সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তেও অন্ধকার

সুড়ঙ্গের অপর প্রান্তে আলোর ক্ষীণ রশ্মি দেখা দিয়েছিল। দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে প্রধান দুটি দলের সংলাপের উদ্যোগে জনগণ আশ্বস্ত হয়। তবে এতেও আগাম অবস্থান নির্ধারণ কিংবা শর্ত আরোপের ফলে সাফল্য সম্পর্কে সংশয়বাদী অনেকেই। কিন্তু জনগণ চায় একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা তিক্ততায় পরিপূর্ণ। শান্তিপূর্ণ সমাধানে রাজনীতিকেরা সাম্প্রতিক কালে কোনো সাফল্যের ছাপ রাখেননি। তাই সংশয়বাদীদেরও দোষ দেওয়া যাবে না। সত্যি সত্যি দেখা গেল, সে ক্ষীণ রশ্মি আবার বিলীন হয়ে গেছে গভীর তমসায়। প্রধান বিরোধী দল একটি সময়সূচি দিয়ে সরকারকে তাদের দাবি মেনে নিতে বলছে। অন্যদিকে সরকারও তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করছে। তাহলে কি আমাদের জন্য সামনে রয়ে গেল সংঘাতের রাজনীতি? অথচ আমাদের এ স্বপ্নলব্ধ দেশটিতে এরূপ গোল বাধার কোনো কারণ ছিল না। এখানে অতি অল্প ব্যতিক্রম ছাড়া একই ভাষাভাষী এবং মূলত একই নৃগোষ্ঠীর লোক বসবাস করে। প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ একই ধর্মাবলম্বী। অন্য কোনো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কিংবা ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা সাম্প্রতিক কালে আমাদের জন্য তেমন কোনো গোলযোগই সৃষ্টি করেনি, বরং ক্ষেত্রবিশেষে বিশাল সংখ্যাগুরু অংশের কিছু লোক তাদের অনিষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাহলে গোল বাধল কেন? রবীন্দ্রনাথের ‘হালদার গোষ্ঠী’তেও কোনো সংগত কারণ ছাড়াই গোল বেধেছিল। তাদের ‘অবস্থা স্বচ্ছল, মানুষগুলিও কেহই মন্দ নহে। কিন্তু তবু গোল বাধিল।’ রবীন্দ্রনাথের মতে, ‘সঙ্গত কারণেই যদি মানুষের সব-কিছু ঘটিত তবে তো লোকালয়টা একটা অঙ্কের খাতার মত হইত, একটু সাবধানে চলিলেই হিসাবে কোথাও কোন ভুল ঘটিত না; যদি বা ঘটিত সেটাকে রবার দিয়া মুছিয়া সংশোধন করিলেই চলিয়া যাইত।’ একই গল্পে তিনি আরও বলেছেন, ‘মানুষের ভাগ্যদেবতার রসবোধ আছে; গণিত শাস্ত্রে তাঁহার পাণ্ডিত্য আছে কিনা জানি না, কিন্তু অনুরাগ নাই; মানব জীবনের বিশুদ্ধ অঙ্ক-ফলটি উদ্ধার করিতে তিনি মনোযোগ করেন না। এই জন্য তাঁহার ব্যবস্থার মধ্যে একটা পদার্থ তিনি সংগ্রহ করিয়াছেন, সেটা অসংগতি। যাহা হইতে পারিত সেটাকে সে হঠাৎ আসিয়া লন্ড ভন্ড করিয়া দেয়। ইহাতেই নাট্যলীলা জমিয়া উঠে, সংসারের দুই কূল ছাপাইয়া হাসি কান্নার তুফান চলিতে থাকে।’ হয়তো বা এ অসংগতির জন্যই আমাদের দেশটিতে আজ চারদিকে হানাহানি। কেউ কারও কোনো কথা শুনছে না বা মানছে না। যেমন কমলবনে মত্তহস্তী সবকিছু উলটপালট করে দিতে সচেষ্ট। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের প্রিয় দেশটি আজ বহুমাত্রিক সংকট মোকাবিলা করছে। হরতাল, অবরোধ আর এগুলোর আনুষঙ্গিক সংঘাত আজ প্রায় প্রাত্যহিক ব্যাপার। এর ক্ষতিকর দিক সবার জানা। এটা সবারই জানা, কীভাবে আজকের এ সংকট আমাদের ওপর চেপে বসেছে। ১৯৯১-এ দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পুনরায় চালু হওয়ার পর থেকে আজতক কোনো জাতীয় ইস্যুতে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের বিপরীতমুখী অবস্থান এ সংকট সৃষ্টিতে মূল ভূমিকা রেখে চলছে। তারা ক্ষমতায় থাকলে যে মতামত দেয়, বিরোধী দলে গেলে নেয় এর সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থান। তাই নানা আকৃতি আর প্রকৃতিতে এ ধরনের সংকট দেশে স্থিতিশীল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রতিকূলে ভূমিকা রেখে চলছে। তারা মুখে বললেও প্রকৃতপক্ষে ন্যূনতম রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করছে না বলেই অনেকে অভিযোগ করেন। এ সময়কালে সরকারগুলো নির্বাচিত, সন্দেহ নেই। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া কিন্তু সব ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নয়। ১৯৯১ থেকে এযাবৎ সময়ে সময়ে যেসব সংকট বড় হয়ে দেখা দেয়, সেগুলো সহজ পথে সমাধান হয়নি। আজকের সরকারি দলটির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আন্দোলনকে উপেক্ষা করে এখনকার বিরোধী দল ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারিতে যখন একতরফা একটি নির্বাচন করে, তখন আন্দোলনের মুখে দেশের শাসনব্যবস্থা অচল হয়ে যায়। তখনকার সরকার (আজকের বিরোধী দল) বাধ্য হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে নিয়ে সংবিধান সংশোধন করতে। এর আগেই দেশি-বিদেশি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সমঝোতার প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছিল। এমনকি ব্যর্থ হয়েছিল কমনওয়েলথ মহাসচিবের আনুষ্ঠানিক প্রচেষ্টাও।
২০০১-এ নিয়মতান্ত্রিকভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। গোল বাধে আবার ২০০৬-এ। তখন আজকের বিরোধী দল ক্ষমতায়। তারা নানা কারসাজি এবং শেষতক রাষ্ট্রপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে ক্ষমতা ছাড়ে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে রাষ্ট্রপতি ও নির্বাচন কমিশন নিজেদের নিরপেক্ষ অবস্থান প্রমাণে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এবারও ব্যর্থ হয় দেশি-বিদেশি সব সমঝোতা প্রয়াস। ফলে আসে সামরিক বাহিনী-সমর্থিত এক-এগারো। গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতায় দুই বছরের বিরতি পড়ল। তবে দেশে প্রথমবারের মতো তৈরি হলো সব ভোটারের ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা ও জাতীয় পরিচয়পত্র। ২০০৯-এর সূচনায় ক্ষমতায় এল বর্তমান সরকার।
সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলবে মনে করা হলো। সংবিধানের কিছু প্রয়োজনীয় সংশোধনের জন্য একটি সংসদীয় কমিটি হয়েছিল। সেখানে সব দলমতের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে সুপারিশ করা হয়। এর মাঝে সুপ্রিম কোর্ট এক বিভক্ত রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেন। তবে তাঁদের প্রথম সংক্ষিপ্ত আদেশে পর পর দুটি নির্বাচন কিছু সংস্কার সাপেক্ষে এ ব্যবস্থায় করা যাবে বলে মতামত দেওয়া হয়েছিল। এসব মতামতের প্রতি কোনো মর্যাদা না দিয়ে, এমনকি নিজেদের পূর্বাবস্থানের বিপরীতে গিয়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ফলে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের একটি গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া রদ হয়ে যায়। পরিণতিতে দফায় দফায় আসতে লাগল হরতাল আর অবরোধ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সৃষ্টির প্রাসঙ্গিকতা কী ছিল, তা দেশবাসীর স্মৃতিতে আজও অম্লান। এটাও ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করা হয়, সে প্রাসঙ্গিকতা এখনো অপরিবর্তিত।
উল্লেখ্য, ২০১০-এর শুরুর দিকে ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী কার্যকলাপের অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচার-প্রক্রিয়া শুরু হলে জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবির এর বিরোধিতা করতে থাকে। ২০১২-এর শেষ দিক থেকে তাদের আন্দোলনও তীব্রতা পায়। তারা বিচার-প্রক্রিয়া বাতিল এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি করছে। প্রধান বিরোধী দল সূচনায় বিষয়টি একটু এড়িয়ে চললেও একপর্যায়ে এসে বিচারে নিরপেক্ষতা না থাকার অভিযোগ করে ওই দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে। আন্দোলনে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হতে থাকে ব্যাপক। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে শাহবাগকে কেন্দ্র করে তরুণ প্রজন্মের একটি আন্দোলন সূচনায় ব্যাপক সাড়া জাগায়। তাদের দাবি, এসব অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ দণ্ড দিতে হবে। বেআইনি ঘোষণা করতে হবে জামায়াত ও শিবিরকে। এ আন্দোলনের সঙ্গে বেশ কিছু সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনও একাত্মতা ঘোষণা করে।
