চিরকুট-সময় বহিয়া যায় by শাহাদুজ্জামান

ময় বহিয়া যায়’ শিরোনামে দৈনিক সংবাদ-এ এক সময় কলাম লিখতেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। সময়ের ওপরকাঠামো আর ভেতরকাঠামোর নানা মাত্রা নিয়ে লিখতেন তিনি। নিয়মিত পাঠক ছিলাম সে কলামের। সাধু ভাষায় শিরোনামটি হওয়াতে এতে এক ধরনের বহতা নদীর আবহ তৈরি হয়েছিল যেন। একটা অবিরাম স্রোতের মতো সময় যে বয়ে চলেছে আমরা তা টের পাই নিরন্তর। কোথায় সেই সময়-নদীর উ ৎস তাহলে?


হুইলচেয়ারে বসে মূক বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং বলেন, সময়ের শুরু সেই ‘বিগ ব্যাং’ থেকে। কেউ তা মেনে নেন, কেউ মানেন না। সময়ের মতো একটা বিমূর্ত ব্যাপারকে সংজ্ঞায় বেঁধে ফেলা কঠিন। কেউ বলেছেন একটি ঘটনা থেকে আরেকটি ঘটনার দূরত্বই হচ্ছে সময়। বিজ্ঞানের ভাষায় সময়কে বোঝার সেটাই বোধ হয় মোক্ষম উপায়। কিন্তু সময় ধারণাটি সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিকও।
সময়কে মাপার চেষ্টা হাজার বছরের পুরোনো হলেও, এই যে সময়কে ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা, এ খুব পুরোনো ব্যাপার নয়। দূর গ্রামের অনেক কৃষকের কাছে দিন এখনো কেবলই আগা বেলা আর পাছা বেলায় বিভক্ত। ঘড়ির কাঁটা ধরে ধান গজায় না, ধান গজায় সূর্যের মুখ চেয়ে। কিন্তু কারখানার সর্বোচ্চ উ ৎপাদন নিশ্চিত করতে, বাজারব্যবস্থার সর্বাধিক সাফল্য পেতে দিনটিকে ঘড়ির কাঁটায় বেঁধে ফেলা জরুরি। জরুরি জীবনকে নয়টা-পাঁচটার ঘেরাটোপে বেঁধে ফেলা। শিল্পবিপ্লব আর পুঁজির বিকাশের হাত ধরে তাই জন্ম নেয় মন্ত্র ‘টাইম ইজ মানি’। সে মন্ত্র ক্রমশ ধানের গায়ে এসেও লাগে। সূর্যের আলো কিনতে পয়সা না লাগলেও পানি কিনতে গ্রামের কৃষকের পয়সা লাগে এখন। পানির শ্যালো মেশিন চলে ঘণ্টা হিসেবে।
সময় চলে সরলরেখায়, যা কেবলই এগিয়ে যায়, ফেরে না কখনো—এ ধারণা পাশ্চাত্যে প্রবল। কিন্তু সময় চক্রাকার, ফিরে ফিরে আসে—এমন ধারণা প্রাচ্য-ভাবনায় জুড়ে ছিল এক সময়। ফলে এখানে জন্মান্তরের ধারণা অস্বাভাবিক ঠেকেনি। কিন্তু বিশ্বায়নের ছায়ায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সময়-ভাবনার ফারাক প্রায় গেছে ঘুচে। অবশ্য ভাবনার নিষ্পত্তি যে হয়েছে সব ক্ষেত্রে তেমনটা বলা যাবে না। আমাদের দেশেই তো সময় পড়ে আছে এক জটিল পাকচক্রে। আমাদের অফিস-আদালতের দৈনন্দিন কাজ চলে খ্রিষ্টীয় সময়ে, ধর্মীয় আচার চলে আরবি সময়ে, আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চলে বাংলা সময়ে। আমরা এই তিন সময়-ধারণার ভেতর চলাচল করতে গিয়ে বরাবরই একটা পরিচয়ের সংকট বয়ে বেড়াই।
