জয়ার ম্যাজিক by মোশাররফ রুমী
আমাদের
প্রচ্ছদকন্যা দুর্দান্ত ম্যাজিক জানেন। আর সে ম্যাজিক বড় মায়াবী। যেন
রূপকথার রাজকন্যার হাতে থাকা আশ্চর্য প্রদীপ। যার আলোয় এখন দারুণভাবে
আলোকিত দুই বাংলার চলচ্চিত্র। ঢালিউড এবং টলিউড দুই ইন্ডাস্ট্রিতেই এ সময়ে
চলছে তার জয় জয়কার। তিনি জয়া আহসান। একের পর এক ছবিতে সফল অভিনয়
সুবাদে দেশীয় চলচ্চিত্রে যেমন তৈরি করেছেন শক্ত অবস্থান, তেমনই টলিউডেও।
সেখানেও গেল কয়েক বছর ধরে ব্যাপক জনপ্রিয় মুখ তিনি। সে সঙ্গে নির্মাতাদের
কাছে এক আস্থার নাম।
শুটিংয়ের কারণে ঢাকা ও কলকাতা দুই জায়গাতেই এখন থাকতে হয় জয়াকে। আর গত কয়েক বছরের সমীকরণে দেখা যায়, এ অভিনেত্রীর ছবি মানেই যেন নতুন কিছু। নতুন নতুন রূপেই দর্শকের সামনে আসছেন তিনি। আর মুঠোবন্দি করছেন আকাশছোঁয়া সফলতা। দেশের ছবির পাশাপাশি ২০১৩ সালে টলিউডে জয়ার যাত্রা শুরু হয়। প্রথম থেকেই নিজের কাজের জাদুতে দর্শক ও নির্মাতাদের নজর কেড়েছেন এ অভিনেত্রী। অরিন্দম শীল পরিচালিত ‘আবর্ত’ ছবির মাধ্যমে কলকাতায় তার অভিনয়ে সূচনা ঘটে। এরপরে ‘একটি বাঙালি ভূতের গপ্পো’, ‘ঈগলের চোখ’, ‘রাজ কাহিনী’, ‘ভালোবাসার শহর’, ‘বিসর্জন’, ‘ক্রিসক্রস’, ‘বিজয়া’ ও ‘কন্ঠ’ নামের ছবিগুলোতে অনবদ্য অভিনয় করে ওপার বাংলার দর্শকদের মন জয় করেন। বলতে গেলে অল্প সময়ে বেশ মর্যাদার আসন পান তিনি। ওপার বাংলায় জয়ার স্বীকৃতির শুরুটা হয়েছিল ২০১৭ সালে টিভি চ্যানেল এবিপি আনন্দ প্রবর্তিত ‘সেরা বাঙালি পুরস্কার’ দিয়ে। সে বছর জুলাই মাসে তিনি এটা অর্জন করেন। আর বছর শেষে অর্থাৎ ডিসেম্বরে তার হাতে আসে ‘জি সিনে অ্যাওয়ার্ডস’। এখানেই শেষ নয়। জয়ার ঝুলিতে ভারতীয় ছবিতে অভিনয় করে পাওয়া পুরস্কার হিসেবে আরো রয়েছে হায়দরাবাদ চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, ‘ইন্টারন্যাশনাল বাঙালি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড’-এ শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্যালাইডস্কোপ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। এছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকা টলিউড নায়িকাদের নিয়ে গত বছর যে শীর্ষ তালিকা তৈরি করেছে, সেখানে জয়া আহসান সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। এ যেমন তার ব্যক্তিগত অর্জন, তেমনই আমাদের দেশের জন্যও দারুণ গর্বের। এসব বিষয়ে জয়া বলেন, যখন দেখি আমার স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম, তখন মনে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। আমি আসলে কাজ করে চলেছি, স্বীকৃতির কথা ভাবিনি। শুধু ভাগ্য নয়, ভাগ্য আর কর্ম দুটোতেই বিশ্বাসী আমি। কারণ আমার মতে কাজই ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। জয়া আহসানের ‘বিসর্জন’ ছবিটি ভারতের জাতীয় পুরস্কার পায়। কৌশিক গাঙ্গুলির ছবি এটি। যার প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান ও আবির