ন্যায় ও ইতিহাস -দুনিয়ার এ কী হলো by এদুয়ার্দো গালিয়ানো
কিছু
প্রশ্ন আমার মাথার মধ্যে মাছির মতো ভনভন করছে, সেগুলো নিয়ে আপনাদের সঙ্গে
সলাপরামর্শ করতে চাই। দুনিয়া থেকে কি ন্যায়বিচার উধাও হয়ে গেছে?
জর্জ বুশের দিকে জুতা ছুড়ে মেরেছিল ইরাকের যে সাহসী লোকটি তার তিন বছরের কারাবাসের শাস্তি হয়েছে। কিন্তু তাঁকে একটি মেডেল উপহার দেওয়াই কি উচিত ছিল না? কে সন্ত্রাসী—জুতা নিক্ষেপকারী, নাকি যার গায়ে তা লেগেছে সে? সেই পেশাদার খুনিই কি আসল সন্ত্রাসী নয় যে মিথ্যা অজুহাতে ইরাকে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, ভয়াবহ গণহত্যা করেছে এবং আইন পাস করে নির্যাতনের হুকুম দিয়েছে?
কে অপরাধী—মেক্সিকোর আতেনকো, চিলির মাপুচে, গুয়াতেমালার কেকচি আদিবাসী আর ব্রাজিলের ভূমিহীনেরা? নিজেদের জমির হক প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করার অপরাধে যাদের সন্ত্রাসবাদী বলে দোষা হচ্ছে? যদি মাটি পবিত্র হয়ে থাকে তবে আইন যা বলে বলুক, সেই ভূমিপুত্ররাও পবিত্র নয় কি?
মার্কিন ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের চোখে সোমালিয়া হলো বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান। কে আসল জলদস্যু? সেসব ক্ষুধার্ত মানুষ, যারা জাহাজে হামলা চালায় তারা? নাকি বছরের পর বছর প্রস্তুতি নিয়ে এক আক্রমণে দুনিয়াকে দেউলিয়া করে দেওয়া ওয়ালস্ট্রিটের ফটকাবাজরা? আজ তাদেরই দেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ! এসব ব্যাংকডাকাতদের কেন এত বড় ইনাম দেওয়া হচ্ছে? ন্যায়বিচারের দেবী কি তাহলে একচোখা? বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী করপোরেশন ওয়াল মার্ট ট্রেড ইউনিয়নকে নিষিদ্ধ করেছে। ম্যাগডোনাল্ডও তা-ই। কীভাবে এসব কোম্পানি আইনের পরোয়া না করে যা খুশি তা করে যেতে পারে? কারণ, আজকের দুনিয়ায় কাজের থেকে অকাজের দাম বেশি, আবর্জনার থেকে কম দাম শ্রমিকের অধিকারের।
কে তাহলে সত্ আর কে খলনায়ক? আন্তর্জাতিক আইন যদি থাকবেই, তাহলে কেন শক্তিমানদের কৃতকর্মের কোনো বিচার কখনো হয় না? মানুষ হত্যায় সেরা কসাইদের কেন কখনো জেলে পোরা হয় না। এর কারণ হলো, জেলখানার চাবি যে তাদেরই হাতে!
জাতিসংঘে কিসের জোরে পাঁচটি রাষ্ট্রের ভেটো-ক্ষমতা অলঙ্ঘনীয়? তাদের এই ক্ষমতা কি ঈশ্বরের দান? যুদ্ধ যাদের ব্যবসা, তাদের হাতে কি আপনি শান্তিরক্ষার ভার দেবেন? বিশ্বের সর্বোচ্চ অস্ত্র বানানো দেশগুলোর হাতেই থাকবে বিশ্বশান্তির দায়িত্ব, এটা কেমন বিধান? যারা মাদক চোরাচালানের হোতা, তাদের বাদ দিয়ে কীভাবে আমরা সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধাচরণ করি?
দুনিয়ার স্বেচ্ছাচারী মোড়লেরা যখন এতই হত্যাপ্রেমী, তখন কেন আমরা প্রার্থনা করি তারা যাতে সামাজিক অবিচার ছেড়ে ভালো হয়ে যায়? এটা কি সেই দুনিয়া নয়, যেখানে প্রতি মিনিটে সামরিক খাতে ২১০ কোটি টাকা নষ্ট হয় অথচ সামান্য অসুখে বা না খেয়ে প্রতি মিনিটে মারা যায় ১৫টি শিশু? কার বিরুদ্ধে তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অস্ত্র শাণ দিয়ে চলেছে? তাদের নিশানায় কী: মানুষের দারিদ্র্য, না দরিদ্র মানুষ?
