গল্প- বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা by লিডিয়া ডেভিস
অনুবাদ : মেহেদী হাসান।
পাহাড়ের পাদদেশ দিয়ে বয়ে চলা রাস্তাটা থেকে আমাকে জমিটা দেখানো হল। আর
সাথে সাথেই আমি জমিটা কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। জমির দালাল তখন যদি
আমাকে জমিটির খারাপ দিক সম্পর্কে অবগত করত, তাহলে সেই মুহূর্তে আমি তার
কথায় কর্ণপাত করতাম না। আশেপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে আমি মোহিত হয়ে
গিয়েছিলাম : লম্বা উপত্যকা জুড়ে গ্রীষ্মের বৃষ্টিতে খানিকটা তলিয়ে যাওয়া
লাল টকটকে আঙ্গুরের ক্ষেত; বেশ দূরে বুনো হলুদ রঙের লতাপাতা এবং কাঁটাগাছের
ঝোপঝাড়ে ভরা ক্ষেত এবং এগুলোর পেছনে জঙ্গলে আচ্ছাদিত পাহাড়ের ঢালু;
উপত্যকার মাঝখানে সামান্য উঁচু জায়গায় একটা খামার বাড়ির ধ্বংসস্তূপ : এটার
বাগানের প্রাচীরের ভাঙা পাথরের ভেতর থেকে একটি তুন্ত গাছ গজিয়েছে এবং পাশেই
মাটির উপর বিছিয়ে থাকা বাদামী রঙের পঁচে যাওয়া নাশপাতিগুলোর উপর প্রাচীন
নাশপাতি গাছটির ছায়া পড়েছে।
গাড়ির উপর ঝুঁকে পড়ে দালালটি বলল, ‘এখনও একটা কক্ষ অটুট আছে। কক্ষটি ময়লা আবর্জনায় ভরা। অনেক বছর ধরে এখানে নানা ধরনের জীব-জন্তুর বাস’। আমরা পায়ে হেঁটে বাড়িটাতে ঢুকলাম। মেঝের টাইলসের উপর জীব-জন্তুর নাদা জমে ঘন হয়ে আছে। পাথরগুলোর মাঝখান দিয়ে বাতাস এসে গায়ে লাগল এবং সুউচ্চ ছাদের ভেতর দিয়ে সূর্যালোক দেখতে পেলাম। তবে এগুলোর কোন কিছুই আমাকে দমাতে পারল না। আমি সেই দিনই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করিয়ে নিলাম।
এক টুকরো জমি খুঁজে পাওয়া এবং সেই জমির উপর বাড়ি বানানোর জন্য আমি এত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি যে, মাঝে মাঝে মনে হয় এই পৃথিবীতে আমার আগমনের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। এই আকাঙ্ক্ষা আমার ভেতরে জন্ম নেয়ার পর থেকে আমার সকল শক্তি-সামর্থ্য এটা পূরণে নিয়োজিত : স্কুলের পাঠ চুকানোর সাথে সাথেই পাওয়া চাকরীটি খুবই ক্লান্তিকর এবং জঘন্য, তবে চাকরীটিতে আমার কাজের বোঝা বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বেতন বাড়তে থাকে। খুব কম টাকায় দিনাতিপাত করতে আমি খুবই সাদামাটা জীবন-যাপন করি এবং নিত্য নতুন বন্ধু-বান্ধব জোটানো এবং নিজেকে উপভোগ করার হাতছানি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি। চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজেকে জমি খোঁজার কাজে নিয়োজিত করার মত টাকা-পয়সা সঞ্চয় করতে আমার অনেক বছর সময় লেগে যায়। রিয়েল এস্টেটের দালাল আমাকে এক জমি থেকে আরেক জমিতে নিয়ে যেতে থাকে। জমি দেখতে দেখতে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং আসলে কী যে খুঁজছি তার দিশা হারিয়ে ফেলি। অবশেষে এই উপত্যকা আমার নজরে আসার সাথে সাথেই আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার মাথা থেকে একটা বিশাল বোঝা নেমে গেল।
গ্রীষ্মের উষ্ণতা যখন বাড়িটির উপর ঝুলে থাকে, কালি-ঝুলি মাখা আমার এই রাজকীয় কক্ষের ভেতরে আমি বেশ মজেই থাকি। ঝাড়পোছ করে নানা ধরনের আসবাবপত্র দিয়ে কক্ষটি সাজাই এবং কোনার দিকে একটা ছবি আঁকার বোর্ড স্থাপন করি, যেখানে আমি বাড়িটাকে নতুন করে বানানোর পরিকল্পনার কাজ শুরু করি। কাজ থেকে চোখ তুলে জলপাই’র পাতায় সূর্যের আলো দেখে বাইরে যাওয়ার জন্য মন আনচান করে ওঠে। বাড়ির পাশে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর সময় আমি সারা জীবন শহরে কাটানো ক্লান্ত ও উৎসুক চোখে লতাগুল্মের ভেতর দিয়ে উড়ে বেড়ানো ম্যাগপাই এবং দেয়ালের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া টিকটিকির দিকে তাকিয়ে থাকি। ঝড়ো বাতাসে আমার জানালার পাশের সাইপ্রেস গাছগুলো নুয়ে পড়ে।
এরপর আসে শরতের কনকনে শীত এবং শিকারীরা আমার বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করতে শুরু করে। তাদের রাইফেলের গুলির শব্দে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠতে থাকি। পার্শ্ববর্তী ক্ষেতে সুয়ারেজ-ট্রিটমেন্ট চত্বরের একটা পাইপ ফেটে যায় এবং ভয়ানক দুর্গন্ধে চারপাশের বাতাস ভরে ওঠে। ফায়ারপ্লেসে আগুন ধরানোর পরও আমার রুম কখনই গরম হত না।
একদিন আমার জানালার কাছে এক তরুণ শিকারীর শরীরের ছায়া দেখতে পাই। লেদারের জ্যাকেট পরা লোকটির কাঁধে রাইফেল। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আমার দরজার নিকটে এসে কড়া না নেড়েই ধাক্কা দিয়ে দরজাটি খুলে ফেলে। দরজার ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার চোখজোড়া ছিল কোমল নীল এবং পাতলা লালচে দাড়িতে তার ত্বক কোনমতে ঢাকা পড়েছিল। তৎক্ষণাৎ তাকে আমার আধা-পাগল মনে হয় এবং আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠি। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে : তারপর রুমের ভেতরে কী আছে সেসব বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখার পর দরজা বন্ধ করে চলে যায়।
আমার ভেতরটা রাগে গজ গজ করতে থাকে। এমনভাবে লোকটি আমার ছোট্ট পাথুরে কলমটি নাড়াচাড়া করে এবং এমন রূঢ়ভাবে আমাকে নিরীক্ষণ করে, মনে হয় যেন সে চিড়িয়াখানা দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে রুমের ভেতরে পায়চারী করতে থাকি। তবে এই অজপাড়া গায়ে আমার এই নিঃসঙ্গ জীবনে সে কৌতুহল জাগিয়ে তোলে। এবং বেশ কিছুদিন পর তাকে দেখার জন্য আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি।
