স্মরণ-আপনার চেয়ে আপন যে জন
দেখতে দেখতে সাত বছর কেটে গেল সেলিনা বাহার জামান আমাদের মাঝে নেই। আজ ৩ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘সেলিনা বাহার জামান ষষ্ঠ স্মারক বক্তৃতা’ আয়োজন করা হয়েছে। এবারের বক্তা পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও গবেষক প্রাণতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেলিনা আপা সদা হাসিখুশি আনন্দময় জীবনের সন্ধান করেছেন আর তার প্রমাণ আমি পেয়েছি দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে পথ চলে। বাবা হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, মা আনোয়ারা বাহার এবং ফুফু শামসুন নাহার মাহমুদ। বিধিনিষেধের অচলায়তন ভেঙে বাঙালি মুসলমান সমাজ যখন শিক্ষা-সংস্কৃতি-সভ্যতার উন্মুক্ত প্রান্তরে স্থান করে নিচ্ছে, তখন সেলিনা বাহার জামানদের পরিবার সেই অর্গল ভাঙার সারিতে প্রথম কাতারে শামিল হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সেলিনা বাহার জামান আপন স্বকীয়তায় ঘরে-বাইরে, মাঠে-ময়দানে, মেলায়-মজলিশে, সাহিত্য সভায়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, বাংলা একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, জাতীয় জাদুঘরের মঞ্চে, এমনকি দেশের বাইরে কলকাতায় দ্বারভাঙা হলে, অরবিন্দ ভবনে, নন্দনে নিজ আলোচনার বৈভবে নিজেকে অনন্য করে তুলেছিলেন।
ষাটের দশকে প্রথম পর্বে মেয়েরা জীবনসংগ্রামে নেমে গেছেন। সেই সময় অত্যন্ত মেধাবী সেলিনা বাহার জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশুদ্ধ গণিত শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে প্রভাষক হিসেবে ইডেন কলেজে যোগ দেন। গণিতের মতো জটিল বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং একই সঙ্গে সংখ্যা নামে সহজ ভাষায় গণিতের জটিল তত্ত্ব ও তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ রচনা করেছেন।
বিভিন্ন বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ২১টি। সংখ্যার দিক থেকে বই খুব বেশি নয়। তবে মনন-মনীষা ও পাণ্ডিত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে তাঁর রচনা সাহিত্যের আসনে স্থান করে নিয়েছে। সেলিনা আপা বিরল গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। সম্পাদনার গৌরবেই তিনি সম্পাদক হয়েছেন। নজরুল পাণ্ডুলিপি ও নজরুলের ধূমকেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উজ্জ্বল সম্পাদিত গ্রন্থ।
বাবা হবীবুল্লাহ বাহার, মা আনোয়ারা বাহার, ফুপু শামসুন নাহার মাহমুদ ছিলেন তাঁদের কালের অন্যতম গুণী মানুষ। আর আমাদের কালের একজন বিশেষ কৃতিমান প্রজন্ম সেলিনা বাহার জামান। কত নানাবিধ গুণের তিনি অধিকারী ছিলেন। তাঁর আরেক বিরল গুণ ছিল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রতি গভীর আগ্রহ। চিঠিপত্র, পত্রিকা, আলোকচিত্র প্রভৃতি যত্নসহকারে ও পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত এবং সংগ্রহ করেছেন সেই ছোটবেলা থেকে। ১৯২৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই ৮০ বছর সময়কালের এপার বাংলা ওপার বাংলার ৪৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখা ৮৬টি চিঠির সংকলন কয়েক ছত্র প্রাণের পত্র গ্রন্থটি তিনি মৃত্যুর মাত্র ছয় মাস আগে প্রকাশ করেছেন। এ গ্রন্থের অন্যতম সম্পদ এর আলোকচিত্র।
স্কুলজীবনে বুলবুল একাডেমীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন নৃত্যে। পরবর্তী সময়ে নৃত্যের নান্দনিকতায় বহুদিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে নিযুক্ত রাখেন। ছেলেবেলা থেকেই আবৃত্তিকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সুললিত কণ্ঠস্বর, বিশুদ্ধ উচ্চারণ, দৃপ্ত ভঙ্গিমা, আন্তরিক উপস্থাপনায়, একজন আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে তাঁর আসন ছিল প্রতিষ্ঠিত। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ থেকে রেডিওতে ছোটদের আসরে শিশুশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। এরপর বেতার নাটকে অভিনয়, নানাবিধ অনুষ্ঠান পরিচালনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। পরবর্তী সময়ে টেলিভিশনে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত অনুষ্ঠান পরিচালনায় কৃতিত্বের পরিচয় রাখেন। মৃত্যুর আগে ২০০৪ সালে ১৬ অক্টোবর পূর্ব লন্ডনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সাহিত্য-অনুষ্ঠানে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে তাঁর সত্যনিষ্ঠ প্রতিবেদন এবং আন্তরিক উপস্থাপন-উপস্থিতি সুধীজনকে মুগ্ধ করে। এটাই তাঁর শেষ অনুষ্ঠান।
সেলিনা আপা সবদিক থেকেই আমার চেয়ে বড়। কিন্তু কী আশ্চর্য কখন যে বয়সের ব্যবধান ঘুচে আমি তাঁর এত কাছাকাছি চলে এলাম একেবারে সমবয়সী বন্ধুর মতো, মনেই পড়ে না। অবশ্য এ সম্ভব হয়েছে সেলিনা আপার সহজ-সরল ব্যবহার, আন্তরিকতা এবং আপন করে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা। বিশেষ করে ২০০১ সালে তাঁর বড় ছেলে পিকুর মৃত্যুর পর সেলিনা আপার সুখ-দুঃখের একান্ত সাথি হয়ে গেলাম। তখন দেখেছি তাঁর চেনা-জানার পরিধি কী বিশাল। অবাক-বিস্ময়ে দেখেছি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের একেবারে রুটিন করে খোঁজ নেওয়া, তাঁদের উপহার দেওয়া, অসুখে পথ্য নিয়ে যাওয়া কখনোই শ্রান্ত হতেন না। মনে পড়ে, ঝর্ণা বর্মন রায় কর্মজীবী হোস্টেলে থাকতেন। এ দেশে সে একা ছিল। পরে ঝর্ণা বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি ভাড়া করে থাকত। সেলিনা আপা ঠিকই ঠিকানা খুঁজে ওকে বের করতেন এবং বিজয়াতে অবশ্যই উপহার নিয়ে দেখা করতেন। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বিলকিস নাসিরুদ্দীন একা থাকতেন। সেলিনা আপার মৃত্যুর পর তাঁকে ফোন করলেই বলতেন, ‘সেলিনা নাই, আমাকে দেখতে কেউ আসে না।’ সেলিনা আপা নিয়মিত বয়োজ্যেষ্ঠ স্বজন, আত্মীয় ও প্রিয়জনদের খোঁজখবর নিতেন। সঙ্গে নিতেন নিজের রান্না করা খাবার।
আমার কাছে মনে হয়, সেলিনা আপা দিব্য দৃষ্টিতে তাঁর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সর্বক্ষণ ছুটেছেন, কাজ শেষ করার জন্য। শেষ চার বছর তিনি যে কর্মযজ্ঞ করেছেন, তা এক অসাধ্য সাধন। ‘নাই সময়, নাই সময়’ এমন এক হাহাকার আমি দেখেছি। বলতেন, ‘এ কাজগুলো শেষ করতে হবেই আমাকে।’ সেলিনা আপার দৃঢ়তা দেখে আমি ভেবেছিলাম, তাঁর নিজের জীবনী পথে চলে যেতে যেতে এবং পিকুর স্মারকগ্রন্থ এ বই দুটি অন্তত শেষ করতে পারবেন। হাসপাতালে বসে তিনি পথে চলে যেতে যেতে বইয়ের পাণ্ডুলিপি সংশোধন করেছেন। না, তাঁর স্বপ্নের আরাধ্য বই দুটি প্রকাশিত দেখে যেতে পারেননি।
সেলিনা আপাকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
কাজী মদিনা
ষাটের দশকে প্রথম পর্বে মেয়েরা জীবনসংগ্রামে নেমে গেছেন। সেই সময় অত্যন্ত মেধাবী সেলিনা বাহার জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশুদ্ধ গণিত শাস্ত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে প্রভাষক হিসেবে ইডেন কলেজে যোগ দেন। গণিতের মতো জটিল বিষয়ে অধ্যাপনা করেছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং একই সঙ্গে সংখ্যা নামে সহজ ভাষায় গণিতের জটিল তত্ত্ব ও তথ্য বিশ্লেষণ করে একটি জ্ঞানগর্ভ গ্রন্থ রচনা করেছেন।
বিভিন্ন বিষয়ে তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর রচিত ও সম্পাদিত গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ২১টি। সংখ্যার দিক থেকে বই খুব বেশি নয়। তবে মনন-মনীষা ও পাণ্ডিত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে তাঁর রচনা সাহিত্যের আসনে স্থান করে নিয়েছে। সেলিনা আপা বিরল গ্রন্থ সম্পাদনা করেছেন। সম্পাদনার গৌরবেই তিনি সম্পাদক হয়েছেন। নজরুল পাণ্ডুলিপি ও নজরুলের ধূমকেতু একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং উজ্জ্বল সম্পাদিত গ্রন্থ।