যারা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে মাতম করতে ওস্তাদ, তারা কেন বাজারিপনার বিরুদ্ধে তাদের মনের ঝাল মেটায় না, যে বাজারি মূল্যবোধ প্রতিমুহূর্তে জননিরাপত্তাকে হুমকিগ্রস্ত করছে? একটানা বর্ষিত হওয়া বোমার মতো বিজ্ঞাপনগুলো কি মানুষকে অপরাধী হতে ডাক দেয় না? এই বোমাবর্ষণের শব্দে কোটি কোটি বেকার বা সামান্য মজুরি পাওয়া তরুণরা আর কিছু শুনতে পারে না। তাদের শেখানো হয় এই মিথ্যা যে, ‘কিছু একটা হওয়া=কিছু একটা পাওয়া’। শেখায় গাড়ি বা ব্র্যান্ডের জুতার মালিক হওয়াই জীবনের একমাত্র মানে। তারা বলতে থাকে, কেন কেন কেন, না কিনলে তুমি তো কিছুই না। তাই কি? মানুষ মানে কি তাহলে জুতা, গাড়ি, ব্র্যান্ড; আমি নিজে কি তাহলে কিছুই না, নাথিং?
হত্যাকারীর পাশাপাশি কেন হত্যাকাণ্ডেরই মৃত্যুদণ্ড হয় না? আজকের দুনিয়ার সব আয়োজনই তো হত্যার জন্য সংগঠিত। অস্ত্র কোম্পানি ও মিলিটারি-চক্র হত্যার কারখানা বসিয়ে রেখেছে। সত্য নয় কি যে এর জন্যই আমাদের যাবতীয় সম্পদ ও শক্তির বেশির ভাগই খরচ হয়ে যাচ্ছে? তারপরও দুনিয়ার প্রভুরা কেবল অন্যের সন্ত্রাসকেই নিন্দা জানায়, কিন্তু নিজেরা করলে নাম হয় ‘মানবিক হস্তক্ষেপ’। আর কি বিশ্বাস করা যায় যে মানুষ আশাবাদী প্রাণী? বিশ্বে আমরাই একমাত্র জীব যারা ঠান্ডা মাথায় বিনা প্রয়োজনে অন্য মানুষকে হত্যা করেও খুশি থাকি। আমরা এমন ধ্বংসশক্তি অর্জন করেছি বানিয়েছি এমন প্রযুক্তি, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আমাদের এই সাধের গ্রহটি সব অধিবাসীসমেত ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে!
ভয় জাগিয়ে রেখেই টিকে আছে এই প্রযুক্তি। শত্রুর ভয়ের জুজু দেখিয়েই সেনা ও পুলিশের নামে বিপুল সম্পদ ওড়ানো হয়। কেন আমরা এই ভয়ের রাজত্বকে চিরবিদায় দিতে পারি না? এভাবেই পেশাদার আতঙ্কবাজদের অপশাসন থেকে বেরিয়ে আসার যোগ্যতা হবে আমাদের। এই ভয়ের বীজ বপনকারীরা আমাদের ছুড়ে ফেলে একাকিত্বের মধ্যে। এক জাতি অন্য জাতিকে, এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে ভয় করতে করতে একা হয়ে যায়। তারা শেখায় এই দুনিয়া হলো কুকুর কুকুরের মাংস খাওয়া দুনিয়া। শেখায় যে প্রতিবেশীর কাছ থেকেই নাকি আসবে বিপদ। দিনরাত সতর্ক করে যে বাচ্চার দোলনার নিচেই নাকি রয়েছে ‘জঙ্গি-বোমা’। বলে, ওই তরুণটি দেখতে নিরীহ হলেও কিন্তু সন্ত্রাসী, ওই ভালো মানুষ প্রতিবেশিনী নাকি নিশ্চিতভাবে আমার মধ্যে সোয়াইন ফ্লুর ভাইরাস ঢুকিয়ে দেবে।
এই ওল্টানো দুনিয়ায় অতি সাধারণ ভালো কাজকেও ভয়ঙ্কর বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। যখন বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস তাঁর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসীদের লজ্জার হাত থেকে, বঞ্চনার হাত থেকে বাঁচাতে দেশ পুনর্গঠনে নামলেন, সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করা হলো চরমাতঙ্ক। যারা বর্ণবাদী, যারা বংশপরম্পরায় মনে করে দেশের সহায়-সম্পদ কেবল তাদেরই জন্য, তাদের অবশ্যই আতঙ্কিত হওয়ার আছে। যখন ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট কোরেয়া তাঁর দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অবৈধ ঋণ শোধ করতে অস্বীকার করলেন, সুদি প্রতিষ্ঠানগুলো কেঁপে উঠল। এ রকম দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য ইকুয়েডরকে চরম শাস্তি দেওয়া হবে বলে শাঁসানোও হলো। যখন আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো সামরিক স্বৈরতন্ত্র ও লুটেরা রাজনীতিবিদদের সর্বদাই প্রশ্রয় দিয়ে যায়, যখন তাদের শাসন টেকানোর জন্য জনগণের নামে ঋণ নেওয়া হয়, তখনই কি আমরা সেই চরম শাস্তি বরণ করে নিইনি? তখনই কি ঠিক হয়নি যে, ধনীদের ভোগবিলাস চালানোয় ঋণের জোয়াল টানবে সাধারণ মানুষ? এই ঋণ যে অবৈধ, তা কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায়।
কাণ্ডজ্ঞান আর ন্যায়বিচার পরস্পর সম্পর্কিত। কাণ্ডজ্ঞান বলে, যে দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মাদকাসক্ত, সেই দেশের কী অধিকার রয়েছে অন্য দেশে মাদকবিরোধী অভিযান চালানোর?
আজ অনেকেরই মন খারাপ। কারণ আর্থিক মন্দার কারণে গাড়ি বিক্রি কমে গেছে। কারও যদি সামান্য কাণ্ডজ্ঞান থাকে তো তিনি বুঝবেন এটা একটা খুশির খবর। কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন যে গাড়ির সংখ্যা কমা মানে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার কম হওয়া, পৃথিবীর ধমনিতে কিছুটা কম বিষ মিশ্রিত হওয়া। অস্বীকার করা অসম্ভব যে এর ফলে পায়ে হাঁটা মানুষের সংখ্যা বাড়বে এবং তারা আরও বেশি দিন বাঁচবে।
লুইস ক্যারলের এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের কাহিনীতে রানি অ্যালিসকে বোঝান যে আয়নামহলের রূপকথার রাজ্যে ন্যায়বিচার আছে:
‘সেখানে রাজদূত আছেন একজন। শাস্তি হিসেবে তিনি এখন কয়েদখানায় বন্দী: তবে বিচার শুরু হবে আগামী বুধবারে: এবং এটা নিশ্চিত যে সবার শেষেই হবে অপরাধের বিচার।’
এল সালভাদরের প্রধান পুরোহিত অস্কার আর্নুলফো রোমেরো দেখলেন যে আইন হলো সাপের মতো, কেবল খালি পায়ের মানুষদেরই কামড়ায়। তিনি মারা যান গুলিতে আহত হয়ে। তাঁর অপরাধ একটাই; তিনি বলেছিলেন, তাঁর দেশে গরিবেরা আজন্ম বঞ্চনা ও দুর্ভাগ্যের শিকার।
সেই এল সালভাদরে এখন গরিবদের দল ক্ষমতায়। এক দিক থেকে গত নির্বাচনের ফল আর্চবিশপ রোমেরোসহ তাঁর মতো হাজার হাজার মানুষের প্রতি জাতির শ্রদ্ধাঞ্জলি, যারা অবিচারের রাজ্যে নায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বিসর্জন করে লড়ে গেছে।
কখনো কখনো ইতিহাসের কাহিনী মর্মান্তিকভাবে থেমে যায়, কিন্তু ইতিহাস কখনো ফুরায় না। সে যখন বলে বিদায়, তার মানে সে বলছে: আমি আবার আসব।
(কাউন্টার পাঞ্চ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ)
এদুয়ার্দো গালিয়ানো: উরুগুয়ের সাহিত্যিক-সাংবাদিক, ল্যাটিন আমেরিকার জনপ্রিয় লেখক। তাঁর বিখ্যাত বই ওপেন ভেইনস অব ল্যাটিন আমেরিকা। সম্প্রতি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ এই বইটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে উপহার দিলে বইটি আন্তর্জাতিক বিক্রি তালিকার শীর্ষে উঠে যায়।
জর্জ বুশের দিকে জুতা ছুড়ে মেরেছিল ইরাকের যে সাহসী লোকটি তার তিন বছরের কারাবাসের শাস্তি হয়েছে। কিন্তু তাঁকে একটি মেডেল উপহার দেওয়াই কি উচিত ছিল না? কে সন্ত্রাসী—জুতা নিক্ষেপকারী, নাকি যার গায়ে তা লেগেছে সে? সেই পেশাদার খুনিই কি আসল সন্ত্রাসী নয় যে মিথ্যা অজুহাতে ইরাকে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, ভয়াবহ গণহত্যা করেছে এবং আইন পাস করে নির্যাতনের হুকুম দিয়েছে?
