পাকিস্তান-ইমরানের পেছনে তরুণদের ভিড় by জেহরা নবী

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেট নায়ক ও বর্তমানে পাকিস্তান তাহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের প্রধান ইমরান খানের ভক্তের সংখ্যা এক লাখের বেশি। ২. ইমরানের অনুসারীদের অধিকাংশের বয়সই ৩০-এর নিচে।  এগুলো ইমরান খান সম্পর্কে খুবই সাধারণ দুটি তথ্য।


কিন্তু এ থেকে প্রশ্ন জাগে, এই যে তরুণের দল কিংবা টুইটার ব্যবহারকারীর সারি, এরা কি প্রয়োজনের সময় ইমরান খানের হয়ে মাঠে-ময়দানে প্রচারণায় নামবে, আন্দোলনে যোগ দেবে কিংবা নির্বাচনী হ্যাপা সামলাবে? মিসর, ইয়েমেন কিংবা লিবিয়ার মতো প্রযুক্তিভিত্তিক যোগাযোগের ওপর নির্ভরশীল এসব তরুণ-যুবকও কি পাকিস্তানে ‘বসন্ত’ আনতে পারবে?
‘এখানে সাইবারভিত্তিক কোনো ধরনের বিপ্লব অসম্ভব। এটা মিসর বা তিউনিসিয়া নয়।’ পিটিআইয়ের ওয়েবসাইটভিত্তিক দলের সদস্য ও ইনসাফ স্টুডেন্ট ফেডারেশনের (আইএসএফ) সভাপতি আরসালান তাজ ঘম্মানের মত এ রকমই। তার মতে, পাকিস্তানে অশিক্ষার উচ্চ হার ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর নিম্ন হারের জন্যই এ ধরনের বিপ্লব এখানে হবে না। এখানে ইন্টারনেট ও সামাজিক প্রচার মাধ্যমগুলো শুধুই বাজারজাতকরণের উপকরণ। তার বেশি কিছু নয়।
তবে আগা খান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র ও সম্প্রতি পিটিআই দলে যোগদানকারী হাসান বসির আশাবাদী। তিনি বলেন, ‘ইমরান খানের অধিকাংশ সমর্থক ডিজিটাল জগতের বাসিন্দা। কিন্তু তাতে কী? ফেসবুক কিংবা টুইটার ব্যবহারকারী এসব সমর্থকের প্রত্যেকে একই সঙ্গে পাকিস্তানিও। তারা পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিবর্তন চায়।’
পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সামাজিক প্রচার মাধ্যমগুলোর ভূমিকা নিয়ে পিটিআইয়ের এই দুই তরুণ সদস্যের চিন্তাভাবনায় পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু এটা সত্যি, পাকিস্তানের রাজনীতিতে পিটিআই সবচেয়ে শক্তিশালী দল না হলেও শুধু করাচির মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরেই দলটির তালিকাভুক্ত শিক্ষার্থী-সদস্য রয়েছে চার হাজারেরও ওপর। এসব শিক্ষার্থীর অধিকাংশই ফেসবুক বা টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করেন। তাই ইমরান খানের ভার্চুয়াল সমর্থকদেরও দলের শক্তি হিসেবে গণনা করতে হবে। ফেসবুকে পাকিস্তানের রাজনীতিকদের সমর্থক-সংখ্যার ওপর নজর দিলে ইমরান খানের পাতার সঙ্গে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী জারদারির পাতার কিছুটা তুলনা চলে।
তবে ক্রিকেট ও জনসেবায় ইমরান খানের সাফল্য কি তাঁকে রাজনীতিতেও সাফল্য এনে দেবে? আরসালান তাজ এ বিষয়ে জানান, ইমরান যখন তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের তুঙ্গে, তখনো তাঁর জন্ম হয়নি। কাজেই তাঁর অতীত পরিচয়ের সঙ্গে বর্তমানের রাজনীতিবিদ পরিচয়ের তুলনা চলে না। তবে আগা খান বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাসান মনে করেন, ক্রিকেট বা জনসেবায় ইমরান খানের সাফল্যের ইতিহাস প্রমাণ করে যখন তিনি কোনো কিছু করতে মনস্থির করেন, তখন তিনি তা করে ছাড়েন।
