অব্যবস্থাপনা ও আস্থার অভাবে তারল্যসংকট by শওকত হোসেন
• বিশৃঙ্খল ব্যাংক খাত।
• তারল্যসংকটে ভুগছে ব্যাংক খাত।
• আবার কমছে না সুদহার।
• এতে বাড়ছে না বিনিয়োগ।
• তারল্যসংকটে ভুগছে ব্যাংক খাত।
• আবার কমছে না সুদহার।
• এতে বাড়ছে না বিনিয়োগ।
আপডেট- ০৭ মে ২০১৯:
ব্যাংক খাতে এখন হাহাকার। কান পাতলেই শোনা যায় টাকা নেই। টান পড়েছে নগদ টাকার। কমছে আমানত। কমেছে ঋণ আদায়। সংকট ডলারেরও। অথচ দুই বছর আগেও ব্যাংক যেন নগদ টাকার ওপর ভাসছিল। এই দুই বছরে দেশের অর্থনীতির বড় কোনো পালাবদল হয়নি। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রকট হয়েছে ব্যাংক খাতের তারল্যসংকট। কমেছে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল। যে ব্যাংক দুই বছর আগেও সাধারণ মানুষের আমানত রাখতে আগ্রহী ছিল না, তারাই এখন হন্যে হয়ে আমানত খুঁজছে। এমনকি অর্থের পরিমাণ বেশি হলে সাড়ে ১০ শতাংশ সুদও দিতে রাজি কিছু ব্যাংক।
সরকার ও ব্যাংকমালিকদের সিদ্ধান্ত ছিল, ব্যাংক ঋণের সুদহার হবে ৯ শতাংশ আর আমানতের সুদ ৬ শতাংশ। সুদ কমলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের খরচ কমবে, এতে নতুন বিনিয়োগও বাড়বে। অথচ ঘটছে উল্টোটা। বাড়ছে সব ধরনের সুদহার।
অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, ভুল নীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সাধারণ মানুষের আস্থার অভাবের কারণেই ব্যাংক খাতের তারল্যসংকট তৈরি হয়েছে বলে ব্যাংকার ও গবেষকেরা মনে করেন।
তারল্য পরিস্থিতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে ৪০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা, আর ঋণ বেড়েছে ৬৭ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোর গত মার্চভিত্তিক তারল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় দেখা গেছে, সব মিলিয়ে ৯ থেকে ১০টি ব্যাংকের বিনিয়োগ করার মতো তহবিল আছে। বাকি ব্যাংকগুলো টাকা ধার করে ছোট আকারের বিনিয়োগ কার্যক্রম চালাচ্ছে।
দেশে এখন মোট আমানতের মাত্র ২৮ শতাংশ আছে সরকারি ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে। বাকি ৭২ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে। আবার সরকারি ব্যাংকের ঋণের হার আমানতের ৬৭ শতাংশ, বেসরকারি ব্যাংকে তা ৮৭ শতাংশ। অথচ ঋণ দেওয়ার সীমা সাড়ে ৮৩ শতাংশ। এর মধ্যে বেসিক ও পদ্মা (সাবেক ফারমার্স) ব্যাংকের ঋণের হার যথাক্রমে ১১০ ও ১১৩ শতাংশ। এর বাইরে আরও ১০ ব্যাংক ঋণ দিয়েছে আমানতের ৯০ শতাংশের বেশি। ফলে বেসরকারি ব্যাংকের বড় অংশেরই ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে।
ব্যাংকঋণের একটি বড় অংশ যায় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকে আগের চেয়ে টাকা কমে গেছে, সুদহারও বেড়ে গেছে। এখন ১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হচ্ছে। ব্যবসার জন্য সুদহার আরও কমানো প্রয়োজন।
কেন ভালো নেই ব্যাংক
আশির দশক থেকেই নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে দেশের ব্যাংক খাত। দাতাদের পরামর্শ ও ঋণে একাধিক সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়। গঠন করা হয় একাধিক কমিশন ও কমিটি। অনুসরণ করা হয় ব্যাংক পরিচালনার আন্তর্জাতিক রীতিনীতি। এতে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছিল। কিন্তু এক দশক ধরে উল্টো পথে চলেছে ব্যাংক খাত। নজরদারি শিথিল হয়েছে। ঘটেছে বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। বেড়েছে খেলাপি ঋণ। অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে।
গত এক দশকের মধ্যে ব্যাংক খাতে প্রথম ধাক্কা ছিল হল-মার্ক কেলেঙ্কারি। ২০১১ সালের এই কেলেঙ্কারির পর দেশের সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। এরপরই ঘটে বেসিক ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের একাধিক কেলেঙ্কারি। এরপরও নিয়মনীতি মানেনি অনেক ব্যাংক। তারা নিয়মের বাইরে ঋণ দেয়।
