টিপাইমুখে বাঁধ -সম্মিলিত নারীসমাজের একটি প্রতিবাদী সফর by ফরিদা আখতার
ভারতের টিপাইমুখে প্রস্তাবিত যে প্রকল্প হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে বাংলাদেশে সংগত কারণেই প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। আমরা যারা নারী-আন্দোলন করি, নারীর ওপর সকল প্রকার সহিংসতা ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই, আমরা আজ চুপ করে থাকতে পারছি না। তাই সম্মিলিত নারীসমাজ ১১ আগস্ট ঢাকা থেকে ট্রেনযোগে সিলেট হয়ে জকিগঞ্জে ২০ জন সদস্য নিয়ে একটি প্রতিবাদী সফর করে এসেছে। আমি ওই ২০ জনের একজন ছিলাম। আজ তাই কিছু কথা বলতে চাই।
প্রথমেই বলি ঢাকায় কমলাপুর স্টেশনের কথা। আমরা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাদের সহকর্মীরা কমলাপুর রেলস্টেশনে যে যাত্রী আসছে ও যাচ্ছে, তাদের হাতে লিফলেট ধরিয়ে দিলেন। লাল রঙের ব্যানার নিয়ে এতজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন দেখে উত্সুক জনগণ দাঁড়িয়ে গেল। কেউ এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল। যখন জানতে পারল যে আমরা সিলেট যাচ্ছি এবং জকিগঞ্জে যাব, বেশ খুশি হলো। বুঝলাম সবার মনেই উত্কণ্ঠা আছে, কিন্তু প্রতিবাদ জানানোর জায়গা সবার হয়তো নেই। তবে এমনও হয়েছে, কয়েকজন যুবক আমাদের কিছু জিজ্ঞেস না করে নিজেরাই বলছে, অ্যাই, টিপাইমুখ কী রে? অর্থাত্ তরুণরা অনেকেই হয়তো এ বিষয় জানে না কিংবা তাদের জানানোর মতো কোনো ফোরাম নেই। এ বিষয়টি আমাদের চিন্তিত করেছে। ট্রেনে ওঠার আগে আমাদের মেয়েরা অনেক স্লোগান দিল, মানুষ জড়ো হয়ে গেল এবং আমাদের প্রতি একধরনের সংহতি প্রকাশ করল। আমরা তারপর ট্রেনে উঠে গেলাম এবং ভোরে সিলেট এসে পৌঁছালাম।
সকাল থেকে বৃষ্টি। তবু আমাদের জকিগঞ্জে যেতেই হবে। তিনটি মাইক্রোবাসে করে আমরা প্রথমে অমলশিদ গেলাম। এখানে বিডিআর ক্যাম্প আছে। সিলেটে যারা আমাদের জকিগঞ্জ যেতে সহায়তা করেছে, তাদেরই পরামর্শে আমরা বরাক নদ থেকে যেটা সুরমা ও কুশিয়ারার উত্সস্থল, ঠিক সেই জায়গাটা দেখতে গিয়েছিলাম। হালকা বৃষ্টি ছিল, তবুও গাড়ি থেকে নেমে আমরা ঠিক নদীর পারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওপারে ভারতের কাঁটা তাঁরের বেড়া দেখা যাচ্ছে। বেড়ার ঠিক পরেই নদীতে একটি জিহ্বার মতো চর জেগেছে। স্থানীয় লোকজন জানাল, এই চর ভারত দখল করে রেখেছে। সেখানে বাংলাদেশের মানুষকে যেতে দেয় না। সীমান্ত আইনি ভাষায় এটাকে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ বলা হচ্ছে কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই। নো ম্যান্স ল্যান্ড তাহলে তো ভারতেরও নয়। তবুও ভারতই এটার ওপর দখলদারি। অদ্ভুত কাণ্ড!
