যুক্তি তর্ক গল্প-আদর্শের ইস্যুতে আওয়ামী লীগ কি আন্তরিক? by আবুল মোমেন

থারীতি তিন বছরের মাথায় সরকার ভেতর-বাইরে সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশার পাহাড়কে নিরাশায় ডুবিয়ে এ সরকারও পুরোনো পথেই চলছে। প্রত্যাশার সঙ্গে কাজের মিল না হওয়ায় বাইরে রাজনৈতিক অঙ্গন ও সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাড়ছে। এর ধাক্কায় সরকারের ও ক্ষমতাসীন দলের ভেতরও অস্থিরতা শুরু হয়েছে।


আর এই বাস্তবতায় প্রধান বিরোধী দল স্বভাবতই ত ৎপর হয়ে উঠেছে। অর্থা ৎ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন তপ্ত হয়ে উঠছে, রাজনীতি ঘর ছেড়ে রাজপথ গরম করে তুলছে। এরই আলামত হিসেবে বিরোধী দলের সভায় জনসমাগম বাড়ছে। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের প্রতিবাদী কণ্ঠ ক্রমেই সোচ্চার হয়ে উঠছে। তাতে সরকার, বিশেষত সরকারপ্রধান, অসহিষ্ণু হয়ে পড়ছেন। সরকারি কাজে যেন জেদ-গোঁয়ার্তুমির প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। মোট কথা এবারও বাংলাদেশের রাজনীতি যথাসময়ে অতীতের পুনরাবৃত্তি করে একই ছকে ফিরে যাচ্ছে। তাতে সাধারণ মানুষের হতাশা বাড়ছেই।
কিন্তু সাধারণ মানুষ এই সর্বনাশা ছক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে বহুদিন ধরে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে মানুষ যেন বুক বেঁধে আশা করেছিল অতীতকে স্থায়ীভাবে পেছনে ফেলে সামনে এগোবে দেশ। এ রকম ভাবার তিনটি কারণ ছিল বলে মনে হয়। প্রথমত, যে সরকারকে হটিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তার ব্যাপক দুর্নীতি, হাওয়া ভবনের সমান্তরাল সরকারের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা, গোপন জঙ্গি দলের সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ও তাদের প্রশ্রয় দান ইত্যাদি মিলে মানুষ সত্যিই তাদের প্রত্যাখ্যান করেই পরিবর্তন চেয়েছে। দ্বিতীয়ত, দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে—যাকে মানুষ নিরপেক্ষ হিসেবে ধরে নিয়েছে—বড় দুই দলের যে রূপ ফুটে উঠেছে তাতে বিএনপির নেতিবাচক রূপের তুলনায় আওয়ামী লীগের ইতিবাচক একটি রূপ ফুটে উঠেছিল। তৃতীয়ত, নাগরিক সমাজের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী এবং যুদ্ধাপরাধীবিরোধী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে যে জাগরণ ঘটেছে তার রাজনৈতিক ফসল ঘরে তুলে আওয়ামী লীগ আন্তরিকতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবে বলে ধারণা সৃষ্টি হয়েছিল। এসব মিলে এবারের নির্বাচনকে তরুণ ভোটারসহ সমাজের একটি বড় অংশ কেবল বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে কিংবা চারজোট ও মহাজোটের মধ্যকার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হিসেবে দেখেনি। ভোটারদের সচেতন ও বড় অংশই একে দুই আদর্শের পক্ষে-বিপক্ষে মত প্রকাশের সুযোগ হিসেবে দেখেছে। অর্থা ৎ ক্ষমতার রাজনীতির মধ্যে বহুদিন পরে আদর্শের ছোঁয়া লেগেছিল। ফলে সরাসরি আওয়ামী লীগ করে না এমন বিপুল ভোটারের সমর্থন ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল। এ অনেকটা ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি যেন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যেমন মুষ্টিমেয় পাকিস্তানপন্থী ধর্মান্ধ দল ব্যতীত দলমত-নির্বিশেষে জনগণ আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিল, এও যেন তেমন ঘটনাই।
