পেট্রোবাংলা নিজে গ্যাসঘাটতি মেটাতে পারে -জ্বালানি সম্পদ by বদরূল ইমাম
বিদ্যুৎ
উত্পাদন, সার উত্পাদন, শিল্প কারখানা, গৃহস্থালি ও সিএনজি যানবাহন
চালানোর কাজে গ্যাসের চাহিদা প্রতিবছর বেড়ে চলেছে, কিন্তু গ্যাস উত্পাদন
সে তুলনায় না বাড়ার ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে গ্যাসঘাটতি বিরাজ করছে।
বর্তমানে দেশের গ্যাসের দৈনিক চাহিদা প্রায় ২২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর বিপরীতে
দৈনিক উত্পাদন প্রায় ১৯৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাত্ দৈনিক গ্যাসঘাটতি প্রায়
২৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। আর তাতে জনজীবন কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তা বলার অপেক্ষা
রাখে না। সারকারখানা চালু রাখতে বিদ্যুত্ উত্পাদন কেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ
বন্ধ করে সেই গ্যাস দিতে হচ্ছে সার কারখানায়, ফলে বাড়ছে বিদ্যুতের ঘাটতি।
নতুন শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য গ্যাস নেই, ঘটছে অর্থনৈতিক মন্দা—এসব
খবর এখন নিত্যদিনের।
অনেকের মতে, দেশে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে উত্পাদন বৃদ্ধির উপায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও তা চালু করা। প্রকৃতপক্ষে তা একটি মোক্ষম পন্থা বটে, কিন্তু তা মূলত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং সে ক্ষেত্রে অনুসন্ধানে সফলতা লাভের অনিশ্চয়তা রয়েছে। গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর জন্য দ্রুত এ পন্থা কার্যকর নাও হতে পারে। পেট্রোবাংলার বিশেষজ্ঞমহল মনে করে, স্বল্প সময়ে বর্তমান গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর বিকল্প সমাধান বিদ্যমান এবং তা তাদের নিজের হাতেই রয়েছে। এর জন্য কেবল প্রয়োজন গতিশীল ব্যবস্থাপনা ও স্বনির্ভর মানসিকতা।
বাংলাদেশে আবিষ্কৃত ২৩টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ১৮টি থেকে বর্তমানে গ্যাস উত্পাদন করা হয়। এর মধ্যে ১২টি গ্যাসক্ষেত্র পেট্রোবাংলার অধীনে দেশি কোম্পানি ও ছয়টি বিদেশি কেম্পানিগুলো দ্বারা পরিচালিত হয়। পেট্রোবাংলার বিশেষজ্ঞমহল মনে করে, বর্তমানে পেট্রোবাংলার অধীনে চালু গ্যাসক্ষেত্রসমূহে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা কার্যকর করার মাধ্যমে উত্পাদন বৃদ্ধি ঘটিয়ে স্বল্প সময়ে বর্তমান গ্যাসের ঘাটতি মেটানো সম্ভব। আর এ কাজ করতে বিশাল কর্মযজ্ঞ আয়োজনের দরকার নেই। পেট্রোবাংলার নিজস্ব কারিগরি ও আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে বিরাজমান এ পরিকল্পনাব্যবস্থা কার্যকর করতে প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও উদ্যোগই যথেষ্ট। স্বল্প সময়ে গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর সম্ভাব্য ব্যবস্থাসমূকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়।
