তাইজুদ্দিনের হালচাল by তারিক ফিজার
‘আমার
মনে হয়েছিল তুমি নেই। খুব অবাক হলাম, বাবু। তা বাবু, কেমন আছো?’ বলল,
তাইজুদ্দিন। তালুকদার বলে উঠল, ‘আরে বাবা, তোষামোদি করো সমস্যা নাই কিন্তু
চাউল পাবা না একমুঠো।’ তাইজুদ্দিনের মুখটা কালো হয়ে গেল। এক লাফে
তালুকদারের পা ধরে ফেলল তাইজুদ্দিন।
বাবা! আমার পোলাটা না খেয়ে মরবে। সের আধেক চাউল দাও না। কাজ নিব সামনে, মাইনে পেয়ে সুদসহ দিব খুব আকুল স্বরে বলল তাইজুদ্দিন।
শোনা মাত্রই তালুকদার ভ্রু কুঁচকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘অ্যা, সুদ সহ দিবে! সালা, গত মাসের পাঁচশ টাকা বাকি! টাকা শোধ করবি কবে? ট্যাকনিক তো ভালোই শিখছিস। জমাজমি নাই? জমাজমি থাকলে কিছু, বল।’
খুব অবাক হলো তাইজুদ্দিন। বলে উঠল, ‘পাঁচশ টাকা মানে! আমি তো পাঁচশ টাকার জিনিস নেই নাই।’ তালুকদার চোখ লাল করে রাগান্বিত হয়ে উত্তর দিল, ‘সাড়ে তিনশ টাকার সুদ দেড়শ টাকা। এই হলো হিসাব। সালা, মুর্খের বাচ্চা।’
তাইজুদ্দিন কাঁদো কাঁদো চোখে দোকানের সামনে থেকে চলে গেল। সন্ধ্যার আজান পড়ে গেছে। তাইজুদ্দিন শত চেষ্টা করেও রান্নার জন্য কিছু চাউল সংগ্রহ করতে পারল না। বাড়ি ফেরার পথে করিম ব্যাপারীর সঙ্গে দেখা। তাইজুদ্দিনের ছেলে বেলার বন্ধু। তাইজুদ্দিন বলল, কোথায় যাচ্ছো, করিম?
করিম ব্যাপারী উত্তর দিল, ‘এই তো নামাজ পড়লাম, ভাই। কিছু বলবা?’
তাইজুদ্দিন কিছু না ভেবে হুটহাট বলে ফেলল, ‘কিছু চাউল কর্য দিতে পারবা, করিম? পোলাডার খুব অসুখ।’
করিম ব্যাপারীর মুখে মুচকি হাসি।
‘দিন কাল যা পড়ছে, এই সন্ধ্যা বেলায় চাউল দিতে হবে অন্যের ঘরে। সমাজ, ধর্ম বলে কিছু নাই দুনিয়ায়, বলল করিম ব্যাপারী। তাইজুদ্দিন আবারো বলে উঠল, আমার পোলাডার অসুখ, না খাইলে মইরা যাবে। যদি পারো...
করিম ব্যাপারী মুখ কালো করে উত্তর দিল, সন্ধ্যায় চাউল কর্য দিবে কে? অন্য সময় কইতে পারো নাই, মিয়া?
তাইজুদ্দিনের বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। খালি হাতে বাড়ি যেতে হচ্ছে তাকে। ছেলেকে কি বলবে, বুঝে আসছে না। বাবা হিসাবে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। তাইজুদ্দিন বাড়ি এসে দেখে ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিছানার সঙ্গে মিশে যাওয়া সন্তানের কোমল দেহখানা দেখে তাইজুদ্দিনের মনটা বিষণ্নতায় ভরে উঠল। অতীতের কথা মনে হলো তার। মনে হতে লাগল জীবনের সবচেয়ে করুণ মুহূর্তের কথা। তাইজুদ্দিন তখন যুবক। সবেমাত্র বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে নতুন সংসার গড়েছে। নিজের নামে দুই বিঘা আবাদি জমি, বাড়ি ভিটে এবং গোয়ালভরা গরু। খুব ভালোভাবেই কাটছিল জীবন। একদিন সন্ধ্যায় মাঠের কাজ শেষ তাইজুদ্দিন বাড়ি ফিরেছে। ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল তাইজুদ্দিনের এক দূর সম্পর্কের বোন তাইজুদ্দিনের স্ত্রীর মাথায় পানি ঢালছে।
তাইজুদ্দিন বলে উঠল, ‘কি হইছে? এই দুপুরেই তো ভাল দেইখা গেলাম।’ বোন উত্তর দিল, ‘পোয়াতি মাইয়া, কখন কি হইয়া যায় বলা যায় নাকি? কবিরাজ রে খবর দেন। অবস্থা ভাল না। খুব জ্বর গায়ে, পুইড়া যাইতাছে শরীল।’
তাইজুদ্দিন দেরি না করে কবিরাজ কে খবর দিল। কবিরাজ কিছুক্ষণ ঝাড়ফুঁক করে ভালো হবে এই আশ্বাস দিয়ে চলে গেল। কিন্তু কবিরাজের ঝাড়ফুঁক কোনো কাজে দিল না। অসুস্থতা যেন আরো দ্বিগুণ হারে বাড়তে লাগল। শেষমেশ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হল। গরু পাঁচেক বিক্রি করে ভালো একটা হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো স্ত্রীকে। এভাবে কিছুদিন চলার পর ডাক্তার বলে দিল ক্যান্সার হয়েছে, লাখ দুই টাকা লাগবে। তাইজুদ্দিন মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তালুকদারের কাছে টাকা চাইল। তালুকদার বলল, ‘টাকা দিব কিন্তু জমি দিতে হবে।’ তাইজুদ্দিন বলল, ‘ওই দুই বিঘা ছাড়া কিছু নাই আমার। বিক্রি করলে খাব কি?’
‘আমি অতকিছু বুঝি নে। টাকা নাই আমার কাছে’, তালুকদার নির্দয় ভাবে বলল। অনেক কাকুতিমিনতি করেও কাজ হলো না। জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে শহরের দিয়ে রওনা হলো। হাসপাতালে গিয়ে টাকা দিলে সেই রাতেই অপারেশন হয়। সকালে খবর পেল অপারেশন করেও নাকি কোনো লাভ হয়নি। তাইজুদ্দিনের স্ত্রী মারা গেছে।
হাসপাতালের মধ্যেই তাইজুদ্দিনের সে কি চিত্কার! তাইজুদ্দিন লাশ নিয়ে চলে আসে গ্রামে। গ্রামের মুরব্বিরা বলে, আহারে! একটা পোলা রাইখা চইলে গেল! তাইজুদ্দিন উত্তর দেয়, হ, এখন আমি এই পোলাডারে নিয়া কই যামু। আমার আর কেউ থাকল না। সেই দুঃখের ইতিহাস তাইজুদ্দিন আজও ভুলতে পারে না। বুকের মধ্যে যেন বার বার বেজে ওঠে তার। ভোর ছয়টা। তাইজুদ্দিন ঘুম থেকে উঠেছে। ছেলেটার কথা চিন্তা করে সারারাত ঘুম হয়নি তার। গোয়াল থেকে গরু বের করে তাইজুদ্দিন। গরুগুলো অন্যের থেকে নেয়া। গাই থেকে বাছুর জন্ম নিলে, বাছুরের অর্ধেক ভাগ তাইজুদ্দিনের। তাইজুদ্দিন হঠাত্ টের পায় ছেলেটা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তড়িঘড়ি করে ছেলের কাছে যায় সে। বলে উঠে, বাবা, ঘুম শেষ হইছে?
তাইজুদ্দিনের ছেলে উত্তর দেয়, ‘আব্বা,ভাত খাব।’
তাইজুদ্দিনের মুখটা কালো হয়ে যায় ছেলের কথায়। তাইজুদ্দিন বলে, বাবা, এত সকালে ভাত খাওয়া ঠিক না। ঘরে মুড়ি আছে। মুড়ি দেব?
না, খাব না মুড়ি, উত্তর দেয় ছেলেটা। তাইজুদ্দিন বলে, আজ দিনমজুরি দিব। ভাত খাইতে পারবা, বাবা। তুমি ঘুমাও এখন। আমি কামে গেলাম, ঘুম থেকে উইঠা তোমার কাগজী খালার বাড়ি যাবা। সন্ধ্যা হইলেই বাড়ি ফিরবা কিন্তু তাইজুদ্দিনের ছেলে উত্তর দেয়, ঠিক আছে, আব্বা।
তাইজুদ্দিন ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে ছুটতে থাকে গঞ্জের বাজারে। যেভাবেই হোক টাকা জোগাড় করতেই হবে। কাজ একটা পেয়েও যায়। বিল্ডিং এ ইট টানার কাজ। সারাদিন কাজ করে দুইশ টাকা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় তাইজুদ্দিন। যাওয়ার পথে তালুকদারের দোকান থেকে চাউল, ডাল নেয়।
তালুকদার বলে, ‘আজ না হয় কাম পাইছো। পরে কি করবা!’
তাইজুদ্দিন উত্তর দেয়, গরিব মানুষের আল্লা আছে। তাইজুদ্দিন ঘরে ফেরে। গিয়ে দেখে ছেলেটা নেই। মনে মনে বলে, এখনো ফেরে নাই কাগজীদের বাড়ি থাইকা! এক দৌড়ে কাগজীদের বাড়ি যায় তাইজুদ্দিন। গিয়ে দেখে কাজ করছে কাগজী। তাইজুদ্দিনকে দূর থেকে দেখেই জিজ্ঞাস করে, কেমন আছেন, ভাই?
তাইজুদ্দিন বলে ওঠে, আমি ভাল। আমার পোলাডা তো বাড়ি যায় নাই এখনো। কই গেছে?
কাগজী জবাব দেয়, কই! ও তো আসে নাই আজ। কথা শুনে তাইজুদ্দিনের পা থেকে যেন মাটি সরে গেল।
তাইজুদ্দিন আবারও বাড়ি যায়। আশপাশের সব বাড়িতে খোঁজ নেয়। কোথাও নেই। মাথায় কিছুই কাজ করছে না তাইজুদ্দিনের। প্রতিবেশী কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা এসে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। কেউ বলে, কাল সকালে মাইক মারতে হবে। এছাড়া উপায় নাই। পরদিন সকালে বিছানা থেকে উঠেই কেমন যেন হৈহুল্লোড় শুনতে পায় তাইজুদ্দিন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন তাইজুদ্দিনকে বলে, ‘ভাই, পুকুর ঘাটে যান।’
তাইজুদ্দিন এক দৌড়ে পুকুর ঘাটে যায়, গিয়ে দেখে সহস্র মানুষের ঢল। তাইজুদ্দিনের মায়ের বয়সী একজন মহিলা তাইজুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হায় হায়, একটা মাত্র পোলা! কই যাস ওরে রাইখা? শুনলাম, দুইবেলা ভাত খাওয়াইতেও নাকি পারস নাই। এখন আর ভাত ভাত করবে না।’
তাইজুদ্দিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। মহিলার কথাগুলো ঘোড়ার ক্ষুরের মতো বুকে এসে বিধে তার।
‘আমার বাবা!’ বলে জোরে একটা চিত্কার দেয় তাইজুদ্দিন। আকাশ বাতাস যেন থমকে যায় তাইজুদ্দিনের চিত্কারে। তাইজুদ্দিনের বন্ধু করিম ব্যাপারী এসে তাইজুদ্দিনকে বলে, ‘পা পিছলে হয়তো পুকুরে পড়ে গেছে। সবই খোদার ইচ্ছে। কখন যে কারে নেয়, কেউ জানে না।’
মুখে কোন কথা নাই, পাথর হয়ে গেছে তাইজুদ্দিন। তাড়াতাড়ি করে কয়েকটা যুবক লাশটা পানি থেকে ডাঙায় নিয়ে আসে, গোসল করায়। দুপুরেই জানাজা পড়ে, তারপর গোরস্থানে। তাইজুদ্দিন তখনও নিস্তব্ধ, কোন কথা নেই মুখে। চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু ঝরে অবিরত। অবশেষে ছেলের কবরে মাটি দিয়ে বাড়ি ফেরে তাইজুদ্দিন।
সেই রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে তাইজুদ্দিন। দেখে, ছেলেটা তাইজুদ্দিনের হাত ধরে গঞ্জের বাজারে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে কোমল মুখে বলতে বলতে যাচ্ছে, ‘আব্বা, আজকে আমরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাইমু, পোলাও খাইমু, মাংস খাইমু’। ঘুম ভেঙে যায় তাইজুদ্দিনের। টের পায় চোখ বেয়ে দর দর করে অশ্রু ঝরছে।
কারও কাছেই যেন পৌঁছায় না তার এই কান্নার স্বর। কোন এক গহিন অরণ্যে মিলিয়ে যায় তাইজুদ্দিন এবং তার জীবনের এই দুঃখময় হালচাল।
বাবা! আমার পোলাটা না খেয়ে মরবে। সের আধেক চাউল দাও না। কাজ নিব সামনে, মাইনে পেয়ে সুদসহ দিব খুব আকুল স্বরে বলল তাইজুদ্দিন।
শোনা মাত্রই তালুকদার ভ্রু কুঁচকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, ‘অ্যা, সুদ সহ দিবে! সালা, গত মাসের পাঁচশ টাকা বাকি! টাকা শোধ করবি কবে? ট্যাকনিক তো ভালোই শিখছিস। জমাজমি নাই? জমাজমি থাকলে কিছু, বল।’
খুব অবাক হলো তাইজুদ্দিন। বলে উঠল, ‘পাঁচশ টাকা মানে! আমি তো পাঁচশ টাকার জিনিস নেই নাই।’ তালুকদার চোখ লাল করে রাগান্বিত হয়ে উত্তর দিল, ‘সাড়ে তিনশ টাকার সুদ দেড়শ টাকা। এই হলো হিসাব। সালা, মুর্খের বাচ্চা।’
তাইজুদ্দিন কাঁদো কাঁদো চোখে দোকানের সামনে থেকে চলে গেল। সন্ধ্যার আজান পড়ে গেছে। তাইজুদ্দিন শত চেষ্টা করেও রান্নার জন্য কিছু চাউল সংগ্রহ করতে পারল না। বাড়ি ফেরার পথে করিম ব্যাপারীর সঙ্গে দেখা। তাইজুদ্দিনের ছেলে বেলার বন্ধু। তাইজুদ্দিন বলল, কোথায় যাচ্ছো, করিম?
করিম ব্যাপারী উত্তর দিল, ‘এই তো নামাজ পড়লাম, ভাই। কিছু বলবা?’
তাইজুদ্দিন কিছু না ভেবে হুটহাট বলে ফেলল, ‘কিছু চাউল কর্য দিতে পারবা, করিম? পোলাডার খুব অসুখ।’
করিম ব্যাপারীর মুখে মুচকি হাসি।
‘দিন কাল যা পড়ছে, এই সন্ধ্যা বেলায় চাউল দিতে হবে অন্যের ঘরে। সমাজ, ধর্ম বলে কিছু নাই দুনিয়ায়, বলল করিম ব্যাপারী। তাইজুদ্দিন আবারো বলে উঠল, আমার পোলাডার অসুখ, না খাইলে মইরা যাবে। যদি পারো...
করিম ব্যাপারী মুখ কালো করে উত্তর দিল, সন্ধ্যায় চাউল কর্য দিবে কে? অন্য সময় কইতে পারো নাই, মিয়া?
তাইজুদ্দিনের বুকের ভেতর হাহাকার করে উঠল। খালি হাতে বাড়ি যেতে হচ্ছে তাকে। ছেলেকে কি বলবে, বুঝে আসছে না। বাবা হিসাবে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে। তাইজুদ্দিন বাড়ি এসে দেখে ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিছানার সঙ্গে মিশে যাওয়া সন্তানের কোমল দেহখানা দেখে তাইজুদ্দিনের মনটা বিষণ্নতায় ভরে উঠল। অতীতের কথা মনে হলো তার। মনে হতে লাগল জীবনের সবচেয়ে করুণ মুহূর্তের কথা। তাইজুদ্দিন তখন যুবক। সবেমাত্র বিয়ে করে স্ত্রীকে নিয়ে নতুন সংসার গড়েছে। নিজের নামে দুই বিঘা আবাদি জমি, বাড়ি ভিটে এবং গোয়ালভরা গরু। খুব ভালোভাবেই কাটছিল জীবন। একদিন সন্ধ্যায় মাঠের কাজ শেষ তাইজুদ্দিন বাড়ি ফিরেছে। ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেল তাইজুদ্দিনের এক দূর সম্পর্কের বোন তাইজুদ্দিনের স্ত্রীর মাথায় পানি ঢালছে।
তাইজুদ্দিন বলে উঠল, ‘কি হইছে? এই দুপুরেই তো ভাল দেইখা গেলাম।’ বোন উত্তর দিল, ‘পোয়াতি মাইয়া, কখন কি হইয়া যায় বলা যায় নাকি? কবিরাজ রে খবর দেন। অবস্থা ভাল না। খুব জ্বর গায়ে, পুইড়া যাইতাছে শরীল।’
তাইজুদ্দিন দেরি না করে কবিরাজ কে খবর দিল। কবিরাজ কিছুক্ষণ ঝাড়ফুঁক করে ভালো হবে এই আশ্বাস দিয়ে চলে গেল। কিন্তু কবিরাজের ঝাড়ফুঁক কোনো কাজে দিল না। অসুস্থতা যেন আরো দ্বিগুণ হারে বাড়তে লাগল। শেষমেশ ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হল। গরু পাঁচেক বিক্রি করে ভালো একটা হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো স্ত্রীকে। এভাবে কিছুদিন চলার পর ডাক্তার বলে দিল ক্যান্সার হয়েছে, লাখ দুই টাকা লাগবে। তাইজুদ্দিন মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তালুকদারের কাছে টাকা চাইল। তালুকদার বলল, ‘টাকা দিব কিন্তু জমি দিতে হবে।’ তাইজুদ্দিন বলল, ‘ওই দুই বিঘা ছাড়া কিছু নাই আমার। বিক্রি করলে খাব কি?’
‘আমি অতকিছু বুঝি নে। টাকা নাই আমার কাছে’, তালুকদার নির্দয় ভাবে বলল। অনেক কাকুতিমিনতি করেও কাজ হলো না। জমি বিক্রি করে টাকা নিয়ে শহরের দিয়ে রওনা হলো। হাসপাতালে গিয়ে টাকা দিলে সেই রাতেই অপারেশন হয়। সকালে খবর পেল অপারেশন করেও নাকি কোনো লাভ হয়নি। তাইজুদ্দিনের স্ত্রী মারা গেছে।
হাসপাতালের মধ্যেই তাইজুদ্দিনের সে কি চিত্কার! তাইজুদ্দিন লাশ নিয়ে চলে আসে গ্রামে। গ্রামের মুরব্বিরা বলে, আহারে! একটা পোলা রাইখা চইলে গেল! তাইজুদ্দিন উত্তর দেয়, হ, এখন আমি এই পোলাডারে নিয়া কই যামু। আমার আর কেউ থাকল না। সেই দুঃখের ইতিহাস তাইজুদ্দিন আজও ভুলতে পারে না। বুকের মধ্যে যেন বার বার বেজে ওঠে তার। ভোর ছয়টা। তাইজুদ্দিন ঘুম থেকে উঠেছে। ছেলেটার কথা চিন্তা করে সারারাত ঘুম হয়নি তার। গোয়াল থেকে গরু বের করে তাইজুদ্দিন। গরুগুলো অন্যের থেকে নেয়া। গাই থেকে বাছুর জন্ম নিলে, বাছুরের অর্ধেক ভাগ তাইজুদ্দিনের। তাইজুদ্দিন হঠাত্ টের পায় ছেলেটা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। তড়িঘড়ি করে ছেলের কাছে যায় সে। বলে উঠে, বাবা, ঘুম শেষ হইছে?
তাইজুদ্দিনের ছেলে উত্তর দেয়, ‘আব্বা,ভাত খাব।’
তাইজুদ্দিনের মুখটা কালো হয়ে যায় ছেলের কথায়। তাইজুদ্দিন বলে, বাবা, এত সকালে ভাত খাওয়া ঠিক না। ঘরে মুড়ি আছে। মুড়ি দেব?
না, খাব না মুড়ি, উত্তর দেয় ছেলেটা। তাইজুদ্দিন বলে, আজ দিনমজুরি দিব। ভাত খাইতে পারবা, বাবা। তুমি ঘুমাও এখন। আমি কামে গেলাম, ঘুম থেকে উইঠা তোমার কাগজী খালার বাড়ি যাবা। সন্ধ্যা হইলেই বাড়ি ফিরবা কিন্তু তাইজুদ্দিনের ছেলে উত্তর দেয়, ঠিক আছে, আব্বা।
তাইজুদ্দিন ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে ছুটতে থাকে গঞ্জের বাজারে। যেভাবেই হোক টাকা জোগাড় করতেই হবে। কাজ একটা পেয়েও যায়। বিল্ডিং এ ইট টানার কাজ। সারাদিন কাজ করে দুইশ টাকা নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হয় তাইজুদ্দিন। যাওয়ার পথে তালুকদারের দোকান থেকে চাউল, ডাল নেয়।
তালুকদার বলে, ‘আজ না হয় কাম পাইছো। পরে কি করবা!’
তাইজুদ্দিন উত্তর দেয়, গরিব মানুষের আল্লা আছে। তাইজুদ্দিন ঘরে ফেরে। গিয়ে দেখে ছেলেটা নেই। মনে মনে বলে, এখনো ফেরে নাই কাগজীদের বাড়ি থাইকা! এক দৌড়ে কাগজীদের বাড়ি যায় তাইজুদ্দিন। গিয়ে দেখে কাজ করছে কাগজী। তাইজুদ্দিনকে দূর থেকে দেখেই জিজ্ঞাস করে, কেমন আছেন, ভাই?
তাইজুদ্দিন বলে ওঠে, আমি ভাল। আমার পোলাডা তো বাড়ি যায় নাই এখনো। কই গেছে?
কাগজী জবাব দেয়, কই! ও তো আসে নাই আজ। কথা শুনে তাইজুদ্দিনের পা থেকে যেন মাটি সরে গেল।
তাইজুদ্দিন আবারও বাড়ি যায়। আশপাশের সব বাড়িতে খোঁজ নেয়। কোথাও নেই। মাথায় কিছুই কাজ করছে না তাইজুদ্দিনের। প্রতিবেশী কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলা এসে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে। কেউ বলে, কাল সকালে মাইক মারতে হবে। এছাড়া উপায় নাই। পরদিন সকালে বিছানা থেকে উঠেই কেমন যেন হৈহুল্লোড় শুনতে পায় তাইজুদ্দিন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন তাইজুদ্দিনকে বলে, ‘ভাই, পুকুর ঘাটে যান।’
তাইজুদ্দিন এক দৌড়ে পুকুর ঘাটে যায়, গিয়ে দেখে সহস্র মানুষের ঢল। তাইজুদ্দিনের মায়ের বয়সী একজন মহিলা তাইজুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘হায় হায়, একটা মাত্র পোলা! কই যাস ওরে রাইখা? শুনলাম, দুইবেলা ভাত খাওয়াইতেও নাকি পারস নাই। এখন আর ভাত ভাত করবে না।’
তাইজুদ্দিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। মহিলার কথাগুলো ঘোড়ার ক্ষুরের মতো বুকে এসে বিধে তার।
‘আমার বাবা!’ বলে জোরে একটা চিত্কার দেয় তাইজুদ্দিন। আকাশ বাতাস যেন থমকে যায় তাইজুদ্দিনের চিত্কারে। তাইজুদ্দিনের বন্ধু করিম ব্যাপারী এসে তাইজুদ্দিনকে বলে, ‘পা পিছলে হয়তো পুকুরে পড়ে গেছে। সবই খোদার ইচ্ছে। কখন যে কারে নেয়, কেউ জানে না।’
মুখে কোন কথা নাই, পাথর হয়ে গেছে তাইজুদ্দিন। তাড়াতাড়ি করে কয়েকটা যুবক লাশটা পানি থেকে ডাঙায় নিয়ে আসে, গোসল করায়। দুপুরেই জানাজা পড়ে, তারপর গোরস্থানে। তাইজুদ্দিন তখনও নিস্তব্ধ, কোন কথা নেই মুখে। চোখ বেয়ে শুধু অশ্রু ঝরে অবিরত। অবশেষে ছেলের কবরে মাটি দিয়ে বাড়ি ফেরে তাইজুদ্দিন।
সেই রাতে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে তাইজুদ্দিন। দেখে, ছেলেটা তাইজুদ্দিনের হাত ধরে গঞ্জের বাজারে যাচ্ছে। যাওয়ার পথে কোমল মুখে বলতে বলতে যাচ্ছে, ‘আব্বা, আজকে আমরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাইমু, পোলাও খাইমু, মাংস খাইমু’। ঘুম ভেঙে যায় তাইজুদ্দিনের। টের পায় চোখ বেয়ে দর দর করে অশ্রু ঝরছে।
কারও কাছেই যেন পৌঁছায় না তার এই কান্নার স্বর। কোন এক গহিন অরণ্যে মিলিয়ে যায় তাইজুদ্দিন এবং তার জীবনের এই দুঃখময় হালচাল।
No comments