কাবুলের চোর এবং কারজাই পরিবার
গ্রন্থ পর্যালোচনাঃ জোনা ব্যাঙ্ক # অনুবাদ : হাসান শরীফ>
‘এটা
একটা চোর-ছ্যাঁচড়দের সরকার। আর এর যে পালের গোদা, সে হলো একটা নির্লজ্জ
ছিঁচকাদুনে।’ সোজা-সাপ্টাভাবে বলতে গেলে, প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই সরকার
সম্পর্কে এমন ধারণাই ছিল আফগানিস্তানে অবস্থানকারী বিদেশি পর্যবেক্ষকদের।
তাদের মতে, কারজাই এত গুরুভার নেয়ার মতো লোক ছিলেন না। বলা যেতে পারে, তিনি
যুদ্ধবাজের ভূমিকা পালনকারী এক নন্দনতত্ত্ববিদ। তিনি যে কাজকর্ম করে
যাচ্ছিলেন, সেটা যে তার পদের সাথে মানানসই ছিল না। কিন্তু সেটা জেনেও তিনি
তা থেকে সরে দাঁড়াননি। তাদের মতে, তার ১৩ বছরের আমলে আফগানিস্তান যোগ্য
নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছে, দেশটি অস্থিতিশীলতা আর দারিদ্র্যের দিকে আরো
প্রবল বেগে ধেয়ে গেছে। কারজাই প্রেসিডেন্ট পদ থেকে অব্যাহতি নেয়ার পাঁচ বছর
আগে সেই ২০০৯ সালেই কাবুল আর ওয়াশিংটনের মধ্যকার সম্পর্কে মারাত্মক চির
ধরে। কারজাইয়ের অদক্ষতার কারণেই মূলত এমনটা হয়।
পর্যবেক্ষকদের এই ছবিটা কতটুকু সত্য? যুক্তরাষ্ট্র-আফগানিস্তান সম্পর্কের অবনতির জন্য কারজাই আসলেই কতটুকু দায়ী? বিষয়টা দুর্দান্তভাবে বিশ্লেষণ করেছেন যশুয়া পার্টলো। তার বই অ্যা কিংডম অব দেয়ার ওন : দি ফ্যামিলি কারজাই অ্যান্ড দি আফগান ডিস্যাস্টার -এর প্রধান বিষয় এটাই।
অবশ্য যেকোনো ধরনের বিরোধে দুই পক্ষের কাছ থেকে পাওয়া যায় দুই ধরনের কাহিনী।
আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কারজাই বীরোচিত ব্যক্তি হিসেবে শুরু করেছিলেন। শক্তপোক্ত ও সুদর্শন এই লোকটিকে পাশ্চাত্যের অনেকে তাকে তার জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যতিক্রমী লোক হিসেবে মনে করেছিল।
অবশ্য ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলা শুরু হওয়ার পর দেশটির শীর্ষ পদে নিয়োগ পাওয়ার দাবিদারও ছিল খুব কম। তালেবানবিরোধী সবচেয়ে সক্ষম কমান্ডার আহমদ শাহ মাসুদ ১১ সেপ্টেম্বরের মাত্র দু’দিন আগে আল-কায়েদার হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হন। সন্ত্রাসী হামলার ফলে আমেরিকা আক্রমণ শুরু করতে পারে, এমনটা বুঝতে পেরে ওয়াশিংটনের কাজে লাগার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ব্যক্তিটিকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে তারা। তবে মাসুদ বেঁচে থাকলেও খুব সহজে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতেন না। জাতিগতভাবে তিনি ছিলেন তাজিক। আর আফগান রাজনীতিতে ১৮ শতক থেকে বিপুলভাবে পশতু প্রাধান্যপূর্ণ। ফলে কোনো তাজিকের পক্ষে সেখানে সরকার পরিচালনা করা খুবই কঠিন কাজ। সবচেয়ে মুগ্ধতা সৃষ্টিকারী পশতু নেতা ছিলেন এক পায়ের আবদুল হক। লাইমলাইটে থাকতে ইচ্ছুক এই মুজাহিদ কমান্ডারকে আমেরিকান কর্মকর্তারা ডাকতেন ‘হলিউড হক’ বলে। কিন্তু মাসুদ মারা যাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনিও নিহত হন। এটাও ঘটে তালেবানের হাতে।
