আমেরিকায় সমাজতন্ত্রের ঢেউ by শেলী জামান খান
মার্কিন
নির্বাচনের সবচেয়ে বড় চমক হলো, এই নির্বাচনে ভোট দেয় আমেরিকার নাগরিকেরা।
নির্বাচনের সুফল বা কুফল ভোগ করে সারা বিশ্ব। মার্কিন বোমার আঘাতে
ক্ষতবিক্ষত হয় মানুষ, জনপদ। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানির আগ্রাসী থাবায়
দুমড়ে যাওয়া দেশগুলোর অর্থনীতি দেখলেই এই সত্যটি হাড়ে হাড়ে বোঝা যায়। এ
কারণেই মার্কিন জনরায় কতটা বিচক্ষণ, বহির্বিশ্ব তা নিয়ে পর্যালোচনায় ব্যস্ত
থাকে। বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই আলোচনা এখন অনেক
বেশি গরম হয়ে উঠেছে ,বার্নি স্যান্ডার্সের মত স্বঘোষিত সোশ্যালিস্টের এবারও
প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা ঘোষণায়।
মুক্তবাজার অর্থনীতির সূতিকাগার বলে পরিচিত পশ্চিমা বিশ্বে সমাজতন্ত্র এখন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। ফিরতে চলেছে সমাজতন্ত্রের সুদিন, সমাজতন্ত্রের ঢেউ উঠেছে। খোদ আমেরিকায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সমাজতন্ত্রীরা। পুঁজিবাদ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। কিন্তু কেন মার্কিন মুলুকে সমাজতন্ত্রের উত্থান হচ্ছে? উত্তর হলো বৈষম্য। সমাজতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যই হলো মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করে সমতা আনা। আমেরিকানরা তাদের সমাজে এত বেশি বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে যে, বাধ্য হয়েই সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকছে তারা।
তরুণ মার্কিনিদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতি ব্যাপক হারে বেড়েছে। এই বয়সসীমার প্রায় সিংহভাগ আমেরিকান মনে করেন, সমাজতন্ত্র একটি ইতিবাচক ব্যবস্থা। তাঁরা পুঁজিবাদকে আর ‘সঠিক পন্থা’ বলে মনে করছেন না। একটি বিষয় স্পষ্ট, মার্কিন রাজনীতির ধারায় একটি পরিবর্তন আসছেই। ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার বছরেই চমক দেখিয়েছিলেন ডেমোক্র্যাটপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স। ট্রাম্প ও হিলারির তুলনায় প্রাইমারি ভোটে বেশি সংখ্যক তরুণদের আকৃষ্ট করেছিলেন তিনি। সেই ঘরানার আরেক রাজনীতিকও এখন আলোড়ন তুলেছেন। তিনি হলেন ডেমোক্র্যাট আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ।
বলা যায়, পুরো পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চেই সমাজতন্ত্র ধীরে ধীরে জায়গা দখল করতে শুরু করেছে। কিন্তু এই নতুন ধারার সমাজতন্ত্র আসলে কেমন? আমেরিকার স্যান্ডার্স-কর্টেজরা নিজেদের ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট’ বলে অভিহিত করছেন। এঁদের বলা হচ্ছে ‘মিলেনিয়াল সোস্যালিস্ট’। একবিংশ শতাব্দীর নতুন ধারার সমাজতন্ত্রী তাঁরা।
মিলেনিয়াল সোশ্যালিস্ট মনে করেন, পশ্চিমা সমাজব্যবস্থায় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বর্তমান পশ্চিমা অর্থনীতিও শুধু বৈষম্য টিকিয়ে রাখার কাজই করছে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অতি ধনীদের পক্ষে। সরকার এখন আর সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে না। এই সমাজতন্ত্রীদের মতে, সমতা বিধানের জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি অনুদান বাড়ানোর কথা। এমনকি অতি ধনীদের ওপর বেশি করারোপ করে মধ্য ও নিম্নবিত্তদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার আলোচনা চলছে। তরুণদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন পশ্চিমা সমাজতন্ত্রীরা। মিলেনিয়াল সোশ্যালিস্ট কিছু নির্দিষ্ট বিষয়কে পাদপ্রদীপের আলোয় এনে প্রচারণা শুরু করেছেন। অন্তত এটুকু বলা যায়, এসব বিষয় তরুণসমাজকে আগ্রহী করে তুলেছে।
