নথি নিয়ে আসামের মানুষের ছয় দশকের টিকে থাকার লড়াই
কয়েক
দশকের নানা উদ্যোগের পর ৩১ আগস্ট প্রকাশিত হয়েছে ভারতের আসাম রাজ্যের
চূড়ান্ত নাগরিক তালিকা (এনআরসি)। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ ১৮-এর কাছে এই
তালিকা নিয়ে নিজের দীর্ঘ লড়াইয়ের কথা জানিয়েছেন মোরিগাঁও জেলার লাহারিঘাটের
বাসিন্দা হায়দার আলী। তিনি স্মরণ করছিলেন নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য বছরের
পর বছর অনেকগুলো স্টিলের ট্রাঙ্কে কিভাবে বিভিন্ন নথি জমিয়ে রেখেছিলেন
তিনি। নিউজ ১৮-কে হায়দার আলী বলেন, ‘আমাদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতেই এসব নথি।
এটি আমার নাগরিকত্বের সুরক্ষা দিয়েছে। এর ফলে আমার পরিবার বেঁচে থাকবে।
১৯৬২ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত নানা নথি রয়েছে আমার কাছে। রয়েছে ভূমি রেকর্ড।
এনআরসি-র জন্য এসব নথি দাখিল করেছিলাম যাতে আমার পরিবার শান্তিতে বাঁচতে
পারে।’
২০১৫ সালে যখন এনআরসি তালিকা প্রণয়ণের কাজ শুরু হয় তারও কয়েক দশক আগে থেকে নিজের নাগরিকত্বের প্রমাণগুলো পাতলা প্লাস্টিকের মধ্যে সংরক্ষণ করে একটি ফাইলে রেখে দিতেন। পরে সেগুলো রাখতেন রুপালি রঙের স্টিলের ট্রাংকে। এসব ট্রাংক রাখা থাকতো তার বিছানার নিচে। চার সদস্যের পরিবারের জন্য এই রকম ফাইল তার অনেকগুলো জমে যায়। তিনি বলেন, নাগরিকত্বের প্রমাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই নথিগুলো অনেক হাত ঘুরেছে।
গত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ে এনআরসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে আবেদন করা তিন কোটি ৯০ লাখ মানুষকে এইভাবে নথি সংরক্ষণ করতে হয়েছে। জমা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ নথি। আর তার সবই নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে জমা পড়েছে এনআরসি কর্তৃপক্ষের কাছে।
এই পরিবর্তন উপলব্ধি করতে নিউজ ১৮ কথা বলেছে আসামের অ্যাকাডেমিক ও মানবাধিকার অ্যাকটিভিস্ট প্রসেনজিত বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েক দশক ধরে মানুষ সযত্নে যেসব নথি সংরক্ষণ করেছে তার অনেকগুলোই আজকের আইনে আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে রিটেনশন পিরিয়ডের আইনে যে নথি ইস্যু করা হয়েছিল আজকের সময়ে সরকার সেসব নথি গ্রহণ না-ও করতে পারে। সরকারের কারণে অনেক আবেদনকারী এই সমস্যায় পড়ছে, তাদের রেকর্ড অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে।
প্রসেনজিত বিশ্বাস জানান, ১৯৫৫ সালে গুয়াহাটির একটি এনআরসি সেবা কেন্দ্র থেকে নাগরিকত্বের সনদপত্র নিয়েছিলেন তার বাবা। এখন কর্তৃপক্ষ বলছে, ওই সনদপত্র গ্রহণ করবে না তারা। কারণ এর কোনও সরকারি রেকর্ড তাদের কাছে নেই।
নাগরিকত্ব নিয়ে টানাপোড়েনের পর আসামের নাগরিকদের পরিস্থিতি এখন খানিকটা এমন জীবন হারালে তারা যতটা কষ্ট পায় তার চেয়ে বেশি কষ্ট পায় নথি হারালে। আলাদা করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গেও লড়াই করতে হয় তাদের।