তার পরও কেবলমাত্র ১৯৯২ সালে বিশ্বকাপ বা সওকত খানম ক্যানসার হাসপাতাল নির্মাণে ইমরান খানের ভূমিকার জন্যই যে তাঁর পেছনে নতুন প্রজন্মের পাকিস্তানিরা জড়ো হয়েছে, তা নয়। ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে সম্প্রতি স্নাতক পাস করা ও ইনফরমেশন সিকিউরিটি ফোরামের (আইএসএফ) সক্রিয় সদস্য ইমরান ঘাজালি বলেন, নেওয়াজ শরিফের মতো রাজনীতিকও দুবার পরীক্ষিত হয়েছেন। কিন্তু তাঁর মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সিন্ধু প্রদেশে সাধারণ মানুষের কাছে পূজনীয় ভুট্ট পরিবার। এ পরিবারের সদস্যরা বারবার দেশটির ক্ষমতায় আসা সত্ত্বেও প্রদেশটিতে আজও শিক্ষা কিংবা উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া নেই। দেশটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের কাছে তাদের বর্ণাঢ্য অতীত ও প্রতিপক্ষের দুষ্কৃতি তুলে ধরে ভোট প্রার্থনা করে। সে সময় নিজেদের যত উজ্জ্বল অতীতই তারা তুলে ধরুক না কেন, প্রতিটি দলেই রয়েছে বিবি বা আলতাফ ভাইয়ের মতো লোকজন। তাঁদের ছবিও জনগণের মানসপটে ভেসে ওঠে।
অথচ পিটিআইয়ের এমন কোনো দুর্নীতি নেই। তার চেয়ে বলা ভালো, দলটি নতুন হওয়ায় তাদের অতীতের ঝোলাই শূন্য।
তবে ইমরানের পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে যে কোনো সমালোচনা নেই, তা নয়। আছে। যেমন, ইমরানের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তালেবানের প্রতি সমর্থনের আভাস পান অনেকে। এ সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক ক্রিকেট তারকার সমর্থকেরা অবশ্য তা ৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানায়। তারা মজা করে বলে, এ সবই দেশটিতে প্রচারিত উগ্র মিউজিক ভিডিও ‘আলু আনদে’র কাজ। ওই ভিডিওতে পিটিআইকে জামায়াতে ইসলামির সভ্যভব্য একটি রূপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আইএসএফের সভাপতি আরসালান এ ধরনের অভিযোগের বিরুদ্ধে প্রমাণস্বরূপ ২০০৭ সালে পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির ঘটনা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘জেনারেল পারভেজ মোশাররফের জরুরি আইনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ছাত্রবিক্ষোভে যোগ দিতে ওই বছরের নভেম্বরে সেখানে যান ইমরান খান। তিনি যখন ছাত্রদের মিছিলে শরিক হন, তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির জামায়াতে ইসলামি ছাত্র সংগঠনের সদস্যরা পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে আঁতাত করে তাঁকে আটক করে। পিটিআইয়ের সঙ্গে যদি জামায়াতে ইসলামের সম্পর্ক থাকত, তবে কি তারা এটা করত?’
এ ছাড়া পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে আর যেসব অভিযোগ আছে দলটির তরুণ সমর্থকেরা তা মিথ্যা অভিযোগ হিসেবেই উড়িয়ে দেয়।
ইমরান খানের ইন্টারনেটভিত্তিক এসব ভক্তের আচরণ মনে করিয়ে দেয় ২০০৭-০৮ সালে রাজনৈতিক প্রচারণায় নামা মার্কিন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বারাক ওবামার অনুসারীদের কথা। ওবামা তাঁর প্রচারণায় এক নতুন পন্থা গ্রহণ করেন। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, তিনি প্রচারণায় ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটার বা মাইস্পেস ব্যবহার করেই মূলত তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যাককেইনকে পরাজিত করেন।
যাহোক, আবার পাকিস্তানের কথায় ফেরা যাক। দেশটির ছাত্রদের মধ্যে পরিবর্তনের জন্য আকাঙ্ক্ষা এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তীব্র হতাশা এখন স্পষ্ট। এটা ইমরান খান ও তাঁর রাজনৈতিক দলের এগিয়ে যাওয়ার জন্য একদিকে যেমন ভালো, অন্যদিকে দলটির প্রতিশ্রুতি নির্ধারণে বাড়তি চাপও তৈরি করছে। কারণ, ইমরান ও পিটিআইও যদি তাঁদের প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থ হয়, তাহলে এই নতুন প্রজন্ম পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় হতাশাবাদী গোষ্ঠীতে পরিণত হবে—এটা নিশ্চিত।
নিউজলাইন থকে অনুবাদ: ইসরাত জাহান
জেহরা নবী: পাকিস্তানি সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.