চ্যাটার্জি। মুক্তির পর থেকে বেশ প্রশংসায় ভেসেছে ছবিটি। সে সূত্রে সমালোচকদেরও মন কেড়েছেন জয়া। ছবিটিতে অসাধারণ অভিনয় করে কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছেন এ অভিনেত্রী। আর বাংলাদেশে তিনি তিনটি ছবিতে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এগুলো হচ্ছে- নাসির উদ্দিন ইউসুফের ‘গেরিলা’, রেদোয়ান রনির ‘চোরাবালি’ ও অনিমেষ আইচের ‘জিরো ডিগ্রি’। এখন বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতীয় চলচ্চিত্রের অপরিহার্য অভিনেত্রী হয়ে উঠছেন জয়া আহসান। কিছদিন আগে দেখা গেছে, সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারে বসে ছবির টিকিট বিক্রি করছেন জয়া। কখনো বা ম্যাজিশিয়ান হয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছেন। কখনো আবার ছুটে গেছেন ফুটবল মাঠে। এ সবই তিনি করেছেন নিজের ছবির প্রচারণা কিংবা সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে। নায়িকা জয়া আহসান প্রযোজনায়ও নাম লিখিয়েছেন। সরকারি অনুদানের ছবি ‘দেবী’ প্রযোজনা করে বেশ সফল তিনি। প্রযোজনায় সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে জয়া বলেন, ফর্মুলা মাফিক ছবি না করে যে ভাবনায় বিশ্বাসী সেই ভিন্ন ভিন্ন ধারার ছবি করার বিশ্বাস থেকেই আমার প্রযোজনায় আসা। ‘মিসির আলি’ যেমন বাংলাদেশের এক বিশেষ চরিত্র। তাকে ‘দেবী’ ছবিতে ধরতে চেয়েছি। ছবিটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অনেকদিন মাল্টিপ্লেক্সে হাউজফুল চলেছে। এমনকি গ্রামের হলগুলোতেও ছবিটি দারুণ ব্যবসা করেছে। এটা আমি ভাবিনি। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুক্তি পেয়েও ভালো চলেছে ছবিটি। জয়া বলেন, কোনো বাংলা ছবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এত শো পায়নি ‘দেবী’ যা পেয়েছে। কানাডায় ৫২টি আর অস্ট্রেলিয়ায় ২২টি শো হয়েছে। জয়া আহসান দুই বাংলার একজন সফল নায়িকা। সে হিসেবে তাকে নিয়ে এ যাবৎ গুঞ্জন তৈরি হয়েছে বহুবার। বিশেষ করে টলিউডের পরিচালক সৃজিত মুখার্জীর সঙ্গে তার প্রেমের গুঞ্জন তো বেশ জোরালো। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়া বলেন, এ প্রসঙ্গ ওঠা মানেই অযথা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া। তবে নায়িকাদের জীবনে রটনা, খ্যাতির সঙ্গে কুৎসাও আসে। তাই বলে কি জয়া আহসান প্রেমে পড়েন না? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই পড়ি। তবে খেয়াল করে দেখবেন আমি একটু সাবধানে থাকি। ছবির জন্য সাক্ষাৎকার বা কাজ করলাম, কথা বললাম। মুখ দেখাতে আজও লজ্জা পাই। সারাক্ষণ পাবলিকের সামনে থাকতে চাই না। জয়ার সাবেক স্বামী মডেল ও অভিনেতা ফয়সাল আহসান। বিয়ের পর সুখেই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু হঠাৎ অজানা কিছু বিষয় নিয়ে মনোমালিন্যের ঝড় বইতে শুরু করে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ২০১১ সালে