২০১৯ সালের জুনে যখন বন্যার পানি বাড়তে থাকে তখন মোরিগাও জেলায় পরিবারের সঙ্গে বাস করা আরফান আলী জীবন রক্ষার আগে এনআরসি নথি সংরক্ষণের কথা ভেবেছেন। বন্যার পানি বাড়তে থাকলে নথি হারানোর দুশ্চিন্তাও বাড়তে থাকে তার। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারে চার সদস্য। সবাই এনআরসি’র আবেদন করেছিলাম। প্রথম খসড়া তালিকায় নাম আসে তিনজনের। বাদ পড়ে আমার স্ত্রী। তাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেছিলাম। কিন্তু বন্যার পানিতে সব ভেসে যায়। আমার বাড়িঘর সব ধুয়ে নিয়ে গেছে বন্যার পানি’। তিনি বলেন ১৯৬০-এর দশক থেকে সংরক্ষণ করা এসব নথির বয়স আমাদের থেকেও বেশি।
প্রসেনহজিত বিশ্বাস বলেন, নথি মজুদের এই পুরো প্রক্রিয়া নাগরিকত্ব নিয়ে আসামের মানুষের উদ্বেগের কথাই মনে করিয়ে দেয়। তিনি বলেন, নথি সংরক্ষণের প্রথাগত পদ্ধতি থেকে আধুনিক উপায়ে চলে এসেছি আমরা। ১৯৫০-৬০ এর দশকে গ্রামের মানুষ বাঁশের চোঙ্গার মধ্যে কাগজ রাখতো। আসামের বাণিজ্যিক বাজোরে আলমিরার প্রবেশ ঘটে ১৯৭০-এর দশকে। বন্যার সময় বাড়ির উঁচু জায়গায় মানুষ তাদের নথি রাখতো।
বাক্স জেলায় গোবিন্দ নন্দি ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম এনআরসি তালিকায় আসেনি। বাবার সংগ্রহ করা নথিগুলো দেখানোর পরও কিভাবে তিনি নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেন সেটাই বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, আমার সহোদর আর আমি যখন খুবই ছোট তখন বাবা প্রথম একটা ফাইল নিয়ে আসলেন এসব নথি সংরক্ষণের জন্য। আমরা বড় হতে শুরু করলে স্কুলের উত্তরপত্রগুলোও জমা রাখতে শুরু করলাম। অন্য মানুষের ক্ষেত্রে এগুলো কোনও কাজে লাগে না। কিন্তু এগুলো এই ভূমিতে আমাদের বসবাসের প্রমাণ দেয়।
নন্দি ১৯৬৪ সালে প্রণয়ন করা তার বাবার পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট ও ১৯৬৮ সালে স্কুলে ভর্তির নথিও এনআরসি কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করেন।
এ ধরনের গল্প আরও অনেকেরই আছে। সে কথা মাথায় রেখে আসামের অ্যাকাডেমিক প্রসেনজিত বিশ্বাস বলেন, এনআরসি যে সময় অনেক মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে ফেলবে তখনও বহু মানুষ তাদের নথি সংরক্ষণ করে যাবে। অনেকের কাছে এটা আবেগের বিষয়। আবার অন্যদের কাছে এটা তাদের পরিচয়ের প্রশ্ন।
গোয়ালপাড়া জেলার প্রদীপ চন্দ্র দে’র কাছে রয়েছে ১৯৬৪ সালে প্রণিত হওয়া বাবার শরণার্থী সার্টিফিকেট। দুধনোই এলাকার ১১ নম্বর শরণার্থী শিবিরের কথা স্মরণ করেন তিনি। তিনি বলেন, আমার বড় বোন আর আমি ক্যাম্পে কাজ পেলাম। বিনামূল্যে রেশন পেতাম আমরা। আমার পরিবারকে দেওয়া হলো শরণার্থী সার্টিফিকেট। ২০১৫ সালে এসব সার্টিফিকেট আমরা এনআরসি’র কাছে দাখিল করেছিলাম। আমি জানি না ওই শিবিরের কতজনের নাম এই তালিকায় এসেছে।
প্রদীপ চন্দ্র দে ও তার পরিবারের আট সদস্যের নাম এনআরসি তালিকায় আসেনি। যদিও তারা ১৯৬৬ সালের ভূমি রেকর্ড ও বাবার শরণার্থী সার্টিফিকেট দাখিল করেছেন। তিনি জানান, ১৯৬৬ সালে সরকারের কাছ থেকে ২ হাজার ৬০০ রুপি ঋণ নেই আমরা। ওই অর্থ দিয়ে তামুলপুরে একটা ছোট জমি কিনি। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ৫৩ বছর পরও যদি ওই জমির রেজিস্ট্রেশন টিকে থাকে তাহলে নথি কেন অবৈধ হয়ে যাবে?
