পুঁজিবাজারকে সঠিক ধারায় নিতে হলে by সালেহউদ্দিন আহমেদ
শিল্পে বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কোনো বিনিয়োগ, বিশেষত, বৃহৎ ও দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের জন্য পুঁজিবাজারের গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যাংক ফাইন্যান্স অর্থাৎ ঋণ নিয়ে শিল্প বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ব্যাংকের কিছু সীমাবদ্ধতা থাকার পরিপ্রেক্ষিতে কোনো দেশে শিল্পায়ন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নয়নে পুঁজি সরবরাহের বিষয়টি অনেকটা পুঁজিবাজারের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু বাংলাদেশের পুঁজিবাজার অত্যন্ত ছোট এবং ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের অর্থায়নের তুলনা করলে দেখা যাবে, ব্যাংক থেকে অর্থায়ন হয় অনেক বেশি। তাই বলা যায়, আমাদের পুঁজিবাজার এখনো পুরোপুরি বিকশিত হয়নি, বিকাশমান আছে। এর মধ্যে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা থেকে পুঁজিবাজারের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে এবং পুঁজিবাজার উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমরা হোঁচট খাচ্ছি। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, পুঁজিবাজারের দুটি দিক আছে। এটাকে আমরা বলি বন্ড মার্কেট ও ইক্যুইটি মার্কেট। ইক্যুইটি বা শেয়ারবাজার নিয়ে আমাদের বিস্তর আলোচনা হয়, কিন্তু সেই তুলনায় বন্ড মার্কেট নিয়ে একেবারেই আলোচনা হয় না। শেয়ারবাজারে বেশির ভাগ বিনিয়োগ প্রাতিষ্ঠানিক। আর আছেন ব্যক্তিগত পর্যায়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। আমাদের দেশে গত কয়েক বছরে এই সংখ্যা প্রায় ৩৫ লাখে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিত পুঁজিবাজারের কার্যকারিতা, উত্থান-পতন প্রভাব ফেলে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারী— সবার ওপর।
ইক্যুইটি মার্কেটে ও প্রাইমারি মার্কেটের ক্ষেত্রে আমাদের কতগুলো সমস্যা আছে। প্রথমত, ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (আইপিও) ইস্যু করার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল—সেখানে অস্বচ্ছতা আছে, অনেক সময় লাগে। এতে ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার সময়মতো আসে না। আবার কিছু কিছু কোম্পানি শেয়ার ম্যানিপুলেশন করে আইপিওতে ছাড়ে। অন্যদিকে আইপিওতে ইনিশিয়াল শেয়ার প্রাইসিংয়ের ক্ষেত্রেও যোগসাজশ করে অভিহিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এসব জায়গায় কিছু গলদ আছে। আমি মনে করি, যেসব কোম্পানি আইপিও ইস্যু করে এবং ইস্যু ব্যবস্থাপনা করে, তাদের বিশেষ ভূমিকা আছে। তারা ইচ্ছা করেই ইস্যুমূল্যটা অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমরা দেখেছি, ১০ টাকার একটা শেয়ারের ইস্যুমূল্য ৩০০ টাকা হয়েছে। এটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। পৃথিবীর কোনো বাজারে ইস্যুমূল্যের এত ভিন্নতা দেখা যায় না। আইপিওর এই জায়গায়ও একটা গলদ আছে।