ডিভোর্স হয়ে যায় দুজনের। এরপর থেকেই দীর্ঘ আট বছর ধরে একাই পথ চলছেন নায়িকা। দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশ ও কলকাতার চলচ্চিত্র জগত। অভিনয় দিয়ে দুই বাংলায়ই অর্জন করেছেন সমান জনপ্রিয়তা। দুই ইন্ডাস্ট্রি থেকেই তার হাতে উঠেছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। কিন্তু হাতে উঠছে না শুধু মেহেদির রঙ। ভাবছেন না নতুন কোনো জীবনসঙ্গীর কথা। বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়া বলেন, বিয়ে তো হতেই হবে। দেখি কী হয়। সময়ই বলবে। তবে যত দিন আরাম করে থাকা যায়। আঙুলে বাঁ হাতে ওই হাতকড়াটা এখনই পরতে চাই না। আসলে আপাতত বিয়ের কোনো চিন্তা ভাবনা মাথায় নেই। কারণ কাজ নিয়ে আমি এতটাই ব্যস্ত যে, সংসারের মায়াজালে এখনই আবদ্ধ হতে চাই না। তাহলে কি কখনো বিয়ে করবেন না? এমন প্রশ্নের উত্তরে জয়ার ভাষ্য, পরিবার থেকে বিয়ের জন্য মাঝে মাঝেই চাপ দেয়। বিয়ে করব। যখন করব সবাইকে জানাবো। কেমন জীবনসঙ্গী পছন্দ জয়ার? নায়িকা বলেন, অবশ্যই বিচক্ষণ, অনুভূতিশীল, সৃজনশীল ও প্রতিশ্রুতিবান হতে হবে। জয়া আহসানের বাবা মুক্তিযোদ্ধা এ এস মাসউদ এবং মা রেহানা মাসউদ ছিলেন একজন শিক্ষিকা। তারা দুই বোন এক ভাই। অভিনয় শুরুর আগে জয়া নাচ ও গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি ছবি আঁকা শিখেছিলেন। তিনি একটি সংগীত স্কুলও পরিচালনা করেন। জয়া আহসান চলচ্চিত্রে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে দীর্ঘদিন টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় শুরুর আগে নাচ এবং গানের প্রতি আকৃৃষ্ট ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রসংগীতের উপর ডিপ্লোমা এবং আধুনিক গানের উপর প্রশিক্ষণও নেয়া আছে তার। প্রসঙ্গত, গত ১০ই মে ভারতে মুক্তি পাওয়া জয়া অভিনীত ‘কন্ঠ’ ছবিটি নিয়ে গেল কিছুদিন ধরে বয়ে গেছে ব্যাপক আলোচনার ঝড়। ছবিটি দেখার জন্য হলে হলে ছিল দর্শকের উপচেপড়া ভিড়। সে সঙ্গে ছবিটি ঘিরে ব্যাপক প্রশংসায় মেতেছিলেন দর্শকরা। বিশেষ করে এতে ‘স্পিচ থেরাপিস্ট’ চরিত্রে জয়ার অভিনয় দারণভাবে প্রশংশিত হয়েছে। এছাড়া বলিউডের খ্যাতিমান অভিনেতা ঋষি কাপুর ও ভারতের বিখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন দেবী শেঠি ছবিটি দেখে খুব প্রশংসা করেছেন। বর্তমানে দেশে জয়ার অভিনয়ে মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে তিনটি ছবি। এগুলো হচ্ছে-
‘বিউটি সার্কাস’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ ও ‘পেয়ারার সুবাস’। ছবি তিনটির মধ্যে প্রচার-প্রচারণা সুবাদে দর্শকমহলে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে ‘বিউটি সার্কাস’। এর কারণ হচ্ছে এতে জয়ার চরিত্র। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা এ অভিনেত্রীর। তবে এবারই প্রথম ‘বিউটি সার্কাস’ ছবিটিতে সার্কাস কর্মীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সার্কাসকে কেন্দ্র করে গণমানুষের পক্ষে এক নারীর সংগ্রামের লড়াই নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি। দীর্ঘদিন ধরেই ছবিটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন জয়াভক্তরা। ২০১৬ সালে সরকারি অনুদানে শুরুর পর বিভিন্ন কারণে মাঝপথে বন্ধ ছিল এর শুটিং। তবে ভক্তদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত ছবিটি শিগগিরই মুক্তি পেতে যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে ছবির টিজার। টিজারটি ছবির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ ছাড়াও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ফেসবুক পেজে প্রকাশ হয়েছে। এক মিনিট ১৫ সেকেন্ডের টিজারে জয়াকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেখা যায় সার্কাসের প্যাডেলে। টিজারের লিংক অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে শেয়ার করে জয়া আহসান লিখেছেন, শিগগির সিনেমা হলে মুক্তি পেতে যাচ্ছে ‘বিউটি সার্কাস’। উল্লেখ্য, ছবিটির শুটিং হয়েছে নওগাঁ ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন লোকেশনে। ছবিতে জয়া আহসান ছাড়াও অভিনয় করেছেন ফেরদৌস, তৌকীর আহমেদ প্রমুখ। এদিকে জয়া আহসান ভারতে এবার হিন্দি-বাংলা দ্বিভাষিক সিরিজে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতে চলেছেন। তিনি এই প্রথম অভিনয় করবেন একজন সিরিয়াল কিলারের ভূমিকায়। এক ধাপ্পাবাজ আর তার সঙ্গিনী নিয়ে এই সিরিজের গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে। ছবিটি তৈরি করছেন অরিন্দম শীল। উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে বাস্তব চরিত্র নির্ভর এই সিরিজের চিত্রনাট্য তৈরির কাজে গবেষণার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলারের কাহিনী এটি। জয়াকে ভিলেন চরিত্রে নেয়া প্রসঙ্গে অরিন্দম বলেছেন, আমার প্রথম ছবি ‘আবর্ত’র মধ্য দিয়ে প্রথম কলকাতার বাংলা ছবিতে জয়া কাজ করেছিলেন। আমার নতুন প্রজেক্ট ‘ত্রৈলোক্য’-তে একজন শক্তিশালী অভিনেত্রীর দরকার ছিল। চরিত্রটির মধ্যে চার পাঁচটি স্তর রয়েছে। তাই জয়া ছাড়া আর কারো কথা আমার মাথায় আসেনি। সিরিজে ত্রৈলোক্য চরিত্রে জয়া অভিনয় করলেও তার প্রেমিক হিসেবে ভাবা হচ্ছে বলিউডের কাউকে। আর ডিটেকটিভের চরিত্রে অভিনয় করছেন টোটা রায় চৌধুরী। পরিচালক অরিন্দম আরও জানিয়েছেন, এটা আমার প্রথম হিন্দি কাজ। দুই সিজন ধরে চলবে এই সিরিজ। পূজার আগেই শুটিং শুরু হওয়ার কথা। এ বছরের শেষ দিকে দেখা যাবে সিরিজটি।