১. স্থগিত কূপসমূহ চালু: পেট্রোবাংলার অধীনে চালু গ্যাসক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি কূপে গ্যাস উত্পাদন বন্ধ রয়েছে। ইতিপূর্বে উত্পাদনকারী এসব কূপে গ্যাস উত্পাদন বন্ধ হওয়ার কারণ বিবিধ। কোনো কোনো কূপে গ্যাস উত্পাদন বন্ধ, কারণ উত্পাদনরত নির্দিষ্ট গ্যাসস্তরটিতে আর গ্যাস নেই। সে ক্ষেত্রে ওই কূপেই অন্য গ্যাসস্তরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ লাগিয়ে গ্যাস উত্পাদন পুনরায় শুরু করা যায়। উল্লেখ্য, একটি গ্যাসক্ষেত্রে সাধারণত একাধিক গ্যাসস্তর থাকে এবং গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর লগিং ও অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে সব কটি গ্যাসস্তর চিহ্নিত করা হয়। পেট্রোবাংলা কর্তৃক শনাক্ত করা বন্ধ হয়ে যাওয়া কূপ, যেগুলোতে নতুন স্তর থেকে গ্যাস উত্পাদন শুরু করা যায়, তা হলো মেঘনা-১, কৈলাসটিলা-৫, রশিদপুর-৫ ইত্যাদি। আবার কোনো কূপে গ্যাস উত্পাদন বন্ধ হওয়ার কারণ অত্যধিক পানিজনিত সমস্যা। সে ক্ষেত্রে কূপটিতে মেরামতব্যবস্থা নিয়ে গ্যাস উত্পাদন পুনরায় শুরু করা যায়। এক হিসাবমতে, বর্তমানে ১০টি কূপে উপরিউক্ত নানা কারণে উত্পাদন বন্ধ রয়েছে, যেগুলোতে স্বল্প বিনিয়োগ করে নিশ্চিতভাবে গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। এ কূপসমূহে পুনরায় উত্পাদন চালু করার মাধ্যমে প্রতিটি কূপে গড়ে দৈনিক অন্তত ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট করে মোট দৈনিক অন্তত ১৫০ ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন সম্ভব।
উল্লেখ্য, সমপ্রতি পেট্রোবাংলার অধীনে বাংলাদেশ গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক তিতাস-১৪ কূপটি পুনরায় উত্পাদন পর্যায়ে নিয়ে আসার সংবাদ উপরিউক্ত বক্তব্যকে সমর্থন করে। তিতাস-১৪ কূপটি দীর্ঘদিন ধরে অত্যধিক পানিজনিত সমস্যার কারণে বন্ধ ছিল। সমপ্রতি কূপটিতে মেরামত (ওয়ার্ক ওভার) কাজ সম্পন্ন করে দৈনিক প্রায় ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন চালু করা গেছে।
২. উত্পাদনকূপের সংখ্যা বাড়ানো: বাংলাদেশের বড় গ্যাসক্ষেত্রে যে-সংখ্যক উত্পাদনরত গ্যাসকূপ রয়েছে, এর তুলনায় অনেক বেশি কূপ খনন ও গ্যাস উত্পাদন করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে গ্যাসক্ষেত্রসমূহ একটি আদর্শ গ্যাস উন্নয়ন পন্থায় পরিচালিত হয় না। ধরা যাক, দেশের সর্ববৃহত্ তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের (প্রাথমিক মজুদ প্রায় পাঁচ টিসিএফ) কথা। ১৯৬৮ সালে গ্যাস উত্পাদন শুরু হওয়ার পর আজ অবধি ৪১ বছরে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে উত্পাদন কূপ খনন করা হয় ১৬টি, যার ১৪টি থেকে গ্যাস উত্পাদন চালু রয়েছে। তুলনামূলকভাবে অপর একটি বড় গ্যাসক্ষেত্রের কথা ধরা যাক, শেভরন কোম্পানি পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র (প্রাথমিক মজুদ প্রায় ২.