সে আবার আসে এবং এবার সে আর দরজার সামনে ইতস্তত করে না, সোজা হেঁটে ঘরের ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করে। তবে তার মুখের ভাষা আমি বুঝতে পারি না। সে একটা শব্দ দুই-তিন বার করে বলে এবং তা সত্ত্বেও সে কী বলতে চাচ্ছে, তা কেবল ধারণা করতে পারি। এবং যখন আমি তার কথার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি, আমার শহুরে ভাষা বুঝতে তার একই ধরনের সমস্যা হয়। তার সাথে কথাবলা বন্ধ করে আমি তাকে এক গ্লাস মদ এনে দেই। তবে সে তা ফিরিয়ে দেয়। সে অদ্ভুতভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং খুব কাছ থেকে আমার জিনিসপত্র নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করে। দেয়ালের পাশে আমার বইয়ের তাক থেকে সে দেখা শুরু করে। বইয়ের তাকটি ঢাকা ছিল এমন একটা কাপড় দিয়ে, যার উপর ছিল আমার বিশেষ পছন্দের বিভিন্ন স্থাপত্যের বাড়ির প্রিন্ট— বাড়িগুলোর কিছু ছিল প্যারিসের প্লাস দি ভোস (Place des Vosges)-এর রাজকীয় বাড়িগুলোর মতো এবং কিছু ছিল মোনপাহনাস (Montparnasse)-এর পেছনে দরিদ্র লোকদের কোয়ার্টারগুলোর মতো। অবশেষে সে আমার ছবি আঁকার বোর্ডের নিকট আসে, যেখানে সে কিছুক্ষণের জন্য থেমেবোর্ডের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে ব্যাপারটা কী তা জানার জন্য অপেক্ষা করে। আমি একটা বাড়ির বানানোর পরিকল্পনা করছি এই সত্যটি বুঝতে তার বেশ সময় লাগে এবং বুঝতে পারার পর সে প্রতিটি কক্ষের দেয়ালের কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে আঙুল ঘোরাতে থাকে। পরীক্ষা করে দেখা এবং আঙুল ঘোরানো শেষে সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এরপর সে একপাশে এমন ব্যঙ্গাত্মকভাবে তাকায়, যার অর্থ আমি ধরতে পারি না এবং এরপর সে চলে যায়।
আমি আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি এই ভেবে যে, সে আমার রুমে অনধিকার প্রবেশ করে আমার গোপনীয়তা জেনে গেল। তা সত্ত্বেও আমার রাগ পড়ে যাওয়ার পর চাই যে, সে ফিরে আসুক। এই ঝড়ো বাতাসের মধ্যেও সে পরের দিন এল। এবং কয়েকদিন পর আবারও এল। আমি তার প্রতীক্ষায় বসে থাকতে শুরু করি। সে প্রতিদিন অনেক ভোরে শিকারে বের হত এবং সপ্তাহে বেশ কয়েকবার শিকারের পর মাঠ থেকে হেঁটে আমার এখানে চলে আসত, মাঠের সাদা মাটির ওপর রোদ পড়ে চকচক করত। তার মুখ আনন্দে ঝলমল করত এবং সে প্রাণ শক্তিতে এতটাই ভরপুর থাকত যে, তা ভেতরে আটকে রাখতে পারত না : কয়েক মিনিট পরপর চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দ্রুত হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাত, বেসুরো ভাবে শিষ বাজাতে বাজাতে রুমের মাঝখানে ফিরে এসে চেয়ারে বসে পড়ত। ধীরে ধীরে তার শক্তি ফুরিয়ে আসত এবং এক পর্যায়ে সব শক্তি শেষ হয়ে গেলে সে চলে যেত। সে কখনই কোন কিছু খেত না এবং খেতে বললে সে অবাক হয়ে যেত—যেন খাবার বা পানীয় ভাগ করে খাওয়া অন্তরঙ্গতার প্রকাশ।
আমাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করা তেমন সহজ ছিল না, তবে একত্রে করার মতো অনেক কাজ আমরা জুটিয়ে নিয়েছিলাম। দেয়ালের ফাটল বন্ধ করা এবং ফায়ারপ্লেসের জন্য কাঠ জড়ো করে দিয়ে সে শীতকালের জন্য প্রস্তুতি নিতে আমাকে সাহায্য করে। কাজ করার পর আমরা ক্ষেতে ও জঙ্গলে বেড়াতে যেতাম। আমার বন্ধুটি আমাকে তার পছন্দের জায়গাগুলো দেখায়—কাঁটাগাছের কুঞ্জ, খরগোশের আস্তানা এবং পাহাড় গায়ে একটা গুহা। তাকে দেখানোর মত একটা জিনিসই আমার ছিল এবং আমার মতই তার কাছেও এটাকে রহস্যাবৃত এবং চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছে।
সে আমার সাথে দেখা করতে এলেই আমরা প্রথমে নীলনকশাটির কাছে যেতাম, যেখানে আমি আরেকটি কক্ষ যুক্ত করেছি অথবা আমার পড়ার কক্ষের পরিধি বাড়িয়েছি। তাকে দেখানোর জন্য সেখানে সবসময় কোন না কোন পরিবর্তন থাকত, কারণ পরিকল্পনার উন্নতিকল্পে আমি কখনও থেমে থাকি নি এবং সার্বক্ষণিক কাজ করে গিয়েছি। মাঝে মাঝে সে আমার পেন্সিল তুলে নিত এবং এলোপাতাড়ি এমন কিছু আঁকত যা আমার মনে কখনও আসে নি—একটি ধূমপান কক্ষ অথবা আলু রাখার ভূগর্ভস্থ ভান্ডার।
তবে পরিকল্পনাটি নিয়ে ব্যস্ত থাকা এবং বন্ধুর সাথে সময় কাটানো একটা ভয়ঙ্কর সত্য থেকে আমার চোখ ফিরিয়ে রাখে : আমি যতই আমার এই বাড়িটাতে বাস করতে থাকি এবং সময় যতই গড়িয়ে যেতে থাকে আমার বাড়ি বানানোর সম্ভবনা ততই ফিকে হয়ে উঠে। টাকা-পয়সা হাত গলে বেরিয়ে যেতে থাকে এবং আমার স্বপ্নও এটার সাথে সাথে উবে যেতে শুরু করে। আশেপাশে কোন বাজার না থাকা এই গ্রামটিতে খাবারের দাম ছিল শহরের চেয়ে দ্বিগুন। ভাল রাজমিস্ত্রি এবং ছুতার, এমনকি গরীবরাও ছিল দুষ্প্রাপ্য এবং তাদের মজুরী এখানে অনেক বেশী : কয়েক মাসের জন্য তাদের কাজে লাগালে আমার কাছে চলার মত আর তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। এসব জানার পরও আমি হাল ছাড়ি নি, তবে আমাকে জর্জরিত করে রাখা এইসব প্রশ্নের কোন উত্তর আমার জানা ছিল না।
শুরুতে বাড়ির নীলনকশা আমার সকল সময় এবং মনোযোগ কেড়ে নিত কারণ এই নীলনকশা থেকেই আমি আমার বাড়ি তৈরী করতে চেয়েছি। ধীরে ধীরে এই নীলনকশাটি আমার কাছে সত্যিকারের বাড়ির চেয়েও বেশী জীবন্ত হয়ে ওঠে : পেনসিলে আঁকা রেখাগুলোর মাঝে আমি কল্পনায় আরো বেশী সময় কাটাতে থাকি, যে রেখাগুলো আমি আমার খুশী মত পরিবর্তন করতাম। তবে আমি যদি খোলাখুলি স্বীকার করতাম যে, বাড়িটি তৈরীর আর কোন সম্ভাবনা নেই তাহলে নীলনকশাটা তার আবেদন হারাত। সুতরাং বাড়ি তৈরীতে আমি বিশ্বাস হারাই নি যদিও আমার এই বিশ্বাসের তলা থেকে বাড়ি তৈরির সম্ভাবনা ক্রমান্বয়ে ধ্বসে যেতে থাকে।
গ্রামটির আশেপাশে কয়েক মাস অন্তর অন্তর নতুন বাড়ি গজিয়ে ওঠা আমার পরিস্থিতিকে আরো বেশী নাজুক করে তোলে। জমিটা কেনার সময় এই উপত্যকায় একমাত্র যে স্থাপনাগুলো ছিল, তা হল মাঠের মধ্যে চষা জমির উপর উবু হয়ে বসে থাকা পাথরের কুঁড়েঘর যেগুলোর ভেতরটা গুহার মতই অন্ধকার। দলিলে সাক্ষর করার পর আমি এখানে দাঁড়িয়ে একরের পর একর পরিত্যক্ত আঙুর এবং ফসলের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এরপর চোখ চলে গিয়েছিল দিগন্তে যেখানে গ্রামটি একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। দুর্গের মত দেখতে গ্রামটির গীর্জার বুরুজগুলো উপরে গুচ্ছবদ্ধ। আর এখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এই এলাকাটির এখানে সেখানে লাল মাটির উপরে ক্ষত চোখে পড়ে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই ক্ষতের উপর থেকে খোস-পাঁচড়ার মত জেগে উঠে নতুন বাড়ি। এইসব পরিবর্তন মানিয়ে নেয়ার মত সময় এই অঞ্চলটির ছিল না : এক বাড়ির কাজ শেষ হতে না হতেই আরেকটা বাড়ির তৈরীর জন্য ওক গাছ কাটা শুরু হয়ে যেত।
আমি ভয় এবং সন্দেহের সাথে একটা বাড়ি কাজ এগিয়ে যেতে দেখি, কারণ আমার বাড়ি থেকে এটার দূরত্ব ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ। যে পরিকল্পিত গতিতে এটার কাজ এগোতে থাকে তা আমাকে নাড়িয়ে দেয় এবং মনে হয় যেন এটা আমার পরিস্থিতিকে বিদ্রুপ করছে। পান্ডুর বর্ণের দেয়াল এবং জানালায় সস্তা লোহার গ্রিলের বাড়িটা দেখতে কুৎসিত।