শুটিংয়ের কারণে ঢাকা ও কলকাতা দুই জায়গাতেই এখন থাকতে হয় জয়াকে। আর গত কয়েক বছরের সমীকরণে দেখা যায়, এ অভিনেত্রীর ছবি মানেই যেন নতুন কিছু। নতুন নতুন রূপেই দর্শকের সামনে আসছেন তিনি। আর মুঠোবন্দি করছেন আকাশছোঁয়া সফলতা। দেশের ছবির পাশাপাশি ২০১৩ সালে টলিউডে জয়ার যাত্রা শুরু হয়। প্রথম থেকেই নিজের কাজের জাদুতে দর্শক ও নির্মাতাদের নজর কেড়েছেন এ অভিনেত্রী। অরিন্দম শীল পরিচালিত ‘আবর্ত’ ছবির মাধ্যমে কলকাতায় তার অভিনয়ে সূচনা ঘটে। এরপরে ‘একটি বাঙালি ভূতের গপ্পো’, ‘ঈগলের চোখ’, ‘রাজ কাহিনী’, ‘ভালোবাসার শহর’, ‘বিসর্জন’, ‘ক্রিসক্রস’, ‘বিজয়া’ ও ‘কন্ঠ’ নামের ছবিগুলোতে অনবদ্য অভিনয় করে ওপার বাংলার দর্শকদের মন জয় করেন। বলতে গেলে অল্প সময়ে বেশ মর্যাদার আসন পান তিনি। ওপার বাংলায় জয়ার স্বীকৃতির শুরুটা হয়েছিল ২০১৭ সালে টিভি চ্যানেল এবিপি আনন্দ প্রবর্তিত ‘সেরা বাঙালি পুরস্কার’ দিয়ে। সে বছর জুলাই মাসে তিনি এটা অর্জন করেন। আর বছর শেষে অর্থাৎ ডিসেম্বরে তার হাতে আসে ‘জি সিনে অ্যাওয়ার্ডস’। এখানেই শেষ নয়। জয়ার ঝুলিতে ভারতীয় ছবিতে অভিনয় করে পাওয়া পুরস্কার হিসেবে আরো রয়েছে হায়দরাবাদ চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, ‘ইন্টারন্যাশনাল বাঙালি ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড’-এ শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী এবং যুক্তরাষ্ট্রের ‘ক্যালাইডস্কোপ ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার। এছাড়া আনন্দবাজার পত্রিকা টলিউড নায়িকাদের নিয়ে গত বছর যে শীর্ষ তালিকা তৈরি করেছে, সেখানে জয়া আহসান সবার চেয়ে এগিয়ে ছিলেন। এ যেমন তার ব্যক্তিগত অর্জন, তেমনই আমাদের দেশের জন্যও দারুণ গর্বের। এসব বিষয়ে জয়া বলেন, যখন দেখি আমার স্বীকৃতির সঙ্গে সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম, তখন মনে এক অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করে। আমি আসলে কাজ করে চলেছি, স্বীকৃতির কথা ভাবিনি। শুধু ভাগ্য নয়, ভাগ্য আর কর্ম দুটোতেই বিশ্বাসী আমি। কারণ আমার মতে কাজই ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করে। জয়া আহসানের ‘বিসর্জন’ ছবিটি ভারতের জাতীয় পুরস্কার পায়। কৌশিক গাঙ্গুলির ছবি এটি। যার প্রধান দুটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়া আহসান ও আবির চ্যাটার্জি। মুক্তির পর থেকে বেশ প্রশংসায় ভেসেছে ছবিটি। সে সূত্রে সমালোচকদেরও মন কেড়েছেন জয়া। ছবিটিতে অসাধারণ অভিনয় করে কয়েকটি পুরস্কারও পেয়েছেন এ অভিনেত্রী। আর বাংলাদেশে তিনি তিনটি ছবিতে পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এগুলো হচ্ছে- নাসির উদ্দিন ইউসুফের ‘গেরিলা’, রেদোয়ান রনির ‘চোরাবালি’ ও অনিমেষ আইচের ‘জিরো ডিগ্রি’। এখন বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতীয় চলচ্চিত্রের অপরিহার্য অভিনেত্রী হয়ে উঠছেন জয়া আহসান। কিছদিন আগে দেখা গেছে, সিনেমা হলের টিকিট কাউন্টারে বসে ছবির টিকিট বিক্রি করছেন জয়া। কখনো বা ম্যাজিশিয়ান হয়ে ম্যাজিক দেখিয়েছেন। কখনো আবার ছুটে গেছেন ফুটবল মাঠে। এ সবই তিনি করেছেন নিজের ছবির প্রচারণা কিংবা সামাজিক দায়িত্ববোধ থেকে। নায়িকা জয়া আহসান প্রযোজনায়ও নাম লিখিয়েছেন। সরকারি অনুদানের ছবি ‘দেবী’ প্রযোজনা করে বেশ সফল তিনি। প্রযোজনায় সম্পৃক্ত