৫ টিসিএফ)। ২০০৭ সালে উত্পাদন চালু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র দুই বছরে ১২টি উত্পাদন খনন করা হয় এবং বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ গ্যাস-উত্পাদক। এ কথা বলার কোনো যুক্তি নেই যে শেভরন বিদেশি কোম্পানি হিসেবে অধিকতর আর্থিক ও কারিগরি ক্ষমতার অধিকারী বিধায় সে অধিকতর গ্যাস উত্পাদনে সক্ষম। গ্যাস উত্পাদনের কূপ খনন ও তা পরিচালনা করা রকেট বিজ্ঞান নয়, বরং তা রুটিন বিজ্ঞান। পেট্রোবাংলার অধীনে কর্মরত ভূবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের গ্যাসকূপ খনন ও গ্যাস উত্পাদনে ২০ থেকে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তাদের কর্মদক্ষতা যেকোনো বিদেশি কোম্পানির কর্মীদের সমকক্ষ। তাহলে ফাঁকটা কোথায়? প্রকৃতপক্ষে ফাঁকটা দূরদর্শিতা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার অভাব।
এ কথা অবশ্যই সঠিক যে শেভরন কোম্পানির মূল লক্ষ্য অধিক উত্পাদন ও দ্রুত মুনাফা অর্জন। এটি অর্জন করতে কোম্পানি যে পন্থা অবলম্বন করেছে, তা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে একটি বড় গ্যাসক্ষেত্রে কেবল দুই বছর সময়ে ১২টি উত্পাদনকূপ খনন করে দৈনিক প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন সম্ভব। পেট্রোবাংলা দেশি কোম্পানি এবং এর লক্ষ্য দ্রুত মুনাফা অর্জন নয়, বরং মূলত দেশে গ্যাস সরবরাহের সুবন্দোবস্ত করা। তাই পেট্রোবাংলার পক্ষে শেভরনের সমান গতিতে গ্যাস উত্পাদন বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু পেট্রোবাংলার কর্মপরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা এতটা ধীরগতিসম্পন্ন কেন যে ৪১ বছরে মাত্র ১৬টি কূপ খনন করা হয়, যেখানে তিতাসের মতো বড় গ্যাসক্ষেত্রে এ সময় এর দ্বিগুণসংখ্যক উত্পাদনকূপ খনন করা হলেও তা স্বাভাবিক গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়নের ধারা বিবেচিত হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে দেশে গ্যাসঘাটতি বিদ্যমান ও বড় ধরনের জ্বালানি সংকট আসন্ন, সে ক্ষেত্রে তিতাস ও হবিগঞ্জের মতো বড় গ্যাসক্ষেত্রসমূহ সার্বিকভাবে গতিশীল উন্নয়ন পরিকল্পনার অধীনে এনে বর্তমান ও অদূর-ভবিষ্যতের জ্বালানি-সংকট মোকাবিলা করা যাবে না কেন? এ কাজে নতুন গ্যাস খুঁজে বের করার ঝুঁকি নেই, এ ধরনের উন্নয়নকূপ খননের খরচ অপেক্ষাকৃত কম এবং গ্যাস উত্তোলনের পর তা প্রসেসিং ও সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বিদ্যমান।
৩. বিদেশি কূপ বনাম দেশি কূপ: বাংলাদেশে গ্যাস উত্পাদনের ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত গ্যাসকূপসমূহে দৈনিক গ্যাস উত্পাদনের হার পেট্রোবাংলার অধীনে পরিচালিত গ্যাসকূপসমূহের তুলনায় অনেক বেশি। যেমন শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে গড়ে প্রতিটি কূপে দৈনিক ৫২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদিত হয় এবং একটি কূপে সর্বোচ্চ ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস উত্পাদিত হয়। তুলনামূলকভাবে পেট্রোবাংলার অধীনে পরিচালিত হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রে গড়ে প্রতিটি কূপে দৈনিক ২৫, তিতাসে ২৯, রশিদপুরে ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন করা হয়। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, তিতাস বা হবিগঞ্জে গ্যাসস্তরসমূহের গুণাগুণ বিবিয়ানার গ্যাসস্তরের চেয়ে অনেক ভালো এবং তাই তিতাস ও হবিগঞ্জ ক্ষেত্রে প্রতিটি কূপে বিবিয়ানার তুলনায় অধিকতর গ্যাস উত্পাদনের ক্ষমতা থাকার কথা।
