বাংলানিউজকে ড. কামাল হোসেন: রাজনীতিতে চলছে দুই জমিদারের লড়াই
রাজনীতিতে চলছে দুই জমিদারের লড়াই। একজন মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দোহাই দিয়ে
ক্ষমতায় থাকতে চান। আরেকজন ইসলাম ধর্মকে ক্ষমতার ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে
চাইছেন।
দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষ নেতা সম্পর্কে
এমন অভিমত বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ও বরেণ্য আইনজীবী ড. কামাল
হোসেনের।
গত বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বেইলি রোডে তার বাসভবনে বাংলানিউজকে দেওয়া এক দীর্ঘ ও একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ অভিমত দেন। এ সময় ‘ওয়ান-ইলেভেন না এলে তারেক রহমান’ প্রধানমন্ত্রী হতেন বলেও মন্তব্য করেন কামাল হোসেন।
বাংলানিউজের পক্ষে সাক্ষাৎকার নেন চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট আদিত্য আরাফাত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও মাজেদুল নয়ন।
ওই সাক্ষাৎকারের তৃতীয় ও শেষ কিস্তি ছাপা হলো রোববার।
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি, রাজনৈতিক সংকট, তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে জটিলতা, যুদ্ধাপরাধের বিচার, শাহবাগে তরুণদের গণজাগরণ এবং দেশভাগের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাত ও অর্জনগুলো তুলে ধরেন কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, “দুই নেত্রী আলোচনায় বসলেই সংকটের সমাধান হবে না। তারা সমঝোতা করে সুবিধা ভাগাভাগি করে নিলে জনগণের কোনই লাভ হবে না। তাতে বরং ক্ষতির আশংকাই থাকবে। তাই জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
ড. কামাল হোসেন: বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা হিসেবেই তাঁর অধিক পরিচিতি। দেশের রাজনীতিতে তিনি সবসময়ই সোচ্চার। জন্ম ১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল। ১৯৫৭ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি এবং ১৯৫৮ সালে ব্যাচেলর অব সিভিল ল ডিগ্রি লাভ করেন। লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল অর্জনের পর আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে পিএইচডি করেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই বছর আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ড. কামাল হোসেন জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। তিনি গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
দুই নেত্রীর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, “দেশের লোক কী তাদের কাছে মাথা বিক্রি করে দিয়েছেন। তারা যা করবে তাই মেনে নিতে হবে কেন? ১৬ কোটি জনগণের মতামতের কি কোন দাম নেই!”
তিনি বলেন, “দুই দল জনগণকে প্রজা মনে করে, নাগরিক মনে করে না। তারা রাজত্ব করছে, দেশ শাসন করছে না। জনগণ এক রাজার হাত থেকে অন্য রাজার কাছে যাচ্ছে।”
ড. কামাল বলেন, “দেশের মানুষ প্রকৃত অর্থে নাগরিক হতে পারছে না। তাই তারা যতদিন নিজেদের ক্ষমতার মালিক মনে করতে না পারবে, ততদিন জনগণের রক্ষা নেই।”
