কুলদীপ নায়ার-সরকারের দোদুল্যমান পদক্ষেপ
দুনিয়াজোড়া যে ধারণা বিদ্যমান, তাতে পাকিস্তানে হয়তো গণতন্ত্র নেই। এটা অর্থনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য, যা নাকি গণতন্ত্রকে ধারণ করে। কিন্তু বিচারব্যবস্থা এবং সাংবাদিকদের স্বাধীনতার বিষয়টি উল্লেখ করতে হবে। আর এই অর্জনের জন্য সেখানকার আইনজীবী ও সাংবাদিকরা দীর্ঘ আন্দোলন করেছেন। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা পাকিস্তানকে এ ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। কারণ দুটি দেশেই কর্তৃত্ববাদী শাসন চলছে।
বিচারব্যবস্থা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টি উভয় দেশই স্বীকার করে। অবশ্য বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক ভালো।
ভারত যেন অন্য কাপের চা। দেশটির সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি গণমাধ্যম ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতাকে গুরুত্বসহ স্বীকার করে। তবে এও ঠিক, মনমোহন সিং সরকারের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সন্দেহযুক্ত। যদিও আন্না হাজারের অনশন ও আন্দোলনের ব্যাপারটি অনেক বড় একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে তাদের সামনে। দুর্নীতি প্রতিরোধে লোকপাল নিয়োগের দাবির বিষয়টি নিয়ে তাঁর আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশে কিংবা তাঁদের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তেমন একটা বাধা প্রদান করা হয়নি।
যা হোক, সরকারের ত্রুটি পর্যালোচনার ক্ষেত্র যখন ভিন্নতর দিকে মোড় নেয়, তখন নতুন করে প্রশ্ন দেখা দেয়। তারা ভাবতে শুরু করেছে, গণমাধ্যম আর বিচারব্যবস্থার কি তাহলে স্বাধীনতা থাকা উচিত? মনে হতে পারে, এটা জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর সমুদ্রের দোষ খুঁজে বেড়ানোর মতো, যদিও জাহাজ ডুবে গেল চালকের কারণে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম, মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী কপিল শিবাল এবং অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রীকে যুক্তি দেখিয়েছেন, এই দুটি ব্যাপারে যেন কিছু একটা করেন। তাঁদের মতে, দুটি বিষয়েরই সংশোধন প্রয়োজন।
গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের একটি পদক্ষেপ হিসেবে সংবাদ নিষিদ্ধ করে দেওয়ার কৌশল কাজে লাগছে। এই কাজে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া ভালো ভূমিকাও পালন করছে। কারণ ভাড়া করা সংবাদ ভারতের সংবাদকর্মী কিংবা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না কিংবা তারা পছন্দও করে না। আর এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকে।
পাশাপাশি শাস্তিবিধানের মতো ঘটনারও উৎপত্তি হতে পারে। কিন্তু সরকারের প্রস্তাব হচ্ছে, কাউন্সিলে দাঁত বসিয়ে দেওয়া। এ রকম করার কিন্তু অনেক চেষ্টা হয়েছে, তবে তেমন একটা সফল হওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ প্রেস কাউন্সিল ওই রকম নয়। সরকারের প্রস্তাবটি হয়তো সেখানে ব্যর্থও হয়ে যেতে পারে। এডিটরস গিল্ড কিংবা সাংবাদিক নেতাদের বৈঠক হতে পারে তখন।
তবে সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য যদি কোনো আইনও করতে যায়, তাহলেও আমি খুব একটা ভীত হব না। বোফর্স কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর রাজীব গান্ধীও মানহানি রোধে আইন করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কার্যকর হওয়ার আগেই যে কথাবার্তা হতে থাকে, তাতে তিনি আলামত পেয়ে যান পরিণতি সম্পর্কে। আর তাতেই তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন। গণতন্ত্রে গণমাধ্যমের কিছু করণীয় থাকে। তারা মন্ত্রিপরিষদ কিংবা মন্ত্রীদের কোনো একটি গ্রুপের হুমকি কিংবা নির্দেশে চুপ করে থাকতে পারে না।
টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সরকারের মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে গেছে। দূরদর্শন আন্না হাজারের ঘটনাকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রচার করেনি। অথচ তা ছিল ১৯৭৪ সালের জয়প্রকাশ নারায়ণের ঘটনার পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ভারতে করের টাকায় পরিচালিত হয় দূরদর্শন। এই প্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞাপনের ওপরও নির্ভর করে চলতে হয় না। পাঠক কিংবা দর্শককে সংবাদ দেখার জন্য বেসরকারি চ্যানেলের দিকে নজর ফিরিয়ে নিতে হয়। এটা শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালে সেন্সরশিপ চালু করার পর থেকে। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, কোনো সরকারই গণমাধ্যম এবং বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা চায় না। যেহেতু সরকারের কাছে বাজেট প্রদানের ক্ষমতা আছে, তাই বিচারব্যবস্থায়ও হস্তক্ষেপের সুযোগ থেকে যায়। আর গণমাধ্যমকে সোজা করা যায় করপোরেট হাউসের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। বিজ্ঞাপনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ফলও পাওয়া যায় তাদের জন্য। এদিকে আন্না হাজারের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সরকার সেই পুরনো খেলাই খেলেছে। সরকার হাজারের সহযোগী প্রশান্তভূষণ, অরবিন্দ খেজেরওয়াল এবং কিরণ বেদীর বিরুদ্ধে পুরনো মামলা চালু করেছে। আমি জানি না, কোন কারণে মনিশ তেওয়ারি, যে নাকি স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছ থেকেও রেহাই পেয়ে গেছেন, তাঁকেও আবার মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হলো।
এসবই কিন্তু দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটা কিন্তু সরকারি কিংবা বিরোধী, কোনো দলের কাছেই তেমন বাহবা পায়নি। সংসদও এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেনি।
অথচ পার্লামেন্ট মেম্বার এবং সংসদীয় কমিটির মেম্বারদেরও দেখা গেল, তাঁরা পথ খুঁজছেন কিভাবে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের উপস্থাপিত সম্পদের হিসাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। আবার এও বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে যাতে কোনো তদন্তাধীন বিচারকের নাম প্রকাশ না করা হয়। তবে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতায় যেন কোনো বাধা না আসে, সেদিকে নজর দিতে হবে। বিচারব্যবস্থা কিভাবে লোকপালের অধীনে আসতে পারে, তাও ভেবে দেখতে হবে।
লেখক : ভাতের সাংবাদিক ও কলাম লেখক
ডেকান হেরাল্ড থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
ভারত যেন অন্য কাপের চা। দেশটির সংবিধান এবং গণতান্ত্রিক রীতিনীতি গণমাধ্যম ও বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতাকে গুরুত্বসহ স্বীকার করে। তবে এও ঠিক, মনমোহন সিং সরকারের বিষয়টি এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সন্দেহযুক্ত। যদিও আন্না হাজারের অনশন ও আন্দোলনের ব্যাপারটি অনেক বড় একটি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে তাদের সামনে। দুর্নীতি প্রতিরোধে লোকপাল নিয়োগের দাবির বিষয়টি নিয়ে তাঁর আন্দোলনের সংবাদ প্রকাশে কিংবা তাঁদের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে তেমন একটা বাধা প্রদান করা হয়নি।
যা হোক, সরকারের ত্রুটি পর্যালোচনার ক্ষেত্র যখন ভিন্নতর দিকে মোড় নেয়, তখন নতুন করে প্রশ্ন দেখা দেয়। তারা ভাবতে শুরু করেছে, গণমাধ্যম আর বিচারব্যবস্থার কি তাহলে স্বাধীনতা থাকা উচিত? মনে হতে পারে, এটা জাহাজ ডুবে যাওয়ার পর সমুদ্রের দোষ খুঁজে বেড়ানোর মতো, যদিও জাহাজ ডুবে গেল চালকের কারণে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম, মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী কপিল শিবাল এবং অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি প্রধানমন্ত্রীকে যুক্তি দেখিয়েছেন, এই দুটি ব্যাপারে যেন কিছু একটা করেন। তাঁদের মতে, দুটি বিষয়েরই সংশোধন প্রয়োজন।
গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের একটি পদক্ষেপ হিসেবে সংবাদ নিষিদ্ধ করে দেওয়ার কৌশল কাজে লাগছে। এই কাজে প্রেস কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া ভালো ভূমিকাও পালন করছে। কারণ ভাড়া করা সংবাদ ভারতের সংবাদকর্মী কিংবা সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না কিংবা তারা পছন্দও করে না। আর এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি চিহ্নিত হয়ে যাওয়ার ব্যাপার থাকে।
পাশাপাশি শাস্তিবিধানের মতো ঘটনারও উৎপত্তি হতে পারে। কিন্তু সরকারের প্রস্তাব হচ্ছে, কাউন্সিলে দাঁত বসিয়ে দেওয়া। এ রকম করার কিন্তু অনেক চেষ্টা হয়েছে, তবে তেমন একটা সফল হওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ প্রেস কাউন্সিল ওই রকম নয়। সরকারের প্রস্তাবটি হয়তো সেখানে ব্যর্থও হয়ে যেতে পারে। এডিটরস গিল্ড কিংবা সাংবাদিক নেতাদের বৈঠক হতে পারে তখন।
তবে সরকার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য যদি কোনো আইনও করতে যায়, তাহলেও আমি খুব একটা ভীত হব না। বোফর্স কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর রাজীব গান্ধীও মানহানি রোধে আইন করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু কার্যকর হওয়ার আগেই যে কথাবার্তা হতে থাকে, তাতে তিনি আলামত পেয়ে যান পরিণতি সম্পর্কে। আর তাতেই তিনি পিছু হটতে বাধ্য হন। গণতন্ত্রে গণমাধ্যমের কিছু করণীয় থাকে। তারা মন্ত্রিপরিষদ কিংবা মন্ত্রীদের কোনো একটি গ্রুপের হুমকি কিংবা নির্দেশে চুপ করে থাকতে পারে না।
টেলিভিশন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সরকারের মানসিকতা স্পষ্ট হয়ে গেছে। দূরদর্শন আন্না হাজারের ঘটনাকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রচার করেনি। অথচ তা ছিল ১৯৭৪ সালের জয়প্রকাশ নারায়ণের ঘটনার পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অথচ ভারতে করের টাকায় পরিচালিত হয় দূরদর্শন। এই প্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞাপনের ওপরও নির্ভর করে চলতে হয় না। পাঠক কিংবা দর্শককে সংবাদ দেখার জন্য বেসরকারি চ্যানেলের দিকে নজর ফিরিয়ে নিতে হয়। এটা শুরু হয়েছে ১৯৭৫ সালে সেন্সরশিপ চালু করার পর থেকে। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, কোনো সরকারই গণমাধ্যম এবং বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা চায় না। যেহেতু সরকারের কাছে বাজেট প্রদানের ক্ষমতা আছে, তাই বিচারব্যবস্থায়ও হস্তক্ষেপের সুযোগ থেকে যায়। আর গণমাধ্যমকে সোজা করা যায় করপোরেট হাউসের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। বিজ্ঞাপনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ফলও পাওয়া যায় তাদের জন্য। এদিকে আন্না হাজারের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও সরকার সেই পুরনো খেলাই খেলেছে। সরকার হাজারের সহযোগী প্রশান্তভূষণ, অরবিন্দ খেজেরওয়াল এবং কিরণ বেদীর বিরুদ্ধে পুরনো মামলা চালু করেছে। আমি জানি না, কোন কারণে মনিশ তেওয়ারি, যে নাকি স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছ থেকেও রেহাই পেয়ে গেছেন, তাঁকেও আবার মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হলো।
এসবই কিন্তু দেশব্যাপী দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠার পেছনে কাজ করেছে। আরো মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটা কিন্তু সরকারি কিংবা বিরোধী, কোনো দলের কাছেই তেমন বাহবা পায়নি। সংসদও এ নিয়ে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেনি।
অথচ পার্লামেন্ট মেম্বার এবং সংসদীয় কমিটির মেম্বারদেরও দেখা গেল, তাঁরা পথ খুঁজছেন কিভাবে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের উপস্থাপিত সম্পদের হিসাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যায়। আবার এও বলা হয়েছে, গণমাধ্যমে যাতে কোনো তদন্তাধীন বিচারকের নাম প্রকাশ না করা হয়। তবে বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতায় যেন কোনো বাধা না আসে, সেদিকে নজর দিতে হবে। বিচারব্যবস্থা কিভাবে লোকপালের অধীনে আসতে পারে, তাও ভেবে দেখতে হবে।
লেখক : ভাতের সাংবাদিক ও কলাম লেখক
ডেকান হেরাল্ড থেকে ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
No comments