২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এই পরিবারটি গুয়াহাটির এনআরসি কার্যালয়ে গিয়েছেন। তিনি অনুতাপ করে বলেন, আমার বাবা বা আমি কেউই এসব নথি যত্ন নিয়ে সংরক্ষণ করিনি।
২০১৫ সালে যখন এনআরসি তালিকা প্রণয়ণের কাজ শুরু হয় তারও কয়েক দশক আগে থেকে নিজের নাগরিকত্বের প্রমাণগুলো পাতলা প্লাস্টিকের মধ্যে সংরক্ষণ করে একটি ফাইলে রেখে দিতেন। পরে সেগুলো রাখতেন রুপালি রঙের স্টিলের ট্রাংকে। এসব ট্রাংক রাখা থাকতো তার বিছানার নিচে। চার সদস্যের পরিবারের জন্য এই রকম ফাইল তার অনেকগুলো জমে যায়। তিনি বলেন, নাগরিকত্বের প্রমাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই নথিগুলো অনেক হাত ঘুরেছে।
গত ৫০ বছরেরও বেশি সময়ে এনআরসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে আবেদন করা তিন কোটি ৯০ লাখ মানুষকে এইভাবে নথি সংরক্ষণ করতে হয়েছে। জমা হয়েছে প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ নথি। আর তার সবই নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে জমা পড়েছে এনআরসি কর্তৃপক্ষের কাছে।
এই পরিবর্তন উপলব্ধি করতে নিউজ ১৮ কথা বলেছে আসামের অ্যাকাডেমিক ও মানবাধিকার অ্যাকটিভিস্ট প্রসেনজিত বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, কয়েক দশক ধরে মানুষ সযত্নে যেসব নথি সংরক্ষণ করেছে তার অনেকগুলোই আজকের আইনে আদালতের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ১৯৭১ সালে রিটেনশন পিরিয়ডের আইনে যে নথি ইস্যু করা হয়েছিল আজকের সময়ে সরকার সেসব নথি গ্রহণ না-ও করতে পারে। সরকারের কারণে অনেক আবেদনকারী এই সমস্যায় পড়ছে, তাদের রেকর্ড অস্তিত্বহীন হয়ে যাচ্ছে।
প্রসেনজিত বিশ্বাস জানান, ১৯৫৫ সালে গুয়াহাটির একটি এনআরসি সেবা কেন্দ্র থেকে নাগরিকত্বের সনদপত্র নিয়েছিলেন তার বাবা। এখন কর্তৃপক্ষ বলছে, ওই সনদপত্র গ্রহণ করবে না তারা। কারণ এর কোনও সরকারি রেকর্ড তাদের কাছে নেই।
নাগরিকত্ব নিয়ে টানাপোড়েনের পর আসামের নাগরিকদের পরিস্থিতি এখন খানিকটা এমন জীবন হারালে তারা যতটা কষ্ট পায় তার চেয়ে বেশি কষ্ট পায় নথি হারালে। আলাদা করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গেও লড়াই করতে হয় তাদের।
২০১৯ সালের জুনে যখন বন্যার পানি বাড়তে থাকে তখন মোরিগাও জেলায় পরিবারের সঙ্গে বাস করা আরফান আলী জীবন রক্ষার আগে এনআরসি নথি সংরক্ষণের কথা ভেবেছেন। বন্যার পানি বাড়তে থাকলে নথি হারানোর দুশ্চিন্তাও বাড়তে থাকে তার। তিনি বলেন, ‘আমার পরিবারে চার সদস্য। সবাই এনআরসি’র আবেদন করেছিলাম। প্রথম খসড়া তালিকায় নাম আসে তিনজনের। বাদ পড়ে আমার স্ত্রী। তাকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেছিলাম। কিন্তু বন্যার পানিতে সব ভেসে যায়। আমার বাড়িঘর সব ধুয়ে নিয়ে গেছে বন্যার পানি’। তিনি বলেন ১৯৬০-এর দশক থেকে সংরক্ষণ করা এসব নথির বয়স আমাদের থেকেও বেশি।