জনগণকে প্রজা হয়ে থাকার মনোভাব ঝেড়ে ফেলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সংবিধানে জনগণকেই প্রজাতন্ত্রের মালিক বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কথা লেখা নেই।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে ড. কামাল হোসেন ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং তখনকার রাজনৈতিক অবস্থা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “তখন কি হয়ে ছিলো? বিএনপির সেই বাজে ইলেকশনকে আমরা সবাই প্রত্যাখান করে ছিলাম। তখন শেখ হাসিনা কি বলে ছিলেন? আমি তখন ছুটে গেছি। হোটেল সোনাগাঁওয়ে প্রেস কনফারেন্স করেছি। আমি বলেছি, এই ইলেকশন বাতিল করতে হবে, এমন ইলেকশন মেনে নেওয়া যায় না।”
তিনি বলেন, তখন সবাই প্রশ্ন করেন কি হবে? ইলেকশন কিভাবে হবে? মিলটারি আসবে? আমি বলেছি--না, মোটেও না। একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে। যোগ্য নির্দলীয় ব্যক্তিরা সরকার চালাবে। কি উপায়ে হবে? বলেছি দুই ভাবে হতে পারে। এক, আমরা কোর্টে গিয়ে বলতে পারি। সংবিধানকে রক্ষা করতে হলে--এ নির্বাচন হতে পারে না। কোর্ট আদেশে বলে দেবে-- অর্ন্তবর্তীকালীন এ ইলেকশন করার জন্যে একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ শাসনের দ্বায়িত্ব অমুক-অমুকরা করবে। এই পিটিশনটা, ফাইলটা এখনো আমার কাছে আছে। হয়তো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দিয়ে দেব।”
তিনি বলেন, “দ্বিতীয়টি আরও সহজ। বিএনপি অবস্থা বুঝে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করে দেয়। তখন সবাইকে নিয়ে বসা হলো। অনেকেই এসে ছিলেন। বিএনপি’র কয়েকজন ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন এলো। সবাই সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার বিষয়ে একমত হলেন। নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হলো। ৭৫’র পর প্রথম আমরা আওয়ামী লীগ সরকারকে পেলাম। কিসের মধ্য দিয়ে? নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের মধ্য দিয়ে।”
তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে দুই নেত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “উনাদের স্মরণশক্তি এত দুর্বল কেন? আমি বুঝি না।”
১৯৯১ সালে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই দলের মধ্যে কী সমঝোতা হয়েছিলো জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, “একবারের জন্যেই করা হয়েছিল কেয়ারটেকার সরকার। প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনই তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে—এটি লক্ষ্য ছিল না। নির্বাচিত সরকাররা যেভাবে গত ২০ বছর দেশ চালিয়েছে- আমরা এটি কল্পনাও করতেও পারিনি। কোন নির্বাচিত সরকারই কথা দিয়ে কথা রাখে নি।”
তিনি বলেন, “এখন যেমন খালেদা জিয়া বলছেন- তত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আগামী নির্বাচন হবে না। নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। ১৯৯৬ সালের পত্রিকা পড়লেই দেখবেন, ঠিক একই ভাবে এখনকার প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্ববধায়ক সরকার ছাড়া কোন নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। তারপর ২০০৬ সালে এসেও তিনি একই কথা বলেছেন। তাই বলি, উনাদের কথা আমরা যত কম বলি ততই ভালো।”
ওয়ান-ইলেভেন ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের কথা তুলে ধরে ড. কামাল হোসেন বলেন, “খালেদা জিয়া বলেছিলেন- ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন হতেই হবে। তা না হলে সংবিধান লঙ্ঘন হবে। তখন আমরা বলেছিলাম- কিসের নির্বাচন। ভোটার লিস্টই তো ঠিক নেই। ইয়াজউদ্দিন তো নিজেই বলেছেন, তিনি নিরপেক্ষ নন। তখন ২৪ মাসের মধ্যে সুষ্ঠু ভোটার লিস্ট করা হলো।”