সবশেষ ঘটে ২০১৮ সালের ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি। আমানতের তুলনায় বেশি ঋণ দেয় তারা। একপর্যায়ে নগদ টাকা না থাকায় গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় ব্যাংকটি। এতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমানত তুলে নেওয়া শুরু করলে এর প্রভাব পড়ে অন্য ব্যাংকের ওপর। আস্থার সংকটে তাদের আমানতও কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে যে সমস্যাগুলো চলছে, তা একদিনে আসেনি। ব্যবসায়ী ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আইনকানুন ঠিক করে দিচ্ছেন। এ কারণেই এত সমস্যার উদ্ভব। সমস্যা সবারই জানা, প্রয়োজন দৃশ্যমান পদক্ষেপ। কিন্তু অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কাউকে তো শাস্তি দিতে দেখা গেল না। অথচ ব্যাংক খাতে এমন পরিস্থিতি চললে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নও সম্ভব না।
তারল্যসংকটের আরও কারণ
অন্যান্য খাত থেকেও ব্যাংকের আয় কমে গেছে। যেমন, আমদানি ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, রপ্তানি ও প্রবাসী-আয় সেভাবে বাড়েনি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানি ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৭৮৩ কোটি ডলার। সেবা, ঋণ ও সুদ পরিশোধে খরচ হয়েছে আরও ৮৮৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে এ সময়ে প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ১৮৬ কোটি ডলার, রপ্তানি আয় ৩ হাজার ৯০ কোটি ডলার। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৬৯ কোটি ডলার।
এর আগের অর্থবছরে ব্যয় ছিল আরও বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ২৫ শতাংশ হারে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানি করতে ওই সময়ে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়। এতে ডলারের সংকট দেখা দিলে এর দর বেড়ে যায়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে যে ডলার ছিল ৮০ টাকা, তা এখন ৮৪ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ এখনো কম। আমদানি দায় মেটাতে গত জুলাই-মার্চ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১৮৭ কোটি ডলার কিনেছে ব্যাংকগুলো। এর বিপরীতে ১৫ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। যা তারল্যসংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
শিল্পের কাঁচামাল ও সাধারণের ভোগ্যপণ্যের বড় অংশই আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধি পেলে এসব পণ্যের দামও বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ে। চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকেই মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে।
এর মধ্যেই আবার সরকার ঋণখেলাপিদের নতুন করে ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। খেলাপিরা ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ নিয়মিত করতে পারবে। এতেও ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কার্যক্রমে বড় ধাক্কা লেগেছে।
একজন বড় উদ্যোক্তা এই প্রতিবেদককে জানালেন, চলতি মাসেই তাঁর শিল্পগ্রুপের নেওয়া ঋণের কয়েকটা কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা ছিল। এখন তিনি একটু দেরি করছেন। কারণ, খেলাপি হলে সুবিধা বেশি, কম সুদে ঋণ পরিশোধ করা যাবে।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বড় অঙ্কের টাকা খেলাপিদের কাছে আটকে পড়েছে। চাহিদামতো আমানতও মিলছে না। আবার ৯ শতাংশ সুদে টাকা পরিশোধের সুযোগ আসবে—এমন ঘোষণায় অনেকেই টাকা শোধ বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্যে বড় চাপ এসেছে।
আস্থার সংকট
ব্যাংক খাতের এবারের তারল্যসংকটের অন্যতম কারণ আস্থার অভাব। এ সংকট কাটাতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসেনি। যেমন, ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল সোনারগাঁও হোটেলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকার ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) হার ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার অনুমোদন দেওয়া হয়, যা আগে ছিল সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ।