হওয়া প্রসঙ্গে জয়া বলেন, ফর্মুলা মাফিক ছবি না করে যে ভাবনায় বিশ্বাসী সেই ভিন্ন ভিন্ন ধারার ছবি করার বিশ্বাস থেকেই আমার প্রযোজনায় আসা। ‘মিসির আলি’ যেমন বাংলাদেশের এক বিশেষ চরিত্র। তাকে ‘দেবী’ ছবিতে ধরতে চেয়েছি। ছবিটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। অনেকদিন মাল্টিপ্লেক্সে হাউজফুল চলেছে। এমনকি গ্রামের হলগুলোতেও ছবিটি দারুণ ব্যবসা করেছে। এটা আমি ভাবিনি। এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে মুক্তি পেয়েও ভালো চলেছে ছবিটি। জয়া বলেন, কোনো বাংলা ছবি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এত শো পায়নি ‘দেবী’ যা পেয়েছে। কানাডায় ৫২টি আর অস্ট্রেলিয়ায় ২২টি শো হয়েছে। জয়া আহসান দুই বাংলার একজন সফল নায়িকা। সে হিসেবে তাকে নিয়ে এ যাবৎ গুঞ্জন তৈরি হয়েছে বহুবার। বিশেষ করে টলিউডের পরিচালক সৃজিত মুখার্জীর সঙ্গে তার প্রেমের গুঞ্জন তো বেশ জোরালো। এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়া বলেন, এ প্রসঙ্গ ওঠা মানেই অযথা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া। তবে নায়িকাদের জীবনে রটনা, খ্যাতির সঙ্গে কুৎসাও আসে। তাই বলে কি জয়া আহসান প্রেমে পড়েন না? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, অবশ্যই পড়ি। তবে খেয়াল করে দেখবেন আমি একটু সাবধানে থাকি। ছবির জন্য সাক্ষাৎকার বা কাজ করলাম, কথা বললাম। মুখ দেখাতে আজও লজ্জা পাই। সারাক্ষণ পাবলিকের সামনে থাকতে চাই না। জয়ার সাবেক স্বামী মডেল ও অভিনেতা ফয়সাল আহসান। বিয়ের পর সুখেই চলছিল তাদের সংসার। কিন্তু হঠাৎ অজানা কিছু বিষয় নিয়ে মনোমালিন্যের ঝড় বইতে শুরু করে। ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ২০১১ সালে ডিভোর্স হয়ে যায় দুজনের। এরপর থেকেই দীর্ঘ আট বছর ধরে একাই পথ চলছেন নায়িকা। দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশ ও কলকাতার চলচ্চিত্র জগত। অভিনয় দিয়ে দুই বাংলায়ই অর্জন করেছেন সমান জনপ্রিয়তা। দুই ইন্ডাস্ট্রি থেকেই তার হাতে উঠেছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। কিন্তু হাতে উঠছে না শুধু মেহেদির রঙ। ভাবছেন না নতুন কোনো জীবনসঙ্গীর কথা। বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়া বলেন, বিয়ে তো হতেই হবে। দেখি কী হয়। সময়ই বলবে। তবে যত দিন আরাম করে থাকা যায়। আঙুলে বাঁ হাতে ওই হাতকড়াটা এখনই পরতে চাই না। আসলে আপাতত বিয়ের কোনো চিন্তা ভাবনা মাথায় নেই। কারণ কাজ নিয়ে আমি এতটাই ব্যস্ত যে, সংসারের মায়াজালে এখনই আবদ্ধ হতে চাই না। তাহলে কি কখনো বিয়ে করবেন না? এমন প্রশ্নের উত্তরে জয়ার ভাষ্য, পরিবার থেকে বিয়ের জন্য মাঝে মাঝেই চাপ দেয়। বিয়ে করব। যখন করব সবাইকে জানাবো। কেমন জীবনসঙ্গী পছন্দ জয়ার? নায়িকা বলেন, অবশ্যই বিচক্ষণ, অনুভূতিশীল, সৃজনশীল ও প্রতিশ্রুতিবান হতে হবে। জয়া আহসানের বাবা মুক্তিযোদ্ধা এ এস মাসউদ এবং মা রেহানা