জিহ্বা চরটি বেশ কিছুক্ষণ দেখলাম। সুরমা-কুশিয়ারার অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখা ভুলে গিয়ে মনে হচ্ছিল এটুকু চর জাগছে তাতেই যদি আমাদের দখল নিয়ে এত সমস্যা হয়, তাহলে বরাক নদের পানি প্রবাহ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত হলে সুরমা-কুশিয়ারার পানি কি আমাদের থাকবে? ‘জিহ্বা চর’ যেন প্রতীকী অর্থে প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের লিপসা প্রকাশ করছে। টিপাইমুখে বাঁধ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আজ আমাদের এই ছোট জিহ্বা চরের সমাধানও করে ফেলা উচিত নয় কি? কারণ, এটাই আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমাদের পানিসম্পদকে কেন্দ্র করে ভারতে কোনো প্রকল্প হলে সেটার ফলাফল কী হতে পারে। স্থানীয় খুব সাধারণ দু-একজন মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম—আচ্ছা, ওপারে বাঁধ হলে আপনাদের কি ভালো হবে? ‘না, কেমন করে ভালো হবে? আমাদের পানি তো থাকবে না।’ এর চেয়ে বেশি কথার প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞরাও যা বলবেন তারও সারমর্ম এই কথাই। সাধারণ মানুষের জীবনের উপলব্ধির চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে?
অমলশিদ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে জকিগঞ্জ। কিন্তু যাওয়ার পথে দেখা গেল একটি ব্রিজ ভাঙা। আমাদের গাড়ি কিছুতেই যেতে পারবে না, তাই টেম্পু নিতে হলো। এতজন মহিলা একসঙ্গে কোথায় যাচ্ছে? একটু যেন কৌতূহলের বিষয় ছিল সবার মধ্যে। আমাদের সঙ্গে ফটোগ্রাফার এবং স্থানীয়ভাবে সব আয়োজন করার জন্য যে কয়েকজন পুরুষ ছিলেন, তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় কম। কাজেই মহিলারাই চোখে পড়ার মতো ছিল। আর যাকেই বলছি আমরা ঢাকা থেকে এসেছি টিপাইমুখে বাঁধের ব্যাপারে এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করতে, সংহতি প্রকাশ করতে—তারাই আমাদের স্বাগত জানিয়েছে।
জকিগঞ্জে পৌঁছানোর পর বৃষ্টি থেমেছে, তবে যেকোনো সময় হতে পারে এমন ভাব। আমরা প্রথমে একটি ডাকবাংলোয় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় করলাম। সেখানকার স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষিকা স্কুল থেকেই চলে এলেন আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। তাঁর প্রথম কথা ছিল—এ অঞ্চলের মানুষ টিপাইমুখে বাঁধ হোক এটা চায় না। এর ক্ষতি সম্পর্কে তারা বোঝে। তা ছাড়া ভারতের কিছু আচরণ এ অঞ্চলের মানুষকে আহত করেছে। দুই বছর আগে বিএসএফ মর্টার ছুড়ে মেরেছিল, তাতে একটি স্কুলছাত্র মারা গিয়েছিল, এ কথাটি তারা ভোলেনি। এখন ভারত আবার সুরমা-কুশিয়ারার পানি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে! স্থানীয় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের প্রতিনিধিদের কথা ছিল একটাই—আমাদের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবে, এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এই টিপাইমুখে বাঁধ হোক, প্রকল্প যা-ই হোক, একে প্রতিহত করতেই হবে। তবে এটাও ঠিক, এ মুহূর্তে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই।
সম্মিলিত নারীসমাজের নেত্রীদের দেখে এবং টিপাইমুখে বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে জকিগঞ্জ এসেছেন এবং স্থানীয় জনগণের প্রতি সংগতি প্রকাশ করতে এসেছেন শুনে তাঁরা খুব খুশি হলেন। বললেন, এতজন নারীনেত্রী একসঙ্গে জকিগঞ্জের মানুষ দেখেনি।
সভা শেষ করে আমরা ব্যানার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে যখন বাজারে পৌঁছালাম, অনেক মানুষ সেখানে জড়ো হয়ে গেল। আমাদের পক্ষ থেকে সুলতানা আখতার রুবী বক্তব্য দিলেন। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনল, ব্যানার লেখা এবং ফেস্টুনের লেখাগুলো খুঁটিয়ে পড়ল। দোতালা বাড়িঘর, দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়েও লোকজন আমাদের দেখছিল। তাদের চোখে-মুখে সমর্থন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছিল। আমরা যতবার তাদের দিকে তাকাই, মনে হচ্ছিল এরাই তো হবে প্রথম ভুক্তভোগী। তাদের কথা শোনার মানুষ কই?