সত্তর ও একাত্তরের এই বিপুল জনসমর্থনকে আওয়ামী লীগ অবশ্য ধরে রাখতে পারেনি। স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ক্ষমতা এককভাবে ভোগ করতে গিয়ে মানুষের প্রত্যাশা ও মানসিক প্রস্তুতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি সরকার। একাত্তরের ঐক্য ও উদ্দীপনা নষ্ট করে ক্রমে সরকার কঠোর ও কর্তৃত্ববাদী হয়েছিল। বিশেষ ক্ষমতা আইনের মতো কালো আইনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে এবং সবচেয়ে বড় কথা, সরকার জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। আমরা আশা করেছিলাম প্রায় ৪০ বছর পরে আবার যে ঐক্য—আগেরবারের মতো ব্যাপক ও সার্বিক না হলেও, কিছুটা সীমিত হলেও—গড়ে উঠেছে তার গুরুত্ব ও মূল্য শেখ হাসিনার সরকার অনুধাবন করে তাকে রক্ষা করার ও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে যত্ন নেবে।
কিন্তু তেমনটা ঘটল না। শরিক দলগুলো তো বলছেই সরকারের কোনো কাজে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের মতামত নেওয়া বা জানানো হয় না, এখন খোদ সরকারি দলের নেতারা বলছেন, তাঁরাও আছেন অন্ধকারে। সরকারে মহাজোটের শরিক দলগুলোর প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণ এতই কম যে বোঝাই যায় ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের কোনো পাত্তাই নেই। কিন্তু এটুকুতে আর অবাক হওয়ার কিছু নেই। কারণ, খোদ সরকারি দলের সাংসদ, এমনকি মন্ত্রিসভার সদস্যরাও বলছেন সরকারের নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ কি প্রক্রিয়ায় হচ্ছে তা তাঁরা জানেন না।
এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে দলে ও সরকারে শেখ হাসিনাই সর্বেসর্বা, একক ক্ষমতার অধিকারী। এটা বিএনপির ক্ষেত্রেও সত্য হলেও একটু বোধহয় পার্থক্য আছে। শেখ হাসিনা নিজের যোগ্যতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী, হয়তো অনেকের মতে অতি-আত্মবিশ্বাসী আর খালেদা জিয়া অনেক ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যক্তির ওপর নির্ভর করেন। খালেদা জিয়াকে বুঝিয়ে পক্ষে নিয়ে অন্য কেউ কাজ করাতে পারেন, শেখ হাসিনা উদ্যোগী মানুষ, নিজেই পছন্দের ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু যেভাবেই হোক, সরকার হয়ে পড়ে দুই নেত্রীকেন্দ্রিক এবং বিশেষ কোটারিতে আবদ্ধ। এ রকম বাস্তবতায় দল, সরকার, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনেকটাই অন্ধকারে থেকে যায়। এভাবে আর যা-ই হোক গণতন্ত্রের বিকাশ হতে পারে না। বরং সব ক্ষমতা এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত হতে থাকে। এই ক্ষুদ্র শক্তিশালী ক্ষমতাকেন্দ্রের হুকুম মানাই হয় বাকি সবার কাজ। যে মানুষ কেবল একজনের হুকুম পালনের সুযোগটুকু পায় কিংবা একজনকে সন্তুষ্ট করার দায়িত্বটুকু পায় তার পক্ষে নিজের মেধা, সৃজনশীলতার প্রকাশ ঘটিয়ে কোনো কাজ আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে করা মুশকিল হয়ে পড়ে। অন্যের হুকুম তামিল করা আর নিজের কাজ মনে করে একটি দায়িত্ব পালনে কর্মীর ভূমিকা ও মনস্তত্ত্ব এক রকম থাকে না। সেই নেতৃত্বই সার্থক, যা হুকুমের ওপর নির্ভরশীল নয়, যা এমন এক কাজের পরিবেশ ও সংস্কৃতি তৈরি করে যেখানে কাজকে সবাই নিজের মনে করার সুযোগ পায় এবং সাগ্রহে ও মর্যাদার সঙ্গে কাজ করে তৃপ্ত হয়। কিন্তু যার প্রধান চিন্তা বা দুশ্চিন্তা ক্ষমতা যেন হাতছাড়া না হয়, যেন ধরে রাখা যায়, অন্য কেউ কৃতিত্ব নিতে না পারে সেই নেতৃত্বে কর্তৃত্বই হয় মুখ্য, তাতে বেশি মানুষের সৃজনশীল মেধা যুক্ত হওয়ার অবকাশ ঘটে না। সেখানে কাজ মানুষকে আনন্দ দেয় না, দেয় ক্লান্তি ও হতাশা। কাজের মধ্যে ব্যক্তির জন্য মর্যাদা ও মুক্তির আনন্দ থাকে না, থাকে মর্যাদা হারানোর ভয় ও অপরের হুকুমের দাসত্বের গ্লানি। গণতন্ত্রই পারে এই রাজনৈতিক অপসংস্কৃতিকে ভাঙতে। কিন্তু আমরা সে পথ থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছি।
এখন সরকারের তিন বছরের মাথায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাই বলছেন আগামী নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা নেই। তাঁরা ক্ষমতায় থাকা না-থাকা নিয়ে চিন্তিত। সেদিক থেকেই কথাটা বলেন। কিন্তু যাঁরা গত নির্বাচনে একটি আদর্শিক লড়াইয়ের ছায়া দেখেছিলেন, একাত্তরের ঘাতক-দালালদের হাত থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন, যাঁরা ধর্মান্ধ পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির কবল থেকে স্থায়ীভাবে উদ্ধার পেতে চেয়েছিলেন, যাঁরা হাওয়া ভবনীয় অপত ৎপরতা ও ষড়যন্ত্রের জাল থেকে বের হতে চেয়েছিলেন, তাঁদের কি সান্ত্বনা মিলবে? আমার মনে আছে, ২০০৮ সালের নির্বাচনী বিজয়ের পর শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছিলাম তাঁর এবারের সরকারের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। ভারতসহ বহু দেশের দৃষ্টান্ত দেখিয়ে বলেছিলাম, সদ্য স্বাধীন যেকোনো দেশের অগ্রগতির পেছনে ছিল একটি দলের দীর্ঘ শাসন। এভাবে অর্থনীতি, প্রশাসন, সমাজজীবনে একটি সুস্থিরতা তৈরি হয়। আমরা কেবলই অস্থিরতার কবলে পড়ছি। আদর্শিক দ্বন্দ্বে যদি দেশ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে থাকে, তাহলে সেখানে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নিজ আদর্শের পক্ষে সৃষ্ট ঐক্যকে বিস্তৃত ও জোরদার করতে হবে এবং অত্যন্ত ধৈর্য, দক্ষতা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে সরকার পরিচালনা করে আদর্শিক সংঘাত থেকে জাতিকে বের করে আনতে হবে।
মানুষ শেখ হাসিনার কাছে সেই নেতৃত্বই দেখতে চেয়েছিল। কিন্তু এভাবে গতানুগতিক পথে ক্ষমতার করিডরে পথ হারালে যে প্রশ্নটা জোরালো হবে তা হলো—আসলে আওয়ামী লীগ কি আদর্শের রাজনীতি আর ধারণ করে? এ আওয়ামী লীগ কি আদর্শের রাজনীতি এগিয়ে নিতে ইচ্ছুক? সক্ষম?
মুখের কথায় আর কাজ হবে না। কাজের মাধ্যমেই প্রমাণ করতে হবে ক্ষমতার বাইরে সত্যিই অন্য ইস্যুগুলোতে—বিশেষত আদর্শের ইস্যুতে—আওয়ামী লীগ আন্তরিক কিনা।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.