বাড়িটার কাজ শেষ হওয়ার এবং বাড়িটির পাশে শেষ চারা গাছটি রোপন হওয়ার সাথে সাথে বাড়ির মালিক পরিবার নিয়ে শহর থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে পুরো সেইন্টডে এখানে কাটিয়ে যায়। এরা বারান্দা থেকে উপত্যকার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন তারা বক্সসিটে বসে অপেরা উপভোগ করছে। আবহাওয়া ভাল থাকলে প্রত্যেক সাপ্তাহিক ছুটিতে তারা বাড়িটাতে আসে এবং এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটাকে তাদের রেডিও’র শব্দে ভরিয়ে ফেলে। আমি গোমড়া মুখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের কাজকর্ম দেখি।
সবচেয়ে খারাপ ঘটনাটা হল, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আমার বন্ধুটি আমার সাথে দেখা করতে আসা বন্ধ করে দিল। আমি জানতাম যে আমার প্রতিবেশীরা তাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। একদিন দূর থেকে উঠানের মধ্যে তাদের মাঝখানে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগে। অবশেষে আমাকে মনে মনে স্বীকার করতে হল যে, আমার পরিস্থিতি কতটা নাজুক। মনে হল জমিটা বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই।
আশা করলাম যে, শহুরে লোকদের কাছ থেকে জমিটির ভাল দাম পাব। তবে যখন আমি রিয়েল এস্টেটের দালালের শরণাপন্ন হলাম, সে আমাকে খোলাখুলি বলল, যেহেতু পাশের জমিতে একটা সুয়ারেজ ইয়ার্ড আছে এবং আমার বাড়ি বসবাসের অযোগ্য তাই, এই জমি বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব। সে আরো বলল যে, আমার প্রতিবেশীরাই কেবল এই জমি কেনার ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। যারা সত্যিকার অর্থে এখানে আমার উপস্থিতিতে বিরক্ত এবং আমাকে এখান থেকে বিদায় করার জন্য নামমাত্র একটা মূল্য দিতে রাজী। তারা এই দালালকে জানিয়েছে যে তাদের বাহির উঠানের সামনে আমার বাড়িটি একটা চক্ষুশূল এবং তাদের বন্ধু-বান্ধব বেড়াতে এলে এটা তাদের জন্য বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়। এটা শুনে আমি খুবই মর্মাহত হলাম। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে, এই জমি কখনই আমার প্রতিবেশীদের নিকট বিক্রি করব না। কখনই আমার উপর দিয়ে তাদেরকে টেক্কা দিতে দিব না। আমি কোন কথা না বাড়িয়ে দালালটির কাছ থেকে চলে আসি। যখন আমি বিষন্ন মনে দরজার বাইরে পা রাখি তখন তার অন্য রুমে হেঁটে যাওয়ার এবং তার বউয়ের সাথে কথা বলার এবং উচ্চস্বরে হাসার শব্দ শুনতে পাই।
এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়।
কয়েক সপ্তাহ পর আমার বন্ধুটি যখন কোন কিছু না জানিয়ে আমার এখানে আসা একবারে বন্ধ করে দেয় তখন আমার তিক্ততা কানায় কানায় ভরে উঠে। আমি হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হই এবং সিদ্ধান্তে আসি যে, বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে শহরে গিয়ে আমার পুরাতন চাকরীতে ফিরে যাব। আমার প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা আমার জায়গায় নেয়ার মত এমন কাউকে খুঁজে পায় নি যে, এই দীর্ঘ কর্ম ঘন্টা হাসি মুখে সহ্য করবে এবং নিজেকে এই অন্তহীন জটিলতার মধ্যে নিক্ষেপ করবে। তারা বেশ কয়েকবার চিঠি লেখে আমাকে ফিরে আসতে বলেছে এবং বেশী বেতনের প্রস্তাব দিয়েছে। আমার মনে হল আমি খুব সহজেই আমার পুরাতন জীবনে ফিরে যেতে পারি। তাহলে এই গ্রামাঞ্চলে আমার এই থাকাটাকে একটা দীর্ঘ ছুটি কাটানো বলে চালিয়ে দেয়া যায়। এমনকি কিছুক্ষণের জন্য আমার মধ্যে এই উপলব্ধি আসে যে আমি শহুরে জীবন এবং অফিসে আমার পরিচিতদের অভাব অনুভব করছি, যারা আমাকে বিশেষ করে কর্মক্লান্ত দিন শেষে পানীয় কিনে খাওয়াত। জমির দালালটিকে আমার প্রতিবেশীদের কাছে জমি বিক্রির প্রস্তাব দিতে বলি এবং নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে আমি সঠিক কাজটিই করছি। তবে এই কাজে আমার হৃদয় টানে নি। জিনিসপত্র বাঁধার সময় এবং বাড়ির ক্ষুদ্র চৌহদ্দির মধ্যে শেষবারের মত হেঁটে বেড়ানোর সময় নিজেকে একজন বদলে যাওয়া মানুষ মনে হতে থাকে।
প্রথম সূর্যালোকে আমার সুটকেস দরজার বাইরে আসে এবং আমার ভাড়া করা ট্যাক্সিটি ধুলো-ধূসরিত রাস্তা দিয়ে হেলেদুলে আমার কাছে চলে আসে। এবং আমি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছিলাম। মনে হল আমি বোধ হয় একটু তাড়াহুড়া করে ফেলছি। তরুণ বন্ধুটির কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে যাওয়াটা বোধ হয় ঠিক হবে না, যে বন্ধুটির নামও আমি জানি না। ট্যাক্সি চালককে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে পরের দিন ঠিক এই সময়ে আসতে বলি। সে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। ট্যাক্সির পেছনে ধুলো ঘূর্ণি হয়ে উঠে গাড়ির পেছন পেছন যেতে থাকে। আমি সুটকেসগুলো রুমের ভেতরে নিয়ে এসে বসে থাকি। আমার বন্ধুটিকে কিভাবে খুঁজে বের করা যায় তা ভেবে কিছুটা সময় ব্যয় করার পর আমার মনে হল যে, বোকার মত কাজ করে ফেলেছি। এরকম শোচনীয় পরিস্থিতিতে নিজেকে আরেকটা দিন ধরে রাখার কোন মানে হয় না এবং তাকে খুঁজে পাওয়াও সম্ভব নয়। অফিসের কর্তাব্যক্তিরা যখন দেখবে যে আমি অফিসে এসে উপস্থিত হই নি তখন বিরক্ত হয়ে উঠবে। তারা আমার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে আমার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করবে। এবং খোঁজ নিতে না পেরে পুরোপুরি হতাশ হয়ে যাবে। সকাল গড়িয়ে যেতে থাকে এবং আমি আরো বেশী অস্থির ও নিজের প্রতি রেগে উঠি। আমার মনে হয় যে, বিশাল ভুল করে ফেলেছি। তবে এটা ভেবে একটু স্বস্তি পাই যে, পরের দিন সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক হবে এবং শেষমেষ মনে হবে যে এই দিনটি আমাকে কখনও পার করতে হয় নি।
সেই দীর্ঘতপ্ত বিকেলে ছোট ছোট পাখিরা কাঁটাময় ঝোপঝাড়ে ডানা ঝাপটাতে থাকে এবং মাটি থেকে মিষ্টি গন্ধ ভেসে ওঠে। আকাশ ছিল মেঘশূন্য এবং সূর্য জমিনের বুকে কালো ছায়া ফেলছিল। আমি চারপাশের সৌন্দর্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কাচারী ঘরের দেয়ালের পাশে বসে থাকি। আমার মন পড়ে থাকে শহরে এবং গ্রামের এই বন্দীদশা একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। ঘরে রাতের বেলায় খাওয়ার মত কিছু ছিল না, তবে গ্রামের দিকে হেঁটে যেতেও ইচ্ছা করছিল না। ঠান্ডায় এবং ক্ষুধায় কাতর হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় নির্ঘুম শুয়ে থাকি।