তাহলে প্রশ্ন হলো, দেশি কূপসমূহে উত্পাদনের হার কম কেন? প্রশ্নটি এ কারণে অতিগুরুত্বপূর্ণ যে কূপপ্রতি উত্পাদনের হার বৃদ্ধি করতে পারলে দেশি গ্যাসক্ষেত্রে বর্তমানে চালু কূপসমূহই দেশের বর্তমান ঘাটতি মেটাতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক হিসাবমতে, কেবল তিতাস ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র দুটির মধ্য অঞ্চলে ১৩টি কূপে কূপপ্রতি দৈনিক ১০ থেকে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন বৃদ্ধি করলে দেশের দৈনিক গ্যাস উত্পাদনে বৃদ্ধি ঘটবে ১৫০ থেকে ২৫০ ঘনফুট পর্যন্ত।
কিন্তু এখানে একটি কথা আছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, শেভরন প্রতিটি কূপে অত্যধিক গ্যাস উত্পাদন করে, যা কিনা গ্যাসস্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে এবং তা গ্যাসক্ষেত্রটির ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু বিষয়টি পরীক্ষা ও প্রমাণসাপেক্ষ। এটি অতি জরুরি যে পেট্রোবাংলা তার বিশেষজ্ঞ দ্বারা বিষয়টি যথার্থ নির্ধারণ করবে। যদি শেভরন বা অন্য বিদেশি কোম্পানির উচ্চ উত্পাদনের হার গ্যাসস্তর তথা গ্যাসক্ষেত্রের জন্য ক্ষতিকারক প্রতীয়মান হয়, তবে অনতিবিলম্বে বিদেশি কোম্পানিসমূহকে তাদের উত্পাদনের মাত্রা কমাতে নির্দেশ দেওয়া অত্যাবশ্যক। অপরদিকে, যদি পেট্রোবাংলার বিশেষজ্ঞ দল বিদেশিদের গ্যাস উত্পাদনের হার গ্যাসক্ষেত্রের জন্য ক্ষতিকর নয় মনে করে, তবে দেশীয় কোম্পানি পরিচালিত কূপসমূহে উত্পাদনের হার কেন বাড়ানো যাবে না, সে প্রশ্ন এসে যায়। আর সে ক্ষেত্রে দেশি কূপসমূহে উত্পাদনের হার বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও ব্যবস্থাপনা করার দায়িত্ব পেট্রোবাংলার। এটি সম্ভব হলে, তা সর্বাপেক্ষা স্বল্প খরচ ও নিশ্চয়তার মাধ্যমে দ্রুত গ্যাস উত্পাদন বাড়ানোর মোক্ষম উপায় প্রমাণিত হতে পারে।
>>>বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয়।
অনেকের মতে, দেশে গ্যাসের ঘাটতি মেটাতে উত্পাদন বৃদ্ধির উপায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার ও তা চালু করা। প্রকৃতপক্ষে তা একটি মোক্ষম পন্থা বটে, কিন্তু তা মূলত সময়সাপেক্ষ ব্যাপার এবং সে ক্ষেত্রে অনুসন্ধানে সফলতা লাভের অনিশ্চয়তা রয়েছে। গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর জন্য দ্রুত এ পন্থা কার্যকর নাও হতে পারে। পেট্রোবাংলার বিশেষজ্ঞমহল মনে করে, স্বল্প সময়ে বর্তমান গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর বিকল্প সমাধান বিদ্যমান এবং তা তাদের নিজের হাতেই রয়েছে। এর জন্য কেবল প্রয়োজন গতিশীল ব্যবস্থাপনা ও স্বনির্ভর মানসিকতা।
