যোগ্য নেতৃত্বের হাত ধরে এগিয়ে যাক -মামুন রশীদ
স্বাধীনতা অর্জনের আগে তিনি যখন ছাত্ররাজনীতি করতেন, তখনই প্রগতিশীল সব আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন ও অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘অগ্নিকন্যা’ খেতাব পেয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতিতেও তিনি প্রশ্নাতীত সততা, নৈতিকতা ও সাহসিকতা অব্যাহত রেখেছেন। ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে বর্তমান ১৪ দলীয় জোট সরকারের কৃষিমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়ে তিনি কৃষি খাতের শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ও খাদ্যশস্যের উত্পাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে নীতি সংস্কার, সহজে ও সময়মতো কৃষি উপকরণ বিতরণ ও উত্পাদন খরচ কমানোর ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন বলে জোরাল প্রতিশ্রুতি দেন। এরই আলোকে তিনি দেশের এক কোটি ৮২ লাখ কৃষকের কাছে সরকারের দেওয়া ভর্তুকি পৌঁছাতে তাঁদের মধ্যে পরিচয়পত্র বিতরণের কাজও শুরু করেছেন। সব মিলিয়ে এই প্রথমবারের মতো আমরা উন্নয়ন পরিকল্পনার একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ দেখতে পেলাম। প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই এতক্ষণে বুঝে গেছেন যে আমি কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কথাই বলছি। যেহেতু দেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৮ শতাংশই কৃষি কাজে নিয়োজিত, সেহেতু এই খাতের নেতৃত্ব দিতে তাঁকে যোগ্যতম ব্যক্তিত্ব মনে করি। কারণ ১৯৯৬-২০০১ সময়েও তিনি সাফল্যের সঙ্গে তত্কালীন সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন।
সরকার চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে খাদ্যশস্যের উত্পাদন বাড়ানোর বিষয়ে বেশ জোর দিয়েছে। সে অনুযায়ী এই অর্থবছরে খাদ্যশস্য উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা তিন কোটি ২২ লাখ মেট্রিক টনে প্রক্ষেপণ করেছে, যা আগের ২০০৮-০৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮.১ শতাংশ বেশি। সরকার সত্যিকার অর্থেই কৃষিখাতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতার সমাধানেও মনোযোগ দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই সরকার সারের দাম সমন্বয় করে অর্থাত্ কমিয়ে তার একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। নবনির্বাচিত সরকার সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ইউরিয়া-বহির্ভূত সারে ভর্তুকি প্রদান, সার সরবরাহের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধা অপসারণ এবং ডিজেল ও কেরোসিনে অব্যাহতভাবে ভর্তুকি দিয়ে কৃষি খাতে উত্পাদন খরচ কমানোর মতো সময়োপযোগী কিছু সঠিক নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সেদিকেও নিবিড় নজরদারির ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।
পুরো ২০০৯ সাল জুড়ে নতুন সরকার বারবার কৃষি খাতে নীতি-সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই আসে সরকারের নেওয়া আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বা কার্যক্রমের কথা, যেখানে কৃষিকে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তিন হাজার ৪২৪ কোটি টাকার এই আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বা কার্যক্রমে দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় কৃষি খাতে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য। যা আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বা কার্যক্রমের ৬৯ শতাংশ। চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৭.৮ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয় মত্স্য, পশুপালন ও পানিসম্পদসহ সার্বিকভাবে কৃষি খাতের জন্য। বাজেটে সেচ-ব্যবস্থার সম্প্রসারণসহ কৃষি খাতে অবকাঠামো জোরদারকরণ, আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো ও নদীভাঙন রোধের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে কৃষি ও গ্রামীণ অবকাঠামো জোরদার করতে এডিপির আওতায় বরাদ্দ করা হয় এক হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। কৃষি খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতিতে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে এ জন্য বরাদ্দ করা হয় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সে আলোকে ২০০৯ সালের নভেম্বরে এসে আবার সারের দাম কমানো হয়। এবার প্রতি কেজি টিএসপি সার ২২, এমওপি ২৫ ও ডিএপি ৩০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়, যা একই বছরের এপ্রিলে দাম কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছিল যথাক্রমে ৪০, ৩৫ ও ৪০ টাকায়।