দলীয় প্রাথমিক বাছাইয়ের শুরুর দিকে দৃষ্টি ফেরালে আমরা দেখতে পাই, মার্কিন জনগণ তখন স্পষ্টতই একটা পরিবর্তন চেয়েছিল। অস্পষ্ট মুখচোরা রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে একটি স্পষ্ট কঠোর নীতি শুনতে চেয়েছিল জনগণ। জনগণের এই চাওয়া প্রতিফলিত হয়েছিল রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দলের উচ্চকণ্ঠ দুই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বার্নি স্যান্ডার্সের উত্থানে। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে এই দুজনই চরম বিতর্কিত প্রার্থী।
আমেরিকা একটি বহুজাতিক দেশ। এখানে নানা দেশের, নানা জাতির মানুষের বাস। আমেরিকার উন্নয়নে এদের সবারই আছে মেধা-শ্রম-পুঁজি। সেখানে ট্রাম্পের মতো কট্টর ডানপন্থীর উত্থান বিস্ময়কর। আবার পুঁজিবাদের পতাকাবাহী, সমাজতন্ত্র বিদ্বেষী আমেরিকার বার্নি স্যান্ডার্সের মত স্বঘোষিত সোশ্যালিস্টের উত্থান ট্রাম্পের উত্থানের চেয়েও বিস্ময়কার। অবশ্য স্নায়ুযুদ্ধের যে কঠিন সময় এই দেশটি পার করে এসেছে, তাতে এটাই খুব স্বাভাবিক।
তাহলে এই ধারা বদলের পেছনের কাহিনি কম? কাহিনি হলো নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিবাদ আমেরিকার রাজনীতিকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলেছে। কীভাবে করল তা বুঝতে হলে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দিতে হবে।
পুঁজিবাদে ধনী আরও ধনী হয়, এটি চরম সত্য। তাই বলে গরিব কিন্তু সব সময়ই আরও গরিব হয় না। কারণ পুঁজিবাদের বাজার শুধু একটি দেশের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না। পুঁজিবাদকে টিকতে হলে বাজার বড় করতেই হবে, নইলে পুঁজিবাদ টিকবে না। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সারা বিশ্বে তাদের বাজার প্রতিষ্ঠা করেছে। সারা বিশ্ব থেকে টাকা নিয়ে আসছে নিজের দেশে। সেই টাকার ভাগ দেশের সাধারণ মানুষও পেয়েছে নানাভাবে। ফলে ধনী আরও ধনী হলেও দেশের গরিব আরও গরিব হয়নি। দেশ ঠিকভাবেই চলেছে।
কিন্তু ঝামেলা বেঁধেছে কয়েকটি ঘটনায়। সুপার পাওয়ার হিসেবে বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন বাইরের দেশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আমেরিকাকে বড় একটা ধাক্কা দিয়েছে। এদিকে সারা বিশ্বে বছরের পর বছর ধরে চীনের বাণিজ্য সম্প্রসারণ আমেরিকার বাণিজ্যকে সংকুচিত করেছে। সঙ্গে পিঠের ওপর সওয়ার হয়েছে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার নিষ্ফলা সব যুদ্ধের খরচ, দেশের ভেতরে ব্যাংকিং খাতের ভয়াবহ দুর্নীতি। জনজীবনে এসবের প্রতিক্রিয়া বিশাল। যেখানে ব্যবসায়ীরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, সে দেশে সরকারের পক্ষে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে অবস্থা সামাল দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে জনগণ লাগামহীন পুঁজিবাদের ফাঁকি ধরে ফেলল। হতাশা গ্রাস করল তাদের। শিক্ষিত যুবসমাজ খুঁজছে গঠনমূলক উত্তরণের পথ। তাই তারা আবারও বার্নি স্যান্ডার্সের পেছনে দাঁড়াবে, তাতে সন্দেহ নেই।
আর একদল দেখছে, ভিনদেশি মানুষ এসে তাদের ভাগের চাকরি, ভাগের সম্পদ ভোগ করছে। তারা ভাবছে, ভিন জাতি মানুষগুলোকে দূর করতে পারলেই ভাগ্য ফিরবে। তাই তারা এখনো ভিড়ে আছে ট্রাম্পের পেছনে। রিপাবলিকান প্রার্থীরা ঘুরেফিরে ট্রাম্পের কাছাকাছি নীতিই পোষণ করে। ফলে রিপাবলিকান সমর্থকেরা স্পষ্টভাষী ট্রাম্পকে আবারও হয়তো লুফে নেবে।
সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে ট্রাম্প-স্যান্ডার্স আসলে একই জিনিস প্রচার করেছেন। তা হলো আমেরিকার অর্থনীতিতে কীভাবে মৌলিক পরিবর্তন আনা যায়। যদিও তাদের পদ্ধতি ভিন্ন। বার্নি স্যান্ডার্স এই জায়গায় উপযুক্ত একজন নেতা হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু অভিজাত ডেমোক্র্যাটরা তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি। বরং ক্ষয়ে যাওয়া ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার প্রবল ইচ্ছা মার্কিন সমাজে যে সংকট তৈরি করেছিল, তা পুরোপুরি লুফে নিয়েছিলেন চতুর ট্রাম্প। ব্যক্তি ট্রাম্প আমাদের যতটুকু ধারণা দেন, তাতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনার মত ব্যক্তিত্ব তাঁর নেই। ব্যবসায়ী শাসিত আমেরিকায় তাঁর মতো একজন নিখাদ ব্যবসায়ী চলমান উপায়ে পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকেই নিয়ে যাবেন। নতুবা চমকপ্রদ কোনো উপায় গ্রহণ করতে গিয়ে সংকটকে নতুনভাবে ঘনীভূত করবেন। সে ক্ষেত্রে সামনে হয়তো স্যান্ডার্সের মত লোকের উঠে আসার সুযোগ আরও বাড়বে। ব্যর্থ সমাজতন্ত্র ও মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ পুঁজিবাদ মিলে বিশ্বে যে অশান্তি সৃষ্টি করেছে, তাতে দীর্ঘদিন ধরে একটা বিকল্প ব্যবস্থার জন্য সারা বিশ্ব অধীর আশায় বসে আছে। স্যান্ডার্স যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তাতে নতুন ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। ডেমোক্র্যাটদের হঠকারিতায়, সেই সম্ভাবনা ভেস্তে গেছে। এখন দেখা যাক, ভবিষ্যতের আমেরিকা বিশ্ববাসীর জন্য কম চমক নিয়ে অপেক্ষা করছে!
লেখক অ্যাশলে ডওসোন বলছেন, ‘ট্রাম্প নিজেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে আটকা পড়ে গেছেন। এ থেকে তিনি বের হতে পারবেন না। আমেরিকাও বের হতে পারবে না।’পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে এই ধনতান্ত্রিক অস্থির পুঁজিবাদী সমাজকে ভাঙতেই হবে। বিশ্বকে জাগতেই হবে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির সূতিকাগার বলে পরিচিত পশ্চিমা বিশ্বে সমাজতন্ত্র এখন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। ফিরতে চলেছে সমাজতন্ত্রের সুদিন, সমাজতন্ত্রের ঢেউ উঠেছে। খোদ আমেরিকায় মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে সমাজতন্ত্রীরা। পুঁজিবাদ কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। কিন্তু কেন মার্কিন মুলুকে সমাজতন্ত্রের উত্থান হচ্ছে? উত্তর হলো বৈষম্য। সমাজতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যই হলো মানুষে মানুষে বৈষম্য দূর করে সমতা আনা। আমেরিকানরা তাদের সমাজে এত বেশি বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছে যে, বাধ্য হয়েই সমাজতন্ত্রের দিকে ঝুঁকছে তারা।
তরুণ মার্কিনিদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের প্রতি সহানুভূতি ব্যাপক হারে বেড়েছে। এই বয়সসীমার প্রায় সিংহভাগ আমেরিকান মনে করেন, সমাজতন্ত্র একটি ইতিবাচক ব্যবস্থা। তাঁরা পুঁজিবাদকে আর ‘সঠিক পন্থা’ বলে মনে করছেন না। একটি বিষয় স্পষ্ট, মার্কিন রাজনীতির ধারায় একটি পরিবর্তন আসছেই। ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার বছরেই চমক দেখিয়েছিলেন ডেমোক্র্যাটপ্রার্থী বার্নি স্যান্ডার্স। ট্রাম্প ও হিলারির তুলনায় প্রাইমারি ভোটে বেশি সংখ্যক তরুণদের আকৃষ্ট করেছিলেন তিনি। সেই ঘরানার আরেক রাজনীতিকও এখন আলোড়ন তুলেছেন। তিনি হলেন ডেমোক্র্যাট আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্টেজ।