এরপরও চাহিদামতো আমানত আসেনি ব্যাংক খাতে। গ্রাহকেরা এখন মূলত টাকা খাটাচ্ছে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে। মুনাফার হার বেশি থাকায় নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রই এখন টাকা রাখার বড় ভরসার জায়গা হিসেবে তৈরি হয়েছে। যেমন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু অর্থবছরের আট মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬১ হাজার ১২ কোটি টাকা।
গত ১০ বছরে জিডিপির অংশ হিসেবে বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে কর্মসংস্থানের সুযোগও খুব বাড়েনি। এই উচ্চ প্রবৃদ্ধিকে অনেক গবেষক কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ অবস্থায় যখন বিনিয়োগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন, সেই সময়ে দুর্বল ব্যাংক খাত, তারল্যসংকট ও উচ্চ সুদহার বিনিয়োগ সুযোগকে আরও কমিয়ে দিচ্ছে।
মীর নাসির হোসেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, একজন উদ্যোক্তা হিসেবে বিনিয়োগের জন্য জরুরি হচ্ছে জ্বালানির প্রাপ্যতা। বিশেষ করে গ্যাস। অনেক দিন ধরে এ নিয়ে কথা হলেও এখনো প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তরলীকৃত বা এলএনজি গ্যাস আসতে বেশি সময় নিয়েছে। অন্যদিকে সংকট কমলেও মানসম্পন্ন ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এখনো নিশ্চিত হয়নি। জ্বালানির এসব চাহিদা পূরণ হলে তবেই আসবে ব্যাংকঋণের প্রশ্ন। কিন্তু ব্যাংক খাত বিশৃঙ্খল, জবাবদিহিও কম। তার ওপর অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে খেলাপি ঋণ ও সুদহার দুটিই বেড়েছে। সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে। ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমাতে চাইছে। এসব উদ্যোগ ভালো। কিন্তু জ্বালানি ও ব্যাংক সমস্যার সমাধান না হলে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়বে না।
ব্যাংক খাতে এখন হাহাকার। কান পাতলেই শোনা যায় টাকা নেই। টান পড়েছে নগদ টাকার। কমছে আমানত। কমেছে ঋণ আদায়। সংকট ডলারেরও। অথচ দুই বছর আগেও ব্যাংক যেন নগদ টাকার ওপর ভাসছিল। এই দুই বছরে দেশের অর্থনীতির বড় কোনো পালাবদল হয়নি। প্রবৃদ্ধি বেড়েছে, মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে প্রকট হয়েছে ব্যাংক খাতের তারল্যসংকট। কমেছে বিনিয়োগযোগ্য তহবিল। যে ব্যাংক দুই বছর আগেও সাধারণ মানুষের আমানত রাখতে আগ্রহী ছিল না, তারাই এখন হন্যে হয়ে আমানত খুঁজছে। এমনকি অর্থের পরিমাণ বেশি হলে সাড়ে ১০ শতাংশ সুদও দিতে রাজি কিছু ব্যাংক।
সরকার ও ব্যাংকমালিকদের সিদ্ধান্ত ছিল, ব্যাংক ঋণের সুদহার হবে ৯ শতাংশ আর আমানতের সুদ ৬ শতাংশ। সুদ কমলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের খরচ কমবে, এতে নতুন বিনিয়োগও বাড়বে। অথচ ঘটছে উল্টোটা। বাড়ছে সব ধরনের সুদহার।
অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, ভুল নীতি, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সাধারণ মানুষের আস্থার অভাবের কারণেই ব্যাংক খাতের তারল্যসংকট তৈরি হয়েছে বলে ব্যাংকার ও গবেষকেরা মনে করেন।
তারল্য পরিস্থিতি
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০১৮ সালের জুলাই থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে আমানত বেড়েছে ৪০ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা, আর ঋণ বেড়েছে ৬৭ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা।
ব্যাংকগুলোর গত মার্চভিত্তিক তারল্য পরিস্থিতি বিবেচনায় দেখা গেছে, সব মিলিয়ে ৯ থেকে ১০টি ব্যাংকের বিনিয়োগ করার মতো তহবিল আছে। বাকি ব্যাংকগুলো টাকা ধার করে ছোট আকারের বিনিয়োগ কার্যক্রম চালাচ্ছে।
