গাড়ি আমদানির নিষেধাজ্ঞা শিথিল শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসের পতনের পর শ্রীলঙ্কায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। এ কারণে শ্রীলঙ্কাকে অনেক দেশ আদর্শ হিসেবে মনে করে। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে অনেক দেশ। এবার বলা হচ্ছে, কিছু যানবাহন আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করছে দেশটি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে- গাড়ি আমদানির নিষেধাজ্ঞা শিথিল করলেই কি দেশটির জনগণ একটি নতুন গাড়ি কেনার সামর্থ্য রাখেন? অনলাইন বিবিসিতে এ প্রশ্নটির বিশ্লেষণ করেছেন সাংবাদিক আনবারাসান ইথিরাজন। তিনি লিখেছেন, ১লা ফেব্রুয়ারি থেকে বাস, ট্রাক ও বিভিন্ন ব্যবহার্য গাড়ি আমদানি শুরু করার কথা দেশটির। অন্য যানবাহন আমদানিতে বিধিনিষেধ আস্তে আস্তে তুলে নেয়া হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশটির বহু নাগরিক অপেক্ষা করছেন কখন প্রাইভেটকার আমদানির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেবেন কর্তৃপক্ষ। বিশেষ করে স্পোর্টসে ব্যবহৃত গাড়ি এবং তিন চাকার গাড়ি। তিন চাকার গাড়ি ব্যাপকভাবে ট্যাক্সি হিসেবে ব্যবহার করা হয় সেখানে। কিন্তু নতুন গাড়ির দাম বেড়ে যাবে। তার সঙ্গে আছে দুর্বল মুদ্রা মান এবং উচ্চহারে শুল্ক। ফলে এ অবস্থায় খুব কম মানুষেরই একটি নতুন গাড়ি কেনার সামর্থ্য থাকবে। ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা ভয়াবহভাবে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে পড়ে। এর ফলে দেশটির ইতিহাসে ঋণদাতাদের কাছে তারা স্বীকার করে যে, তারা দেউলিয়া হয়ে গেছে। ঋণদাতাদেরকে যে অর্থ ফেরত দিতে হয়, তা দিতে অক্ষম তারা। দেশটিতে বসবাস করেন প্রায় দুই কোটি ২০ লাখ মানুষ। সেখানে আর্থিক এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে দেখা দেয় জ্বালানি, খাদ্য এবং ওষুধের অস্বাভাবিক সংকট। এতে দেশ টালমাটাল হয়ে পড়ে। ব্যাপক গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। তার স্রোতের কাছে টিকে থাকতে পারেননি তখনকার প্রেসিডেন্ট গোটাবাইয়া রাজাপাকসে। তাকে কয়েক মাসের মধ্যেই সব গুটিয়ে বিদায় নিতে হয়। সাংবাদিক ইথিরাজন আরও লিখেছেন, রাজাপাকসের উত্তরসূরিরা উচ্চ শুল্ক, জ্বালানিতে ভর্তুকি দেয়া বন্ধ সহ বিভিন্ন রকম কৃচ্ছ্রসাধন করতে থাকে। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল আইএমএফ’র কাছ থেকে ২৯০ কোটি ডলার বেইলআউট নিয়ে সমঝোতা শুরু করে কলম্বো। তখন থেকে দেশটির অর্থনীতি উন্নত হতে শুরু করে। অর্থনীতি ধ্বংসস্তূপ থেকে আস্তে আস্তে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করে। তাই বলে দেশবাসীর হাতে যে একেবারে অঢেল কাঁচা টাকা এসে পড়েছে এমন নয়। গাড়ি আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা শ্রীলঙ্কানদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। তারা একটি নতুন গাড়ি বা একটি ভ্যান কেনার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করছিলেন। কলম্বোভিত্তিক অর্থনৈতিক থিঙ্কট্যাংক এডভোকেটা’র চেয়ারম্যান মুর্তাজা জাফিরজি বলেছেন, তিনি মনে করেন সরকারের এই পদক্ষেপ ছিল দীর্ঘ প্রতীক্ষিত। তিনি আরও বলেন, গাড়ি আমদানিতে সরকারের শুধু রাজস্ব বাড়াবে এমন নয়। একই সঙ্গে এতে অর্থনৈতিক অন্যান্য কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পাবে। যেমন গাড়ির খাতে অর্থায়ন হবে, ডিলাররা রাজস্ব পাবেন, কার  সার্ভিসিং খাতে যারা আছেন তারা সুবিধা পাবেন। অন্যরা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্মকাণ্ডে জড়িত হবেন। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু মঙ্গলবার দেশটির তথ্যমন্ত্রী নালিন্দা জয়াতিসা মিডিয়া ব্রিফিংয়ে বলেছেন, দেশ খুব সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হচ্ছে। আমরা ব্যাপক হারে আমদানি চাই না। কারণ, তাতে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাবে।