বাংলাদেশে আবিষ্কৃত ২৩টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে ১৮টি থেকে বর্তমানে গ্যাস উত্পাদন করা হয়। এর মধ্যে ১২টি গ্যাসক্ষেত্র পেট্রোবাংলার অধীনে দেশি কোম্পানি ও ছয়টি বিদেশি কেম্পানিগুলো দ্বারা পরিচালিত হয়। পেট্রোবাংলার বিশেষজ্ঞমহল মনে করে, বর্তমানে পেট্রোবাংলার অধীনে চালু গ্যাসক্ষেত্রসমূহে বিশেষ কর্মপরিকল্পনা কার্যকর করার মাধ্যমে উত্পাদন বৃদ্ধি ঘটিয়ে স্বল্প সময়ে বর্তমান গ্যাসের ঘাটতি মেটানো সম্ভব। আর এ কাজ করতে বিশাল কর্মযজ্ঞ আয়োজনের দরকার নেই। পেট্রোবাংলার নিজস্ব কারিগরি ও আর্থিক ক্ষমতার মধ্যে বিরাজমান এ পরিকল্পনাব্যবস্থা কার্যকর করতে প্রশাসনিক সদিচ্ছা ও উদ্যোগই যথেষ্ট। স্বল্প সময়ে গ্যাসের ঘাটতি মেটানোর সম্ভাব্য ব্যবস্থাসমূকে নিম্নোক্ত ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়।
১. স্থগিত কূপসমূহ চালু: পেট্রোবাংলার অধীনে চালু গ্যাসক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি কূপে গ্যাস উত্পাদন বন্ধ রয়েছে। ইতিপূর্বে উত্পাদনকারী এসব কূপে গ্যাস উত্পাদন বন্ধ হওয়ার কারণ বিবিধ। কোনো কোনো কূপে গ্যাস উত্পাদন বন্ধ, কারণ উত্পাদনরত নির্দিষ্ট গ্যাসস্তরটিতে আর গ্যাস নেই। সে ক্ষেত্রে ওই কূপেই অন্য গ্যাসস্তরে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ লাগিয়ে গ্যাস উত্পাদন পুনরায় শুরু করা যায়। উল্লেখ্য, একটি গ্যাসক্ষেত্রে সাধারণত একাধিক গ্যাসস্তর থাকে এবং গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর লগিং ও অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে সব কটি গ্যাসস্তর চিহ্নিত করা হয়। পেট্রোবাংলা কর্তৃক শনাক্ত করা বন্ধ হয়ে যাওয়া কূপ, যেগুলোতে নতুন স্তর থেকে গ্যাস উত্পাদন শুরু করা যায়, তা হলো মেঘনা-১, কৈলাসটিলা-৫, রশিদপুর-৫ ইত্যাদি। আবার কোনো কূপে গ্যাস উত্পাদন বন্ধ হওয়ার কারণ অত্যধিক পানিজনিত সমস্যা। সে ক্ষেত্রে কূপটিতে মেরামতব্যবস্থা নিয়ে গ্যাস উত্পাদন পুনরায় শুরু করা যায়। এক হিসাবমতে, বর্তমানে ১০টি কূপে উপরিউক্ত নানা কারণে উত্পাদন বন্ধ রয়েছে, যেগুলোতে স্বল্প বিনিয়োগ করে নিশ্চিতভাবে গ্যাস পাওয়া যেতে পারে। এ কূপসমূহে পুনরায় উত্পাদন চালু করার মাধ্যমে প্রতিটি কূপে গড়ে দৈনিক অন্তত ১৫ মিলিয়ন ঘনফুট করে মোট দৈনিক অন্তত ১৫০ ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন সম্ভব।
উল্লেখ্য, সমপ্রতি পেট্রোবাংলার অধীনে বাংলাদেশ গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড কর্তৃক তিতাস-১৪ কূপটি পুনরায় উত্পাদন পর্যায়ে নিয়ে আসার সংবাদ উপরিউক্ত বক্তব্যকে সমর্থন করে। তিতাস-১৪ কূপটি দীর্ঘদিন ধরে অত্যধিক পানিজনিত সমস্যার কারণে বন্ধ ছিল। সমপ্রতি কূপটিতে মেরামত (ওয়ার্ক ওভার) কাজ সম্পন্ন করে দৈনিক প্রায় ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন চালু করা গেছে।
