তবু শুভ শরত্ by আশরাফুলহক

আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ, আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা—
নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা\
এসো গো শারদলক্ষ্মী, তোমার শুভ্র মেঘের রথে,
এসো নির্মল নীলপথে।
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আজকের আকাশ সুনীল হয়তো বা, হয়তো বা তার বুকে ভেসে বেড়ানো মেঘগুলো আজও শাদা, যেমন থাকার কথা শরতে। কিন্তু ধোঁয়া আর ধুলোয় ভরা বায়ুমণ্ডলের ওপারের আকাশ যেমন নগরবাসীর চোখে নীল নয়, তেমনি মেঘও শাদা নয়। আর এই শহরে ধানক্ষেত নেই যে তাতে রৌদ্রছায়া লুকোচুরি খেলা করবে। তাই শরত্ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই, লুকোচুরি খেলা—/নীল আকাশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা রে ভাই—লুকোচুরি খেলা\’ অপূর্ব এই কথাগুলো যদি কোনো নগরবাসীকে দোলা না দেয়, তাহলে দোষ দেওয়া যাবে না। তবে হূদয়ের তাগিদে কিংবা অভ্যাবসত এই কথাগুলোয় অনেকের মতো আজও আমার মন দোলে, যেমন দুলতো শৈশবে, যখন গ্রামে ছিলাম। সেখানকার শরতে সুনীল আকাশে তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়ায়। ঝিরঝির বাতাস, সবুজ ধানক্ষেত, কখনো একপশলা বৃষ্টি, মুহূর্তেই আবার মেঘমুক্ত আকাশ। আকাশ নীলে মন হারিয়ে জেগে ওঠে মন। কিন্তু এই নগরে ‘মন হারিয়ে জেগে ওঠা মন’-এর শরত্ আসে না। এখানে কাশফুল নেই, শিউলি-সুরভি রাত বা শিউলি-কুড়ানো সকাল নেই। তবে প্রকৃতি শরতের কথা না বললেও ক্যালেন্ডারের দিন-তারিখ বলছে, আজ শরতের প্রথম দিন। তাই সবাইকে—‘শুভ শরত্’। বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুর মধ্যে শরতের রূপের স্নিগ্ধতা সবচেয়ে বেশি। উত্তপ্ত গ্রীষ্ম আর বৃষ্টি-কাদায় মাখামাখি বর্ষার পর শরত্ যেন নিয়ে আসে অনাবিল প্রশান্তি। কবির ভাষায়—
স্নেহ হাসি শরত্ আসে
পূর্ণিমা মালিকা
সকল বন আকুল করে
শুভ্র শেফালিকা।
এমন স্নেহ হাসির অনাবিল শরত্ এই নগরে আসে না। অবশ্য বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রভাব সব জায়গায়ই কম-বেশি পড়েছে। ঋতুচক্রের ধারাই পাল্টে গেছে। আর এবার তো বসন্ত থেকেই প্রচণ্ড তাপে পুড়ে যাচ্ছে দেশ, বর্ষায়ও মাটি তেমন সিক্ত হলো না। সেখানে শরত্ কী বয়ে আনবে বোঝা দায়। বোধকরি সামনে রুক্ষশ্রী শরত্ দাঁড়িয়ে! শরতের বর্তমান রূপ বড্ড জ্বালাধরা। আর রাজধানীর শরত্-চিত্র সে না বলাই ভালো।