বলা যায়, পুরো পশ্চিমা বিশ্বের রাজনৈতিক মঞ্চেই সমাজতন্ত্র ধীরে ধীরে জায়গা দখল করতে শুরু করেছে। কিন্তু এই নতুন ধারার সমাজতন্ত্র আসলে কেমন? আমেরিকার স্যান্ডার্স-কর্টেজরা নিজেদের ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট’ বলে অভিহিত করছেন। এঁদের বলা হচ্ছে ‘মিলেনিয়াল সোস্যালিস্ট’। একবিংশ শতাব্দীর নতুন ধারার সমাজতন্ত্রী তাঁরা।
মিলেনিয়াল সোশ্যালিস্ট মনে করেন, পশ্চিমা সমাজব্যবস্থায় বৈষম্য নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। বর্তমান পশ্চিমা অর্থনীতিও শুধু বৈষম্য টিকিয়ে রাখার কাজই করছে। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অতি ধনীদের পক্ষে। সরকার এখন আর সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে না। এই সমাজতন্ত্রীদের মতে, সমতা বিধানের জন্য রাষ্ট্রকে উদ্যোগী হয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে। বলা হচ্ছে, মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন, শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন খাতে সরকারি অনুদান বাড়ানোর কথা। এমনকি অতি ধনীদের ওপর বেশি করারোপ করে মধ্য ও নিম্নবিত্তদের বাড়তি সুবিধা দেওয়ার আলোচনা চলছে। তরুণদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন পশ্চিমা সমাজতন্ত্রীরা। মিলেনিয়াল সোশ্যালিস্ট কিছু নির্দিষ্ট বিষয়কে পাদপ্রদীপের আলোয় এনে প্রচারণা শুরু করেছেন। অন্তত এটুকু বলা যায়, এসব বিষয় তরুণসমাজকে আগ্রহী করে তুলেছে।
দলীয় প্রাথমিক বাছাইয়ের শুরুর দিকে দৃষ্টি ফেরালে আমরা দেখতে পাই, মার্কিন জনগণ তখন স্পষ্টতই একটা পরিবর্তন চেয়েছিল। অস্পষ্ট মুখচোরা রাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে একটি স্পষ্ট কঠোর নীতি শুনতে চেয়েছিল জনগণ। জনগণের এই চাওয়া প্রতিফলিত হয়েছিল রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দলের উচ্চকণ্ঠ দুই প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ও বার্নি স্যান্ডার্সের উত্থানে। যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করলে এই দুজনই চরম বিতর্কিত প্রার্থী।
আমেরিকা একটি বহুজাতিক দেশ। এখানে নানা দেশের, নানা জাতির মানুষের বাস। আমেরিকার উন্নয়নে এদের সবারই আছে মেধা-শ্রম-পুঁজি। সেখানে ট্রাম্পের মতো কট্টর ডানপন্থীর উত্থান বিস্ময়কর। আবার পুঁজিবাদের পতাকাবাহী, সমাজতন্ত্র বিদ্বেষী আমেরিকার বার্নি স্যান্ডার্সের মত স্বঘোষিত সোশ্যালিস্টের উত্থান ট্রাম্পের উত্থানের চেয়েও বিস্ময়কার। অবশ্য স্নায়ুযুদ্ধের যে কঠিন সময় এই দেশটি পার করে এসেছে, তাতে এটাই খুব স্বাভাবিক।
তাহলে এই ধারা বদলের পেছনের কাহিনি কম? কাহিনি হলো নিয়ন্ত্রণহীন পুঁজিবাদ আমেরিকার রাজনীতিকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলেছে। কীভাবে করল তা বুঝতে হলে পুঁজিবাদের বৈশিষ্ট্যের দিকে নজর দিতে হবে।
পুঁজিবাদে ধনী আরও ধনী হয়, এটি চরম সত্য। তাই বলে গরিব কিন্তু সব সময়ই আরও গরিব হয় না। কারণ পুঁজিবাদের বাজার শুধু একটি দেশের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না। পুঁজিবাদকে টিকতে হলে বাজার বড় করতেই হবে, নইলে পুঁজিবাদ টিকবে না। মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সারা বিশ্বে তাদের বাজার প্রতিষ্ঠা করেছে। সারা বিশ্ব থেকে টাকা নিয়ে আসছে নিজের দেশে। সেই টাকার ভাগ দেশের সাধারণ মানুষও পেয়েছে নানাভাবে। ফলে ধনী আরও ধনী হলেও দেশের গরিব আরও গরিব হয়নি। দেশ ঠিকভাবেই চলেছে।