সূর্যাদয়ের আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়ি। আমি এমন ভয়ঙ্কর ক্ষুধার্ত ছিলাম যে, মনে হল যেন পেটে পাথর গজিয়েছে। ভাবলাম ট্রেন স্টেশনে গিয়ে সকালের নাস্তা সারা যাবে। জানালার বাইরে সবকিছু অন্ধকারে ঢাকা। অন্ধকার জঙ্গলের ওপাশে পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে এলে দমকা হাওয়া এসে গাছের পাতা নাড়িয়ে দিল। ধীরে ধীরে গাছের পাতারা সবুজ রঙ ফিরে পেল। জঙ্গলে এবং বাড়ির পাশে পাখ-পাখালির কলকাকলী জেগে উঠে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। আমি খুব মনযোগ দিয়ে পাখিদের কল-কাকলী শুনলাম। অবশেষে যখন ট্যাক্সিটি চলে এল তখন এখানে এতই ভাল লেগে গেল যে, এখান থেকে চলে যেতে মন সায় দিল না। ট্যাক্সি চালক রাগারাগি করে চলে গেল।
পুরো সকালবেলা এবং বিকেল অব্দি আগের দিন ঠিক যেমনভাবে বসে ছিলাম সেভাবে আমি কাচারী ঘরে বসে রইলাম, তবে আজকে আমি অধৈর্য হয়ে পড়ি নি বা অন্য কোথাও যেতে মন উৎসুক হয় নি। আমার সামনে যা ঘটে চলে তাতে আমি মগ্ন হয়ে পড়ি—জঙ্গলের ভেতরে পাখদের হারিয়ে যাওয়া, পোকা-মাকড়দের পাথরের গা বেয়ে হেঁটে বেড়ানো—যেন আমি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছি, যেন আমি নিজের অনুপুস্থিতে সবকিছু চেয়ে চেয়ে দেখছি। অথবা এমন জায়গায় আছি যেখানে আমার থাকা উচিত নয়, যেখানে আমাকে কেউ চায় না, কিছুক্ষণের জন্য আলোর পেছনে পড়ে গিয়ে আমি নিজের ছায়া হয়ে উঠেছি; স্যুটকেসের ফিতা শীঘ্রই আটোসাটো হবে এবং আমি চলে যাব নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেতে : আমি আবার স্বাধীন হয়ে উঠব।
সন্ধ্যা নামার সময় আমি বুঝতে পারি নি যে, আমি ক্ষুধার্ত। বেশ হালকা বোধ হতে থাকে। আমি বসে বসে কিসের জন্য যেন অপেক্ষা করতে থাকি। প্রচণ্ড শীত এবং অন্ধকার তাড়িত হয়ে ঘরের ভেতরে এসে শুয়ে পড়ি এবং নানা ধরনের দুঃস্বপ্ন দেখি।
পরের দিন সকালবেলায় সবচেয়ে কাছের ক্ষেতটির দূর প্রান্তে ধীরে ধীরে হেঁটে আসতে থাকা একটা অবয়ব চোখে পড়ে। আমার মনে হল যেন একটি বিশাল শূন্যতা ভরে উঠল। শূন্যতাটির কথা না জেনেই আমি সেই কবে থেকে আমার বন্ধুর প্রতীক্ষায় বসে আছি। তাকে দেখার সাথে সাথে তার দ্বিধা অস্বাভাবিক মনে হতে শুরু হল এবং এটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিল। সে হলরেখার ওপর দিয়ে হেলেদুলে আসছে, সে তার নাকটি এমনভাবে উপরে তুলে রেখেছে যেন স্প্যানিয়েল কুকুরের মত বাতাসের গন্ধ শুকছে এবং মনে হল কোথায় যাচ্ছে তা সে জানে না। তাকে এগিয়ে আনার জন্য তার দিকে দৌড়ে যাই এবং কাছাকাছি এসে দেখতে পাই যে, কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা এবং মুখ ভয়ানক ফ্যাকাসে। কাছে আসতেই সে হতচকিত হয়ে যায় এবং আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন আমি তার অপরিচিত। আমি তাকে ধরে ধরে নিয়ে আসি। বাড়িতে ঢোকা মাত্রই সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে সে থরথর করে কাঁপছিল। সে এত বেশী শুকিয়ে গেছে যে তার গালে গর্ত পড়ে গেছে এবং তার হাত হয়ে উঠেছে নখরের মত, চোখ জ্বরে জবা ফুলের মত লাল। আমি ডাক্তার ডাকতে গ্রামে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠি। তবে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হওয়ার পর সে অনেকটা ধীর-স্থির ভাবে কথা বলতে শুরু করে। অনেকক্ষণ ধরে সে কিছু একটা বলে এবং আমি কিছু না বুঝেই বিছানার পাশে বসে শুনে যাই। সে তার হাত দিয়ে বেশ কয়েকটা অঙ্গভঙ্গি করল এবং অবশেষে আমি বুঝতে পারি যে, শিকার করার সময় সে কোন একটা দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে যখন আমি তাকে মনে মনে গালাগাল দিচ্ছি তখন সে কোন এক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে।
সে অবিরত কথা বলতে থাকে এবং সে কী বলছে সেদিকে মনযোগ দেয়া আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠে। আমি অধৈর্য হয়ে উঠি। কিছুক্ষণ পর আমি এটা আর নিতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে রুমের ভেতরে পায়চারি করতে শুরু করি। অবশেষে সে চুপ করে এবং রুমের এক কোনে জানালার নীচে আঙুল নির্দেশ করে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না কারন সেখানে জানালা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম যে, সে ছবি আকার বোর্ডের দিকে আমার মনযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে যা ওখান থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। মানে, সে আমার বাড়ির নীলনকশাটা দেখতে চায়। মোড়ক খুলে নীলনকশাটা তার হাতে দিলাম। তারপরও তাকে অসন্তুষ্ট মনে হল। পকেট হাতড়ে একটা পেনসিল বের করে তাকে দিলাম। সে নীলনকশার উপর আঁকতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে সে পুরো কাগজটি কিনারা পর্যন্ত জটিল সব চিত্র দিয়ে ভরে ফেলল। তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে কাগজটির দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে আমি একটি টাওয়ারের ছবি চিনতে পারলাম এবং এমন একটা কিছু যাকে এই সব আঁকিবুঁকির মধ্যে একটা দরজা বলে বোধ হল। পৃষ্ঠাটি ভরিয়ে ফেললে আমি তাকে আরো পৃষ্ঠা এনে দিলাম এবং সে আঁকতে থাকল। আঁকার সময় তার হাত থামে নি বললেই চলে এবং যা সে এঁকেছে তার মধ্যে এমন জটিলতা আছে যা, বহু নিঃসঙ্গ দিনের চিন্তা এবং অনুশীলনের ফলেই কেবল আয়ত্ত করা সম্ভব। যখন সে এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে, পেনসিল নড়ানোর মত শক্তিও আর অবশিষ্ট রইল না, তখন সে ঘুমিয়ে পড়ল। সেই সন্ধ্যায় আমি তাকে রেখে গ্রামে খাবারের খোঁজে গেলাম।
ক্ষেত-খামার পাড়ি দিয়ে বাড়িতে ফেরার সময় লাল রঙের ভূ-দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে মনে হল যে আমি এটার সাথে গভীরভাবে পরিচিত, যেন এখানে আসার অনেক আগে থেকেই এটা আমার। এটাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তাকে তাৎপর্যহীন মনে হল। কয়েক দিনের মধ্যে আমার ক্ষোভ এবং হতাশায় ভাটা পড়ে, এখন সেই শুরুর দিককার মত যে জিনিসের দিকেই তাকাই না কেন, মনে হয় যেন একটা খোলস অথবা একটা খোসা যা ফেঁটে গিয়ে একটা নিখুঁত ফল বের হয়ে পড়বে। ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও, আমার মন সম্মুখ পানে ধাবিত হল : আমি বাড়ির পাশের এক ফালি জমি পরিষ্কার করে নিয়ে একটা আস্তাবল তৈরী করে সাদা-কালো গাভীদের নিয়ে এসে সেখানে ঢোকালাম আর ভীত-সন্ত্রস্ত মুরগীরা এগুলোর চারপাশে হেঁটে বেড়াতে লাগল। প্রতিবেশীর বাড়িটাকে আড়াল করার জন্য বাড়ির সীমানা দিয়ে একসার সাইপ্রেস গাছ লাগালাম। ধ্বসে পড়া দেয়ালটি ভেঙ্গে ফেলে একই পাথর দিয়ে আমার নিজস্ব খামার বাড়ি তৈরী করে ফেললাম। শেষ হওয়ার পর মনে হল এটা যার চোখে পড়বে তারই ঈর্ষা জাগ্রত হবে। আমার স্বপ্ন সত্যি হবে, প্রথমে যেমনটা হওয়ার কথা ছিল।