দ্বিতীয়ত, ইনফরমেশন অ্যাসিমেট্রি বা তথ্যের অসামঞ্জস্যতা। যে কোম্পানি বা ব্রোকার বা যে মার্চেন্ট ব্যাংক আইপিও বিক্রির মাধ্যমে শেয়ার প্রাইসের লেনদেন করে আর যারা কেনে, তাদের মধ্যে তথ্যের বিস্তর ফারাক আছে। এই অসামঞ্জস্যতার জন্য যারা তথ্য কম পায়, বিশেষত, ক্রেতা ও বিক্রেতা একটা বেকায়দা অবস্থায় পড়ে। কোম্পানি সম্পর্কে, কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা, অডিট রিপোর্টে উপস্থাপিত তথ্য ঠিকমতো আসে না। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তারা এসব তথ্য পায় না, কিন্তু পায় স্টক এক্সচেঞ্জ, এসইসি, ডিএসই, মার্চেন্ট ব্যাংকের লোক। ফলে তারা ইনসাইডার ট্রেডিং করতে পারে। তারা জানে, কার শেয়ার বাড়বে, কারটা কমবে। ইনসাইডার ট্রেডিং আমাদের দেশে হয়েছে এবং এখনো হয়। এটা রোধ করার জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তৃতীয়ত, ভালো ভালো অনেক কোম্পানির শেয়ার সময়মতো আসছে না আইপিও প্রক্রিয়াটি জটিল হওয়ার কারণে। এই সমস্যাটি অবিলম্বে সমাধান করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ডিমিউচুয়ালাইজেশন। এখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের যে ট্রেডিং হাউসগুলো আছে, এগুলো চালায় নির্বাচিত ও অনির্বাচিত সদস্যরা। তাদের বেশির ভাগই হলো মার্চেন্ট ব্যাংকার্স, ব্রোকারস। তারাই যদি গভর্নেন্সে থাকে, আবার ব্যবসায়ও থাকে, তার মানে হলো জবাবদিহির ঘাটতি থাকবে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের মানে হলো যারা গভর্নেন্সে থাকবে, তারা ব্যবস্থাপনায় থাকবে না, স্টেকহোল্ডার হবে না। দুটোকে আলাদা করতে হবে। অন্যান্য দেশে এটা করা হয়েছে। এ কাজটি করতে যত দেরি হবে, ততই ট্রেডিং হাউসগুলো স্টেকহোল্ডারদের দ্বারা ম্যানিপুলেশনের শিকার হবে। তদন্ত প্রতিবেদনেও এ ব্যাপারে অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরা অনেক দিন ধরে এ ব্যাপারে কথাই বলছি, গতকাল রোববারও পত্রিকায় দেখলাম, এ জন্য আরও অনেক সময় লাগবে, অনেক সভা করা হচ্ছে। আমার মনে হয়, এতে অযথা বিলম্ব ঘটবে। ইতিমধ্যে বহু দেশের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। অবিলম্বে সেই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
শেয়ারবাজারে সম্প্রতি যা চলছে তা নিয়ে বলব, এসব বিষয়ে অনেক আগেই আমাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু রেগুলেটররা (স্টক এক্সচেঞ্জ, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ) তা করেনি। আমাদের স্টক মার্কেটের বর্তমান সমস্যার পেছনে একটা অশুভ আঁতাত ছিল। কিছু এক্সচেঞ্জ হাউস, এসইসির লোকজন, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকাররা মিলে লোকজনকে ধোঁকা দিয়ে নানাভাবে পুঁজি হাতিয়ে নিয়েছে। এ কাজে তারা বিভিন্ন মাধ্যম বা প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছে। ডাইরেক্ট লিস্টিং, প্রাইভেট প্লেসমেন্ট, বুক বিল্ডিং মেথড ইত্যাদি ম্যানিপুলেট করেছে। যেমন বুক বিল্ডিং মেথডের কথাই ধরা যাক। বুক বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে ঘোষণা দিয়ে একটা বাজারমূল্য ঠিক করা হয়। কিন্তু যদি আগেই প্রচার করে কিছু লোক দিয়ে সেই কোম্পানির শেয়ারটির মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন তাহলে বুক বিল্ডিংয়ে একটি অন্যায্য মূল্য আসবে। বুক বিল্ডিং প্রক্রিয়াটি আদতে খারাপ নয়, কিন্তু এর অপপ্রয়োগ করা হয়েছে। এটা বন্ধ করতে হবে। প্রাইভেট প্লেসমেন্ট, ডাইরেক্ট লিস্টিংয়ের ক্ষেত্রেও একই রকম অবস্থা। এসবের ম্যানিপুলেট করার মাধ্যমে যারা শেয়ার ইস্যু করে, তাদের পকেটেই টাকা চলে যায়। পুঁজিবাজারে অর্থ উত্তোলনের উদ্দেশ্য থাকে কোম্পানির মূলধন বাড়িয়ে নিজের বিস্তৃতি ঘটানো, কাজের সুযোগ তৈরি হবে, তারপর যারা শেয়ারের মালিক তাদের রিটার্ন দেওয়া হবে। কিন্তু এই অর্থ ব্যক্তির পকেটে চলে যাওয়ার অর্থ তা আর বিনিয়োগ হলো না। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই অর্থ ব্যক্তিগত লাভে চলে যায়—ব্যবসা না করেও পুঁজিবাজারে গিয়ে ব্যবসার লাভটা পাওয়া হয়ে যায়। এটা হলো অর্থ লাভের চোরা পথ।
এবার প্রাইমারি মার্কেটে বেশির ভাগ ম্যানিপুলেশন হয়েছে। প্রাইমারি মার্কেটেই টাকা যারা বানানোর বানিয়ে চলে গেছে। সেকেন্ডারি মার্কেটেও হয়েছে, তবে তুলনামূলকভাবে কম।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। আমি গভর্নর থাকাকালে মনে আছে, প্রতি মাসে একবার করে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে সভা হতো। তাদের ও আমাদের ইস্যুগুলোর সমাধানের চেষ্টা করা হতো। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি সম্পর্কিত নয়, তবু সেই সভার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারতাম কী ঘটছে। কিন্তু এবার দেখলাম, যখন ঝামেলা শুরু হলো, তখন এসইসির চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে গেলেন। এটা মূলত এসইসির দায়িত্ব ছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল আরেকটু এগিয়ে আসা। ব্যাংকিং খাতের বিনিয়োগ তদারকি করা উচিত ছিল। পুরো ডিপোটিজের ১০ ভাগ অর্থ কিন্তু কম নয়। ডিপোজিটরদের অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা সাধারণভাবে ঠিক নয়। এই অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক আগে থেকে মনিটর করতে পারত। হুট করে বাংলাদেশ ব্যাংক এসে বলেছে, যারা ১০ শতাংশের বেশি করেছেন, তারা তাড়াতাড়ি অর্থ সমন্বয় করেন বা বিনিয়োগ কমিয়ে আনেন। তখন ব্যাংকগুলো ভয়ে শেয়ারগুলো বিক্রি করে সরে আসতে চাইল। তখন একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ পুঁজিবাজারে কম হলেও তা সবার কাছে একটা সংকেত দেয়। ব্যাংকাররা কিছু করলে তারা সেই সংকেত খুব বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে নেয়। ব্যাংকাররা চলে যাচ্ছে তার মানে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। চটচট করে সূচক উঠছে কেন, এটা বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটর করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো সময়োপযোগী হয়নি। সিদ্ধান্তগুলো হয়তো ঠিক ছিল। আর মনিটরিংটাও সময়মতো করেনি। এখানেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রসঙ্গ আসে। এখন পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, পাশাপাশি লিজিং কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের ব্যাপারেও বিধিনিষেধ আরোপ করা জরুরি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এসইসির ভূমিকা। এসইসি কোনো রেগুলেটরের মতো কাজ করেনি। আসলে অনেকটা ট্রেডিং হাউসের মতো কাজ করেছে, তাদের শরিক হিসেবে কাজ করেছে। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ভেবেচিন্তে, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং তা বাস্তবায়ন করতে হয়। দু-একজনের ক্ষতি হলেই পরিবর্তন করবে কেন? কিন্তু চাপে পড়ে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের মানে এসইসিতে যাঁরা কাজ করছিলেন, তাঁরা নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না, বাইরের লোক অথবা বাইরের স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তা তো দেখাই যাচ্ছে—তদন্ত প্রতিবেদনে বেরিয়েছে। এসইসিকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে, এটা ভালো কথা। তবে শুধু নতুন নিয়োগ দিলেই হবে না, এসইসিকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে দিতে হবে—সঙ্গে সঙ্গে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এসইসিতে যত সৎ ও দক্ষ লোকই আসুন না কেন, তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করা হলে তিনি নিজের মতো কাজ করতে পারবেন না।
আমি মনে করি, সাম্প্রতিক তদন্ত প্রতিবেদনে প্রধান বিষয়গুলো ঠিকভাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তদন্ত দল সুনির্দিষ্টভাবে বলেছে, কারা কারা জড়িত, আর এসইসির কী কী দুর্বলতা। তাদের সুপারিশগুলোর কিছু কিছু এখনই বাস্তবায়নযোগ্য।
এখনই কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটা বার্তা দিতে হবে। তদন্তে যাদের নাম এসেছে, সেগুলো প্রকাশ করা হবে না বলে সরকার যে বার্তাটি দিতে চেয়েছে, তা সঠিক নয়। এটা আমি একদমই সমর্থন করি না। কেন নাম প্রকাশ করা হবে না? তাদের তো এখনো অভিযুক্ত বলা হচ্ছে না। এই নামগুলো আড়াল করলে হবে কি, পরবর্তীকালে যারা এ ধরনের কাজ করবে তারা একটা ইনটেনসিভ পাবে—ভাববে, আমি করলেও তো আমার নাম আসবে না, পর্দার আড়ালে লাভ করে নিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলতে পারব। মনে রাখা দরকার, শেয়ারবাজার সংকট তো নিছক গবেষণার বিষয়বস্তু নয়। পুঁজিবাজার চলে মানুষের আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে। মানুষের আস্থা তৈরি করতে হলে সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে তো।
পরিশেষে আমার আশঙ্কার কথা বলি। পুঁজিবাজারের বর্তমান সমস্যা শুধু পুঁজিবাজারের সমস্যা নয়, আর্থিক খাতের জন্যই এক অশনিসংকেত। পুঁজিবাজারে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক জড়িত। তা ছাড়া, পুঁজিবাজার থেকে যে তহবিল আর্থিক খাতে আসার কথা তা সরে যাচ্ছে। ১৯৯৬ সালে একবার তদন্ত হলো, সেটার কোনো সুরাহা হলো না। এবারও যদি কোনো সুরাহা না হয়, পুঁজিবাজারের উন্নতি হবে না, শৃঙ্খলা আসবে না। কিছুদিন পর আরেকটা বিপর্যয়ের পথ খোলা রয়ে যাবে। আরেকটি ব্যাপার হলো, কিছুসংখ্যক মানুষকে ব্যবসা না করে ধন-সম্পদ অর্জনের একটা সহজ পথ করে দেওয়া হয়েছে ব্যবসার নামে, অন্যদিকে বঞ্চিত হলেন কতগুলো নিরীহ মানুষ।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।
ইক্যুইটি মার্কেটে ও প্রাইমারি মার্কেটের ক্ষেত্রে আমাদের কতগুলো সমস্যা আছে। প্রথমত, ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (আইপিও) ইস্যু করার প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল—সেখানে অস্বচ্ছতা আছে, অনেক সময় লাগে। এতে ভালো ভালো কোম্পানির শেয়ার সময়মতো আসে না। আবার কিছু কিছু কোম্পানি শেয়ার ম্যানিপুলেশন করে আইপিওতে ছাড়ে। অন্যদিকে আইপিওতে ইনিশিয়াল শেয়ার প্রাইসিংয়ের ক্ষেত্রেও যোগসাজশ করে অভিহিত মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এসব জায়গায় কিছু গলদ আছে। আমি মনে করি, যেসব কোম্পানি আইপিও ইস্যু করে এবং ইস্যু ব্যবস্থাপনা করে, তাদের বিশেষ ভূমিকা আছে। তারা ইচ্ছা করেই ইস্যুমূল্যটা অনেক বাড়িয়ে দেয়। আমরা দেখেছি, ১০ টাকার একটা শেয়ারের ইস্যুমূল্য ৩০০ টাকা হয়েছে। এটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। পৃথিবীর কোনো বাজারে ইস্যুমূল্যের এত ভিন্নতা দেখা যায় না। আইপিওর এই জায়গায়ও একটা গলদ আছে।