তবুও শরত্কাল। যাকে নিয়ে কবি-সাহিত্যিকদের হাজারো কল্পনা, হাজারো সৃষ্টি। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ যতভাবে শরেক উপস্থাপন করেছেন—তাঁর গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, নিবন্ধে ও চিঠিতে; তাতে মুগ্ধ মন-প্রাণ। ফলে এই নাগরিক ব্যস্ততায়ও শরেক স্বাগত জানাতেই হয়। যদিও এই যান্ত্রিক নগরে প্রকৃতির রূপ উপভোগ করা দুষ্কর। ক্যালেন্ডারে দিন-তারিখ না গুনে বোঝাই মুশকিল কখন কোন ঋতু। এখানে বাতাসে বিষ, আকাশে...আকাশ কোথা পাই! এখানকার বাড়িগুলোয় বারান্দা নেই, থাকলেও সেখানে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখা যায় না। দেখা যায় অন্য কোনো বাড়ির দেয়াল। পথে নেমেও শান্তি নেই, যান আর জনজটের চাপে প্রাণ ওষ্ঠাগত।
শরতের পরিচয় বহনকারী দুটি ফুল—শিউলি আর কাশ। নতুন প্রজন্ম এদের দেখেছে ছবিতে বা টিভিতে। তা ছাড়া উপায় কী? শিউলির টুকটাক দেখা পাওয়া গেলেও কাশফুল তো হারিয়েই গেছে, কদাচ নদীর চরে এর দেখা মেলে। এই বৃষ্টি, এই রোদ, অতঃপর আকাশজুড়ে বর্ণিল রংধনু—শরতের চিরায়ত এই রূপটি দেখার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনি, কিন্তু দেখা মেলে না। তবে একটি ব্যাপার থেকে নগরবাসী মোটেও বঞ্চিত হয় না। আর তা হচ্ছে ভাদ্রের তালপাকা ভ্যাপসা গরম। তালপাকা গরম থেকে বঞ্চিত না হলেও তালের বিভিন্ন রকম পিঠা-পায়েশ থেকে অধিকাংশ নগরবাসী ঠিকই বঞ্চিত।
যা-ই হোক এই শরত্কালকে ঘিরে কিছু সংস্কার এখনো মেনে চলে গ্রামের মানুষ। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের মানুষ ভাদ্রের প্রথম ১৩ দিন নতুন বউকে শ্বশুরবাড়ি থাকতে দেয় না, ‘টের্যা’ (আঞ্চলিক শব্দ, ‘অশুভ’ ১৩ থেকে এ শব্দের উত্পত্তি) কাটিয়ে আসার জন্য বাপেরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তারা এই সময়টুকুকে অশুভ মনে করে। আবার ভাদ্রের পূর্ণিমাকে নষ্ট পূর্ণিমা মনে করা হয়। অন্যদিকে আশ্বিনের পূর্ণিমা বছরের সবচেয়ে শুভ ও সুন্দর পূর্ণিমা হিসেবে আখ্যায়িত। এই পূর্ণিমাকে ‘কোজাগর’ বলা হয়। শারদীয় এই পূর্ণিমায় হিন্দু সম্প্রদায় লক্ষ্মীপূজা পালন করে। শরতের চাঁদকে বলা হয়শরদিন্দু।
একসময় আশ্বিনেই একটু একটু ঠান্ডা অনুভূত হতো। গ্রামের বাড়িতে প্রবীণদের বলতে শুনেছি, ‘আশ্বিন, গা করে শিনশিন’। এখন সেই সব কথা শোনা যায় না, সেই সব কথার সঙ্গে কিছু মেলেও না। মানুষ নিজের আরাম-আয়েশের জন্য ক্রমাগত কার্বন ডাই-অক্সাইড উত্পাদন করে আর গাছপালা কেটে প্রকৃতিকে বদলে দিয়েছে।
তবুও শরত্ এসেছে। ঢাকায় না হোক, ঢাকার বাইরে কোথাও কোথাও নিশ্চয়ই এই শরত্ নিয়ে এসেছে সুনীল আকাশ, শ্যামল কানন, শিউলি-সৌরভ এমনি আরও কত শত প্রাকৃতিক উপহার। তাই নাগরিক ব্যস্ততাকে ছুটি দিয়ে কয়েকটা দিন বের করে সেই সব সৌন্দর্যকে উপভোগ করতে নির্জন গ্রামের পথ ধরুন, যেখানে নদীর তীরে কাশফুল আছে, যেখানে প্রকৃতি আপনি এসে ছোঁয়া দিয়ে যায়।
aurka.dhaka@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.