বাবা হবীবুল্লাহ বাহার, মা আনোয়ারা বাহার, ফুপু শামসুন নাহার মাহমুদ ছিলেন তাঁদের কালের অন্যতম গুণী মানুষ। আর আমাদের কালের একজন বিশেষ কৃতিমান প্রজন্ম সেলিনা বাহার জামান। কত নানাবিধ গুণের তিনি অধিকারী ছিলেন। তাঁর আরেক বিরল গুণ ছিল সংগ্রহ ও সংরক্ষণের প্রতি গভীর আগ্রহ। চিঠিপত্র, পত্রিকা, আলোকচিত্র প্রভৃতি যত্নসহকারে ও পরিকল্পিতভাবে বিন্যস্ত এবং সংগ্রহ করেছেন সেই ছোটবেলা থেকে। ১৯২৫ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত এই ৮০ বছর সময়কালের এপার বাংলা ওপার বাংলার ৪৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির লেখা ৮৬টি চিঠির সংকলন কয়েক ছত্র প্রাণের পত্র গ্রন্থটি তিনি মৃত্যুর মাত্র ছয় মাস আগে প্রকাশ করেছেন। এ গ্রন্থের অন্যতম সম্পদ এর আলোকচিত্র।
স্কুলজীবনে বুলবুল একাডেমীতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন নৃত্যে। পরবর্তী সময়ে নৃত্যের নান্দনিকতায় বহুদিন পর্যন্ত তিনি নিজেকে নিযুক্ত রাখেন। ছেলেবেলা থেকেই আবৃত্তিকার হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সুললিত কণ্ঠস্বর, বিশুদ্ধ উচ্চারণ, দৃপ্ত ভঙ্গিমা, আন্তরিক উপস্থাপনায়, একজন আবৃত্তিশিল্পী হিসেবে তাঁর আসন ছিল প্রতিষ্ঠিত। পঞ্চাশের দশকের মধ্যভাগ থেকে রেডিওতে ছোটদের আসরে শিশুশিল্পী হিসেবে যোগদান করেন। এরপর বেতার নাটকে অভিনয়, নানাবিধ অনুষ্ঠান পরিচালনা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। পরবর্তী সময়ে টেলিভিশনে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত অনুষ্ঠান পরিচালনায় কৃতিত্বের পরিচয় রাখেন। মৃত্যুর আগে ২০০৪ সালে ১৬ অক্টোবর পূর্ব লন্ডনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সাহিত্য-অনুষ্ঠানে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে তাঁর সত্যনিষ্ঠ প্রতিবেদন এবং আন্তরিক উপস্থাপন-উপস্থিতি সুধীজনকে মুগ্ধ করে। এটাই তাঁর শেষ অনুষ্ঠান।
সেলিনা আপা সবদিক থেকেই আমার চেয়ে বড়। কিন্তু কী আশ্চর্য কখন যে বয়সের ব্যবধান ঘুচে আমি তাঁর এত কাছাকাছি চলে এলাম একেবারে সমবয়সী বন্ধুর মতো, মনেই পড়ে না। অবশ্য এ সম্ভব হয়েছে সেলিনা আপার সহজ-সরল ব্যবহার, আন্তরিকতা এবং আপন করে নেওয়ার অসীম ক্ষমতা। বিশেষ করে ২০০১ সালে তাঁর বড় ছেলে পিকুর মৃত্যুর পর সেলিনা আপার সুখ-দুঃখের একান্ত সাথি হয়ে গেলাম। তখন দেখেছি তাঁর চেনা-জানার পরিধি কী বিশাল। অবাক-বিস্ময়ে দেখেছি বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের একেবারে রুটিন করে খোঁজ নেওয়া, তাঁদের উপহার দেওয়া, অসুখে পথ্য নিয়ে যাওয়া কখনোই শ্রান্ত হতেন না। মনে পড়ে, ঝর্ণা বর্মন রায় কর্মজীবী হোস্টেলে থাকতেন। এ দেশে সে একা ছিল। পরে ঝর্ণা বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি ভাড়া করে থাকত। সেলিনা আপা ঠিকই ঠিকানা খুঁজে ওকে বের করতেন এবং বিজয়াতে অবশ্যই উপহার নিয়ে দেখা করতেন। বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী বিলকিস নাসিরুদ্দীন একা থাকতেন। সেলিনা আপার মৃত্যুর পর তাঁকে ফোন করলেই বলতেন, ‘সেলিনা নাই, আমাকে দেখতে কেউ আসে না।’ সেলিনা আপা নিয়মিত বয়োজ্যেষ্ঠ স্বজন, আত্মীয় ও প্রিয়জনদের খোঁজখবর নিতেন। সঙ্গে নিতেন নিজের রান্না করা খাবার।
আমার কাছে মনে হয়, সেলিনা আপা দিব্য দৃষ্টিতে তাঁর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিলেন। সর্বক্ষণ ছুটেছেন, কাজ শেষ করার জন্য। শেষ চার বছর তিনি যে কর্মযজ্ঞ করেছেন, তা এক অসাধ্য সাধন। ‘নাই সময়, নাই সময়’ এমন এক হাহাকার আমি দেখেছি। বলতেন, ‘এ কাজগুলো শেষ করতে হবেই আমাকে।’ সেলিনা আপার দৃঢ়তা দেখে আমি ভেবেছিলাম, তাঁর নিজের জীবনী পথে চলে যেতে যেতে এবং পিকুর স্মারকগ্রন্থ এ বই দুটি অন্তত শেষ করতে পারবেন। হাসপাতালে বসে তিনি পথে চলে যেতে যেতে বইয়ের পাণ্ডুলিপি সংশোধন করেছেন। না, তাঁর স্বপ্নের আরাধ্য বই দুটি প্রকাশিত দেখে যেতে পারেননি।
সেলিনা আপাকে জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
কাজী মদিনা
No comments