কে অপরাধী—মেক্সিকোর আতেনকো, চিলির মাপুচে, গুয়াতেমালার কেকচি আদিবাসী আর ব্রাজিলের ভূমিহীনেরা? নিজেদের জমির হক প্রতিষ্ঠায় সংগ্রাম করার অপরাধে যাদের সন্ত্রাসবাদী বলে দোষা হচ্ছে? যদি মাটি পবিত্র হয়ে থাকে তবে আইন যা বলে বলুক, সেই ভূমিপুত্ররাও পবিত্র নয় কি?
মার্কিন ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের চোখে সোমালিয়া হলো বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক স্থান। কে আসল জলদস্যু? সেসব ক্ষুধার্ত মানুষ, যারা জাহাজে হামলা চালায় তারা? নাকি বছরের পর বছর প্রস্তুতি নিয়ে এক আক্রমণে দুনিয়াকে দেউলিয়া করে দেওয়া ওয়ালস্ট্রিটের ফটকাবাজরা? আজ তাদেরই দেওয়া হচ্ছে কোটি কোটি ডলারের ক্ষতিপূরণ! এসব ব্যাংকডাকাতদের কেন এত বড় ইনাম দেওয়া হচ্ছে? ন্যায়বিচারের দেবী কি তাহলে একচোখা? বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী করপোরেশন ওয়াল মার্ট ট্রেড ইউনিয়নকে নিষিদ্ধ করেছে। ম্যাগডোনাল্ডও তা-ই। কীভাবে এসব কোম্পানি আইনের পরোয়া না করে যা খুশি তা করে যেতে পারে? কারণ, আজকের দুনিয়ায় কাজের থেকে অকাজের দাম বেশি, আবর্জনার থেকে কম দাম শ্রমিকের অধিকারের।
কে তাহলে সত্ আর কে খলনায়ক? আন্তর্জাতিক আইন যদি থাকবেই, তাহলে কেন শক্তিমানদের কৃতকর্মের কোনো বিচার কখনো হয় না? মানুষ হত্যায় সেরা কসাইদের কেন কখনো জেলে পোরা হয় না। এর কারণ হলো, জেলখানার চাবি যে তাদেরই হাতে!
জাতিসংঘে কিসের জোরে পাঁচটি রাষ্ট্রের ভেটো-ক্ষমতা অলঙ্ঘনীয়? তাদের এই ক্ষমতা কি ঈশ্বরের দান? যুদ্ধ যাদের ব্যবসা, তাদের হাতে কি আপনি শান্তিরক্ষার ভার দেবেন? বিশ্বের সর্বোচ্চ অস্ত্র বানানো দেশগুলোর হাতেই থাকবে বিশ্বশান্তির দায়িত্ব, এটা কেমন বিধান? যারা মাদক চোরাচালানের হোতা, তাদের বাদ দিয়ে কীভাবে আমরা সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধাচরণ করি?
দুনিয়ার স্বেচ্ছাচারী মোড়লেরা যখন এতই হত্যাপ্রেমী, তখন কেন আমরা প্রার্থনা করি তারা যাতে সামাজিক অবিচার ছেড়ে ভালো হয়ে যায়? এটা কি সেই দুনিয়া নয়, যেখানে প্রতি মিনিটে সামরিক খাতে ২১০ কোটি টাকা নষ্ট হয় অথচ সামান্য অসুখে বা না খেয়ে প্রতি মিনিটে মারা যায় ১৫টি শিশু? কার বিরুদ্ধে তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অস্ত্র শাণ দিয়ে চলেছে? তাদের নিশানায় কী: মানুষের দারিদ্র্য, না দরিদ্র মানুষ?