জকিগঞ্জ থেকে সিলেট যেতে প্রায় ৮০ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে হয়। দেখলাম রাস্তার দুইধারে মাঠে বিস্তর পানি, সেখানে অসংখ্য হাঁস, বক দেখলাম। অপূর্ব! মাছ ধরার জন্য জাল পেতে বসে আছে জেলে। রাস্তায় গাড়ি চালাতে গেলে ছাগল-গরুর জন্য গাড়ির গতি কমাতেই হবে। অর্থাত্ এলাকার মানুষ ছাগল-গরু পালছে। এদের খাদ্যের অভাব নেই। এসবই আছে পানি আছে বলেই। পানি না থাকলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা বলতে কিছু থাকবে না। তখন তাদের চলে আসতে হবে শহরে, ঢাকার বস্তিতে।
টিপাইমুখে বাঁধ বিদ্যুত্ প্রকল্প হবে না সেচ প্রকল্প, নাকি ড্যাম হবে সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের পানিসম্পদের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণের বিষয়। যে প্রকল্পই হোক না কেন, আমরা পানির জন্য প্রকৃতির ওপর নয়, ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হবো। এটা কিছুতেই গ্রহণ করা যেতে পারে না। সিলেটে একটি মতবিনিময় সভা হলো, সেখানেও সবার এক কথা—এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এটাও বলা হলো, হাজার কোটি টাকা খরচ করে ভারত বাংলাদেশের উপকার করার জন্য এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে এ কথা কোনো পাগলেও বিশ্বাস করবে না। সিলেটের একটি রিকশাওয়ালাও বোঝে টিপাইমুখ বাঁধ কত ক্ষতি করবে। কাজেই বিশেষজ্ঞরা বললেই টিপাইমুখ বাঁধ ভালো, আর তাঁরা খারাপ বললেই খারাপ—এমন একটি অবস্থায় নিজেদের বেঁধে রাখার দরকার নেই। নিজেদের চোখ-কান খোলা রেখে জনগণের জীবন-জীবিকার বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করুন। সবই বুঝতে পারবেন। সিলেটে আন্দোলন হচ্ছে; রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রয়োজন শুধু সমন্বিতভাবে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে আন্দোলন করার। যে কথা সবাই বলার চেষ্টা করেছে, এ আন্দোলন হওয়া উচিত জনগণের। টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়টি দলীয়করণ করা হলে তারা জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করবে। কারণ, এই দলাদলিতে মূল বিষয়টি হারিয়ে যাবে।
ঢাকায় বসে টিপাইমুখে বাঁধ নিয়ে লিখতে বসে সেই মানুষগুলোর চেহারা আমার চোখে ভাসছে। এরা কোনো দোষ করেনি, কিন্তু আজ যদি আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারি, তাহলে হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষকে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত করব। জাতীয় সংসদের সংসদীয় একটি দল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ভারতে ঘুরে এসে বলেছে, তারা আশ্বস্ত হয়েছে। আমরা সম্মিলিত নারীসমাজের একটি দল অমলশিদ ও জকিগঞ্জ ঘুরে এসে বলছি, আমাদের উত্কণ্ঠা, আতঙ্ক ও উদ্বিগ্নতা আরও হাজার গুণ বেড়েছে। আবদুর রাজ্জাক যে কথা ঢাকায় বসে বলছেন, সে কথা তিনি জকিগঞ্জে ঘুরে এসে বলুন না। এখানে যেতে হেলিকপ্টার লাগবে না। সোজা গাড়িতেই যেতে পারবেন। ভারত আশ্বস্ত করেছে তাদেরই স্বার্থে, আপনার কাজটি আপনি করুন। ভারতের আশ্বাস নিয়ে নয়, জনগণের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে দেখুন। সবচেয়ে বড় কথা, এটা আশ্বস্ত হওয়ার বিষয় নয়, জনগণকে বর্তমান ও ভবিষ্যত্ বিপদ থেকে রক্ষা করার বিষয়। আমরা বুঝেছি, সেই কাজটি ক্ষমতাসীন কোনো দল করবে না, করতে হবে আমদেরই। তাই সম্মিলিত নারীসমাজ আজ মাঠে নেমেছে।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