আমি সম্ভবত প্রলাপ বকছিলাম। ব্যাপারটির এমন পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তবে আমি যখন ক্ষেতের উপর হলরেখার গভীরে এক পা দিয়ে এবং আরেক পা দিয়ে হলরেখার চূড়া অতিক্রম করে হেঁটে আসছিলাম, এই আশঙ্কায় আমি খুবই খুশী হয়ে উঠি যে, যেকোন সময় আমার হতাশা এবং নৈরাশ্য পঙ্গপালের মত আকাশ অন্ধকার করে দিয়ে আমার উপর নিমজ্জিত হবে। সন্ধ্যাটা স্নিগ্ধ, আলো নরম ও কমনীয়, পৃথিবীটা পক্ষাঘাতগ্রস্থ এবং আমি, অনেক নীচে, একমাত্র সচল প্রাণী।
গাড়ির উপর ঝুঁকে পড়ে দালালটি বলল, ‘এখনও একটা কক্ষ অটুট আছে। কক্ষটি ময়লা আবর্জনায় ভরা। অনেক বছর ধরে এখানে নানা ধরনের জীব-জন্তুর বাস’। আমরা পায়ে হেঁটে বাড়িটাতে ঢুকলাম। মেঝের টাইলসের উপর জীব-জন্তুর নাদা জমে ঘন হয়ে আছে। পাথরগুলোর মাঝখান দিয়ে বাতাস এসে গায়ে লাগল এবং সুউচ্চ ছাদের ভেতর দিয়ে সূর্যালোক দেখতে পেলাম। তবে এগুলোর কোন কিছুই আমাকে দমাতে পারল না। আমি সেই দিনই প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করিয়ে নিলাম।
এক টুকরো জমি খুঁজে পাওয়া এবং সেই জমির উপর বাড়ি বানানোর জন্য আমি এত বছর ধরে অপেক্ষা করে আছি যে, মাঝে মাঝে মনে হয় এই পৃথিবীতে আমার আগমনের আর কোন উদ্দেশ্য নেই। এই আকাঙ্ক্ষা আমার ভেতরে জন্ম নেয়ার পর থেকে আমার সকল শক্তি-সামর্থ্য এটা পূরণে নিয়োজিত : স্কুলের পাঠ চুকানোর সাথে সাথেই পাওয়া চাকরীটি খুবই ক্লান্তিকর এবং জঘন্য, তবে চাকরীটিতে আমার কাজের বোঝা বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বেতন বাড়তে থাকে। খুব কম টাকায় দিনাতিপাত করতে আমি খুবই সাদামাটা জীবন-যাপন করি এবং নিত্য নতুন বন্ধু-বান্ধব জোটানো এবং নিজেকে উপভোগ করার হাতছানি থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখি। চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে নিজেকে জমি খোঁজার কাজে নিয়োজিত করার মত টাকা-পয়সা সঞ্চয় করতে আমার অনেক বছর সময় লেগে যায়। রিয়েল এস্টেটের দালাল আমাকে এক জমি থেকে আরেক জমিতে নিয়ে যেতে থাকে। জমি দেখতে দেখতে আমি বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি এবং আসলে কী যে খুঁজছি তার দিশা হারিয়ে ফেলি। অবশেষে এই উপত্যকা আমার নজরে আসার সাথে সাথেই আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার মাথা থেকে একটা বিশাল বোঝা নেমে গেল।
গ্রীষ্মের উষ্ণতা যখন বাড়িটির উপর ঝুলে থাকে, কালি-ঝুলি মাখা আমার এই রাজকীয় কক্ষের ভেতরে আমি বেশ মজেই থাকি। ঝাড়পোছ করে নানা ধরনের আসবাবপত্র দিয়ে কক্ষটি সাজাই এবং কোনার দিকে একটা ছবি আঁকার বোর্ড স্থাপন করি, যেখানে আমি বাড়িটাকে নতুন করে বানানোর পরিকল্পনার কাজ শুরু করি। কাজ থেকে চোখ তুলে জলপাই’র পাতায় সূর্যের আলো দেখে বাইরে যাওয়ার জন্য মন আনচান করে ওঠে। বাড়ির পাশে ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর সময় আমি সারা জীবন শহরে কাটানো ক্লান্ত ও উৎসুক চোখে লতাগুল্মের ভেতর দিয়ে উড়ে বেড়ানো ম্যাগপাই এবং দেয়ালের ভেতরে হারিয়ে যাওয়া টিকটিকির দিকে তাকিয়ে থাকি। ঝড়ো বাতাসে আমার জানালার পাশের সাইপ্রেস গাছগুলো নুয়ে পড়ে।
এরপর আসে শরতের কনকনে শীত এবং শিকারীরা আমার বাড়ির আশপাশ দিয়ে ঘুরঘুর করতে শুরু করে। তাদের রাইফেলের গুলির শব্দে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠতে থাকি। পার্শ্ববর্তী ক্ষেতে সুয়ারেজ-ট্রিটমেন্ট চত্বরের একটা পাইপ ফেটে যায় এবং ভয়ানক দুর্গন্ধে চারপাশের বাতাস ভরে ওঠে। ফায়ারপ্লেসে আগুন ধরানোর পরও আমার রুম কখনই গরম হত না।
একদিন আমার জানালার কাছে এক তরুণ শিকারীর শরীরের ছায়া দেখতে পাই। লেদারের জ্যাকেট পরা লোকটির কাঁধে রাইফেল। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে আমার দরজার নিকটে এসে কড়া না নেড়েই ধাক্কা দিয়ে দরজাটি খুলে ফেলে। দরজার ছায়ায় দাঁড়িয়ে সে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার চোখজোড়া ছিল কোমল নীল এবং পাতলা লালচে দাড়িতে তার ত্বক কোনমতে ঢাকা পড়েছিল। তৎক্ষণাৎ তাকে আমার আধা-পাগল মনে হয় এবং আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠি। সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে : তারপর রুমের ভেতরে কী আছে সেসব বেশ কিছুক্ষণ ধরে দেখার পর দরজা বন্ধ করে চলে যায়।
আমার ভেতরটা রাগে গজ গজ করতে থাকে। এমনভাবে লোকটি আমার ছোট্ট পাথুরে কলমটি নাড়াচাড়া করে এবং এমন রূঢ়ভাবে আমাকে নিরীক্ষণ করে, মনে হয় যেন সে চিড়িয়াখানা দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়ে রুমের ভেতরে পায়চারী করতে থাকি। তবে এই অজপাড়া গায়ে আমার এই নিঃসঙ্গ জীবনে সে কৌতুহল জাগিয়ে তোলে। এবং বেশ কিছুদিন পর তাকে দেখার জন্য আমি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি।
সে আবার আসে এবং এবার সে আর দরজার সামনে ইতস্তত করে না, সোজা হেঁটে ঘরের ভেতরে ঢুকে একটা চেয়ারে বসে আমার সাথে কথা বলতে শুরু করে। তবে তার মুখের ভাষা আমি বুঝতে পারি না। সে একটা শব্দ দুই-তিন বার করে বলে এবং তা সত্ত্বেও সে কী বলতে চাচ্ছে, তা কেবল ধারণা করতে পারি। এবং যখন আমি তার কথার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি, আমার শহুরে ভাষা বুঝতে তার একই ধরনের সমস্যা হয়। তার সাথে কথাবলা বন্ধ করে আমি তাকে এক গ্লাস মদ এনে দেই। তবে সে তা ফিরিয়ে দেয়। সে অদ্ভুতভাবে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং খুব কাছ থেকে আমার জিনিসপত্র নিরীক্ষণ করার চেষ্টা করে। দেয়ালের পাশে আমার বইয়ের তাক থেকে সে দেখা শুরু করে। বইয়ের তাকটি ঢাকা ছিল এমন একটা কাপড় দিয়ে, যার উপর ছিল আমার বিশেষ পছন্দের বিভিন্ন স্থাপত্যের বাড়ির প্রিন্ট— বাড়িগুলোর কিছু ছিল প্যারিসের প্লাস দি ভোস (Place des Vosges)-এর রাজকীয় বাড়িগুলোর মতো এবং কিছু ছিল মোনপাহনাস (Montparnasse)-এর পেছনে দরিদ্র লোকদের কোয়ার্টারগুলোর মতো। অবশেষে সে আমার ছবি আঁকার বোর্ডের নিকট আসে, যেখানে সে কিছুক্ষণের জন্য থেমেবোর্ডের দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে ব্যাপারটা কী তা জানার জন্য অপেক্ষা করে। আমি একটা বাড়ির বানানোর পরিকল্পনা করছি এই সত্যটি বুঝতে তার বেশ সময় লাগে এবং বুঝতে পারার পর সে প্রতিটি কক্ষের দেয়ালের কয়েক ইঞ্চি ওপর দিয়ে আঙুল ঘোরাতে থাকে। পরীক্ষা করে দেখা এবং আঙুল ঘোরানো শেষে সে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। এরপর সে একপাশে এমন ব্যঙ্গাত্মকভাবে তাকায়, যার অর্থ আমি ধরতে পারি না এবং এরপর সে চলে যায়।