যারা মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে মাতম করতে ওস্তাদ, তারা কেন বাজারিপনার বিরুদ্ধে তাদের মনের ঝাল মেটায় না, যে বাজারি মূল্যবোধ প্রতিমুহূর্তে জননিরাপত্তাকে হুমকিগ্রস্ত করছে? একটানা বর্ষিত হওয়া বোমার মতো বিজ্ঞাপনগুলো কি মানুষকে অপরাধী হতে ডাক দেয় না? এই বোমাবর্ষণের শব্দে কোটি কোটি বেকার বা সামান্য মজুরি পাওয়া তরুণরা আর কিছু শুনতে পারে না। তাদের শেখানো হয় এই মিথ্যা যে, ‘কিছু একটা হওয়া=কিছু একটা পাওয়া’। শেখায় গাড়ি বা ব্র্যান্ডের জুতার মালিক হওয়াই জীবনের একমাত্র মানে। তারা বলতে থাকে, কেন কেন কেন, না কিনলে তুমি তো কিছুই না। তাই কি? মানুষ মানে কি তাহলে জুতা, গাড়ি, ব্র্যান্ড; আমি নিজে কি তাহলে কিছুই না, নাথিং?
হত্যাকারীর পাশাপাশি কেন হত্যাকাণ্ডেরই মৃত্যুদণ্ড হয় না? আজকের দুনিয়ার সব আয়োজনই তো হত্যার জন্য সংগঠিত। অস্ত্র কোম্পানি ও মিলিটারি-চক্র হত্যার কারখানা বসিয়ে রেখেছে। সত্য নয় কি যে এর জন্যই আমাদের যাবতীয় সম্পদ ও শক্তির বেশির ভাগই খরচ হয়ে যাচ্ছে? তারপরও দুনিয়ার প্রভুরা কেবল অন্যের সন্ত্রাসকেই নিন্দা জানায়, কিন্তু নিজেরা করলে নাম হয় ‘মানবিক হস্তক্ষেপ’। আর কি বিশ্বাস করা যায় যে মানুষ আশাবাদী প্রাণী? বিশ্বে আমরাই একমাত্র জীব যারা ঠান্ডা মাথায় বিনা প্রয়োজনে অন্য মানুষকে হত্যা করেও খুশি থাকি। আমরা এমন ধ্বংসশক্তি অর্জন করেছি বানিয়েছি এমন প্রযুক্তি, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আমাদের এই সাধের গ্রহটি সব অধিবাসীসমেত ধ্বংসের দিকে যাচ্ছে!
ভয় জাগিয়ে রেখেই টিকে আছে এই প্রযুক্তি। শত্রুর ভয়ের জুজু দেখিয়েই সেনা ও পুলিশের নামে বিপুল সম্পদ ওড়ানো হয়। কেন আমরা এই ভয়ের রাজত্বকে চিরবিদায় দিতে পারি না? এভাবেই পেশাদার আতঙ্কবাজদের অপশাসন থেকে বেরিয়ে আসার যোগ্যতা হবে আমাদের। এই ভয়ের বীজ বপনকারীরা আমাদের ছুড়ে ফেলে একাকিত্বের মধ্যে। এক জাতি অন্য জাতিকে, এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে ভয় করতে করতে একা হয়ে যায়। তারা শেখায় এই দুনিয়া হলো কুকুর কুকুরের মাংস খাওয়া দুনিয়া। শেখায় যে প্রতিবেশীর কাছ থেকেই নাকি আসবে বিপদ। দিনরাত সতর্ক করে যে বাচ্চার দোলনার নিচেই নাকি রয়েছে ‘জঙ্গি-বোমা’। বলে, ওই তরুণটি দেখতে নিরীহ হলেও কিন্তু সন্ত্রাসী, ওই ভালো মানুষ প্রতিবেশিনী নাকি নিশ্চিতভাবে আমার মধ্যে সোয়াইন ফ্লুর ভাইরাস ঢুকিয়ে দেবে।
এই ওল্টানো দুনিয়ায় অতি সাধারণ ভালো কাজকেও ভয়ঙ্কর বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। যখন বলিভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইভো মোরালেস তাঁর দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসীদের লজ্জার হাত থেকে, বঞ্চনার হাত থেকে বাঁচাতে দেশ পুনর্গঠনে নামলেন, সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করা হলো চরমাতঙ্ক। যারা বর্ণবাদী, যারা বংশপরম্পরায় মনে করে দেশের সহায়-সম্পদ কেবল তাদেরই জন্য, তাদের অবশ্যই