মাসুদ, হক এবং প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আফগানিস্তানের অন্য সম্ভাব্য নেতাদের চেয়ে কারজাই ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশটি ২০ বছর ধরে যুদ্ধে বিধ্বস্ত হলেও কারজাই একবারের জন্য যুদ্ধ দেখেননি। যুদ্ধের সাথে তার পরিচিত ঘটে ২০০১ সালে, মার্কিন হামলার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে। ইউএস গ্রিন বেরেট সৈন্যরা তাকে চুপিসারে দক্ষিণ আফগানিস্তানে নিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা না থাকাটা তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার অনুকূলে ছিল না। তবে আফগান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, তিনি ছিলেন ঠিক অবস্থানে। একদিকে তিনি পশতু, তালেবানবিরোধী দুররানি ধারার পোপালজাই গোত্রের। আমেরিকানদের দৃষ্টিতে, তাকে দেখতে-শুনতে নেতার মতোই লাগে।
কারজাইকে ১৯৯০-এর দশক থেকে চিনতেন, এমন অনেকে মাঝারি মানের এক নেতা থেকে রাতারাতি বিশ্বকে মোহিতকারী লোকে পরিণত হতে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন। তখন বড়জোর তিনি ছিলেন এক ‘গোত্রীয় নেতা।’ তারপর হঠাৎ করে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে সম্মানিত হতে লাগলেন, এমনকি ২০০২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়ে গেলেন।
অবশ্য ২০০৯ সাল নাগাদ, কারজাই আর মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যকার মধুর সম্পর্কটা খুবই তেতো হয়ে যায়। ওয়াশিংটনের মতে, ‘কারজাই পরিচিত ছিলেন আপস করতে আগ্রহী আপসকামী হিসেবে।’ ওয়াশিংটন মনে করত, কারজাই তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেননি, চেষ্টাও করেননি। তার সরকার বিশেষ করে তার স্বজনরা যে ভয়াবহ মাত্রায় দুর্নীতি করেছে, তিনি সে দিকে চোখ পুরোপুরি বন্ধ করেছিলেন। আমেরিকানরা তাদের যুদ্ধের ব্যাপারে অনীহ যুদ্ধকালীন নেতা হিসেবে দেখেছে। তাদের কাছে তিনি স্বার্থান্বেষীদের কান পরামর্শে চলেন। এমনকি আমেরিকান সৈন্যদের অব্যাহতভাবে অপমান করা সত্ত্বেও এক ‘অকৃতজ্ঞকে’ ক্ষমতায় বহাল রেখেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কারজাই কোনো সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেন না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রতিষ্ঠান গড়ার ব্যাপারে আগ্রহী নন। আবার তালেবানকে তার ‘ভাই’ হিসেবে অভিহিত করে ন্যাটো সৈন্যদের দখলদার হিসেবেও অভিহিত করেছেন। ২০১০ সালে কারজাই যখন তার পদ ছেড়ে নিজেই তালেবান বাহিনীতে যোগ দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তখন অনেক আমেরিকানই দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল। অনেকে তো মনে করেছিল, তিনি সত্য কথা বলছেন।