দেশে এখন মোট আমানতের মাত্র ২৮ শতাংশ আছে সরকারি ছয়টি বাণিজ্যিক ব্যাংকে। বাকি ৭২ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে। আবার সরকারি ব্যাংকের ঋণের হার আমানতের ৬৭ শতাংশ, বেসরকারি ব্যাংকে তা ৮৭ শতাংশ। অথচ ঋণ দেওয়ার সীমা সাড়ে ৮৩ শতাংশ। এর মধ্যে বেসিক ও পদ্মা (সাবেক ফারমার্স) ব্যাংকের ঋণের হার যথাক্রমে ১১০ ও ১১৩ শতাংশ। এর বাইরে আরও ১০ ব্যাংক ঋণ দিয়েছে আমানতের ৯০ শতাংশের বেশি। ফলে বেসরকারি ব্যাংকের বড় অংশেরই ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে।
ব্যাংকঋণের একটি বড় অংশ যায় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ব্যাংকে আগের চেয়ে টাকা কমে গেছে, সুদহারও বেড়ে গেছে। এখন ১৩ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হচ্ছে। ব্যবসার জন্য সুদহার আরও কমানো প্রয়োজন।
কেন ভালো নেই ব্যাংক
আশির দশক থেকেই নানা চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে গেছে দেশের ব্যাংক খাত। দাতাদের পরামর্শ ও ঋণে একাধিক সংস্কার কর্মসূচি নেওয়া হয়। গঠন করা হয় একাধিক কমিশন ও কমিটি। অনুসরণ করা হয় ব্যাংক পরিচালনার আন্তর্জাতিক রীতিনীতি। এতে সামগ্রিকভাবে ব্যাংক খাতের অবস্থা কিছুটা ভালো হয়েছিল। কিন্তু এক দশক ধরে উল্টো পথে চলেছে ব্যাংক খাত। নজরদারি শিথিল হয়েছে। ঘটেছে বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি। বেড়েছে খেলাপি ঋণ। অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পাশ কাটিয়ে।
গত এক দশকের মধ্যে ব্যাংক খাতে প্রথম ধাক্কা ছিল হল-মার্ক কেলেঙ্কারি। ২০১১ সালের এই কেলেঙ্কারির পর দেশের সবচেয়ে বড় সোনালী ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল হয়ে পড়ে। এরপরই ঘটে বেসিক ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের একাধিক কেলেঙ্কারি। এরপরও নিয়মনীতি মানেনি অনেক ব্যাংক। তারা নিয়মের বাইরে ঋণ দেয়।
সবশেষ ঘটে ২০১৮ সালের ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারি। আমানতের তুলনায় বেশি ঋণ দেয় তারা। একপর্যায়ে নগদ টাকা না থাকায় গ্রাহকের অর্থ ফেরত দিতে ব্যর্থ হয় ব্যাংকটি। এতে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমানত তুলে নেওয়া শুরু করলে এর প্রভাব পড়ে অন্য ব্যাংকের ওপর। আস্থার সংকটে তাদের আমানতও কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে যে সমস্যাগুলো চলছে, তা একদিনে আসেনি। ব্যবসায়ী ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আইনকানুন ঠিক করে দিচ্ছেন। এ কারণেই এত সমস্যার উদ্ভব। সমস্যা সবারই জানা, প্রয়োজন দৃশ্যমান পদক্ষেপ। কিন্তু অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কাউকে তো শাস্তি দিতে দেখা গেল না। অথচ ব্যাংক খাতে এমন পরিস্থিতি চললে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নও সম্ভব না।
তারল্যসংকটের আরও কারণ
অন্যান্য খাত থেকেও ব্যাংকের আয় কমে গেছে। যেমন, আমদানি ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, রপ্তানি ও প্রবাসী-আয় সেভাবে বাড়েনি। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ফেব্রুয়ারি সময়ে আমদানি ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৭৮৩ কোটি ডলার। সেবা, ঋণ ও সুদ পরিশোধে খরচ হয়েছে আরও ৮৮৬ কোটি ডলার। অন্যদিকে এ সময়ে প্রবাসী আয় এসেছে ১ হাজার ১৮৬ কোটি ডলার, রপ্তানি আয় ৩ হাজার ৯০ কোটি ডলার। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি ১ হাজার ৬৯ কোটি ডলার।
এর আগের অর্থবছরে ব্যয় ছিল আরও বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ২৫ শতাংশ হারে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যন্ত্রপাতি আমদানি করতে ওই সময়ে প্রায় দুই হাজার কোটি ডলারের ঋণপত্র খোলা হয়। এতে ডলারের সংকট দেখা দিলে এর দর বেড়ে যায়। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে যে ডলার ছিল ৮০ টাকা, তা এখন ৮৪ টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