আমি আবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠি এই ভেবে যে, সে আমার রুমে অনধিকার প্রবেশ করে আমার গোপনীয়তা জেনে গেল। তা সত্ত্বেও আমার রাগ পড়ে যাওয়ার পর চাই যে, সে ফিরে আসুক। এই ঝড়ো বাতাসের মধ্যেও সে পরের দিন এল। এবং কয়েকদিন পর আবারও এল। আমি তার প্রতীক্ষায় বসে থাকতে শুরু করি। সে প্রতিদিন অনেক ভোরে শিকারে বের হত এবং সপ্তাহে বেশ কয়েকবার শিকারের পর মাঠ থেকে হেঁটে আমার এখানে চলে আসত, মাঠের সাদা মাটির ওপর রোদ পড়ে চকচক করত। তার মুখ আনন্দে ঝলমল করত এবং সে প্রাণ শক্তিতে এতটাই ভরপুর থাকত যে, তা ভেতরে আটকে রাখতে পারত না : কয়েক মিনিট পরপর চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে দ্রুত হেঁটে দরজার কাছে গিয়ে বাইরে তাকাত, বেসুরো ভাবে শিষ বাজাতে বাজাতে রুমের মাঝখানে ফিরে এসে চেয়ারে বসে পড়ত। ধীরে ধীরে তার শক্তি ফুরিয়ে আসত এবং এক পর্যায়ে সব শক্তি শেষ হয়ে গেলে সে চলে যেত। সে কখনই কোন কিছু খেত না এবং খেতে বললে সে অবাক হয়ে যেত—যেন খাবার বা পানীয় ভাগ করে খাওয়া অন্তরঙ্গতার প্রকাশ।
আমাদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করা তেমন সহজ ছিল না, তবে একত্রে করার মতো অনেক কাজ আমরা জুটিয়ে নিয়েছিলাম। দেয়ালের ফাটল বন্ধ করা এবং ফায়ারপ্লেসের জন্য কাঠ জড়ো করে দিয়ে সে শীতকালের জন্য প্রস্তুতি নিতে আমাকে সাহায্য করে। কাজ করার পর আমরা ক্ষেতে ও জঙ্গলে বেড়াতে যেতাম। আমার বন্ধুটি আমাকে তার পছন্দের জায়গাগুলো দেখায়—কাঁটাগাছের কুঞ্জ, খরগোশের আস্তানা এবং পাহাড় গায়ে একটা গুহা। তাকে দেখানোর মত একটা জিনিসই আমার ছিল এবং আমার মতই তার কাছেও এটাকে রহস্যাবৃত এবং চিত্তাকর্ষক মনে হয়েছে।
সে আমার সাথে দেখা করতে এলেই আমরা প্রথমে নীলনকশাটির কাছে যেতাম, যেখানে আমি আরেকটি কক্ষ যুক্ত করেছি অথবা আমার পড়ার কক্ষের পরিধি বাড়িয়েছি। তাকে দেখানোর জন্য সেখানে সবসময় কোন না কোন পরিবর্তন থাকত, কারণ পরিকল্পনার উন্নতিকল্পে আমি কখনও থেমে থাকি নি এবং সার্বক্ষণিক কাজ করে গিয়েছি। মাঝে মাঝে সে আমার পেন্সিল তুলে নিত এবং এলোপাতাড়ি এমন কিছু আঁকত যা আমার মনে কখনও আসে নি—একটি ধূমপান কক্ষ অথবা আলু রাখার ভূগর্ভস্থ ভান্ডার।
তবে পরিকল্পনাটি নিয়ে ব্যস্ত থাকা এবং বন্ধুর সাথে সময় কাটানো একটা ভয়ঙ্কর সত্য থেকে আমার চোখ ফিরিয়ে রাখে : আমি যতই আমার এই বাড়িটাতে বাস করতে থাকি এবং সময় যতই গড়িয়ে যেতে থাকে আমার বাড়ি বানানোর সম্ভবনা ততই ফিকে হয়ে উঠে। টাকা-পয়সা হাত গলে বেরিয়ে যেতে থাকে এবং আমার স্বপ্নও এটার সাথে সাথে উবে যেতে শুরু করে। আশেপাশে কোন বাজার না থাকা এই গ্রামটিতে খাবারের দাম ছিল শহরের চেয়ে দ্বিগুন। ভাল রাজমিস্ত্রি এবং ছুতার, এমনকি গরীবরাও ছিল দুষ্প্রাপ্য এবং তাদের মজুরী এখানে অনেক বেশী : কয়েক মাসের জন্য তাদের কাজে লাগালে আমার কাছে চলার মত আর তেমন কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। এসব জানার পরও আমি হাল ছাড়ি নি, তবে আমাকে জর্জরিত করে রাখা এইসব প্রশ্নের কোন উত্তর আমার জানা ছিল না।
শুরুতে বাড়ির নীলনকশা আমার সকল সময় এবং মনোযোগ কেড়ে নিত কারণ এই নীলনকশা থেকেই আমি আমার বাড়ি তৈরী করতে চেয়েছি। ধীরে ধীরে এই নীলনকশাটি আমার কাছে সত্যিকারের বাড়ির চেয়েও বেশী জীবন্ত হয়ে ওঠে : পেনসিলে আঁকা রেখাগুলোর মাঝে আমি কল্পনায় আরো বেশী সময় কাটাতে থাকি, যে রেখাগুলো আমি আমার খুশী মত পরিবর্তন করতাম। তবে আমি যদি খোলাখুলি স্বীকার করতাম যে, বাড়িটি তৈরীর আর কোন সম্ভাবনা নেই তাহলে নীলনকশাটা তার আবেদন হারাত। সুতরাং বাড়ি তৈরীতে আমি বিশ্বাস হারাই নি যদিও আমার এই বিশ্বাসের তলা থেকে বাড়ি তৈরির সম্ভাবনা ক্রমান্বয়ে ধ্বসে যেতে থাকে।
গ্রামটির আশেপাশে কয়েক মাস অন্তর অন্তর নতুন বাড়ি গজিয়ে ওঠা আমার পরিস্থিতিকে আরো বেশী নাজুক করে তোলে। জমিটা কেনার সময় এই উপত্যকায় একমাত্র যে স্থাপনাগুলো ছিল, তা হল মাঠের মধ্যে চষা জমির উপর উবু হয়ে বসে থাকা পাথরের কুঁড়েঘর যেগুলোর ভেতরটা গুহার মতই অন্ধকার। দলিলে সাক্ষর করার পর আমি এখানে দাঁড়িয়ে একরের পর একর পরিত্যক্ত আঙুর এবং ফসলের ক্ষেতের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। এরপর চোখ চলে গিয়েছিল দিগন্তে যেখানে গ্রামটি একটি ছোট্ট পাহাড়ের উপর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। দুর্গের মত দেখতে গ্রামটির গীর্জার বুরুজগুলো উপরে গুচ্ছবদ্ধ। আর এখন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এই এলাকাটির এখানে সেখানে লাল মাটির উপরে ক্ষত চোখে পড়ে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই ক্ষতের উপর থেকে খোস-পাঁচড়ার মত জেগে উঠে নতুন বাড়ি। এইসব পরিবর্তন মানিয়ে নেয়ার মত সময় এই অঞ্চলটির ছিল না : এক বাড়ির কাজ শেষ হতে না হতেই আরেকটা বাড়ির তৈরীর জন্য ওক গাছ কাটা শুরু হয়ে যেত।
আমি ভয় এবং সন্দেহের সাথে একটা বাড়ি কাজ এগিয়ে যেতে দেখি, কারণ আমার বাড়ি থেকে এটার দূরত্ব ছিল মাত্র কয়েক মিনিটের হাঁটাপথ। যে পরিকল্পিত গতিতে এটার কাজ এগোতে থাকে তা আমাকে নাড়িয়ে দেয় এবং মনে হয় যেন এটা আমার পরিস্থিতিকে বিদ্রুপ করছে। পান্ডুর বর্ণের দেয়াল এবং জানালায় সস্তা লোহার গ্রিলের বাড়িটা দেখতে কুৎসিত।
বাড়িটার কাজ শেষ হওয়ার এবং বাড়িটির পাশে শেষ চারা গাছটি রোপন হওয়ার সাথে সাথে বাড়ির মালিক পরিবার নিয়ে শহর থেকে গাড়ি চালিয়ে এসে পুরো সেইন্টডে এখানে কাটিয়ে যায়। এরা বারান্দা থেকে উপত্যকার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন তারা বক্সসিটে বসে অপেরা উপভোগ করছে। আবহাওয়া ভাল থাকলে প্রত্যেক সাপ্তাহিক ছুটিতে তারা বাড়িটাতে আসে এবং এই প্রত্যন্ত অঞ্চলটাকে তাদের রেডিও’র শব্দে ভরিয়ে ফেলে। আমি গোমড়া মুখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে তাদের কাজকর্ম দেখি।