সরকার উচ্চফলনশীল (উফশী) বীজের উদ্ভাবন ও উন্নয়ন এবং কৃষিপণ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা বাড়াতে ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শস্য উত্পাদনে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার কৃষি গবেষণা ও কৃষি খাতে পুনর্বাসন সহায়তা বাবদ ১৮৫ কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বাজেট মিলিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা।
নতুন সরকার কৃষি ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়ানো এবং কৃষকেরা যাতে সহজে ও সময়মতো কৃষি ঋণ গ্রহণের সুযোগ পায়, সে বিষয়ে বিশেষভাবে জোর দিয়েছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সালে ‘কৃষি/পল্লি ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি নীতি-নির্দেশনা জারি করে। এই নীতি-কর্মসূচিতে এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক শস্য উত্পাদন, কৃষকদের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ, সফল কৃষকদের স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ্যে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করেছে, যা এর আগের ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৯ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা।
কৃষি খাতে আরো কিছু জরুরি নীতি-পদক্ষেপ গ্রহনের বিষয়টি লক্ষ্যনীয়। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো, কৃষকদের নিয়ে একটি সহজে ব্যবহারযোগ্য সমন্বিত ডাটাবেজ বা উপাত্ত-ভান্ডার তৈরি করা। সরকার কৃষি খাত নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কৌশল হাতে নিয়ে নিয়েছে এবং সে অনুযায়ী কৃষকদের দোরগোড়ায় সময়মতো সঠিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও উপকরণ পৌঁছে দেবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সরকার কৃষি বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উত্পাদক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য ন্যায্যদামে কৃষিপণ্যের বেচাকেনার প্রক্রিয়া খুঁজে বের করার লক্ষ্যেও কাজ করছে। আমরা যদ্দুর জানি, কৃষক ও ভোক্তাদের স্বার্থ সমুন্নত রেখে কৃষিপণ্যের বিপণন কার্যক্রম জোরদারের ব্যাপারে গাইডলাইন বা দিক-নির্দেশনা দিতে ‘এগ্রিকালচার প্রাইস কমিশন’ নামে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
কৃষি খাতের উন্নয়নে বর্তমান সরকার সঠিক ইস্যুগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি নীতি-পদক্ষেপও গ্রহণ করে আসছে। কিন্তু তা কতটা কাজে লাগছে সেটিও কিন্তু দেখতে হবে। কারণ অতীতে বারবার দেখা গেছে, সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করলেও কার্যকর তদারকির অভাবে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। বাণিজ্য শর্ত (টার্মস অব ট্রেড) বিষয়েও সরকারের একটি সুসমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত। তবে এই প্রক্রিয়ায় সরকারের সামনে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে। যেমন—বিতরণ নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপনা, বাজারমূল্য ও ভোক্তাদের কাঙ্ক্ষিত দামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে বাজারচালিত পথ ধরে সমাধানসূত্র খোঁজা। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সময়মতো সম্পদের জোগান নিশ্চিত করা।
সরকারের উচিত, কৃষি খাতের সংস্কার সাধন ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতকেও সম্পৃক্ত করা। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতকে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক কৃষিতে আকৃষ্ট করতে হবে, যাতে আবাদযোগ্য জমির সবটাই ব্যবহার করা যায় ও তাদের বিনিয়োগও হয়ে ওঠে লাভজনক। সময়মতো কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও বিতরণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কৃষকদের কাছে ভর্তুকি পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ছাড়া দেশব্যাপী যেহেতু ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) কার্যক্রম বিস্তৃত রয়েছে, সেহেতু কৃষি উপকরণ বিতরণে তাদেরও কাজে লাগানো যায়।
দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে উত্পাদকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে অতীতের মতো নীতি ও সুশাসনের ব্যর্থতা যেন পরিলক্ষিত না হয়, সেদিকেও নিবিড় নজরদারি চালাতে হবে। আমি নিশ্চিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সব সময়ই প্রবল উদ্দীপনা নিয়েই গ্রামীণ বাংলাদেশ তথা আমাদের প্রবৃদ্ধির নায়ক কৃষক-সমাজের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবেন এবং সোচ্চার থাকবেন।
[নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব]
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
সরকার চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে খাদ্যশস্যের উত্পাদন বাড়ানোর বিষয়ে বেশ জোর দিয়েছে। সে অনুযায়ী এই অর্থবছরে খাদ্যশস্য উত্পাদনের লক্ষ্যমাত্রা তিন কোটি ২২ লাখ মেট্রিক টনে প্রক্ষেপণ করেছে, যা আগের ২০০৮-০৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮.১ শতাংশ বেশি। সরকার সত্যিকার অর্থেই কৃষিখাতে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধকতার সমাধানেও মনোযোগ দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই সরকার সারের দাম সমন্বয় করে অর্থাত্ কমিয়ে তার একটি নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছে। নবনির্বাচিত সরকার সার ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় ইউরিয়া-বহির্ভূত সারে ভর্তুকি প্রদান, সার সরবরাহের ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধা অপসারণ এবং ডিজেল ও কেরোসিনে অব্যাহতভাবে ভর্তুকি দিয়ে কৃষি খাতে উত্পাদন খরচ কমানোর মতো সময়োপযোগী কিছু সঠিক নীতি-পদক্ষেপ গ্রহণ করার পাশাপাশি তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না, সেদিকেও নিবিড় নজরদারির ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে।
পুরো ২০০৯ সাল জুড়ে নতুন সরকার বারবার কৃষি খাতে নীতি-সহায়তা দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথমেই আসে সরকারের নেওয়া আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বা কার্যক্রমের কথা, যেখানে কৃষিকে অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তিন হাজার ৪২৪ কোটি টাকার এই আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বা কার্যক্রমে দেড় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয় কৃষি খাতে ভর্তুকি দেওয়ার জন্য। যা আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ বা কার্যক্রমের ৬৯ শতাংশ। চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের ৩০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ৭.৮ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ করা হয় মত্স্য, পশুপালন ও পানিসম্পদসহ সার্বিকভাবে কৃষি খাতের জন্য। বাজেটে সেচ-ব্যবস্থার সম্প্রসারণসহ কৃষি খাতে অবকাঠামো জোরদারকরণ, আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ বাড়ানো ও নদীভাঙন রোধের বিষয়ে জোর দেওয়া হয়। এ লক্ষ্যে কৃষি ও গ্রামীণ অবকাঠামো জোরদার করতে এডিপির আওতায় বরাদ্দ করা হয় এক হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। কৃষি খাতে ভর্তুকি অব্যাহত রাখার প্রতিশ্রুতিতে ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে এ জন্য বরাদ্দ করা হয় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা। সে আলোকে ২০০৯ সালের নভেম্বরে এসে আবার সারের দাম কমানো হয়। এবার প্রতি কেজি টিএসপি সার ২২, এমওপি ২৫ ও ডিএপি ৩০ টাকায় নির্ধারণ করা হয়, যা একই বছরের এপ্রিলে দাম কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছিল যথাক্রমে ৪০, ৩৫ ও ৪০ টাকায়।
সরকার উচ্চফলনশীল (উফশী) বীজের উদ্ভাবন ও উন্নয়ন এবং কৃষিপণ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা বাড়াতে ২৮০ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ বিভিন্ন প্রকল্প ও কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। শস্য উত্পাদনে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর লক্ষ্যে সরকার কৃষি গবেষণা ও কৃষি খাতে পুনর্বাসন সহায়তা বাবদ ১৮৫ কোটি ২১ লাখ টাকা বরাদ্দ করেছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বাজেট মিলিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৯৬৫ কোটি টাকা।