ওয়ান-ইলেভেনের কেয়ারটেকার সরকারের সুফল ভোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “সবচেয়ে বড় বেনিফিসিরারি কে? আজ যারা ২৬৭ সিট নিয়ে সংসদে আছে, তারাই। তারা নিজেদের এই প্রশ্ন করুক না! যদি ইলেকশন না হতো, ভোটার লিস্ট যদি আবার না হতো, ইলেকশন কমিশনার যদি শামসুল হুদা না হতেন, তাহলে কী হতো? কেয়ারটেকারের বিরুদ্ধে তো কথা বলা তাদের মুখে শোভা পায় না।”
তিনি বলেন, “কেয়ারটেকার সরকারের সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি যারা হয়েছে, আজ তারাই সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করছে। কেয়ারটেকার সরকার যদি বেশি খারাপ কাজ করে থাকে, তবে এর দায় কার? ক্ষমতাসীন সরকারই দুই দফায় চাপ প্রয়োগ করে কেয়ারটেকার সরকার বসিয়েছে।”
তিনি বলেন, “কেয়ারটেকার সরকারের দাবি উঠে নাই। এটি সংবিধানে ছিল। অন্যায়ভাবে এটি সরানো হয়েছে। এটি করার জন্যে কে ভোট দিয়েছিল। এটি কী তাদের ইস্যু ছিল? তারা ইলেকশনের আগে এটি বলেনি।”
কামাল হোসেন বলেন, “ওয়ান-ইলেভেনের যারা সমালোচনা করছেন, তারা কী ভেবে দেখেছেন--২২ জানুয়ারি নির্বাচন হলে কী হতো। তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হতো। ৩০০ আসনের মধ্যে জামায়াত আগের চেয়েও বেশি আসন পেতো। ২ থেকে বেড়ে ৫ জন মন্ত্রী হতো। ওয়ান-ইলেভেন না এলে এসব হতো। তারা সরকারে বসতো। আর্মি, পুলিশ সব চালাতো। হয় তো আমরা জয়ী হতাম। আবার ১৬ ডিসেম্বর আসতো। কিন্তু এক ১৬ ডিসেম্বরের জন্যে কি কম জীবন দিতে হয়েছে। আবারও আমাদের জীবন দিতে হতো।’’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, “হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটি আরও দুই টার্ম থাকতে পারে। কিন্তু, এটি কোথায় চলে গেলো!”
তিনি বলেন, “২২ জানুয়ারির মতো ইলেকশন আমরা চাই না। তখন বলবে, জজ সাহেব বলেছেন। কিন্তু, জজ সাহেব এটাও বলেছেন, দেশের বিরাজমান অবস্থায় আরও দুই টার্ম এটি থাকা উচিৎ।”
নির্বাচিতদের প্রতি হতাশা প্রকাশ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, “এই যে আমাদের রাজনীতি পচিয়েছে এরশাদ। সেই পচন থেকে ক্ষমতাসীনরাও মুক্ত হতে পারছেন না। এক পচন থেকে মুক্ত হতে আমরা যাদের নির্বাচিত করছি, তারা আরও পচাচ্ছে। পচাতে পচাতে শুরু হয়েছে একটা পচানোর প্রতিযোগিতা।”
ড. কামাল হোসেন তরুণদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “বাঙালির যতগুলো অর্জন সবই এনেছে তরুণরা। দেশের এই দুর্দিনে যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে।”
তরুণদের পাশে থেকে তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চান বলেও জানান কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতি পদকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। এতে ক্ষমতা ভারসম্যহীন হয়ে পড়েছে।”
তাই সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
ড. কামাল হোসেন বলেন, “সৎ লোকদের এখন মনোনয়ন দেওয়া হয় না। এখন কালো টাকার মালিকদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। তারা টাকা ও পেশি শক্তির জোরে ক্ষমতায় আসে। এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রকৃত দেশ প্রেমিককে নির্বাচিত করতে হবে। তা না হলে জনগণের মুক্তি সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, এখন মেধার কোন মূল্যায়ন নেই। চাকরি দেওয়া হচ্ছে টাকার বিনিময়ে। শিক্ষক নিয়োগ পেতে লাখ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে। এমনকি টাকার বিনিময়ে অযোগ্য শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষাতেও নিয়োগ দেওয়া হয় টাকার বিনিময়ে। এতে জাতির ভবিষ্যত খারাপের দিকে যাচ্ছে।