সবচেয়ে খারাপ ঘটনাটা হল, সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে আমার বন্ধুটি আমার সাথে দেখা করতে আসা বন্ধ করে দিল। আমি জানতাম যে আমার প্রতিবেশীরা তাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে। একদিন দূর থেকে উঠানের মধ্যে তাদের মাঝখানে তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। আমার নিজেকে খুব অসহায় লাগে। অবশেষে আমাকে মনে মনে স্বীকার করতে হল যে, আমার পরিস্থিতি কতটা নাজুক। মনে হল জমিটা বিক্রি করে দিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই।
আশা করলাম যে, শহুরে লোকদের কাছ থেকে জমিটির ভাল দাম পাব। তবে যখন আমি রিয়েল এস্টেটের দালালের শরণাপন্ন হলাম, সে আমাকে খোলাখুলি বলল, যেহেতু পাশের জমিতে একটা সুয়ারেজ ইয়ার্ড আছে এবং আমার বাড়ি বসবাসের অযোগ্য তাই, এই জমি বিক্রি করা প্রায় অসম্ভব। সে আরো বলল যে, আমার প্রতিবেশীরাই কেবল এই জমি কেনার ব্যাপারে আগ্রহী হতে পারে। যারা সত্যিকার অর্থে এখানে আমার উপস্থিতিতে বিরক্ত এবং আমাকে এখান থেকে বিদায় করার জন্য নামমাত্র একটা মূল্য দিতে রাজী। তারা এই দালালকে জানিয়েছে যে তাদের বাহির উঠানের সামনে আমার বাড়িটি একটা চক্ষুশূল এবং তাদের বন্ধু-বান্ধব বেড়াতে এলে এটা তাদের জন্য বিব্রতকর হয়ে দাঁড়ায়। এটা শুনে আমি খুবই মর্মাহত হলাম। আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলাম যে, এই জমি কখনই আমার প্রতিবেশীদের নিকট বিক্রি করব না। কখনই আমার উপর দিয়ে তাদেরকে টেক্কা দিতে দিব না। আমি কোন কথা না বাড়িয়ে দালালটির কাছ থেকে চলে আসি। যখন আমি বিষন্ন মনে দরজার বাইরে পা রাখি তখন তার অন্য রুমে হেঁটে যাওয়ার এবং তার বউয়ের সাথে কথা বলার এবং উচ্চস্বরে হাসার শব্দ শুনতে পাই।
এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়।
কয়েক সপ্তাহ পর আমার বন্ধুটি যখন কোন কিছু না জানিয়ে আমার এখানে আসা একবারে বন্ধ করে দেয় তখন আমার তিক্ততা কানায় কানায় ভরে উঠে। আমি হতাশার সাগরে নিমজ্জিত হই এবং সিদ্ধান্তে আসি যে, বাড়ি বানানোর পরিকল্পনা বাদ দিয়ে শহরে গিয়ে আমার পুরাতন চাকরীতে ফিরে যাব। আমার প্রতিষ্ঠানের কর্তা ব্যক্তিরা আমার জায়গায় নেয়ার মত এমন কাউকে খুঁজে পায় নি যে, এই দীর্ঘ কর্ম ঘন্টা হাসি মুখে সহ্য করবে এবং নিজেকে এই অন্তহীন জটিলতার মধ্যে নিক্ষেপ করবে। তারা বেশ কয়েকবার চিঠি লেখে আমাকে ফিরে আসতে বলেছে এবং বেশী বেতনের প্রস্তাব দিয়েছে। আমার মনে হল আমি খুব সহজেই আমার পুরাতন জীবনে ফিরে যেতে পারি। তাহলে এই গ্রামাঞ্চলে আমার এই থাকাটাকে একটা দীর্ঘ ছুটি কাটানো বলে চালিয়ে দেয়া যায়। এমনকি কিছুক্ষণের জন্য আমার মধ্যে এই উপলব্ধি আসে যে আমি শহুরে জীবন এবং অফিসে আমার পরিচিতদের অভাব অনুভব করছি, যারা আমাকে বিশেষ করে কর্মক্লান্ত দিন শেষে পানীয় কিনে খাওয়াত। জমির দালালটিকে আমার প্রতিবেশীদের কাছে জমি বিক্রির প্রস্তাব দিতে বলি এবং নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করি যে আমি সঠিক কাজটিই করছি। তবে এই কাজে আমার হৃদয় টানে নি। জিনিসপত্র বাঁধার সময় এবং বাড়ির ক্ষুদ্র চৌহদ্দির মধ্যে শেষবারের মত হেঁটে বেড়ানোর সময় নিজেকে একজন বদলে যাওয়া মানুষ মনে হতে থাকে।
প্রথম সূর্যালোকে আমার সুটকেস দরজার বাইরে আসে এবং আমার ভাড়া করা ট্যাক্সিটি ধুলো-ধূসরিত রাস্তা দিয়ে হেলেদুলে আমার কাছে চলে আসে। এবং আমি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছিলাম। মনে হল আমি বোধ হয় একটু তাড়াহুড়া করে ফেলছি। তরুণ বন্ধুটির কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে যাওয়াটা বোধ হয় ঠিক হবে না, যে বন্ধুটির নামও আমি জানি না। ট্যাক্সি চালককে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে পরের দিন ঠিক এই সময়ে আসতে বলি। সে আমার দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে গাড়ি নিয়ে চলে যায়। ট্যাক্সির পেছনে ধুলো ঘূর্ণি হয়ে উঠে গাড়ির পেছন পেছন যেতে থাকে। আমি সুটকেসগুলো রুমের ভেতরে নিয়ে এসে বসে থাকি। আমার বন্ধুটিকে কিভাবে খুঁজে বের করা যায় তা ভেবে কিছুটা সময় ব্যয় করার পর আমার মনে হল যে, বোকার মত কাজ করে ফেলেছি। এরকম শোচনীয় পরিস্থিতিতে নিজেকে আরেকটা দিন ধরে রাখার কোন মানে হয় না এবং তাকে খুঁজে পাওয়াও সম্ভব নয়। অফিসের কর্তাব্যক্তিরা যখন দেখবে যে আমি অফিসে এসে উপস্থিত হই নি তখন বিরক্ত হয়ে উঠবে। তারা আমার ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে আমার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করবে। এবং খোঁজ নিতে না পেরে পুরোপুরি হতাশ হয়ে যাবে। সকাল গড়িয়ে যেতে থাকে এবং আমি আরো বেশী অস্থির ও নিজের প্রতি রেগে উঠি। আমার মনে হয় যে, বিশাল ভুল করে ফেলেছি। তবে এটা ভেবে একটু স্বস্তি পাই যে, পরের দিন সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক হবে এবং শেষমেষ মনে হবে যে এই দিনটি আমাকে কখনও পার করতে হয় নি।
সেই দীর্ঘতপ্ত বিকেলে ছোট ছোট পাখিরা কাঁটাময় ঝোপঝাড়ে ডানা ঝাপটাতে থাকে এবং মাটি থেকে মিষ্টি গন্ধ ভেসে ওঠে। আকাশ ছিল মেঘশূন্য এবং সূর্য জমিনের বুকে কালো ছায়া ফেলছিল। আমি চারপাশের সৌন্দর্য থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে কাচারী ঘরের দেয়ালের পাশে বসে থাকি। আমার মন পড়ে থাকে শহরে এবং গ্রামের এই বন্দীদশা একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। ঘরে রাতের বেলায় খাওয়ার মত কিছু ছিল না, তবে গ্রামের দিকে হেঁটে যেতেও ইচ্ছা করছিল না। ঠান্ডায় এবং ক্ষুধায় কাতর হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিছানায় নির্ঘুম শুয়ে থাকি।
সূর্যাদয়ের আগেই ঘুম থেকে উঠে পড়ি। আমি এমন ভয়ঙ্কর ক্ষুধার্ত ছিলাম যে, মনে হল যেন পেটে পাথর গজিয়েছে। ভাবলাম ট্রেন স্টেশনে গিয়ে সকালের নাস্তা সারা যাবে। জানালার বাইরে সবকিছু অন্ধকারে ঢাকা। অন্ধকার জঙ্গলের ওপাশে পুবের আকাশ ফর্সা হয়ে এলে দমকা হাওয়া এসে গাছের পাতা নাড়িয়ে দিল। ধীরে ধীরে গাছের পাতারা সবুজ রঙ ফিরে পেল। জঙ্গলে এবং বাড়ির পাশে পাখ-পাখালির কলকাকলী জেগে উঠে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। আমি খুব মনযোগ দিয়ে পাখিদের কল-কাকলী শুনলাম। অবশেষে যখন ট্যাক্সিটি চলে এল তখন এখানে এতই ভাল লেগে গেল যে, এখান থেকে চলে যেতে মন সায় দিল না। ট্যাক্সি চালক রাগারাগি করে চলে গেল।