কিন্তু ঝামেলা বেঁধেছে কয়েকটি ঘটনায়। সুপার পাওয়ার হিসেবে বিশ্বরাজনীতিতে রাশিয়ার প্রত্যাবর্তন বাইরের দেশে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় আমেরিকাকে বড় একটা ধাক্কা দিয়েছে। এদিকে সারা বিশ্বে বছরের পর বছর ধরে চীনের বাণিজ্য সম্প্রসারণ আমেরিকার বাণিজ্যকে সংকুচিত করেছে। সঙ্গে পিঠের ওপর সওয়ার হয়েছে বিশ্বজুড়ে আমেরিকার নিষ্ফলা সব যুদ্ধের খরচ, দেশের ভেতরে ব্যাংকিং খাতের ভয়াবহ দুর্নীতি। জনজীবনে এসবের প্রতিক্রিয়া বিশাল। যেখানে ব্যবসায়ীরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, সে দেশে সরকারের পক্ষে কঠোর কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে অবস্থা সামাল দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে জনগণ লাগামহীন পুঁজিবাদের ফাঁকি ধরে ফেলল। হতাশা গ্রাস করল তাদের। শিক্ষিত যুবসমাজ খুঁজছে গঠনমূলক উত্তরণের পথ। তাই তারা আবারও বার্নি স্যান্ডার্সের পেছনে দাঁড়াবে, তাতে সন্দেহ নেই।
আর একদল দেখছে, ভিনদেশি মানুষ এসে তাদের ভাগের চাকরি, ভাগের সম্পদ ভোগ করছে। তারা ভাবছে, ভিন জাতি মানুষগুলোকে দূর করতে পারলেই ভাগ্য ফিরবে। তাই তারা এখনো ভিড়ে আছে ট্রাম্পের পেছনে। রিপাবলিকান প্রার্থীরা ঘুরেফিরে ট্রাম্পের কাছাকাছি নীতিই পোষণ করে। ফলে রিপাবলিকান সমর্থকেরা স্পষ্টভাষী ট্রাম্পকে আবারও হয়তো লুফে নেবে।
সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করলে ট্রাম্প-স্যান্ডার্স আসলে একই জিনিস প্রচার করেছেন। তা হলো আমেরিকার অর্থনীতিতে কীভাবে মৌলিক পরিবর্তন আনা যায়। যদিও তাদের পদ্ধতি ভিন্ন। বার্নি স্যান্ডার্স এই জায়গায় উপযুক্ত একজন নেতা হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু অভিজাত ডেমোক্র্যাটরা তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি। বরং ক্ষয়ে যাওয়া ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসার প্রবল ইচ্ছা মার্কিন সমাজে যে সংকট তৈরি করেছিল, তা পুরোপুরি লুফে নিয়েছিলেন চতুর ট্রাম্প। ব্যক্তি ট্রাম্প আমাদের যতটুকু ধারণা দেন, তাতে মৌলিক কোনো পরিবর্তন আনার মত ব্যক্তিত্ব তাঁর নেই। ব্যবসায়ী শাসিত আমেরিকায় তাঁর মতো একজন নিখাদ ব্যবসায়ী চলমান উপায়ে পরিস্থিতিকে আরও খারাপের দিকেই নিয়ে যাবেন। নতুবা চমকপ্রদ কোনো উপায় গ্রহণ করতে গিয়ে সংকটকে নতুনভাবে ঘনীভূত করবেন। সে ক্ষেত্রে সামনে হয়তো স্যান্ডার্সের মত লোকের উঠে আসার সুযোগ আরও বাড়বে। ব্যর্থ সমাজতন্ত্র ও মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ পুঁজিবাদ মিলে বিশ্বে যে অশান্তি সৃষ্টি করেছে, তাতে দীর্ঘদিন ধরে একটা বিকল্প ব্যবস্থার জন্য সারা বিশ্ব অধীর আশায় বসে আছে। স্যান্ডার্স যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, তাতে নতুন ব্যবস্থা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। ডেমোক্র্যাটদের হঠকারিতায়, সেই সম্ভাবনা ভেস্তে গেছে। এখন দেখা যাক, ভবিষ্যতের আমেরিকা বিশ্ববাসীর জন্য কম চমক নিয়ে অপেক্ষা করছে!
লেখক অ্যাশলে ডওসোন বলছেন, ‘ট্রাম্প নিজেও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে আটকা পড়ে গেছেন। এ থেকে তিনি বের হতে পারবেন না। আমেরিকাও বের হতে পারবে না।’পৃথিবীকে বাঁচাতে হলে এই ধনতান্ত্রিক অস্থির পুঁজিবাদী সমাজকে ভাঙতেই হবে। বিশ্বকে জাগতেই হবে।
No comments