আবার গত মার্চ মাসে এসে হেফাজতে ইসলাম নামের একটি সংগঠন শাহবাগকেন্দ্রিক আন্দোলনের বিপরীতে অবস্থান নেয়। তারা দাবি করে, এ আন্দোলনকারীদের মাঝে বেশ কিছু নাস্তিক ব্লগার রয়েছে। এটা বন্ধ ও নাস্তিক ব্লগারদের সাজা দেওয়ার দাবিও তারা করতে থাকে। এ ছাড়া তারা দেশে ব্লাসফেমি আইন চালুসহ আরও কতিপয় দাবিতে রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ, অবরোধ ও হরতাল করেছে। রাজধানীতে তাদের সাম্প্রতিক অবরোধকালে যে সহিংস তাণ্ডব দেখা গেল, তা ভয়াবহ। সরকার শক্তি প্রয়োগে এবারের মতো তাদের হটিয়েছে। কিছু ইসলামি সংগঠন অবশ্য তাদের বিপরীতেও অবস্থান নিয়েছে। এর মাঝে সরকার কয়েকজন ব্লগারকেও অন্যদের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করার অভিযোগে গ্রেপ্তার ও মামলা দায়ের করেছে। এই ঘটনাবলির ফলে দেশের সংকট আজ বহুমুখী।
এ সংঘাতময় পরিস্থিতিতে দেশের সুশীল সমাজ প্রধান দুটি দলকে একটি সমঝোতার জন্য ক্রমাগত তাগিদ দিচ্ছে। একই পরামর্শ দিচ্ছে আমাদের উন্নয়ন-সহযোগী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। ১০টি আরব দেশের রাষ্ট্রদূতেরাও একত্র হয়ে একটি সমঝোতার প্রয়াস নিয়েছেন বলে সংবাদপত্রে দেখা যায়। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত এ দেশের বিরাজমান সহিংসতার জন্য হতাশা ব্যক্ত করেছেন। দেশের সব শ্রেণীর মানুষ চায় এ সংকট থেকে সফলভাবে উত্তরণ। তবে আমাদের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের জেদ, তাদের অবস্থান থেকে কোনো রূপ ছাড় না দেওয়ার ঐতিহ্য লক্ষ করলে আমরা আশাবাদী হতে পারি না। নেহাত বাধ্য না হলে অতীতে তারা কখনো নিজ অবস্থান থেকে সামান্যতম ছাড় দেয়নি। ফলে মাশুল দেয় এ দেশের জনগণ। জনগণ কিন্তু দেশে গণতন্ত্রই চায়। চায় রাজনীতিবিদদের শাসন। আর রাজনীতি তো সমন্বয় ও আপস করে চলারই শিক্ষা দেওয়ার কথা।
আগামী নির্বাচন আর প্রায় নয় মাস পরে হবে। এ নির্বাচনে যাতে সব দল অংশ নেয় এবং নির্বাচনটি যাতে অবাধ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হয়, এমন একটি ব্যবস্থা কি করা যায় না? প্রধান দুটি দল এ বিষয়ে একমত হলে কোনো প্রতিবন্ধকতাই সামনে থাকবে না। সূত্র একটা বেরিয়ে আসবে। সে ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল অন্য আন্দোলনগুলোর সঙ্গে এতটা একাত্ম হয়তো বা হবে না বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন। কেননা নির্বাচনে তাদের জনগণের কাছে ভোটের জন্য যেতে হবে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোর ফলাফল সাক্ষ্যপ্রমাণ ও আইনের ভিত্তিতে আদালতই নির্ধারণ করতে পারেন। এই বিচারকাজে কোনো পক্ষেরই এমন কিছু করা সমীচীন হবে না, যাতে বিচারকেরা মনস্তাত্ত্বিক চাপের মুখে থাকেন।
এই সংকটময় মুহূর্তে আপসের বিকল্প কী আছে, তা বোধগম্য নয়। প্রধান বিরোধী দলকে বাদ রেখে নির্বাচন করে সংসদ ও সরকার কি স্থিতিশীল হবে? অতীত তো তা বলে না। রাজনৈতিক সহিংসতা আরও বাড়ার সম্ভাবনাই থাকবে। তাই অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে উভয় প্রধান দল দ্রুত একটি আপস নিষ্পত্তিতে পৌঁছাক—এটাই সবার প্রত্যাশা। জাতি চায় সমাধানটা রাজনীতিবিদদের দ্বারাই হোক। তাই কোনো রূপ পূর্বশর্ত ব্যতিরেকে সংলাপের উদ্যোগ আবার চালু করা হোক। সব বাধা-বিপত্তির অবসান ঘটিয়ে তা সফল হোক—এ আশা আমরা করতে থাকব। আশা করতে থাকব, ভ্রান্ত প্রমাণিত হবে সংশয়বাদীদের আশঙ্কা।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.