পুরো সকালবেলা এবং বিকেল অব্দি আগের দিন ঠিক যেমনভাবে বসে ছিলাম সেভাবে আমি কাচারী ঘরে বসে রইলাম, তবে আজকে আমি অধৈর্য হয়ে পড়ি নি বা অন্য কোথাও যেতে মন উৎসুক হয় নি। আমার সামনে যা ঘটে চলে তাতে আমি মগ্ন হয়ে পড়ি—জঙ্গলের ভেতরে পাখদের হারিয়ে যাওয়া, পোকা-মাকড়দের পাথরের গা বেয়ে হেঁটে বেড়ানো—যেন আমি অদৃশ্য হয়ে গিয়েছি, যেন আমি নিজের অনুপুস্থিতে সবকিছু চেয়ে চেয়ে দেখছি। অথবা এমন জায়গায় আছি যেখানে আমার থাকা উচিত নয়, যেখানে আমাকে কেউ চায় না, কিছুক্ষণের জন্য আলোর পেছনে পড়ে গিয়ে আমি নিজের ছায়া হয়ে উঠেছি; স্যুটকেসের ফিতা শীঘ্রই আটোসাটো হবে এবং আমি চলে যাব নিজেকে নতুন করে খুঁজে পেতে : আমি আবার স্বাধীন হয়ে উঠব।
সন্ধ্যা নামার সময় আমি বুঝতে পারি নি যে, আমি ক্ষুধার্ত। বেশ হালকা বোধ হতে থাকে। আমি বসে বসে কিসের জন্য যেন অপেক্ষা করতে থাকি। প্রচণ্ড শীত এবং অন্ধকার তাড়িত হয়ে ঘরের ভেতরে এসে শুয়ে পড়ি এবং নানা ধরনের দুঃস্বপ্ন দেখি।
পরের দিন সকালবেলায় সবচেয়ে কাছের ক্ষেতটির দূর প্রান্তে ধীরে ধীরে হেঁটে আসতে থাকা একটা অবয়ব চোখে পড়ে। আমার মনে হল যেন একটি বিশাল শূন্যতা ভরে উঠল। শূন্যতাটির কথা না জেনেই আমি সেই কবে থেকে আমার বন্ধুর প্রতীক্ষায় বসে আছি। তাকে দেখার সাথে সাথে তার দ্বিধা অস্বাভাবিক মনে হতে শুরু হল এবং এটা আমাকে ভয় পাইয়ে দিল। সে হলরেখার ওপর দিয়ে হেলেদুলে আসছে, সে তার নাকটি এমনভাবে উপরে তুলে রেখেছে যেন স্প্যানিয়েল কুকুরের মত বাতাসের গন্ধ শুকছে এবং মনে হল কোথায় যাচ্ছে তা সে জানে না। তাকে এগিয়ে আনার জন্য তার দিকে দৌড়ে যাই এবং কাছাকাছি এসে দেখতে পাই যে, কপালে ব্যান্ডেজ বাঁধা এবং মুখ ভয়ানক ফ্যাকাসে। কাছে আসতেই সে হতচকিত হয়ে যায় এবং আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেন আমি তার অপরিচিত। আমি তাকে ধরে ধরে নিয়ে আসি। বাড়িতে ঢোকা মাত্রই সে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ক্লান্তিতে সে থরথর করে কাঁপছিল। সে এত বেশী শুকিয়ে গেছে যে তার গালে গর্ত পড়ে গেছে এবং তার হাত হয়ে উঠেছে নখরের মত, চোখ জ্বরে জবা ফুলের মত লাল। আমি ডাক্তার ডাকতে গ্রামে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠি। তবে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হওয়ার পর সে অনেকটা ধীর-স্থির ভাবে কথা বলতে শুরু করে। অনেকক্ষণ ধরে সে কিছু একটা বলে এবং আমি কিছু না বুঝেই বিছানার পাশে বসে শুনে যাই। সে তার হাত দিয়ে বেশ কয়েকটা অঙ্গভঙ্গি করল এবং অবশেষে আমি বুঝতে পারি যে, শিকার করার সময় সে কোন একটা দূর্ঘটনার শিকার হয়েছে। কয়েক সপ্তাহ ধরে যখন আমি তাকে মনে মনে গালাগাল দিচ্ছি তখন সে কোন এক হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছে।
সে অবিরত কথা বলতে থাকে এবং সে কী বলছে সেদিকে মনযোগ দেয়া আমার জন্য কঠিন হয়ে উঠে। আমি অধৈর্য হয়ে উঠি। কিছুক্ষণ পর আমি এটা আর নিতে না পেরে উঠে দাঁড়িয়ে রুমের ভেতরে পায়চারি করতে শুরু করি। অবশেষে সে চুপ করে এবং রুমের এক কোনে জানালার নীচে আঙুল নির্দেশ করে। আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না কারন সেখানে জানালা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। হঠাৎ আমি বুঝতে পারলাম যে, সে ছবি আকার বোর্ডের দিকে আমার মনযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে যা ওখান থেকে সরিয়ে রাখা হয়েছে। মানে, সে আমার বাড়ির নীলনকশাটা দেখতে চায়। মোড়ক খুলে নীলনকশাটা তার হাতে দিলাম। তারপরও তাকে অসন্তুষ্ট মনে হল। পকেট হাতড়ে একটা পেনসিল বের করে তাকে দিলাম। সে নীলনকশার উপর আঁকতে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে সে পুরো কাগজটি কিনারা পর্যন্ত জটিল সব চিত্র দিয়ে ভরে ফেলল। তার দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টে কাগজটির দিকে তাকিয়ে থেকে অবশেষে আমি একটি টাওয়ারের ছবি চিনতে পারলাম এবং এমন একটা কিছু যাকে এই সব আঁকিবুঁকির মধ্যে একটা দরজা বলে বোধ হল। পৃষ্ঠাটি ভরিয়ে ফেললে আমি তাকে আরো পৃষ্ঠা এনে দিলাম এবং সে আঁকতে থাকল। আঁকার সময় তার হাত থামে নি বললেই চলে এবং যা সে এঁকেছে তার মধ্যে এমন জটিলতা আছে যা, বহু নিঃসঙ্গ দিনের চিন্তা এবং অনুশীলনের ফলেই কেবল আয়ত্ত করা সম্ভব। যখন সে এতই ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে, পেনসিল নড়ানোর মত শক্তিও আর অবশিষ্ট রইল না, তখন সে ঘুমিয়ে পড়ল। সেই সন্ধ্যায় আমি তাকে রেখে গ্রামে খাবারের খোঁজে গেলাম।
ক্ষেত-খামার পাড়ি দিয়ে বাড়িতে ফেরার সময় লাল রঙের ভূ-দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে মনে হল যে আমি এটার সাথে গভীরভাবে পরিচিত, যেন এখানে আসার অনেক আগে থেকেই এটা আমার। এটাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তাকে তাৎপর্যহীন মনে হল। কয়েক দিনের মধ্যে আমার ক্ষোভ এবং হতাশায় ভাটা পড়ে, এখন সেই শুরুর দিককার মত যে জিনিসের দিকেই তাকাই না কেন, মনে হয় যেন একটা খোলস অথবা একটা খোসা যা ফেঁটে গিয়ে একটা নিখুঁত ফল বের হয়ে পড়বে। ক্লান্ত হওয়া সত্ত্বেও, আমার মন সম্মুখ পানে ধাবিত হল : আমি বাড়ির পাশের এক ফালি জমি পরিষ্কার করে নিয়ে একটা আস্তাবল তৈরী করে সাদা-কালো গাভীদের নিয়ে এসে সেখানে ঢোকালাম আর ভীত-সন্ত্রস্ত মুরগীরা এগুলোর চারপাশে হেঁটে বেড়াতে লাগল। প্রতিবেশীর বাড়িটাকে আড়াল করার জন্য বাড়ির সীমানা দিয়ে একসার সাইপ্রেস গাছ লাগালাম। ধ্বসে পড়া দেয়ালটি ভেঙ্গে ফেলে একই পাথর দিয়ে আমার নিজস্ব খামার বাড়ি তৈরী করে ফেললাম। শেষ হওয়ার পর মনে হল এটা যার চোখে পড়বে তারই ঈর্ষা জাগ্রত হবে। আমার স্বপ্ন সত্যি হবে, প্রথমে যেমনটা হওয়ার কথা ছিল।
আমি সম্ভবত প্রলাপ বকছিলাম। ব্যাপারটির এমন পরিণতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। তবে আমি যখন ক্ষেতের উপর হলরেখার গভীরে এক পা দিয়ে এবং আরেক পা দিয়ে হলরেখার চূড়া অতিক্রম করে হেঁটে আসছিলাম, এই আশঙ্কায় আমি খুবই খুশী হয়ে উঠি যে, যেকোন সময় আমার হতাশা এবং নৈরাশ্য পঙ্গপালের মত আকাশ অন্ধকার করে দিয়ে আমার উপর নিমজ্জিত হবে। সন্ধ্যাটা স্নিগ্ধ, আলো নরম ও কমনীয়, পৃথিবীটা পক্ষাঘাতগ্রস্থ এবং আমি, অনেক নীচে, একমাত্র সচল প্রাণী।
No comments