বরগুনা হত্যাকাণ্ড: বন্ড০০৭ এর মতো কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে কিভাবে by রাকিব হাসনাত
ঢাকার মোহাম্মদপুরে বাস করেন ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ড-কালীন শিক্ষক তাহমিনা আক্তার পলি। নিজের কিশোর
সন্তান বন্ধুত্ব করতে গিয়ে ভুল করে কি-না কিংবা অপরাধীদের চক্রের সাথে
জয়ে পড়ে কি-না এ নিয়ে রীতিমত উৎকণ্ঠায় থাকেন তিনি।
বিবিসি
বাংলাকে তিনি বলেন, "আমার ছেলের বয়স ১৪ বছর। আমি সবসময় চিন্তিত, ভীত ও
আশঙ্কায় যে ছেলেটা কোথায় কার সাথে মিশছে। এখন তো দুনিয়া হাতের মুঠোয়।
নেট..হোয়াটসঅ্যাপ ওরা ব্যবহার করে। এগুলো আমাকে ভাবায় যে আমার ছেলেটাকে
আমি কোথায় দেখতে চাই আর ও কোথায় যাচ্ছে।"
ঢাকার আরেকজন কর্মজীবী
অভিভাবক নুসরাত জাহান শাওন বলছেন, সন্তানের সব সঙ্গী ও মনোজগৎ সম্পর্কে
বোঝাটা খুব সহজ নয়, যে কারণে উদ্বেগও বেশি থাকে।
"প্রথমত আমি বুঝতে
পারিনা যে স্কুলে কাদের সাথে মিশছে। আরেকটা বিষয় হলো সে কিভাবে চিন্তা
করছে সেটা পুরোপুরি বোঝা যায় না। ইন্টারনেট সে কিভাবে ব্যবহার করছে,
বিবেচনাবোধ প্রয়োগ করে করছে কি-না সেটা বোঝার মতো কোনো কন্ট্রোল আমার কাছে
নেই। এটাই বড় উদ্বেগের।"
যে কিশোর গ্যাং নিয়ে মায়েদের এতো
উদ্বেগ তার খবর ঢাকায় প্রকাশ পেতে শুরু করেছিলো বছর দুয়েক আগে দুটি দলের
মধ্যে বিরোধে আদনান কবীর নামে এক কিশোরের মৃত্যুর পর।
সেসময়
আলোচনায় এসেছিলো উত্তরা ডিসকো বয়েজ ও বিগ বস কিশোর গ্যাং নামের দুটো
গ্রুপ। এরপর গত দু'বছরে ঢাকা ও চট্টগ্রামে বারবার নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছে
বেশ কয়েকটি কিশোর গ্যাং।
এবার বরগুনায় রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার পর আলোচনায় এসেছে বন্ড০০৭ নামের একটি গ্রুপ।
বরগুনায় রিফাত শরীফ নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যার পর আলোচনায় এসেছে বন্ড০০৭ নামের একটি গ্রুপ। |
বরগুনার
পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন বিবিসিকে জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় রোববার আরো
একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সে ফেসবুকভিত্তিক বন্ড০০৭ গ্রুপের সদস্য।
এ নিয়ে রিফাত হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত দুজনসহ মোট চারজনকে আটক করা হলো।
কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ কয়েকটি বড় শহরে বিভিন্ন কিশোর গ্যাং
নানা ঘটনায় আলোচনায় আসলেও মফস্বল শহরে এ ধরনের সংঘবদ্ধ কিশোর দলের
অপরাধমূলক তৎপরতার খবর বরগুনার আগে খুব একটা আসেনি।
চট্টগ্রামের
সেগুফতা পারভীন বলছেন, এমনিতেই এই বয়সী সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়েরা
সবসময় চিন্তিত থাকেন। তার মধ্যে সমাজে নতুন উপসর্গ হিসেবে এসেছে কিশোর
গ্যাং কালচার যা অভিভাবকদের আরও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে।