প্রথমেই বলি ঢাকায় কমলাপুর স্টেশনের কথা। আমরা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে ব্যানার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। আমাদের সহকর্মীরা কমলাপুর রেলস্টেশনে যে যাত্রী আসছে ও যাচ্ছে, তাদের হাতে লিফলেট ধরিয়ে দিলেন। লাল রঙের ব্যানার নিয়ে এতজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন দেখে উত্সুক জনগণ দাঁড়িয়ে গেল। কেউ এগিয়ে এসে প্রশ্ন করল। যখন জানতে পারল যে আমরা সিলেট যাচ্ছি এবং জকিগঞ্জে যাব, বেশ খুশি হলো। বুঝলাম সবার মনেই উত্কণ্ঠা আছে, কিন্তু প্রতিবাদ জানানোর জায়গা সবার হয়তো নেই। তবে এমনও হয়েছে, কয়েকজন যুবক আমাদের কিছু জিজ্ঞেস না করে নিজেরাই বলছে, অ্যাই, টিপাইমুখ কী রে? অর্থাত্ তরুণরা অনেকেই হয়তো এ বিষয় জানে না কিংবা তাদের জানানোর মতো কোনো ফোরাম নেই। এ বিষয়টি আমাদের চিন্তিত করেছে। ট্রেনে ওঠার আগে আমাদের মেয়েরা অনেক স্লোগান দিল, মানুষ জড়ো হয়ে গেল এবং আমাদের প্রতি একধরনের সংহতি প্রকাশ করল। আমরা তারপর ট্রেনে উঠে গেলাম এবং ভোরে সিলেট এসে পৌঁছালাম।
সকাল থেকে বৃষ্টি। তবু আমাদের জকিগঞ্জে যেতেই হবে। তিনটি মাইক্রোবাসে করে আমরা প্রথমে অমলশিদ গেলাম। এখানে বিডিআর ক্যাম্প আছে। সিলেটে যারা আমাদের জকিগঞ্জ যেতে সহায়তা করেছে, তাদেরই পরামর্শে আমরা বরাক নদ থেকে যেটা সুরমা ও কুশিয়ারার উত্সস্থল, ঠিক সেই জায়গাটা দেখতে গিয়েছিলাম। হালকা বৃষ্টি ছিল, তবুও গাড়ি থেকে নেমে আমরা ঠিক নদীর পারে গিয়ে দাঁড়ালাম। ওপারে ভারতের কাঁটা তাঁরের বেড়া দেখা যাচ্ছে। বেড়ার ঠিক পরেই নদীতে একটি জিহ্বার মতো চর জেগেছে। স্থানীয় লোকজন জানাল, এই চর ভারত দখল করে রেখেছে। সেখানে বাংলাদেশের মানুষকে যেতে দেয় না। সীমান্ত আইনি ভাষায় এটাকে ‘নো ম্যান্স ল্যান্ড’ বলা হচ্ছে কোনো প্রকার আলোচনা ছাড়াই। নো ম্যান্স ল্যান্ড তাহলে তো ভারতেরও নয়। তবুও ভারতই এটার ওপর দখলদারি। অদ্ভুত কাণ্ড!
জিহ্বা চরটি বেশ কিছুক্ষণ দেখলাম। সুরমা-কুশিয়ারার অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য দেখা ভুলে গিয়ে মনে হচ্ছিল এটুকু চর জাগছে তাতেই যদি আমাদের দখল নিয়ে এত সমস্যা হয়, তাহলে বরাক নদের পানি প্রবাহ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রিত হলে সুরমা-কুশিয়ারার পানি কি আমাদের থাকবে? ‘জিহ্বা চর’ যেন প্রতীকী অর্থে প্রাকৃতিক সম্পদ দখলের লিপসা প্রকাশ করছে। টিপাইমুখে বাঁধ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আজ আমাদের এই ছোট জিহ্বা চরের সমাধানও করে ফেলা উচিত নয় কি? কারণ, এটাই আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে, আমাদের পানিসম্পদকে কেন্দ্র করে ভারতে কোনো প্রকল্প হলে সেটার ফলাফল কী হতে পারে। স্থানীয় খুব সাধারণ দু-একজন মানুষকে জিজ্ঞেস করলাম—আচ্ছা, ওপারে বাঁধ হলে আপনাদের কি ভালো হবে? ‘না, কেমন করে ভালো হবে? আমাদের পানি তো থাকবে না।’ এর চেয়ে বেশি কথার প্রয়োজন নেই। বিশেষজ্ঞরাও যা বলবেন তারও সারমর্ম এই কথাই। সাধারণ মানুষের জীবনের উপলব্ধির চেয়ে বড় কথা আর কী হতে পারে?