নতুন সরকার কৃষি ঋণ বিতরণের পরিমাণ বাড়ানো এবং কৃষকেরা যাতে সহজে ও সময়মতো কৃষি ঋণ গ্রহণের সুযোগ পায়, সে বিষয়ে বিশেষভাবে জোর দিয়েছে। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৯ সালে ‘কৃষি/পল্লি ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি নীতি-নির্দেশনা জারি করে। এই নীতি-কর্মসূচিতে এলাকা বা অঞ্চলভিত্তিক শস্য উত্পাদন, কৃষকদের মধ্যে সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ, সফল কৃষকদের স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকাশ্যে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার চলতি ২০০৯-১০ অর্থবছরের বাজেটে কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে ১০ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করেছে, যা এর আগের ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ছিল ৯ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা।
কৃষি খাতে আরো কিছু জরুরি নীতি-পদক্ষেপ গ্রহনের বিষয়টি লক্ষ্যনীয়। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো, কৃষকদের নিয়ে একটি সহজে ব্যবহারযোগ্য সমন্বিত ডাটাবেজ বা উপাত্ত-ভান্ডার তৈরি করা। সরকার কৃষি খাত নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন কৌশল হাতে নিয়ে নিয়েছে এবং সে অনুযায়ী কৃষকদের দোরগোড়ায় সময়মতো সঠিক কৃষি যন্ত্রপাতি ও উপকরণ পৌঁছে দেবে। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সরকার কৃষি বাজারের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং উত্পাদক ও ভোক্তা উভয়ের জন্য ন্যায্যদামে কৃষিপণ্যের বেচাকেনার প্রক্রিয়া খুঁজে বের করার লক্ষ্যেও কাজ করছে। আমরা যদ্দুর জানি, কৃষক ও ভোক্তাদের স্বার্থ সমুন্নত রেখে কৃষিপণ্যের বিপণন কার্যক্রম জোরদারের ব্যাপারে গাইডলাইন বা দিক-নির্দেশনা দিতে ‘এগ্রিকালচার প্রাইস কমিশন’ নামে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠনের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।
কৃষি খাতের উন্নয়নে বর্তমান সরকার সঠিক ইস্যুগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি নীতি-পদক্ষেপও গ্রহণ করে আসছে। কিন্তু তা কতটা কাজে লাগছে সেটিও কিন্তু দেখতে হবে। কারণ অতীতে বারবার দেখা গেছে, সরকার নীতিমালা প্রণয়ন করলেও কার্যকর তদারকির অভাবে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়নি। বাণিজ্য শর্ত (টার্মস অব ট্রেড) বিষয়েও সরকারের একটি সুসমন্বিত নীতিমালা গ্রহণ করা উচিত। তবে এই প্রক্রিয়ায় সরকারের সামনে কিছু বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে। যেমন—বিতরণ নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপনা, বাজারমূল্য ও ভোক্তাদের কাঙ্ক্ষিত দামের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার মাধ্যমে বাজারচালিত পথ ধরে সমাধানসূত্র খোঁজা। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সময়মতো সম্পদের জোগান নিশ্চিত করা।
সরকারের উচিত, কৃষি খাতের সংস্কার সাধন ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেসরকারি খাতকেও সম্পৃক্ত করা। সেই সঙ্গে বেসরকারি খাতকে ক্রমান্বয়ে বাণিজ্যিক কৃষিতে আকৃষ্ট করতে হবে, যাতে আবাদযোগ্য জমির সবটাই ব্যবহার করা যায় ও তাদের বিনিয়োগও হয়ে ওঠে লাভজনক। সময়মতো কৃষি উপকরণ সরবরাহ ও বিতরণের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কৃষকদের কাছে ভর্তুকি পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক আর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এ ছাড়া দেশব্যাপী যেহেতু ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান (এমএফআই) ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর (এনজিও) কার্যক্রম বিস্তৃত রয়েছে, সেহেতু কৃষি উপকরণ বিতরণে তাদেরও কাজে লাগানো যায়।
দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে উত্পাদকদের জন্য পর্যাপ্ত প্রণোদনার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে অতীতের মতো নীতি ও সুশাসনের ব্যর্থতা যেন পরিলক্ষিত না হয়, সেদিকেও নিবিড় নজরদারি চালাতে হবে। আমি নিশ্চিত, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী সব সময়ই প্রবল উদ্দীপনা নিয়েই গ্রামীণ বাংলাদেশ তথা আমাদের প্রবৃদ্ধির নায়ক কৃষক-সমাজের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবেন এবং সোচ্চার থাকবেন।
[নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব]
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক।
No comments