"আমার এক ছেলে
ক্লাস সিক্সে আর এক ছেলে এ লেভেল শেষ করেছে। ইংরেজি মিডিয়ামে পড়েছে ওরা।
আমি দেখেছি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের অনেকে গ্যাং বা গ্রুপে জড়িয়ে
পড়েছে। ক্রাইম করে ফেলছে। আমার ছেলেকে সবসময় তাই গাইডের মধ্যে রেখেছি।
বন্ধুর মতো সবসময় তার সাথে ছিলাম। ইন্টারমিডিয়েটে ওঠার পর তাকে মোবাইল ও
ইন্টারনেট দিয়েছি।"
নোয়াখালীর নাসিমা আক্তার বেবী বলছেন,
বিষয়টি তিনিও জানেন,তবে তার মতে জেলা শহরগুলোতে এখনো সামাজিক বন্ধন দৃঢ়
থাকা ও পরিচিতির গণ্ডি বেশি থাকায় সমস্যাটা ততটা প্রকট হয়নি।
"ইন্টারনেটের
অপব্যবহারের কারণে এগুলো বেশি ঘটছে। অনেক চিন্তিত থাকি আমরা। আমি এবং ওর
বাবা চেষ্টা করি তার দিকে খেয়াল রাখতে। কিন্তু সমস্যা হলো সে তো কলেজে
পড়ে। সেখানে সে কী করে বা ইন্টারনেটে কাদের সাথে তার যোগাযোগ বেশি হয়
সেটা তো মনিটর করা সম্ভব নয়। তাই টেনশন লাগে।"
ঢাকায় পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা নাজমুল ইসলামও
বলছেন ইন্টারনেটের কারণে কিশোর গ্যাংয়ের ধারণা শহর থেকে মফস্বল শহরগুলোতে
প্রকাশ পাচ্ছে। তবে এসবের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে পুলিশও দিনে দিনে
সক্ষম হয়ে উঠছে বলে মনে করেন তিনি।
"ঢাকার মধ্যে যেসব গ্রুপ কাজ
করছিলো তাদের নিষ্ক্রিয় করেছি। গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, মনিটর করা হচ্ছে।
কিন্তু মফস্বলে পুলিশের সাইবার দক্ষতা ঢাকার পুলিশের তুলনায় কম। বিষয়টি
নিয়ে স্বয়ং আইজিপি নির্দেশনা দিচ্ছেন সাইবার কর্মকর্তা তৈরি করার। আমরা
প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, বিভিন্ন ডিভাইস এনে কাজ করছি।"
পুলিশের ক্রাইম
এনালাইসিস বিভাগের কর্মকর্তাদের দাবি ঢাকাতেই গত কয়েক বছরে কিশোর গ্যাং
গ্রুপের সন্ধান মিলেছে অন্তত ৫০টি। এখন নতুন করে মফস্বল জেলা শহরের
কিশোররাও জড়িয়ে পড়ছে এ ধরনের অপরাধী চক্রের সাথে।
পুলিশের
কর্মকর্তা মি. ইসলাম বলেন, "অনেক গ্রুপ নিজেদের মধ্যে মাদক নিয়ে কথা বলে।
আবার অনেকে আর্মস নিয়ে। অনেকে সেলেব্রিটিদের ডিস্টার্ব করা নিয়ে কথা বলে,
তাদের ব্ল্যাকমেইল করে, তাদের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করার পরিকল্পনা করে।"
নুসরাত
জাহান শাওন, পেশাগত জীবনেও যিনি শিশু কিশোরদের নিয়ে কাজ করছেন, তার মতে
অভিভাবকদের উচিত সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া এবং তাদের প্রতিটি বিষয়
অনুধাবনের চেষ্টা করা, যাতে সন্তান খারাপ সংসর্গে যাওয়ার সুযোগ না পায়।
আবার
পাড়া মহল্লায় কিশোরদের মধ্যে কখনো কোনো বিষয়ে বিরোধ হলে তা যেন খুব
বেশি দূর না গড়ায় সেদিকে অভিভাবক ও এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের খেয়াল রাখা
উচিত বলেও মনে করেন তিনি।
অনেকেই সোশাল মিডিয়ার কারণে সন্তানদের বিষয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। |
No comments