দ্বিতীয়ত, ইনফরমেশন অ্যাসিমেট্রি বা তথ্যের অসামঞ্জস্যতা। যে কোম্পানি বা ব্রোকার বা যে মার্চেন্ট ব্যাংক আইপিও বিক্রির মাধ্যমে শেয়ার প্রাইসের লেনদেন করে আর যারা কেনে, তাদের মধ্যে তথ্যের বিস্তর ফারাক আছে। এই অসামঞ্জস্যতার জন্য যারা তথ্য কম পায়, বিশেষত, ক্রেতা ও বিক্রেতা একটা বেকায়দা অবস্থায় পড়ে। কোম্পানি সম্পর্কে, কোম্পানির অর্থনৈতিক অবস্থা, অডিট রিপোর্টে উপস্থাপিত তথ্য ঠিকমতো আসে না। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। তারা এসব তথ্য পায় না, কিন্তু পায় স্টক এক্সচেঞ্জ, এসইসি, ডিএসই, মার্চেন্ট ব্যাংকের লোক। ফলে তারা ইনসাইডার ট্রেডিং করতে পারে। তারা জানে, কার শেয়ার বাড়বে, কারটা কমবে। ইনসাইডার ট্রেডিং আমাদের দেশে হয়েছে এবং এখনো হয়। এটা রোধ করার জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তৃতীয়ত, ভালো ভালো অনেক কোম্পানির শেয়ার সময়মতো আসছে না আইপিও প্রক্রিয়াটি জটিল হওয়ার কারণে। এই সমস্যাটি অবিলম্বে সমাধান করতে হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো ডিমিউচুয়ালাইজেশন। এখন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের যে ট্রেডিং হাউসগুলো আছে, এগুলো চালায় নির্বাচিত ও অনির্বাচিত সদস্যরা। তাদের বেশির ভাগই হলো মার্চেন্ট ব্যাংকার্স, ব্রোকারস। তারাই যদি গভর্নেন্সে থাকে, আবার ব্যবসায়ও থাকে, তার মানে হলো জবাবদিহির ঘাটতি থাকবে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের মানে হলো যারা গভর্নেন্সে থাকবে, তারা ব্যবস্থাপনায় থাকবে না, স্টেকহোল্ডার হবে না। দুটোকে আলাদা করতে হবে। অন্যান্য দেশে এটা করা হয়েছে। এ কাজটি করতে যত দেরি হবে, ততই ট্রেডিং হাউসগুলো স্টেকহোল্ডারদের দ্বারা ম্যানিপুলেশনের শিকার হবে। তদন্ত প্রতিবেদনেও এ ব্যাপারে অচিরেই ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। আমরা অনেক দিন ধরে এ ব্যাপারে কথাই বলছি, গতকাল রোববারও পত্রিকায় দেখলাম, এ জন্য আরও অনেক সময় লাগবে, অনেক সভা করা হচ্ছে। আমার মনে হয়, এতে অযথা বিলম্ব ঘটবে। ইতিমধ্যে বহু দেশের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে। অবিলম্বে সেই প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
শেয়ারবাজারে সম্প্রতি যা চলছে তা নিয়ে বলব, এসব বিষয়ে অনেক আগেই আমাদের দৃষ্টি দেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু রেগুলেটররা (স্টক এক্সচেঞ্জ, সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ) তা করেনি। আমাদের স্টক মার্কেটের বর্তমান সমস্যার পেছনে একটা অশুভ আঁতাত ছিল। কিছু এক্সচেঞ্জ হাউস, এসইসির লোকজন, মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকাররা মিলে লোকজনকে ধোঁকা দিয়ে নানাভাবে পুঁজি হাতিয়ে নিয়েছে। এ কাজে তারা বিভিন্ন মাধ্যম বা প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছে। ডাইরেক্ট লিস্টিং, প্রাইভেট প্লেসমেন্ট, বুক বিল্ডিং মেথড ইত্যাদি ম্যানিপুলেট করেছে। যেমন বুক বিল্ডিং