গত বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বেইলি রোডে তার বাসভবনে বাংলানিউজকে দেওয়া এক দীর্ঘ ও একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি এ অভিমত দেন। এ সময় ‘ওয়ান-ইলেভেন না এলে তারেক রহমান’ প্রধানমন্ত্রী হতেন বলেও মন্তব্য করেন কামাল হোসেন।
বাংলানিউজের পক্ষে সাক্ষাৎকার নেন চিফ অব করেসপন্ডেন্টস আহমেদ রাজু, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট আদিত্য আরাফাত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট সেরাজুল ইসলাম সিরাজ ও মাজেদুল নয়ন।
ওই সাক্ষাৎকারের তৃতীয় ও শেষ কিস্তি ছাপা হলো রোববার।
সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনীতি, রাজনৈতিক সংকট, তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে জটিলতা, যুদ্ধাপরাধের বিচার, শাহবাগে তরুণদের গণজাগরণ এবং দেশভাগের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির ঘাত-প্রতিঘাত ও অর্জনগুলো তুলে ধরেন কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, “দুই নেত্রী আলোচনায় বসলেই সংকটের সমাধান হবে না। তারা সমঝোতা করে সুবিধা ভাগাভাগি করে নিলে জনগণের কোনই লাভ হবে না। তাতে বরং ক্ষতির আশংকাই থাকবে। তাই জনগণের মতামতের ভিত্তিতে তত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
ড. কামাল হোসেন: বাংলাদেশের সংবিধানের প্রণেতা হিসেবেই তাঁর অধিক পরিচিতি। দেশের রাজনীতিতে তিনি সবসময়ই সোচ্চার। জন্ম ১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল। ১৯৫৭ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব অক্সফোর্ড থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি এবং ১৯৫৮ সালে ব্যাচেলর অব সিভিল ল ডিগ্রি লাভ করেন। লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল অর্জনের পর আন্তর্জাতিক আইন বিষয়ে পিএইচডি করেন ১৯৬৪ সালে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান রচনা কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই বছর আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ড. কামাল হোসেন জাতিসংঘের স্পেশাল র্যাপোর্টারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় রয়েছেন। তিনি গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি।
দুই নেত্রীর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেন, “দেশের লোক কী তাদের কাছে মাথা বিক্রি করে দিয়েছেন। তারা যা করবে তাই মেনে নিতে হবে কেন? ১৬ কোটি জনগণের মতামতের কি কোন দাম নেই!”
তিনি বলেন, “দুই দল জনগণকে প্রজা মনে করে, নাগরিক মনে করে না। তারা রাজত্ব করছে, দেশ শাসন করছে না। জনগণ এক রাজার হাত থেকে অন্য রাজার কাছে যাচ্ছে।”
ড. কামাল বলেন, “দেশের মানুষ প্রকৃত অর্থে নাগরিক হতে পারছে না। তাই তারা যতদিন নিজেদের ক্ষমতার মালিক মনে করতে না পারবে, ততদিন জনগণের রক্ষা নেই।”
জনগণকে প্রজা হয়ে থাকার মনোভাব ঝেড়ে ফেলার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সংবিধানে জনগণকেই প্রজাতন্ত্রের মালিক বলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ বা বিএনপির কথা লেখা নেই।”
তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে ড. কামাল হোসেন ১৯৯৬ সালে খালেদা জিয়ার ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন এবং তখনকার রাজনৈতিক অবস্থা তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “তখন কি হয়ে ছিলো? বিএনপির সেই বাজে ইলেকশনকে আমরা সবাই প্রত্যাখান করে ছিলাম। তখন শেখ হাসিনা কি বলে ছিলেন? আমি তখন ছুটে গেছি। হোটেল সোনাগাঁওয়ে প্রেস কনফারেন্স করেছি। আমি বলেছি, এই ইলেকশন বাতিল করতে হবে, এমন ইলেকশন মেনে নেওয়া যায় না।”
তিনি বলেন, তখন সবাই প্রশ্ন করেন কি হবে? ইলেকশন কিভাবে হবে? মিলটারি আসবে? আমি বলেছি--না, মোটেও না। একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হবে। যোগ্য নির্দলীয় ব্যক্তিরা সরকার চালাবে। কি উপায়ে হবে? বলেছি দুই ভাবে হতে পারে। এক, আমরা কোর্টে গিয়ে বলতে পারি। সংবিধানকে রক্ষা করতে হলে--এ নির্বাচন হতে পারে না। কোর্ট আদেশে বলে দেবে-- অর্ন্তবর্তীকালীন এ ইলেকশন করার জন্যে একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ শাসনের দ্বায়িত্ব অমুক-অমুকরা করবে। এই পিটিশনটা, ফাইলটা এখনো আমার কাছে আছে। হয়তো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে দিয়ে দেব।”
তিনি বলেন, “দ্বিতীয়টি আরও সহজ। বিএনপি অবস্থা বুঝে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাশ করে দেয়। তখন সবাইকে নিয়ে বসা হলো। অনেকেই এসে ছিলেন। বিএনপি’র কয়েকজন ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন এলো। সবাই সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহম্মদ হাবিবুর রহমানকে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার বিষয়ে একমত হলেন। নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হলো। ৭৫’র পর প্রথম আমরা আওয়ামী লীগ সরকারকে পেলাম। কিসের মধ্য দিয়ে? নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের মধ্য দিয়ে।”
তাই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে দুই নেত্রীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “উনাদের স্মরণশক্তি এত দুর্বল কেন? আমি বুঝি না।”
১৯৯১ সালে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে দুই দলের মধ্যে কী সমঝোতা হয়েছিলো জানতে চাইলে ড. কামাল হোসেন বলেন, “একবারের জন্যেই করা হয়েছিল কেয়ারটেকার সরকার। প্রতিটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনই তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে—এটি লক্ষ্য ছিল না। নির্বাচিত সরকাররা যেভাবে গত ২০ বছর দেশ চালিয়েছে- আমরা এটি কল্পনাও করতেও পারিনি। কোন নির্বাচিত সরকারই কথা দিয়ে কথা রাখে নি।”
তিনি বলেন, “এখন যেমন খালেদা জিয়া বলছেন- তত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আগামী নির্বাচন হবে না। নির্বাচন করতে দেওয়া হবে না। ১৯৯৬ সালের পত্রিকা পড়লেই দেখবেন, ঠিক একই ভাবে এখনকার প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তত্ত্ববধায়ক সরকার ছাড়া কোন নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। তারপর ২০০৬ সালে এসেও তিনি একই কথা বলেছেন। তাই বলি, উনাদের কথা আমরা যত কম বলি ততই ভালো।”
ওয়ান-ইলেভেন ও ২০০৮ সালের নির্বাচনের কথা তুলে ধরে ড. কামাল হোসেন বলেন, “খালেদা জিয়া বলেছিলেন- ১৭ জানুয়ারি নির্বাচন হতেই হবে। তা না হলে সংবিধান লঙ্ঘন হবে। তখন আমরা বলেছিলাম- কিসের নির্বাচন। ভোটার লিস্টই তো ঠিক নেই। ইয়াজউদ্দিন তো নিজেই বলেছেন, তিনি নিরপেক্ষ নন। তখন ২৪ মাসের মধ্যে সুষ্ঠু ভোটার লিস্ট করা হলো।”