চাহিদার তুলনায় ডলারের সরবরাহ এখনো কম। আমদানি দায় মেটাতে গত জুলাই-মার্চ সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ১৮৭ কোটি ডলার কিনেছে ব্যাংকগুলো। এর বিপরীতে ১৫ হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। যা তারল্যসংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
শিল্পের কাঁচামাল ও সাধারণের ভোগ্যপণ্যের বড় অংশই আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বৃদ্ধি পেলে এসব পণ্যের দামও বেড়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ে। চলতি অর্থবছরের প্রথম থেকেই মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে।
এর মধ্যেই আবার সরকার ঋণখেলাপিদের নতুন করে ছাড় দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। খেলাপিরা ৯ শতাংশ সুদহারে ঋণ নিয়মিত করতে পারবে। এতেও ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায় কার্যক্রমে বড় ধাক্কা লেগেছে।
একজন বড় উদ্যোক্তা এই প্রতিবেদককে জানালেন, চলতি মাসেই তাঁর শিল্পগ্রুপের নেওয়া ঋণের কয়েকটা কিস্তি পরিশোধের সময়সীমা ছিল। এখন তিনি একটু দেরি করছেন। কারণ, খেলাপি হলে সুবিধা বেশি, কম সুদে ঋণ পরিশোধ করা যাবে।
ব্যাংকের প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) চেয়ারম্যান সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বড় অঙ্কের টাকা খেলাপিদের কাছে আটকে পড়েছে। চাহিদামতো আমানতও মিলছে না। আবার ৯ শতাংশ সুদে টাকা পরিশোধের সুযোগ আসবে—এমন ঘোষণায় অনেকেই টাকা শোধ বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্যে বড় চাপ এসেছে।
আস্থার সংকট
ব্যাংক খাতের এবারের তারল্যসংকটের অন্যতম কারণ আস্থার অভাব। এ সংকট কাটাতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও তা কাজে আসেনি। যেমন, ২০১৮ সালের ১ এপ্রিল সোনারগাঁও হোটেলে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকার ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণের (সিআরআর) হার ১ শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নেয়। পাশাপাশি সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার অনুমোদন দেওয়া হয়, যা আগে ছিল সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ।
এরপরও চাহিদামতো আমানত আসেনি ব্যাংক খাতে। গ্রাহকেরা এখন মূলত টাকা খাটাচ্ছে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে। মুনাফার হার বেশি থাকায় নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রই এখন টাকা রাখার বড় ভরসার জায়গা হিসেবে তৈরি হয়েছে। যেমন, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু অর্থবছরের আট মাসে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৬১ হাজার ১২ কোটি টাকা।
গত ১০ বছরে জিডিপির অংশ হিসেবে বেসরকারি বিনিয়োগ বেড়েছে মাত্র ১ শতাংশ। বিনিয়োগ বাড়ছে না বলে কর্মসংস্থানের সুযোগও খুব বাড়েনি। এই উচ্চ প্রবৃদ্ধিকে অনেক গবেষক কর্মসংস্থানহীন প্রবৃদ্ধি বলে আখ্যা দিয়েছেন। এ অবস্থায় যখন বিনিয়োগ আরও বাড়ানো প্রয়োজন, সেই সময়ে দুর্বল ব্যাংক খাত, তারল্যসংকট ও উচ্চ সুদহার বিনিয়োগ সুযোগকে আরও কমিয়ে দিচ্ছে।
মীর নাসির হোসেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, একজন উদ্যোক্তা হিসেবে বিনিয়োগের জন্য জরুরি হচ্ছে জ্বালানির প্রাপ্যতা। বিশেষ করে গ্যাস। অনেক দিন ধরে এ নিয়ে কথা হলেও এখনো প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তরলীকৃত বা এলএনজি গ্যাস আসতে বেশি সময় নিয়েছে। অন্যদিকে সংকট কমলেও মানসম্পন্ন ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এখনো নিশ্চিত হয়নি। জ্বালানির এসব চাহিদা পূরণ হলে তবেই আসবে ব্যাংকঋণের প্রশ্ন। কিন্তু ব্যাংক খাত বিশৃঙ্খল, জবাবদিহিও কম। তার ওপর অনেক আর্থিক কেলেঙ্কারির কারণে খেলাপি ঋণ ও সুদহার দুটিই বেড়েছে। সরকার অর্থনৈতিক অঞ্চল করছে। ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কমাতে চাইছে। এসব উদ্যোগ ভালো। কিন্তু জ্বালানি ও ব্যাংক সমস্যার সমাধান না হলে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়বে না।
No comments