অন্যদিকে কারজাইয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে, যুক্তরাষ্ট্র হলো বন্ধুর মুখোশ পরে থাকা শত্রু। আফগানিস্তানে পরাশক্তিগুলোর এটা পুরনো ভূমিকা : ১৯ শতকে ব্রিটিশরা এই পথ দেখিয়েছিল, তারপর ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন একই ভূমিকায় নেমেছিল। কারজাই এবং আরো অনেক আফগান বিশ্বাস করেন, আগের পরাশক্তিগুলো যেসব ভুল করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র সেগুলোই অনেকাংশে পুনরাবৃত্তি করছে। মুক্ত করতে আসা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী শিগগিরই বিবেচিত হবে দখলদার বাহিনী।
পূর্বসূরি সোভিয়েতদের মতো নতুন দখলদাররাও স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আঘাত হেনেছিল, তারা কী ক্ষতি করছে সেটা না জেনেই। সবচেয়ে ক্ষতিকর ছিল অজ্ঞতার বশে আফগানদের ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়গুলো পদদলিত করা : বিদেশি সৈন্যদের রাত্রিকালীন অভিযানের সময় কৃষকদের বাড়িতে কুকুর প্রবেশ করানো, অস্ত্রের সন্ধানে ধর্মীয় সীমা লঙ্ঘন করে নারীদের তল্লাসি, এমনকি কারাগারের কক্ষ পরিষ্কার করার সময় পবিত্র কোরআনের পাতা পুড়িয়ে ফেলা। এসব ব্যাপারে কারজাই যখন ক্ষোভ প্রকাশ করতেন, তখন তিনি সত্য সত্যই তার জনগণের পক্ষে কথা বলতেন।
অন্যদিকে আমেরিকানরা যখন দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির কথা বলত, কারজাইয়ের চোখে তখন পড়ত কেবল আফগান রাজনীতির শীতল বাস্তবতার দিকে, যেখানে পরিবারের আনুগত্যই সর্বোচ্চ বিষয়।
পার্টলোর বইতে কারজাইয়ের সৎভাই আহমদ ওয়ালি কারজাইকে পরিবারটির গডফাদার হিসেবে দেখানো হয়েছে। সাধারণভাবে তার পরিচিতি ছিল এডব্লিউকে। উদার, হিসাবি, ক্যারিশমেটিক এবং সেইসাথে কিংমেকার এই লোকটি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে এক রেস্তোরাঁয় বেয়ারার কাজ করতেন। পরে কান্দাহার প্রদেশে তার উত্থান ঘটে। মার্কিন সরকারের বিভিন্ন স্তরে তিনি একইসাথে প্রিয়ভাজন ও ঘৃণিত ছিলেন। কাবুলে শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তারা যে ধরনের ভয়ঙ্কর যুদ্ধবাজদের উৎখাত করার চেষ্টা তারা করছেন, কারজাইকে তেমনই বিবেচনা করতেন। আবার কান্দাহারে, যেখানকার বেশিরভাগ বৈধ-অবৈধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন এডব্লিউকে, গুপ্তচর ও সামরিক নেতারা তাকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ভাবতেন। তাদের কাছে সরকারের অন্য সদস্যদের চেয়ে তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি।
কারজাই তার সৎভাইয়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্য এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিদের ব্যক্তিগত মিলিশিয়া ছিল। তাদের সম্পদ ছিল যথেষ্ট, অন্যদের বশ করতে কিংবা কিনে নেয়ার সামর্থ্য ছিল তাদের।