প্রসেনহজিত বিশ্বাস বলেন, নথি মজুদের এই পুরো প্রক্রিয়া নাগরিকত্ব নিয়ে আসামের মানুষের উদ্বেগের কথাই মনে করিয়ে দেয়। তিনি বলেন, নথি সংরক্ষণের প্রথাগত পদ্ধতি থেকে আধুনিক উপায়ে চলে এসেছি আমরা। ১৯৫০-৬০ এর দশকে গ্রামের মানুষ বাঁশের চোঙ্গার মধ্যে কাগজ রাখতো। আসামের বাণিজ্যিক বাজোরে আলমিরার প্রবেশ ঘটে ১৯৭০-এর দশকে। বন্যার সময় বাড়ির উঁচু জায়গায় মানুষ তাদের নথি রাখতো।
বাক্স জেলায় গোবিন্দ নন্দি ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম এনআরসি তালিকায় আসেনি। বাবার সংগ্রহ করা নথিগুলো দেখানোর পরও কিভাবে তিনি নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে ব্যর্থ হলেন সেটাই বুঝতে পারছেন না। তিনি বলেন, আমার সহোদর আর আমি যখন খুবই ছোট তখন বাবা প্রথম একটা ফাইল নিয়ে আসলেন এসব নথি সংরক্ষণের জন্য। আমরা বড় হতে শুরু করলে স্কুলের উত্তরপত্রগুলোও জমা রাখতে শুরু করলাম। অন্য মানুষের ক্ষেত্রে এগুলো কোনও কাজে লাগে না। কিন্তু এগুলো এই ভূমিতে আমাদের বসবাসের প্রমাণ দেয়।
নন্দি ১৯৬৪ সালে প্রণয়ন করা তার বাবার পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট ও ১৯৬৮ সালে স্কুলে ভর্তির নথিও এনআরসি কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করেন।
এ ধরনের গল্প আরও অনেকেরই আছে। সে কথা মাথায় রেখে আসামের অ্যাকাডেমিক প্রসেনজিত বিশ্বাস বলেন, এনআরসি যে সময় অনেক মানুষকে রাষ্ট্রহীন করে ফেলবে তখনও বহু মানুষ তাদের নথি সংরক্ষণ করে যাবে। অনেকের কাছে এটা আবেগের বিষয়। আবার অন্যদের কাছে এটা তাদের পরিচয়ের প্রশ্ন।
গোয়ালপাড়া জেলার প্রদীপ চন্দ্র দে’র কাছে রয়েছে ১৯৬৪ সালে প্রণিত হওয়া বাবার শরণার্থী সার্টিফিকেট। দুধনোই এলাকার ১১ নম্বর শরণার্থী শিবিরের কথা স্মরণ করেন তিনি। তিনি বলেন, আমার বড় বোন আর আমি ক্যাম্পে কাজ পেলাম। বিনামূল্যে রেশন পেতাম আমরা। আমার পরিবারকে দেওয়া হলো শরণার্থী সার্টিফিকেট। ২০১৫ সালে এসব সার্টিফিকেট আমরা এনআরসি’র কাছে দাখিল করেছিলাম। আমি জানি না ওই শিবিরের কতজনের নাম এই তালিকায় এসেছে।
প্রদীপ চন্দ্র দে ও তার পরিবারের আট সদস্যের নাম এনআরসি তালিকায় আসেনি। যদিও তারা ১৯৬৬ সালের ভূমি রেকর্ড ও বাবার শরণার্থী সার্টিফিকেট দাখিল করেছেন। তিনি জানান, ১৯৬৬ সালে সরকারের কাছ থেকে ২ হাজার ৬০০ রুপি ঋণ নেই আমরা। ওই অর্থ দিয়ে তামুলপুরে একটা ছোট জমি কিনি। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ৫৩ বছর পরও যদি ওই জমির রেজিস্ট্রেশন টিকে থাকে তাহলে নথি কেন অবৈধ হয়ে যাবে?
২০১৫ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার এই পরিবারটি গুয়াহাটির এনআরসি কার্যালয়ে গিয়েছেন। তিনি অনুতাপ করে বলেন, আমার বাবা বা আমি কেউই এসব নথি যত্ন নিয়ে সংরক্ষণ করিনি।
No comments