আতঙ্কিত হওয়ার আছে। যখন ইকুয়েডরের প্রেসিডেন্ট কোরেয়া তাঁর দেশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া অবৈধ ঋণ শোধ করতে অস্বীকার করলেন, সুদি প্রতিষ্ঠানগুলো কেঁপে উঠল। এ রকম দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য ইকুয়েডরকে চরম শাস্তি দেওয়া হবে বলে শাঁসানোও হলো। যখন আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো সামরিক স্বৈরতন্ত্র ও লুটেরা রাজনীতিবিদদের সর্বদাই প্রশ্রয় দিয়ে যায়, যখন তাদের শাসন টেকানোর জন্য জনগণের নামে ঋণ নেওয়া হয়, তখনই কি আমরা সেই চরম শাস্তি বরণ করে নিইনি? তখনই কি ঠিক হয়নি যে, ধনীদের ভোগবিলাস চালানোয় ঋণের জোয়াল টানবে সাধারণ মানুষ? এই ঋণ যে অবৈধ, তা কাণ্ডজ্ঞান দিয়েই বোঝা যায়।
কাণ্ডজ্ঞান আর ন্যায়বিচার পরস্পর সম্পর্কিত। কাণ্ডজ্ঞান বলে, যে দেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি মাদকাসক্ত, সেই দেশের কী অধিকার রয়েছে অন্য দেশে মাদকবিরোধী অভিযান চালানোর?
আজ অনেকেরই মন খারাপ। কারণ আর্থিক মন্দার কারণে গাড়ি বিক্রি কমে গেছে। কারও যদি সামান্য কাণ্ডজ্ঞান থাকে তো তিনি বুঝবেন এটা একটা খুশির খবর। কেউ কি অস্বীকার করতে পারবেন যে গাড়ির সংখ্যা কমা মানে প্রকৃতির ওপর অত্যাচার কম হওয়া, পৃথিবীর ধমনিতে কিছুটা কম বিষ মিশ্রিত হওয়া। অস্বীকার করা অসম্ভব যে এর ফলে পায়ে হাঁটা মানুষের সংখ্যা বাড়বে এবং তারা আরও বেশি দিন বাঁচবে।
লুইস ক্যারলের এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডের কাহিনীতে রানি অ্যালিসকে বোঝান যে আয়নামহলের রূপকথার রাজ্যে ন্যায়বিচার আছে:
‘সেখানে রাজদূত আছেন একজন। শাস্তি হিসেবে তিনি এখন কয়েদখানায় বন্দী: তবে বিচার শুরু হবে আগামী বুধবারে: এবং এটা নিশ্চিত যে সবার শেষেই হবে অপরাধের বিচার।’
এল সালভাদরের প্রধান পুরোহিত অস্কার আর্নুলফো রোমেরো দেখলেন যে আইন হলো সাপের মতো, কেবল খালি পায়ের মানুষদেরই কামড়ায়। তিনি মারা যান গুলিতে আহত হয়ে। তাঁর অপরাধ একটাই; তিনি বলেছিলেন, তাঁর দেশে গরিবেরা আজন্ম বঞ্চনা ও দুর্ভাগ্যের শিকার।
সেই এল সালভাদরে এখন গরিবদের দল ক্ষমতায়। এক দিক থেকে গত নির্বাচনের ফল আর্চবিশপ রোমেরোসহ তাঁর মতো হাজার হাজার মানুষের প্রতি জাতির শ্রদ্ধাঞ্জলি, যারা অবিচারের রাজ্যে নায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বিসর্জন করে লড়ে গেছে।
কখনো কখনো ইতিহাসের কাহিনী মর্মান্তিকভাবে থেমে যায়, কিন্তু ইতিহাস কখনো ফুরায় না। সে যখন বলে বিদায়, তার মানে সে বলছে: আমি আবার আসব।
(কাউন্টার পাঞ্চ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ)
এদুয়ার্দো গালিয়ানো: উরুগুয়ের সাহিত্যিক-সাংবাদিক, ল্যাটিন আমেরিকার জনপ্রিয় লেখক। তাঁর বিখ্যাত বই ওপেন ভেইনস অব ল্যাটিন আমেরিকা। সম্প্রতি ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ এই বইটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে উপহার দিলে বইটি আন্তর্জাতিক বিক্রি তালিকার শীর্ষে উঠে যায়।
No comments