কারজাইয়ের এসবের কিছুই ছিল না। কাগজে-কলমে তার ক্ষমতা ছিল বিপুল, কিন্তু বাস্তবে এগুলো ছিল মূল্যহীন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য আমেরিকান দেহরক্ষীদের ওপর ভরসা করার জন্য অনেকে তাকে ‘কাবুলের মেয়র’ বলে বিদ্রুপ করত। এমন প্রেক্ষাপটে এডব্লিউকেই তাকে খাতাপত্রে থাকা তার প্রজাদের ওপর তাদের ছড়ি ঘোরানোর কিছু শক্তির ব্যবস্থা করে দিতেন। আমেরিকানরা যখন কারজাইকে তার ভাইকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য চাপ দিত, তারা এই কাজটা অনেকবারই করেছে, তখন তার প্রত্যাখ্যান করাটা ছিল অতি স্বাভাবিক।
কারজাইয়ের ভাই মাহমুদ কারজাই আবার নিজের অপরাধ করতেন বেপরোয়াভাবে। অনেকে তাকে ‘আফগান ডোনাল্ড ট্রাম্প’ হিসেবে অভিহিত করেন। ২০১০ সালে কাবুল ব্যাংকের পতনের সময় তার কাছে পাওনা ছিল ২২ মিলিয়ন ডলার। এখন পর্যন্ত এর এক-তৃতীয়াংশ অনাদায়ী রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কারজাইয়ের বক্তব্য একেবারে সরল : মাহমুদ কারজাই যদি অপরাধী হয়ে থাকে, তবে আফগান এলিটদের বেশিরভাগই তা-ই।
তাছাড়া কাবুল ব্যাংক পতনে কেবল আফগানদের ভূমিকাই ছিল, এমন নয়। ব্যাংকটির শীর্ষ পদে ছিলেন আমেরিকানরা। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন তারাই। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকগুলোকে যারা দেউলিয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তারাই এখানে কলকাঠি নেড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে কি এসব অপরাধের জন্য কারো বিচার হয়েছে? প্রশ্নটা কিন্তু হামিদ কারজাই নানাভাবে করেছেন।
কারজাইয়ের সবচেয়ে বড় অপরাধ কোনটি? তিনি অযোগ্য, অস্থিরমতি, দুর্নীতিগ্রস্ত, তার পরিবার ও মিত্রদের পাশবিকতা ও অপশাসন? না, এগুলোর কোনোটিই নয়। এগুলোর সবই বৈধ অভিযোগ এবং যুক্তরাষ্ট্র আসলে এ ধরনের অপরাধ আমলে নেয় না। গুল আগা শিরাজি, আবদুর রাজ্জাক, ইসমাইল খান, আতা মোহাম্মদের মতো অসংখ্য মার্কিন মিত্র পাওয়া যাবে, তাদের এর চেয়েও ভয়াবহ অপরাধের বিচার তো দূরের কথা, অভিযোগ পর্যন্ত উত্থাপিত হতে দেয়া হয়নি।
হ্যাঁ, কারজাইয়ের একটা অপরাধ ছিল, যা ক্ষমার অযোগ্য। সেটা হলো তার অকৃতজ্ঞতা। আমেরিকান সৈন্যরা যখন তার জীবন রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন দিচ্ছিল, তখন তিনি তাদের গালি দিচ্ছিলেন, তাদের আত্মত্যাগকে তাচ্ছিল্য করছিলেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক বিবৃতিতে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ইউএস স্পেশাল ফোর্স ‘নিরীহ নাগরিকদের হয়রানি, উৎপাত, নির্যাতন এবং এমনকি খুনও করছে।’ ২০১২ সালে কোরআন পোড়ানোর ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর তিনি আমেরিকান সৈন্যদেরকে ‘শয়তান’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, তারা এমন ‘শয়তানি করছে, তা ক্ষমা চাইলেও মার্জনা হবে না।’
যেকোনো যুদ্ধই মানুষের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসে। আফগানিস্তানে মার্কিন হামলাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সোভিয়েত, তালেবান এবং ১৯৯০-এর দশকে গৃহযুদ্ধের চেয়ে আমেরিকান হামলা বেশি ক্ষতিকর ছিল কি না তা নিয়ে বিতর্ক করা কঠিন।
যশুয়া পার্টলো বইটির বড় অংশ জুড়ে আছে কারজাই পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব। বেশ মজাদার। এই অন্তর্দ্বন্দ্বে পরিবারটির অনেক সদস্যই খুন হয়েছেন। এডব্লিউকে পর্যন্ত নিহত হন ২০১১ সালে পরিবারের অপর এক সদস্যের হাতে। পার্টলো বলেন, ‘কারজাইদের ব্যাপারে আমি সবচেয়ে খারাপ কথা শুনেছি কারজাইদের কাছ থেকেই।’
আফগানিস্তানের চলতি পরিস্থিতি বোঝার জন্য বইটি বেশ ভালোই বলতে হবে। এটা পড়ার পর এমনকি অনেকে কারজাই পরিবার সম্পর্কে জানতে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠবে।
পর্যবেক্ষকদের এই ছবিটা কতটুকু সত্য? যুক্তরাষ্ট্র-আফগানিস্তান সম্পর্কের অবনতির জন্য কারজাই আসলেই কতটুকু দায়ী? বিষয়টা দুর্দান্তভাবে বিশ্লেষণ করেছেন যশুয়া পার্টলো। তার বই অ্যা কিংডম অব দেয়ার ওন : দি ফ্যামিলি কারজাই অ্যান্ড দি আফগান ডিস্যাস্টার -এর প্রধান বিষয় এটাই।
অবশ্য যেকোনো ধরনের বিরোধে দুই পক্ষের কাছ থেকে পাওয়া যায় দুই ধরনের কাহিনী।
আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী কারজাই বীরোচিত ব্যক্তি হিসেবে শুরু করেছিলেন। শক্তপোক্ত ও সুদর্শন এই লোকটিকে পাশ্চাত্যের অনেকে তাকে তার জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যতিক্রমী লোক হিসেবে মনে করেছিল।
অবশ্য ২০০১ সালে আফগানিস্তানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হামলা শুরু হওয়ার পর দেশটির শীর্ষ পদে নিয়োগ পাওয়ার দাবিদারও ছিল খুব কম। তালেবানবিরোধী সবচেয়ে সক্ষম কমান্ডার আহমদ শাহ মাসুদ ১১ সেপ্টেম্বরের মাত্র দু’দিন আগে আল-কায়েদার হাতে গুপ্তহত্যার শিকার হন। সন্ত্রাসী হামলার ফলে আমেরিকা আক্রমণ শুরু করতে পারে, এমনটা বুঝতে পেরে ওয়াশিংটনের কাজে লাগার সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ব্যক্তিটিকে চিরদিনের জন্য সরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করে তারা। তবে মাসুদ বেঁচে থাকলেও খুব সহজে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতেন না। জাতিগতভাবে তিনি ছিলেন তাজিক। আর আফগান রাজনীতিতে ১৮ শতক থেকে বিপুলভাবে পশতু প্রাধান্যপূর্ণ। ফলে কোনো তাজিকের পক্ষে সেখানে সরকার পরিচালনা করা খুবই কঠিন কাজ। সবচেয়ে মুগ্ধতা সৃষ্টিকারী পশতু নেতা ছিলেন এক পায়ের আবদুল হক। লাইমলাইটে থাকতে ইচ্ছুক এই মুজাহিদ কমান্ডারকে আমেরিকান কর্মকর্তারা ডাকতেন ‘হলিউড হক’ বলে। কিন্তু মাসুদ মারা যাওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যে তিনিও নিহত হন। এটাও ঘটে তালেবানের হাতে।
মাসুদ, হক এবং প্রেসিডেন্ট পদের জন্য আফগানিস্তানের অন্য সম্ভাব্য নেতাদের চেয়ে কারজাই ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেশটি ২০ বছর ধরে যুদ্ধে বিধ্বস্ত হলেও কারজাই একবারের জন্য যুদ্ধ দেখেননি। যুদ্ধের সাথে তার পরিচিত ঘটে ২০০১ সালে, মার্কিন হামলার মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে। ইউএস গ্রিন বেরেট সৈন্যরা তাকে চুপিসারে দক্ষিণ আফগানিস্তানে নিয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধের অভিজ্ঞতা না থাকাটা তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার অনুকূলে ছিল না। তবে আফগান দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলা যায়, তিনি ছিলেন ঠিক অবস্থানে। একদিকে তিনি পশতু, তালেবানবিরোধী দুররানি ধারার পোপালজাই গোত্রের। আমেরিকানদের দৃষ্টিতে, তাকে দেখতে-শুনতে নেতার মতোই লাগে।
কারজাইকে ১৯৯০-এর দশক থেকে চিনতেন, এমন অনেকে মাঝারি মানের এক নেতা থেকে রাতারাতি বিশ্বকে মোহিতকারী লোকে পরিণত হতে দেখে আশ্চর্য হয়েছিলেন। তখন বড়জোর তিনি ছিলেন এক ‘গোত্রীয় নেতা।’ তারপর হঠাৎ করে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে সম্মানিত হতে লাগলেন, এমনকি ২০০২ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যও মনোনীত হয়ে গেলেন।
অবশ্য ২০০৯ সাল নাগাদ, কারজাই আর মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যকার মধুর সম্পর্কটা খুবই তেতো হয়ে যায়। ওয়াশিংটনের মতে, ‘কারজাই পরিচিত ছিলেন আপস করতে আগ্রহী আপসকামী হিসেবে।’ ওয়াশিংটন মনে করত, কারজাই তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেননি, চেষ্টাও করেননি। তার সরকার বিশেষ করে তার স্বজনরা যে ভয়াবহ মাত্রায় দুর্নীতি করেছে, তিনি সে দিকে চোখ পুরোপুরি বন্ধ করেছিলেন। আমেরিকানরা তাদের যুদ্ধের ব্যাপারে অনীহ যুদ্ধকালীন নেতা হিসেবে দেখেছে। তাদের কাছে তিনি স্বার্থান্বেষীদের কান পরামর্শে চলেন। এমনকি আমেরিকান সৈন্যদের অব্যাহতভাবে অপমান করা সত্ত্বেও এক ‘অকৃতজ্ঞকে’ ক্ষমতায় বহাল রেখেছেন। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কারজাই কোনো সিদ্ধান্তে স্থির থাকতে পারেন না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং প্রতিষ্ঠান গড়ার ব্যাপারে আগ্রহী নন। আবার তালেবানকে তার ‘ভাই’ হিসেবে অভিহিত করে ন্যাটো সৈন্যদের দখলদার হিসেবেও অভিহিত করেছেন। ২০১০ সালে কারজাই যখন তার পদ ছেড়ে নিজেই তালেবান বাহিনীতে যোগ দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন, তখন অনেক আমেরিকানই দ্বিধায় পড়ে গিয়েছিল। অনেকে তো মনে করেছিল, তিনি সত্য কথা বলছেন।
অন্যদিকে কারজাইয়ের দৃষ্টিকোণ থেকে, যুক্তরাষ্ট্র হলো বন্ধুর মুখোশ পরে থাকা শত্রু। আফগানিস্তানে পরাশক্তিগুলোর এটা পুরনো ভূমিকা : ১৯ শতকে ব্রিটিশরা এই পথ দেখিয়েছিল, তারপর ১৯৮০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন একই ভূমিকায় নেমেছিল। কারজাই এবং আরো অনেক আফগান বিশ্বাস করেন, আগের পরাশক্তিগুলো যেসব ভুল করেছিল, যুক্তরাষ্ট্র সেগুলোই অনেকাংশে পুনরাবৃত্তি করছে। মুক্ত করতে আসা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বাহিনী শিগগিরই বিবেচিত হবে দখলদার বাহিনী।
পূর্বসূরি সোভিয়েতদের মতো নতুন দখলদাররাও স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি আঘাত হেনেছিল, তারা কী ক্ষতি করছে সেটা না জেনেই। সবচেয়ে ক্ষতিকর ছিল অজ্ঞতার বশে আফগানদের ধর্মীয় স্পর্শকাতর বিষয়গুলো পদদলিত করা : বিদেশি সৈন্যদের রাত্রিকালীন অভিযানের সময় কৃষকদের বাড়িতে কুকুর প্রবেশ করানো, অস্ত্রের সন্ধানে ধর্মীয় সীমা লঙ্ঘন করে নারীদের তল্লাসি, এমনকি কারাগারের কক্ষ পরিষ্কার করার সময় পবিত্র কোরআনের পাতা পুড়িয়ে ফেলা। এসব ব্যাপারে কারজাই যখন ক্ষোভ প্রকাশ করতেন, তখন তিনি সত্য সত্যই তার জনগণের পক্ষে কথা বলতেন।
অন্যদিকে আমেরিকানরা যখন দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতির কথা বলত, কারজাইয়ের চোখে তখন পড়ত কেবল আফগান রাজনীতির শীতল বাস্তবতার দিকে, যেখানে পরিবারের আনুগত্যই সর্বোচ্চ বিষয়।
পার্টলোর বইতে কারজাইয়ের সৎভাই আহমদ ওয়ালি কারজাইকে পরিবারটির গডফাদার হিসেবে দেখানো হয়েছে। সাধারণভাবে তার পরিচিতি ছিল এডব্লিউকে। উদার, হিসাবি, ক্যারিশমেটিক এবং সেইসাথে কিংমেকার এই লোকটি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের ম্যারিল্যান্ডে এক রেস্তোরাঁয় বেয়ারার কাজ করতেন। পরে কান্দাহার প্রদেশে তার উত্থান ঘটে। মার্কিন সরকারের বিভিন্ন স্তরে তিনি একইসাথে প্রিয়ভাজন ও ঘৃণিত ছিলেন। কাবুলে শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিক ও সামরিক কর্মকর্তারা যে ধরনের ভয়ঙ্কর যুদ্ধবাজদের উৎখাত করার চেষ্টা তারা করছেন, কারজাইকে তেমনই বিবেচনা করতেন। আবার কান্দাহারে, যেখানকার বেশিরভাগ বৈধ-অবৈধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করতেন এডব্লিউকে, গুপ্তচর ও সামরিক নেতারা তাকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার ভাবতেন। তাদের কাছে সরকারের অন্য সদস্যদের চেয়ে তার গুরুত্ব ছিল অনেক বেশি।
কারজাই তার সৎভাইয়ের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিলেন। মন্ত্রিসভার বেশিরভাগ সদস্য এবং সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বিদের ব্যক্তিগত মিলিশিয়া ছিল। তাদের সম্পদ ছিল যথেষ্ট, অন্যদের বশ করতে কিংবা কিনে নেয়ার সামর্থ্য ছিল তাদের।
কারজাইয়ের এসবের কিছুই ছিল না। কাগজে-কলমে তার ক্ষমতা ছিল বিপুল, কিন্তু বাস্তবে এগুলো ছিল মূল্যহীন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য আমেরিকান দেহরক্ষীদের ওপর ভরসা করার জন্য অনেকে তাকে ‘কাবুলের মেয়র’ বলে বিদ্রুপ করত। এমন প্রেক্ষাপটে এডব্লিউকেই তাকে খাতাপত্রে থাকা তার প্রজাদের ওপর তাদের ছড়ি ঘোরানোর কিছু শক্তির ব্যবস্থা করে দিতেন। আমেরিকানরা যখন কারজাইকে তার ভাইকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য চাপ দিত, তারা এই কাজটা অনেকবারই করেছে, তখন তার প্রত্যাখ্যান করাটা ছিল অতি স্বাভাবিক।
কারজাইয়ের ভাই মাহমুদ কারজাই আবার নিজের অপরাধ করতেন বেপরোয়াভাবে। অনেকে তাকে ‘আফগান ডোনাল্ড ট্রাম্প’ হিসেবে অভিহিত করেন। ২০১০ সালে কাবুল ব্যাংকের পতনের সময় তার কাছে পাওনা ছিল ২২ মিলিয়ন ডলার। এখন পর্যন্ত এর এক-তৃতীয়াংশ অনাদায়ী রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কারজাইয়ের বক্তব্য একেবারে সরল : মাহমুদ কারজাই যদি অপরাধী হয়ে থাকে, তবে আফগান এলিটদের বেশিরভাগই তা-ই।
তাছাড়া কাবুল ব্যাংক পতনে কেবল আফগানদের ভূমিকাই ছিল, এমন নয়। ব্যাংকটির শীর্ষ পদে ছিলেন আমেরিকানরা। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন তারাই। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিটের ব্যাংকগুলোকে যারা দেউলিয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছিল, তারাই এখানে কলকাঠি নেড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে কি এসব অপরাধের জন্য কারো বিচার হয়েছে? প্রশ্নটা কিন্তু হামিদ কারজাই নানাভাবে করেছেন।
কারজাইয়ের সবচেয়ে বড় অপরাধ কোনটি? তিনি অযোগ্য, অস্থিরমতি, দুর্নীতিগ্রস্ত, তার পরিবার ও মিত্রদের পাশবিকতা ও অপশাসন? না, এগুলোর কোনোটিই নয়। এগুলোর সবই বৈধ অভিযোগ এবং যুক্তরাষ্ট্র আসলে এ ধরনের অপরাধ আমলে নেয় না। গুল আগা শিরাজি, আবদুর রাজ্জাক, ইসমাইল খান, আতা মোহাম্মদের মতো অসংখ্য মার্কিন মিত্র পাওয়া যাবে, তাদের এর চেয়েও ভয়াবহ অপরাধের বিচার তো দূরের কথা, অভিযোগ পর্যন্ত উত্থাপিত হতে দেয়া হয়নি।
হ্যাঁ, কারজাইয়ের একটা অপরাধ ছিল, যা ক্ষমার অযোগ্য। সেটা হলো তার অকৃতজ্ঞতা। আমেরিকান সৈন্যরা যখন তার জীবন রক্ষার জন্য নিজেদের জীবন দিচ্ছিল, তখন তিনি তাদের গালি দিচ্ছিলেন, তাদের আত্মত্যাগকে তাচ্ছিল্য করছিলেন। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক বিবৃতিতে তিনি স্পষ্টভাবে বলেন, ইউএস স্পেশাল ফোর্স ‘নিরীহ নাগরিকদের হয়রানি, উৎপাত, নির্যাতন এবং এমনকি খুনও করছে।’ ২০১২ সালে কোরআন পোড়ানোর ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পর তিনি আমেরিকান সৈন্যদেরকে ‘শয়তান’ হিসেবে অভিহিত করে বলেন, তারা এমন ‘শয়তানি করছে, তা ক্ষমা চাইলেও মার্জনা হবে না।’
যেকোনো যুদ্ধই মানুষের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় নিয়ে আসে। আফগানিস্তানে মার্কিন হামলাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সোভিয়েত, তালেবান এবং ১৯৯০-এর দশকে গৃহযুদ্ধের চেয়ে আমেরিকান হামলা বেশি ক্ষতিকর ছিল কি না তা নিয়ে বিতর্ক করা কঠিন।
যশুয়া পার্টলো বইটির বড় অংশ জুড়ে আছে কারজাই পরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্ব। বেশ মজাদার। এই অন্তর্দ্বন্দ্বে পরিবারটির অনেক সদস্যই খুন হয়েছেন। এডব্লিউকে পর্যন্ত নিহত হন ২০১১ সালে পরিবারের অপর এক সদস্যের হাতে। পার্টলো বলেন, ‘কারজাইদের ব্যাপারে আমি সবচেয়ে খারাপ কথা শুনেছি কারজাইদের কাছ থেকেই।’
আফগানিস্তানের চলতি পরিস্থিতি বোঝার জন্য বইটি বেশ ভালোই বলতে হবে। এটা পড়ার পর এমনকি অনেকে কারজাই পরিবার সম্পর্কে জানতে আরো বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠবে।
No comments