মেথডের কথাই ধরা যাক। বুক বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে ঘোষণা দিয়ে একটা বাজারমূল্য ঠিক করা হয়। কিন্তু যদি আগেই প্রচার করে কিছু লোক দিয়ে সেই কোম্পানির শেয়ারটির মূল্য বাড়িয়ে দিয়ে থাকেন তাহলে বুক বিল্ডিংয়ে একটি অন্যায্য মূল্য আসবে। বুক বিল্ডিং প্রক্রিয়াটি আদতে খারাপ নয়, কিন্তু এর অপপ্রয়োগ করা হয়েছে। এটা বন্ধ করতে হবে। প্রাইভেট প্লেসমেন্ট, ডাইরেক্ট লিস্টিংয়ের ক্ষেত্রেও একই রকম অবস্থা। এসবের ম্যানিপুলেট করার মাধ্যমে যারা শেয়ার ইস্যু করে, তাদের পকেটেই টাকা চলে যায়। পুঁজিবাজারে অর্থ উত্তোলনের উদ্দেশ্য থাকে কোম্পানির মূলধন বাড়িয়ে নিজের বিস্তৃতি ঘটানো, কাজের সুযোগ তৈরি হবে, তারপর যারা শেয়ারের মালিক তাদের রিটার্ন দেওয়া হবে। কিন্তু এই অর্থ ব্যক্তির পকেটে চলে যাওয়ার অর্থ তা আর বিনিয়োগ হলো না। এসব প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই অর্থ ব্যক্তিগত লাভে চলে যায়—ব্যবসা না করেও পুঁজিবাজারে গিয়ে ব্যবসার লাভটা পাওয়া হয়ে যায়। এটা হলো অর্থ লাভের চোরা পথ।
এবার প্রাইমারি মার্কেটে বেশির ভাগ ম্যানিপুলেশন হয়েছে। প্রাইমারি মার্কেটেই টাকা যারা বানানোর বানিয়ে চলে গেছে। সেকেন্ডারি মার্কেটেও হয়েছে, তবে তুলনামূলকভাবে কম।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এসইসির মধ্যে সমন্বয়ের অভাব। আমি গভর্নর থাকাকালে মনে আছে, প্রতি মাসে একবার করে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সঙ্গে সভা হতো। তাদের ও আমাদের ইস্যুগুলোর সমাধানের চেষ্টা করা হতো। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি সম্পর্কিত নয়, তবু সেই সভার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারতাম কী ঘটছে। কিন্তু এবার দেখলাম, যখন ঝামেলা শুরু হলো, তখন এসইসির চেয়ারম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে গেলেন। এটা মূলত এসইসির দায়িত্ব ছিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ছিল আরেকটু এগিয়ে আসা। ব্যাংকিং খাতের বিনিয়োগ তদারকি করা উচিত ছিল। পুরো ডিপোটিজের ১০ ভাগ অর্থ কিন্তু কম নয়। ডিপোজিটরদের অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা সাধারণভাবে ঠিক নয়। এই অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক আগে থেকে মনিটর করতে পারত। হুট করে বাংলাদেশ ব্যাংক এসে বলেছে, যারা ১০ শতাংশের বেশি করেছেন, তারা তাড়াতাড়ি অর্থ সমন্বয় করেন বা বিনিয়োগ কমিয়ে আনেন। তখন ব্যাংকগুলো ভয়ে শেয়ারগুলো বিক্রি করে সরে আসতে চাইল। তখন একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়। ব্যাংকের বিনিয়োগের পরিমাণ পুঁজিবাজারে কম হলেও তা সবার কাছে একটা সংকেত দেয়। ব্যাংকাররা কিছু করলে তারা সেই সংকেত খুব বিশ্বাসযোগ্য হিসেবে নেয়। ব্যাংকাররা চলে যাচ্ছে তার মানে খারাপ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। চটচট করে সূচক উঠছে কেন, এটা বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটর করেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিদ্ধান্তগুলো সময়োপযোগী হয়নি। সিদ্ধান্তগুলো হয়তো ঠিক ছিল। আর মনিটরিংটাও সময়মতো করেনি। এখানেই ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রসঙ্গ আসে। এখন পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, পাশাপাশি লিজিং কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগের ব্যাপারেও বিধিনিষেধ আরোপ করা জরুরি।