ওয়ান-ইলেভেনের কেয়ারটেকার সরকারের সুফল ভোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “সবচেয়ে বড় বেনিফিসিরারি কে? আজ যারা ২৬৭ সিট নিয়ে সংসদে আছে, তারাই। তারা নিজেদের এই প্রশ্ন করুক না! যদি ইলেকশন না হতো, ভোটার লিস্ট যদি আবার না হতো, ইলেকশন কমিশনার যদি শামসুল হুদা না হতেন, তাহলে কী হতো? কেয়ারটেকারের বিরুদ্ধে তো কথা বলা তাদের মুখে শোভা পায় না।”
তিনি বলেন, “কেয়ারটেকার সরকারের সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি যারা হয়েছে, আজ তারাই সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করছে। কেয়ারটেকার সরকার যদি বেশি খারাপ কাজ করে থাকে, তবে এর দায় কার? ক্ষমতাসীন সরকারই দুই দফায় চাপ প্রয়োগ করে কেয়ারটেকার সরকার বসিয়েছে।”
তিনি বলেন, “কেয়ারটেকার সরকারের দাবি উঠে নাই। এটি সংবিধানে ছিল। অন্যায়ভাবে এটি সরানো হয়েছে। এটি করার জন্যে কে ভোট দিয়েছিল। এটি কী তাদের ইস্যু ছিল? তারা ইলেকশনের আগে এটি বলেনি।”
কামাল হোসেন বলেন, “ওয়ান-ইলেভেনের যারা সমালোচনা করছেন, তারা কী ভেবে দেখেছেন--২২ জানুয়ারি নির্বাচন হলে কী হতো। তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হতো। ৩০০ আসনের মধ্যে জামায়াত আগের চেয়েও বেশি আসন পেতো। ২ থেকে বেড়ে ৫ জন মন্ত্রী হতো। ওয়ান-ইলেভেন না এলে এসব হতো। তারা সরকারে বসতো। আর্মি, পুলিশ সব চালাতো। হয় তো আমরা জয়ী হতাম। আবার ১৬ ডিসেম্বর আসতো। কিন্তু এক ১৬ ডিসেম্বরের জন্যে কি কম জীবন দিতে হয়েছে। আবারও আমাদের জীবন দিতে হতো।’’
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে হাইকোর্টের রায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, “হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এটি আরও দুই টার্ম থাকতে পারে। কিন্তু, এটি কোথায় চলে গেলো!”
তিনি বলেন, “২২ জানুয়ারির মতো ইলেকশন আমরা চাই না। তখন বলবে, জজ সাহেব বলেছেন। কিন্তু, জজ সাহেব এটাও বলেছেন, দেশের বিরাজমান অবস্থায় আরও দুই টার্ম এটি থাকা উচিৎ।”
নির্বাচিতদের প্রতি হতাশা প্রকাশ করে ড. কামাল হোসেন বলেন, “এই যে আমাদের রাজনীতি পচিয়েছে এরশাদ। সেই পচন থেকে ক্ষমতাসীনরাও মুক্ত হতে পারছেন না। এক পচন থেকে মুক্ত হতে আমরা যাদের নির্বাচিত করছি, তারা আরও পচাচ্ছে। পচাতে পচাতে শুরু হয়েছে একটা পচানোর প্রতিযোগিতা।”
ড. কামাল হোসেন তরুণদের দাবি আদায়ে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “বাঙালির যতগুলো অর্জন সবই এনেছে তরুণরা। দেশের এই দুর্দিনে যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে।”
তরুণদের পাশে থেকে তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে চান বলেও জানান কামাল হোসেন।
তিনি বলেন, “রাষ্ট্রপতি পদকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছে। এতে ক্ষমতা ভারসম্যহীন হয়ে পড়েছে।”
তাই সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বাড়ানোর দাবি জানান তিনি।
ড. কামাল হোসেন বলেন, “সৎ লোকদের এখন মনোনয়ন দেওয়া হয় না। এখন কালো টাকার মালিকদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। তারা টাকা ও পেশি শক্তির জোরে ক্ষমতায় আসে। এই অবস্থার পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রকৃত দেশ প্রেমিককে নির্বাচিত করতে হবে। তা না হলে জনগণের মুক্তি সম্ভব নয়।”
তিনি বলেন, এখন মেধার কোন মূল্যায়ন নেই। চাকরি দেওয়া হচ্ছে টাকার বিনিময়ে। শিক্ষক নিয়োগ পেতে লাখ লাখ টাকা দিতে হচ্ছে। এমনকি টাকার বিনিময়ে অযোগ্য শিক্ষকও নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। বিসিএস পরীক্ষাতেও নিয়োগ দেওয়া হয় টাকার বিনিময়ে। এতে জাতির ভবিষ্যত খারাপের দিকে যাচ্ছে।
No comments