উল্লেখ্য, জাপান ও ভারতসহ অনেক দেশের মতো কার ও ট্রাক প্রস্তুতের কোনো রকম বড় কারখানা নেই শ্রীলঙ্কায়। সবরকম গাড়ি তারা আমদানি করে। এখন চীনা গাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, বিশেষ করে বিদ্যুৎচালিত গাড়ি। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কায় ব্যবহৃত গাড়ির দাম অনেক বেড়ে গেছে। নিষেধাজ্ঞা দেয়ার আগে যে দাম ছিল, এখন কিছু মডেলের ব্যবহৃত গাড়ির দাম দুই থেকে তিনগুণ। গায়ানা ইন্ডিকা’র মতো মানুষদের জন্য এই বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে নেয়ার প্রভাব অনেক কঠিন। কারণ, তারা বিয়েতে গাড়ি সবরাহ করতেন। গায়ানা ইন্ডিকা একজন পার্টটাইম ক্যাবচালক।  তিনি বলেন, আমি একটি নতুন গাড়ি কিনতে চাই যাতে আমার কাজ করতে পারি। আমার প্রাইভেট ক্যাব ভাড়া দেয়ার কাজটা শুরু করতে পারি। একটি গাড়ি ছাড়া, চলাচল করা ছাড়া আমিতো রাজস্ব হারাচ্ছি। ক্যান্ডি শহরের একজন সফ্‌টওয়্যারের পেশায় যুক্ত শশীকুমার বলেন, দেশে গণপরিবহন নাজুক। এক্ষেত্রে একটি গাড়ি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেহেতু আমাদের ভালো গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই, দেশের অন্য স্থানগুলোতে সফর করার জন্য একটি গাড়ি অত্যাবশ্যক। হয়তো সরকারকে গাড়ির ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে, না হয় তাদেরকে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।

নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগের বছরে শ্রীলঙ্কা প্রায় ১৪০ কোটি ডলারের যানবাহন আমদানি করেছিল। এ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, তারা যানবাহন আমদানির জন্য একশ’ কোটি ডলার বরাদ্দ রাখার পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু এই অর্থ ছাড় দেয়া হবে আস্তে আস্তে।  ভেহিক্যাল ইমপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব শ্রীলঙ্কার আরোশা রড্রিগো বলেন, কমপক্ষে চার দশক ধরে গাড়ির ডিলারশিপ পরিচালনা করেন তিনি ও তার পরিবার। নিষেধাজ্ঞার আগে

মাসে প্রায় ১০০ যানবাহন আমদানি করেছে তার প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিধিনিষেধ আরোপ হওয়ার পর তারা একটি গাড়িও আমদানি করতে সক্ষম হননি। তিনি বলেন, যদি এই নিষেধাজ্ঞা আরও শিথিল করা হয়, যদি যাত্রীবাহী গাড়ি  এবং অন্য যানবাহন আমদানি অনুমোদন দেয়া হয়, তাহলে বহু মানুষ এগুলো কিনতে সমর্থ হবেন না। কারণ, ট্যাক্স বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রীলঙ্কান মুদ্রা দুর্বল হয়েছে। সরকার আমদানি করা গাড়ির ওপর এক্সসাইজ ডিউটি বা শুল্ক নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি করেছে। ইঞ্জিনের আকারের ওপর নির্ভর করে নতুন এবং সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িতে এই শুল্ক হার যথাক্রমে শতকরা ২০০ ভাগ এবং ৩০০ ভাগ। অর্থাৎ যদি ধরা হয় একটি নতুন গাড়ির দাম ১০০ ডলার। কিন্তু তাতে শতকরা ২০০ ভাগ শুল্ক আরোপ করায় মূল্য দাঁড়াবে ৩০০ ডলার। এখানেই শেষ নয়। এক্সসাইজ ডিউটির শীর্ষে আছে শতকরা ১৮ ভাগ ভ্যাট। বিদেশ থেকে আনা যেকোনো গাড়ির জন্য এই ভ্যাট প্রযোজ্য। বিশ্বের বড় সব মুদ্রার, যেমন ডলার, বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপি মারাত্মক দুর্বল। এর ফলে আমদানি করা গাড়ির দামে বড় রকম প্রভাব ফেলবে। এর ফলে আর যশোদার মতো স্কুল শিক্ষকদের মতো মানুষদের গাড়ি কেনা কঠিন হয়ে পড়বে। যশোদা বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আমরা একটি গাড়ি কেনার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু যদি ট্যাক্স এবং মূল্য হিসাব করি, তাহলে একটি গড় মাপের গাড়ির মূল্য ২৫ লাখ রুপি থেকে দ্বিগুণ হয়ে ৫০ লাখ রুপি হয়েছে। এটা আমাদের জন্য কোনো সুযোগ এনে দেয়নি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.