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এসইসির ভূমিকা। এসইসি কোনো রেগুলেটরের মতো কাজ করেনি। আসলে অনেকটা ট্রেডিং হাউসের মতো কাজ করেছে, তাদের শরিক হিসেবে কাজ করেছে। ঘন ঘন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় ভেবেচিন্তে, তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং তা বাস্তবায়ন করতে হয়। দু-একজনের ক্ষতি হলেই পরিবর্তন করবে কেন? কিন্তু চাপে পড়ে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের মানে এসইসিতে যাঁরা কাজ করছিলেন, তাঁরা নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন না, বাইরের লোক অথবা বাইরের স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তা তো দেখাই যাচ্ছে—তদন্ত প্রতিবেদনে বেরিয়েছে। এসইসিকে শক্তিশালী করার কথা বলা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে, এটা ভালো কথা। তবে শুধু নতুন নিয়োগ দিলেই হবে না, এসইসিকে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করতে দিতে হবে—সঙ্গে সঙ্গে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এসইসিতে যত সৎ ও দক্ষ লোকই আসুন না কেন, তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করা হলে তিনি নিজের মতো কাজ করতে পারবেন না।
আমি মনে করি, সাম্প্রতিক তদন্ত প্রতিবেদনে প্রধান বিষয়গুলো ঠিকভাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তদন্ত দল সুনির্দিষ্টভাবে বলেছে, কারা কারা জড়িত, আর এসইসির কী কী দুর্বলতা। তাদের সুপারিশগুলোর কিছু কিছু এখনই বাস্তবায়নযোগ্য।
এখনই কিছু সুপারিশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটা বার্তা দিতে হবে। তদন্তে যাদের নাম এসেছে, সেগুলো প্রকাশ করা হবে না বলে সরকার যে বার্তাটি দিতে চেয়েছে, তা সঠিক নয়। এটা আমি একদমই সমর্থন করি না। কেন নাম প্রকাশ করা হবে না? তাদের তো এখনো অভিযুক্ত বলা হচ্ছে না। এই নামগুলো আড়াল করলে হবে কি, পরবর্তীকালে যারা এ ধরনের কাজ করবে তারা একটা ইনটেনসিভ পাবে—ভাববে, আমি করলেও তো আমার নাম আসবে না, পর্দার আড়ালে লাভ করে নিয়ে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলতে পারব। মনে রাখা দরকার, শেয়ারবাজার সংকট তো নিছক গবেষণার বিষয়বস্তু নয়। পুঁজিবাজার চলে মানুষের আস্থার ওপর দাঁড়িয়ে। মানুষের আস্থা তৈরি করতে হলে সুস্পষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে তো।
পরিশেষে আমার আশঙ্কার কথা বলি। পুঁজিবাজারের বর্তমান সমস্যা শুধু পুঁজিবাজারের সমস্যা নয়, আর্থিক খাতের জন্যই এক অশনিসংকেত। পুঁজিবাজারে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক জড়িত। তা ছাড়া, পুঁজিবাজার থেকে যে তহবিল আর্থিক খাতে আসার কথা তা সরে যাচ্ছে। ১৯৯৬ সালে একবার তদন্ত হলো, সেটার কোনো সুরাহা হলো না। এবারও যদি কোনো সুরাহা না হয়, পুঁজিবাজারের উন্নতি হবে না, শৃঙ্খলা আসবে না। কিছুদিন পর আরেকটা বিপর্যয়ের পথ খোলা রয়ে যাবে। আরেকটি ব্যাপার হলো, কিছুসংখ্যক মানুষকে ব্যবসা না করে ধন-সম্পদ অর্জনের একটা সহজ পথ করে দেওয়া হয়েছে ব্যবসার নামে, অন্যদিকে বঞ্চিত হলেন কতগুলো নিরীহ মানুষ।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক।
No comments