অমলশিদ থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে জকিগঞ্জ। কিন্তু যাওয়ার পথে দেখা গেল একটি ব্রিজ ভাঙা। আমাদের গাড়ি কিছুতেই যেতে পারবে না, তাই টেম্পু নিতে হলো। এতজন মহিলা একসঙ্গে কোথায় যাচ্ছে? একটু যেন কৌতূহলের বিষয় ছিল সবার মধ্যে। আমাদের সঙ্গে ফটোগ্রাফার এবং স্থানীয়ভাবে সব আয়োজন করার জন্য যে কয়েকজন পুরুষ ছিলেন, তাঁরা ছিলেন সংখ্যায় কম। কাজেই মহিলারাই চোখে পড়ার মতো ছিল। আর যাকেই বলছি আমরা ঢাকা থেকে এসেছি টিপাইমুখে বাঁধের ব্যাপারে এ অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করতে, সংহতি প্রকাশ করতে—তারাই আমাদের স্বাগত জানিয়েছে।
জকিগঞ্জে পৌঁছানোর পর বৃষ্টি থেমেছে, তবে যেকোনো সময় হতে পারে এমন ভাব। আমরা প্রথমে একটি ডাকবাংলোয় স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত মতবিনিময় করলাম। সেখানকার স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষিকা স্কুল থেকেই চলে এলেন আমাদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। তাঁর প্রথম কথা ছিল—এ অঞ্চলের মানুষ টিপাইমুখে বাঁধ হোক এটা চায় না। এর ক্ষতি সম্পর্কে তারা বোঝে। তা ছাড়া ভারতের কিছু আচরণ এ অঞ্চলের মানুষকে আহত করেছে। দুই বছর আগে বিএসএফ মর্টার ছুড়ে মেরেছিল, তাতে একটি স্কুলছাত্র মারা গিয়েছিল, এ কথাটি তারা ভোলেনি। এখন ভারত আবার সুরমা-কুশিয়ারার পানি নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে! স্থানীয় সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী, উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের প্রতিনিধিদের কথা ছিল একটাই—আমাদের জীববৈচিত্র্য নষ্ট হবে, এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এই টিপাইমুখে বাঁধ হোক, প্রকল্প যা-ই হোক, একে প্রতিহত করতেই হবে। তবে এটাও ঠিক, এ মুহূর্তে এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো কেউ নেই।
সম্মিলিত নারীসমাজের নেত্রীদের দেখে এবং টিপাইমুখে বাঁধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে জকিগঞ্জ এসেছেন এবং স্থানীয় জনগণের প্রতি সংগতি প্রকাশ করতে এসেছেন শুনে তাঁরা খুব খুশি হলেন। বললেন, এতজন নারীনেত্রী একসঙ্গে জকিগঞ্জের মানুষ দেখেনি।
সভা শেষ করে আমরা ব্যানার নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে যখন বাজারে পৌঁছালাম, অনেক মানুষ সেখানে জড়ো হয়ে গেল। আমাদের পক্ষ থেকে সুলতানা আখতার রুবী বক্তব্য দিলেন। সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনল, ব্যানার লেখা এবং ফেস্টুনের লেখাগুলো খুঁটিয়ে পড়ল। দোতালা বাড়িঘর, দোকানের বারান্দায় দাঁড়িয়েও লোকজন আমাদের দেখছিল। তাদের চোখে-মুখে সমর্থন ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছিল। আমরা যতবার তাদের দিকে তাকাই, মনে হচ্ছিল এরাই তো হবে প্রথম ভুক্তভোগী। তাদের কথা শোনার মানুষ কই?
