ফল কী।
l আগামীকাল পড়ুন: ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব বোঝার অক্ষমতা
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগেরঅধ্যাপক।
কিন্তু ইতিহাস হচ্ছে একটা কূপের মতো, আপনি কতটা গভীর পর্যন্ত খুঁড়তে চান তার ওপর নির্ভর করবে আপনি শেষ পর্যন্ত কী ধরনের প্রমাণ সংগ্রহ করতে সক্ষম হচ্ছেন। ধর্মভিত্তিক দল ও রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান প্রশ্ন ছিল না মানে কি এই যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি কখনোই আমাদের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেনি?
১৯৪৭ সালে বাংলা প্রদেশ ভাগ হবে কি না সে প্রশ্ন নির্ধারণের ক্ষেত্রে যে সংগঠনের ভূমিকা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো হিন্দু মহাসভা। ইতিহাসের সনিষ্ঠ পাঠকেরা জানেন যে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, আবুল হাশিম এবং শরৎ বসু স্বাধীন-সার্বভৌম যুক্তবাংলা গঠনের যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন, নিখিল ভারত হিন্দু মহাসভার সভাপতি শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি সে প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের কাছে তীব্র প্রতিবাদ করেন। ২ মে ১৯৪৭ সালে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন, ‘একটি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা সম্বন্ধে কিছু এলোমেলো কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে। এর ভাবার্থ আমাদের কাছে একেবারেই বোধগম্য নয় এবং আমরা এর সমর্থন কোনোভাবেই করি না। হিন্দুদের কাছে এই পরিকল্পনা কোনো উপকারে আসবে না। স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা প্রকৃতপক্ষে একটি পাকিস্তানের রূপ নেবে... আমরা কোনোভাবেই ভারতের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাই না (দেখুন, মাউন্ট ব্যাটেন পেপারস, নিকোলাস মানসার্গ ও অন্যান্য, দ্য ট্রান্সফার অব পাওয়ার, ১৯৪২-৪৭, ভলিউম ১০, পৃ. ৫৫৭। তা ছাড়া হিন্দু মহাসভার ভূমিকা বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন জয়া চ্যাটার্জি তাঁর বেঙ্গল ডিভাইডেড বইয়ে)। বিস্মৃত হওয়ার সুযোগ নেই যে হিন্দু মহাসভাই কালক্রমে ভারতে ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির জন্ম দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বলে পরিচিত ভূখণ্ডে ইসলামপন্থী রাজনীতির উপস্থিতি আরও পুরোনো। কার্যত, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে, বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের মধ্যেই তার উদ্ভব। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ায় হাজী শরীয়তউল্লাহ্র নেতৃত্বে সংঘটিত ফারায়েজি আন্দোলন, বিশেষত দুদু মিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন এবং তিতুমীরের নেতৃত্বে তারিক-ই-মুহাম্মাদিয়ার প্রভাবে ‘বাঁশের কেল্লা’ বলে পরিচিত আন্দোলন এই ধারার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। সমাজসংস্কারের এসব আন্দোলন কালক্রমে রাজনৈতিক রূপ লাভ করেছিল। পরে কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের শক্তি সঞ্চয় হলে, তারাই প্রধান দলে পরিণত হলে এসব আন্দোলন হারিয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ মানসে, প্রচলিত লোককথায়, সংস্কৃতিতে তার প্রভাব একেবারে অবসিত হয়ে যায়নি। এখানে এটাও জোর দিয়ে বলতে চাই যে এই ধারার সঙ্গে অতিসমপ্রতি জামায়াতে ইসলামীর যোগাযোগ এবং ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলেও জামায়াত এই ধারার রাজনীতির প্রতিনিধি নয়। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, তা হলো—আমরা কি এখন বহুধা বিভক্ত ইসলামপন্থী রাজনীতিকে একটি কেন্দ্রে সম্মিলিত হতে দেখছি?
আমরা এখানে এলাম কীভাবে?
ইসলামি রাজনীতির ধারা যদি মুসলিম লিগ আর কংগ্রেসের সাফল্যের কারণে ১৯৪৭ সালে নাগাদ দুর্বল ও প্রায়-নিঃশেষিত হয়ে গিয়ে থাকে, তবে আমরা আজকে কেন তার এই শক্তি দেখতে পাই—এ বিষয়টি বোঝা খুব জরুরি। বাংলাদেশের লোককথায় যে ইসলামি আন্দোলন, সেই ধারাটি পাকিস্তানি শাসনামলে (১৯৪৭-১৯৭১) আর বেগ লাভ করতে পারেনি, তার কারণ বহুবিধ। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আদর্শ হিসেবে ইসলামকে গ্রহণ, পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ, আর্থসামাজিক পরিবর্তন ও জামায়াতে ইসলামীর আবির্ভাব। জামায়াতের নেতারা, এমনকি তাঁদের দীক্ষাগুরু আবুল আলা মওদুদী, প্রচলিত অর্থে মাদ্রাসায় শিক্ষিত নয়। পাকিস্তান আমলে জামায়াতে ইসলামী ইসলামপন্থীদের নতুন রাজনীতির জন্ম দেয়, যা নগরকেন্দ্রিক, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতদের নেতৃত্বাধীন এবং যার লক্ষ্য মানুষের আধ্যাত্মিক মুক্তি নয়, এমনকি সমাজে ইসলামি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত নয়, কেবল রাষ্ট্রক্ষমতা দখল। পাকিস্তান আমলে ইসলামপন্থী রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর আধিপত্য ছিল, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের কাছে ও রাজনীতির প্রধান ধারায় তারা কোনো আবেদন রাখতে পারেনি; তার অন্যতম কারণ হলো সাধারণ শিক্ষার প্রসার, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ, নগরায়ণ, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব এবং পাকিস্তানিদের শোষণ।
বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালের পর জামায়াতে ইসলামী এবং ১৯৮১ সালে মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহর (হাফেজ্জি হুজুর) রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার মধ্য দিয়ে কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক ইসলামপন্থীরা রাজনীতিতে ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করেছে। জিয়া ও এরশাদের আমলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য, সাংবিধানিক বৈধতা প্রদান, রাষ্ট্রধর্মের ঘোষণা এবং একই সময়ে প্রধান দুই দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগের আশ্রয়-প্রশ্রয় যেমন জামায়াতে ইসলামীকে শক্তিশালী করেছে, তেমনি কওমি মাদ্রাসার প্রসারের কারণে মাদ্রাসাভিত্তিক ইসলামপন্থী দলগুলোর ভিত্তি জোরালো হয়েছে। সামরিক শাসকেরা তাঁদের অবৈধ শাসনকে বৈধতা দিতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির শরণাপন্ন হয়েছেন, অন্যদিকে ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে নির্বাচনী রাজনীতির অতিসরলীকৃত অঙ্কের বিবেচনায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলেছে। দলগুলোর আচরণ থেকে মনে হয়, তাদের এই ধারণা হয়েছে যে সাধারণ মানুষের ধর্মানুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার প্রমাণ দিতে হলে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে সব সময় তাদের সঙ্গে রাখা দরকার।
দেশের ইতিহাস এবং অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসারের কারণ সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়; কিন্তু তা সম্পূর্ণ চিত্রটি তুলে ধরে না। কেননা দেশের বাইরের ঘটনাপ্রবাহও এর পেছনে কাজ করেছে। তা ছাড়া প্রশ্ন থাকছে ধর্মভিত্তিক দল শক্তিশালী হয়ে উঠলে তার ফল কী।
l আগামীকাল পড়ুন: ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব বোঝার অক্ষমতা
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগেরঅধ্যাপক।
No comments