সময়ের একটা ব্যক্তিগত মাত্রাও আছে। আমাদের মনের ঘড়ি একেক জনের একেক রকম। হিসাব মতো দিন বরাবর চব্বিশ ঘণ্টা হলেও কোনো কোনো দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর, কোনো দিন আবার নিঃশেষ হয়ে যায় নিমেষে। কাজের ঘড়ি সতর্ক মানুষের জন্য কিন্তু বহু মানুষের মন ঘড়ির কর্তৃত্বের বাইরে যেতে চায়। বিনা কাজে বাঁশি বাজাতে চায়। আবার ঘড়ির কাঁটা নানা মানুষের কাছে নানা অর্থ নিয়ে এসে দাঁড়ায়। তিনি মোক্ষম কথাই বলেছিলেন যিনি বলেছেন, একটি বছরের গুরুত্ব কেমন সেটা জানতে জিজ্ঞাসা করুন একজন ছাত্রকে যে বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল করেছে, একটি মাসের গুরুত্ব কেমন সেটি জানতে জিজ্ঞাসা করুন সেই মাকে যিনি পূর্ণগর্ভ সময়ের আগেই একজন মৃত শিশু প্রসব করেছেন, একটি সপ্তাহের গুরুত্ব কেমন তা জানতে জিজ্ঞাসা করুন সাপ্তাহিকীর একজন সম্পাদককে, একটি ঘণ্টার গুরুত্ব কেমন তা জানতে জিজ্ঞাসা করুন সেই প্রেমিকাকে যে তার প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছে, একটি মিনিটের গুরুত্ব কেমন তা জানতে জিজ্ঞেস করুন তাঁকে যিনি এই মুহূর্তে একটি ট্রেন বা প্লেন মিস করেছেন, একটি সেকেন্ডের গুরুত্ব কত তা জানতে জিজ্ঞাসা করুন সেই মানুষকে যিনি কিছুক্ষণ আগে একটি ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেয়েছেন আর একটি সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশের গুরুত্ব কত তা জানতে জিজ্ঞাসা করুন অলিম্পিকের সেই দৌড়বিদকে যিনি স্বর্ণ নয় রৌপ্য পদক জিতেছেন।
তবে সময়ের যত মাত্রাই থাকুক না কেন আমরা তো দেখছি, সময় এক ডাকাতের মতো প্রতিমুহূর্তে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের অতীত। আমরা আমাদের অ আ ক খ-এর দিন পেছনে ফেলে আসছি, আমাদের মেলায় কেনা বাঁশি আর আগের মতো বাজছে না। আমরা টের পাচ্ছি প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার ভেতর একটা সূক্ষ্ম দুঃখবোধ আছে। আমরা দেখছি সবুজ পাতা যে বেগে হলুদ হয় তার চেয়েও দ্রুত চলে আসে সময়। আমাদের এক-একটা জীবন অতিবাহিত হয়ে যায়। আমরা মৃত্যুর দিকে ধাবিত হই। জীবনানন্দ তাঁর কবিতায় খুব সহজ একটা প্রশ্ন করেন, মৃতেরা কি পৃথিবীতে আছে? তারপর নিজেই উত্তর দেন, না, নেই। তাই তো বটে। আমরাও তা-ই দেখি, মৃতেরা আশপাশে কোথাও নেই। এর পরই তিনি একটা আরও সহজতর দাবি তোলেন। তাহলে মৃত্যুর আগে আলো, অন্ন, প্রেম, সুস্থির মত পেলে ভালো হতো। সন্দেহ নেই। সামান্যই তো দাবি আমাদের। আলো, অন্ন, প্রেম। কিন্তু সুস্থির মত, কী করে তা পাওয়া যাবে? সে তো বড় প্রশ্ন, জটিল প্রশ্ন। এ তো ব্যক্তিগত নয়, ব্যাপার সামষ্টিক। কিন্তু আমরা পৃথিবী গ্রহের যে প্রান্তে জন্মেছি সেখানে কোনো কিছুর সুস্থির মত পেতে কত যে বেনোজলে ভাসাভাসি।
অথচ ‘এমন মানব জনম আর কি হবে?’ লক্ষ্যভেদী প্রশ্ন আমাদের লোককবির। তাহলে উপায়? ‘মন যা করো ত্বরায় করো এই ভবে।’
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
zaman567@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.