জকিগঞ্জ থেকে সিলেট যেতে প্রায় ৮০ কিলোমিটার রাস্তা পার হতে হয়। দেখলাম রাস্তার দুইধারে মাঠে বিস্তর পানি, সেখানে অসংখ্য হাঁস, বক দেখলাম। অপূর্ব! মাছ ধরার জন্য জাল পেতে বসে আছে জেলে। রাস্তায় গাড়ি চালাতে গেলে ছাগল-গরুর জন্য গাড়ির গতি কমাতেই হবে। অর্থাত্ এলাকার মানুষ ছাগল-গরু পালছে। এদের খাদ্যের অভাব নেই। এসবই আছে পানি আছে বলেই। পানি না থাকলে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা বলতে কিছু থাকবে না। তখন তাদের চলে আসতে হবে শহরে, ঢাকার বস্তিতে।
টিপাইমুখে বাঁধ বিদ্যুত্ প্রকল্প হবে না সেচ প্রকল্প, নাকি ড্যাম হবে সেটা প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের পানিসম্পদের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণের বিষয়। যে প্রকল্পই হোক না কেন, আমরা পানির জন্য প্রকৃতির ওপর নয়, ভারতের ওপর নির্ভরশীল হতে বাধ্য হবো। এটা কিছুতেই গ্রহণ করা যেতে পারে না। সিলেটে একটি মতবিনিময় সভা হলো, সেখানেও সবার এক কথা—এটা আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন। এটাও বলা হলো, হাজার কোটি টাকা খরচ করে ভারত বাংলাদেশের উপকার করার জন্য এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে এ কথা কোনো পাগলেও বিশ্বাস করবে না। সিলেটের একটি রিকশাওয়ালাও বোঝে টিপাইমুখ বাঁধ কত ক্ষতি করবে। কাজেই বিশেষজ্ঞরা বললেই টিপাইমুখ বাঁধ ভালো, আর তাঁরা খারাপ বললেই খারাপ—এমন একটি অবস্থায় নিজেদের বেঁধে রাখার দরকার নেই। নিজেদের চোখ-কান খোলা রেখে জনগণের জীবন-জীবিকার বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করুন। সবই বুঝতে পারবেন। সিলেটে আন্দোলন হচ্ছে; রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সকল পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। প্রয়োজন শুধু সমন্বিতভাবে দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে আন্দোলন করার। যে কথা সবাই বলার চেষ্টা করেছে, এ আন্দোলন হওয়া উচিত জনগণের। টিপাইমুখ বাঁধের বিষয়টি দলীয়করণ করা হলে তারা জনগণের বিরুদ্ধে কাজ করবে। কারণ, এই দলাদলিতে মূল বিষয়টি হারিয়ে যাবে।
ঢাকায় বসে টিপাইমুখে বাঁধ নিয়ে লিখতে বসে সেই মানুষগুলোর চেহারা আমার চোখে ভাসছে। এরা কোনো দোষ করেনি, কিন্তু আজ যদি আমরা সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারি, তাহলে হাজার হাজার লাখ লাখ মানুষকে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত করব। জাতীয় সংসদের সংসদীয় একটি দল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ভারতে ঘুরে এসে বলেছে, তারা আশ্বস্ত হয়েছে। আমরা সম্মিলিত নারীসমাজের একটি দল অমলশিদ ও জকিগঞ্জ ঘুরে এসে বলছি, আমাদের উত্কণ্ঠা, আতঙ্ক ও উদ্বিগ্নতা আরও হাজার গুণ বেড়েছে। আবদুর রাজ্জাক যে কথা ঢাকায় বসে বলছেন, সে কথা তিনি জকিগঞ্জে ঘুরে এসে বলুন না। এখানে যেতে হেলিকপ্টার লাগবে না। সোজা গাড়িতেই যেতে পারবেন। ভারত আশ্বস্ত করেছে তাদেরই স্বার্থে, আপনার কাজটি আপনি করুন। ভারতের আশ্বাস নিয়ে নয়, জনগণের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলে দেখুন। সবচেয়ে বড় কথা, এটা আশ্বস্ত হওয়ার বিষয় নয়, জনগণকে বর্তমান ও ভবিষ্যত্ বিপদ থেকে রক্ষা করার বিষয়। আমরা বুঝেছি, সেই কাজটি ক্ষমতাসীন কোনো দল করবে না, করতে হবে আমদেরই। তাই সম্মিলিত নারীসমাজ আজ মাঠে নেমেছে।
ফরিদা আখতার: নারী আন্দোলনের নেত্রী।
No comments