২. উত্পাদনকূপের সংখ্যা বাড়ানো: বাংলাদেশের বড় গ্যাসক্ষেত্রে যে-সংখ্যক উত্পাদনরত গ্যাসকূপ রয়েছে, এর তুলনায় অনেক বেশি কূপ খনন ও গ্যাস উত্পাদন করা সম্ভব। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে গ্যাসক্ষেত্রসমূহ একটি আদর্শ গ্যাস উন্নয়ন পন্থায় পরিচালিত হয় না। ধরা যাক, দেশের সর্ববৃহত্ তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের (প্রাথমিক মজুদ প্রায় পাঁচ টিসিএফ) কথা। ১৯৬৮ সালে গ্যাস উত্পাদন শুরু হওয়ার পর আজ অবধি ৪১ বছরে তিতাস গ্যাসক্ষেত্রে উত্পাদন কূপ খনন করা হয় ১৬টি, যার ১৪টি থেকে গ্যাস উত্পাদন চালু রয়েছে। তুলনামূলকভাবে অপর একটি বড় গ্যাসক্ষেত্রের কথা ধরা যাক, শেভরন কোম্পানি পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র (প্রাথমিক মজুদ প্রায় ২.৫ টিসিএফ)। ২০০৭ সালে উত্পাদন চালু হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত মাত্র দুই বছরে ১২টি উত্পাদন খনন করা হয় এবং বর্তমানে এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহত্ গ্যাস-উত্পাদক। এ কথা বলার কোনো যুক্তি নেই যে শেভরন বিদেশি কোম্পানি হিসেবে অধিকতর আর্থিক ও কারিগরি ক্ষমতার অধিকারী বিধায় সে অধিকতর গ্যাস উত্পাদনে সক্ষম। গ্যাস উত্পাদনের কূপ খনন ও তা পরিচালনা করা রকেট বিজ্ঞান নয়, বরং তা রুটিন বিজ্ঞান। পেট্রোবাংলার অধীনে কর্মরত ভূবিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের গ্যাসকূপ খনন ও গ্যাস উত্পাদনে ২০ থেকে ৩০ বছরের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তাদের কর্মদক্ষতা যেকোনো বিদেশি কোম্পানির কর্মীদের সমকক্ষ। তাহলে ফাঁকটা কোথায়? প্রকৃতপক্ষে ফাঁকটা দূরদর্শিতা, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার অভাব।
এ কথা অবশ্যই সঠিক যে শেভরন কোম্পানির মূল লক্ষ্য অধিক উত্পাদন ও দ্রুত মুনাফা অর্জন। এটি অর্জন করতে কোম্পানি যে পন্থা অবলম্বন করেছে, তা প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে একটি বড় গ্যাসক্ষেত্রে কেবল দুই বছর সময়ে ১২টি উত্পাদনকূপ খনন করে দৈনিক প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন সম্ভব। পেট্রোবাংলা দেশি কোম্পানি এবং এর লক্ষ্য দ্রুত মুনাফা অর্জন নয়, বরং মূলত দেশে গ্যাস সরবরাহের সুবন্দোবস্ত করা। তাই পেট্রোবাংলার পক্ষে শেভরনের সমান গতিতে গ্যাস উত্পাদন বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু পেট্রোবাংলার কর্মপরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা এতটা ধীরগতিসম্পন্ন কেন যে ৪১ বছরে মাত্র ১৬টি কূপ খনন করা হয়, যেখানে তিতাসের মতো বড় গ্যাসক্ষেত্রে এ সময় এর দ্বিগুণসংখ্যক উত্পাদনকূপ খনন করা হলেও তা স্বাভাবিক গ্যাসক্ষেত্রের উন্নয়নের ধারা বিবেচিত হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে দেশে গ্যাসঘাটতি বিদ্যমান ও বড় ধরনের জ্বালানি সংকট আসন্ন, সে ক্ষেত্রে তিতাস ও হবিগঞ্জের মতো বড় গ্যাসক্ষেত্রসমূহ সার্বিকভাবে গতিশীল উন্নয়ন পরিকল্পনার অধীনে এনে বর্তমান ও অদূর-ভবিষ্যতের জ্বালানি-সংকট মোকাবিলা করা যাবে না কেন? এ কাজে নতুন গ্যাস খুঁজে বের করার ঝুঁকি নেই, এ ধরনের উন্নয়নকূপ খননের খরচ অপেক্ষাকৃত কম এবং গ্যাস উত্তোলনের পর তা প্রসেসিং ও সঞ্চালনের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো বিদ্যমান।
৩. বিদেশি কূপ বনাম দেশি কূপ: বাংলাদেশে গ্যাস উত্পাদনের ধারা লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে বিদেশি কোম্পানি কর্তৃক পরিচালিত গ্যাসকূপসমূহে দৈনিক গ্যাস উত্পাদনের হার পেট্রোবাংলার অধীনে পরিচালিত গ্যাসকূপসমূহের তুলনায় অনেক বেশি। যেমন শেভরন পরিচালিত বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্রে গড়ে প্রতিটি কূপে দৈনিক ৫২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদিত হয় এবং একটি কূপে সর্বোচ্চ ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট পর্যন্ত গ্যাস উত্পাদিত হয়। তুলনামূলকভাবে পেট্রোবাংলার অধীনে পরিচালিত হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্রে গড়ে প্রতিটি কূপে দৈনিক ২৫, তিতাসে ২৯, রশিদপুরে ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন করা হয়। ভূবিজ্ঞানীরা বলছেন, তিতাস বা হবিগঞ্জে গ্যাসস্তরসমূহের গুণাগুণ বিবিয়ানার গ্যাসস্তরের চেয়ে অনেক ভালো এবং তাই তিতাস ও হবিগঞ্জ ক্ষেত্রে প্রতিটি কূপে বিবিয়ানার তুলনায় অধিকতর গ্যাস উত্পাদনের ক্ষমতা থাকার কথা।
তাহলে প্রশ্ন হলো, দেশি কূপসমূহে উত্পাদনের হার কম কেন? প্রশ্নটি এ কারণে অতিগুরুত্বপূর্ণ যে কূপপ্রতি উত্পাদনের হার বৃদ্ধি করতে পারলে দেশি গ্যাসক্ষেত্রে বর্তমানে চালু কূপসমূহই দেশের বর্তমান ঘাটতি মেটাতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক হিসাবমতে, কেবল তিতাস ও হবিগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র দুটির মধ্য অঞ্চলে ১৩টি কূপে কূপপ্রতি দৈনিক ১০ থেকে ২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্পাদন বৃদ্ধি করলে দেশের দৈনিক গ্যাস উত্পাদনে বৃদ্ধি ঘটবে ১৫০ থেকে ২৫০ ঘনফুট পর্যন্ত।
কিন্তু এখানে একটি কথা আছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, শেভরন প্রতিটি কূপে অত্যধিক গ্যাস উত্পাদন করে, যা কিনা গ্যাসস্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে থাকে এবং তা গ্যাসক্ষেত্রটির ভবিষ্যতের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু বিষয়টি পরীক্ষা ও প্রমাণসাপেক্ষ। এটি অতি জরুরি যে পেট্রোবাংলা তার বিশেষজ্ঞ দ্বারা বিষয়টি যথার্থ নির্ধারণ করবে। যদি শেভরন বা অন্য বিদেশি কোম্পানির উচ্চ উত্পাদনের হার গ্যাসস্তর তথা গ্যাসক্ষেত্রের জন্য ক্ষতিকারক প্রতীয়মান হয়, তবে অনতিবিলম্বে বিদেশি কোম্পানিসমূহকে তাদের উত্পাদনের মাত্রা কমাতে নির্দেশ দেওয়া অত্যাবশ্যক। অপরদিকে, যদি পেট্রোবাংলার বিশেষজ্ঞ দল বিদেশিদের গ্যাস উত্পাদনের হার গ্যাসক্ষেত্রের জন্য ক্ষতিকর নয় মনে করে, তবে দেশীয় কোম্পানি পরিচালিত কূপসমূহে উত্পাদনের হার কেন বাড়ানো যাবে না, সে প্রশ্ন এসে যায়। আর সে ক্ষেত্রে দেশি কূপসমূহে উত্পাদনের হার বাড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা ও ব্যবস্থাপনা করার দায়িত্ব পেট্রোবাংলার। এটি সম্ভব হলে, তা সর্বাপেক্ষা স্বল্প খরচ ও নিশ্চয়তার মাধ্যমে দ্রুত গ্যাস উত্পাদন বাড়ানোর মোক্ষম উপায় প্রমাণিত হতে পারে।
>>>বদরূল ইমাম: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments