সঙ্ঘাত-জর্জরিত আফগানিস্তান ১০ বছরে কিভাবে স্বাস্থ্যের উন্নতি করল by স্বগতা যাদবর
২০০১ সালে তালেবানের পতনের পর এবং সঙ্ঘাত থেকে উদ্ধার পেতে থাকা দেশ
হিসেবে আফগানিস্তান ছিল বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ স্বাস্থ্যসূচকধারী দেশগুলোর
অন্যতম। ২০০৪ সালে প্রতি দুটি শিশুর অন্তত একটি (৫৪%) ছিল খর্বাকার, প্রতি
১০টি শিশুর চারটি (৩৯%) ছিল কম ওজনের। মানব উন্নয়ন সূচকে এর অবস্থান ছিল
১৮১/১৮২।
কিন্তু সঙ্ঘাত ও ব্যাপক দারিদ্র্য সত্ত্বেও মাত্র ১০ বছরে আফগানিস্তান
স্বাস্থ্য সূচকে ব্যাপক অগ্রগতি হাসিল করেছে। পাঁচ বছরের কম বয়সে মৃত্যুর
হার ২৯ ভাগ কমেছে, বামনত্ব হার ২০০৪ সালের ৫৪% থেকে কমে ২০১৩ সালে ৪০ ভাগ,
কম ওজনের শিশু ৩৯ ভাগ থেকে হ্রাস পেয়ে ২০ ভাগ হয়েছে।
মাতৃত্বকালীন পরিচর্যাও বেড়ে ১৬ ভাগ থেকে হয়েছে ৫৩ ভাগ। দক্ষ ব্যক্তির
উপস্থিতিতে জন্মদান ১৪ ভাগ থেকে হয়েছে ৪৬ ভাগ। একইসময় শিশুদের টীকাদান ৪০
ভাগ থেকে হয়েছে ৮০ ভাগ।
আফগান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নজর দেওয়ার ফলেই এ ধরনের
অর্জন সম্ভব হয়েছে। গণস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের গণপুষ্টির পরিচালক হুমায়ূন
লুদিন নয়া দিল্লি সফর করেছিলেন। এ উপলক্ষে তার দেওয়া সাক্ষাতকারের
অংশবিশেষ এখানে তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: বামনত্ব হ্রাস করার কার্যক্রম কখন গ্রহণ করে আফগানিস্তান?
জবাব: শুরু হয়েছিল ২০০২ সালে। আমরা গণস্বাস্থ্য
মন্ত্রণালয়ের অধীনে গণপুষ্টি বিভাগের কার্যক্রম শুরু করি। কয়েক বছরের মধ্যে
বোঝা যাচ্ছিল না আমরা কিভাবে আমাদের লক্ষ্য স্থির করব। তারপর আমরা ২০০৬
সালে নতুন মাত্রায় যাত্রা শুরু করি। হাসপাতালগুলোকে শিশুবান্ধব, মাবান্ধব
করে গড়ে তোলা হতে থাকে। ওই বছর আমাদের প্রেসিডেন্টও শিশু বামনত্বের প্রতি
আগ্রহ দেখান।
প্রশ্ন: অন্যান্য মন্ত্রণালয়কে কিভাবে একত্রিত করলেন একই লক্ষ্যে?
জবাব: আমরা খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টিবিষযক একটি
এজেন্ডা তৈরি করি। এতে সব মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনের ব্যবস্থা করা
হয়। ‘আফগানিস্তান খাদ্য ও পুষ্টি’ এজেন্ডায় ১৭টি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের
মন্ত্রীরা সম্পৃক্ত রয়েছেন।
আমাদের প্রধান নির্বাহী (সিইও) সবাইকে নিয়ে ২০১৭ সালে একটি সম্মেলনের
আয়োজন করেন। প্রতি মাসে মন্ত্রীরা তাদের পরিকল্পনা পেশ করেন। পুষ্টির
ব্যাপারে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব পরিকল্পনা থাকে। তারা সে অনুযায়ী কাজ
করে। উদাহরণ হিসেবে পল্লী পুনর্বাসন কিংবা পানি ও পয়োনিষ্কাষণ
মন্ত্রণালয়ের কথা বলা যায়। তারাও পুষ্টির ব্যাপারে কাজ করছে। শিক্ষা
মন্ত্রণালয়েরও পুষ্টি নিয়ে নিজস্ব পরিকল্পনা রয়েছে। আবার ধর্মীয় লোকজনকে
এতে সম্পৃক্ত করা হয়েছে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। ধর্মীয় ব্যক্তিত্বরাও
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাদের বক্তৃতায় পুষ্টি নিয়ে কথা বলেন।
প্রশ্ন: বামনত্ব নিয়ে উন্নতি কখন লক্ষ্য করলেন?
জবাব: ২০০৪ সালে আমরা প্রথম জাতীয়ভিত্তিক জরিপ করি।
তখন বামনত্ব হার ছিল ৫৪ ভাগ। ২০১৩ সালে তা নেমে আসে ৪০ ভাগে। মাতৃদুগ্ধ
পানের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। ৩০ ভাগ থেকে হয়েছে ৫৮.৪ ভাগ। মাতৃদুগ্ধ
পান বামনত্ব হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। খাদ্য নিরাপত্তা
পরিস্থিতির উন্নতি ও পয়োনিষ্কাষণ ও পানি সরবরাহব্যবস্থার উন্নতিও এতে অবদান
রেখেছে।
প্রশ্ন: মায়ের দুধ পানের ব্যাপারে মন্ত্রণালয় কেন জোর দিয়েছে?
জবাব: শিশুকে মায়ের দুধ পান করানো স্বাস্থ্য ও পুষ্টির
জন্য মৌলিক একটি বিষয। মা যখন তার শিশুকে নিয়ে পরিকল্পনা করেন, আমরা তখন
মায়েদের বলি, তাদের নিজেদের স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দিতে। ধর্মীয় নেতারাও
স্বাস্থ্যবান শিশুর জন্য স্বাস্থ্যবান মায়ের প্রতি জোর দিচ্ছেন।
মহানবী (সা.) বলেছেন, একজন শক্তিশালী মুসলিম একজন দুর্বল মুসলিমের চেয়ে
ভালো। এ কারণে আমরা বলি, আমরা যদি মায়েদের সমর্থন করি, তবে আমরা বিশ্বের
সবচেয়ে শক্তিশালী শিশু পাবো।
প্রথমে আমরা গর্ভকালীন প্রথম নয় মাস নারীদের যত্ন নেই। আমরা আশা করি, এতে জন্মকালীন শিশুর ওজন হবে ৩.৫ কেজি।
শিশুর পুষ্টির জন্য মায়ের দুধ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাছাড়া দুধ পান
করানো হলে মায়েদের স্তন ও জরায়ু ক্যান্সার থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।
প্রশ্ন: আফগান সমাজে মায়ের দুধ পান করতে বলা কি কঠিন কাজ? কোনো নারী কি অন্য পুরুষদের এ ব্যাপারে কথা বলতে দেবে?
জবাব: আমাদের সমাজে যখন কেউ কথা বলে, তখন সবাই, এমনকি
ধর্মীয় নেতারাও শোনেন। মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে আমি ২০০ ধর্মীয় ব্যক্তির
সামনে বক্তব্য রাখি। তারা আমার যুক্তি গ্রহণ করেন।
আর মায়ের দুধ পান করানোর বিষয়টি স্বামীদের মাধ্যমেও করা যেতে পারে।
স্বামীরা এ বিষয়ে জ্ঞান পেতে পারে জুমার নামাজে খুতবায় ইমাম সাহেবের কাছ
থেকে।
প্রশ্ন: ভারতে আপনি কয়েকটি ডে কেয়ার সেন্টার পরিদর্শন করেছেন। এ ব্যাপারে ব্যবধান কতটা বলে আপনি মনে করেন?
জবাব: প্রথমে চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে। তারপর তা পূরণের
কথা আসে। আবার সরবরাহ করতে না পারলে চাহিদা সৃষ্টি করলে সমস্যার সমাধান
হবে না। আমরা এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
প্রশ্ন: আর্থিক সীমাবদ্ধতা নিয়েও আপনারা কিভাবে কাজ করে যাচ্ছেন?
জবাব: আমাদের দেশের আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ফলে আমরা যে সম্পদ আমাদের আছে তথা মানবসম্পদই কাজে লাগাই।
আমাদের ২০০০ স্বাস্থ্য স্থাপনা ও ১০০ হাসপাতাল আছে। আমাদের স্টাফদের
প্রশিক্ষণ দিতে প্রতি ব্যাচে প্রয়োজন আট থেকে ১০ হাজার ডলার। আপনি যদি ১০০
হাসপাতালকে ১০ হাজার দিয়ে গুণ করেন, তবে দেখবেন অঙ্কটি কত বড়। ফলে আমরা
প্রতিটি হাসপাতলের দুজনকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে দিয়ে অন্যদের প্রশিক্ষণের
ব্যবস্থা করি। ফলে কোনো বাজেট ছাড়াই আমরা এ কাজ সম্পন্ন করতে পারি।
প্রশ্ন: শিশুবান্ধব হাসপাতাল উদ্যোগটি কেমন?
জবাব: শিশুটি হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করলে আমরা জন্মের এক
ঘণ্টার মধ্যেই মায়ের দুধ পানের ব্যাপারে জোর দেই। তাছাড়া আমাদের
হাসপাতালগুলোতে মায়ের দুধের বিকল্প কোনো খাবারের প্রচারণা চালানোর সুযোগ
নেই। বিজ্ঞাপন, ফ্রি গিফট ইত্যাদি পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এখন পর্যন্ত আমরা ৮০টি
হাসপাতালকে শিশুবান্ধব বলে স্বীকৃতি দিয়েছি।
No comments