মাসউদ ছিলেন একজন শিক্ষিকা। তারা দুই বোন এক ভাই। অভিনয় শুরুর আগে জয়া নাচ ও গানের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি ছবি আঁকা শিখেছিলেন। তিনি একটি সংগীত স্কুলও পরিচালনা করেন। জয়া আহসান চলচ্চিত্রে সম্পৃক্ত হওয়ার আগে দীর্ঘদিন টিভি নাটকে অভিনয় করেছেন। অভিনয় শুরুর আগে নাচ এবং গানের প্রতি আকৃৃষ্ট ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রসংগীতের উপর ডিপ্লোমা এবং আধুনিক গানের উপর প্রশিক্ষণও নেয়া আছে তার। প্রসঙ্গত, গত ১০ই মে ভারতে মুক্তি পাওয়া জয়া অভিনীত ‘কন্ঠ’ ছবিটি নিয়ে গেল কিছুদিন ধরে বয়ে গেছে ব্যাপক আলোচনার ঝড়। ছবিটি দেখার জন্য হলে হলে ছিল দর্শকের উপচেপড়া ভিড়। সে সঙ্গে ছবিটি ঘিরে ব্যাপক প্রশংসায় মেতেছিলেন দর্শকরা। বিশেষ করে এতে ‘স্পিচ থেরাপিস্ট’ চরিত্রে জয়ার অভিনয় দারণভাবে প্রশংশিত হয়েছে। এছাড়া বলিউডের খ্যাতিমান অভিনেতা ঋষি কাপুর ও ভারতের বিখ্যাত কার্ডিয়াক সার্জন দেবী শেঠি ছবিটি দেখে খুব প্রশংসা করেছেন। বর্তমানে দেশে জয়ার অভিনয়ে মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে তিনটি ছবি। এগুলো হচ্ছে-
‘বিউটি সার্কাস’, ‘লাল মোরগের ঝুঁটি’ ও ‘পেয়ারার সুবাস’। ছবি তিনটির মধ্যে প্রচার-প্রচারণা সুবাদে দর্শকমহলে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি করেছে ‘বিউটি সার্কাস’। এর কারণ হচ্ছে এতে জয়ার চরিত্র। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা এ অভিনেত্রীর। তবে এবারই প্রথম ‘বিউটি সার্কাস’ ছবিটিতে সার্কাস কর্মীর চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। সার্কাসকে কেন্দ্র করে গণমানুষের পক্ষে এক নারীর সংগ্রামের লড়াই নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি। দীর্ঘদিন ধরেই ছবিটি দেখার অপেক্ষায় রয়েছেন জয়াভক্তরা। ২০১৬ সালে সরকারি অনুদানে শুরুর পর বিভিন্ন কারণে মাঝপথে বন্ধ ছিল এর শুটিং। তবে ভক্তদের প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত ছবিটি শিগগিরই মুক্তি পেতে যাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে ছবির টিজার। টিজারটি ছবির অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ ছাড়াও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ফেসবুক পেজে প্রকাশ হয়েছে। এক মিনিট ১৫ সেকেন্ডের টিজারে জয়াকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দেখা যায় সার্কাসের প্যাডেলে। টিজারের লিংক অফিশিয়াল ফেসবুক পেজে শেয়ার করে জয়া আহসান লিখেছেন, শিগগির সিনেমা হলে মুক্তি পেতে যাচ্ছে ‘বিউটি সার্কাস’। উল্লেখ্য, ছবিটির শুটিং হয়েছে নওগাঁ ও মানিকগঞ্জের বিভিন্ন লোকেশনে। ছবিতে জয়া আহসান ছাড়াও অভিনয় করেছেন ফেরদৌস, তৌকীর আহমেদ প্রমুখ। এদিকে জয়া আহসান ভারতে এবার হিন্দি-বাংলা দ্বিভাষিক সিরিজে ভিলেনের চরিত্রে অভিনয় করতে চলেছেন। তিনি এই প্রথম অভিনয় করবেন একজন সিরিয়াল কিলারের ভূমিকায়। এক ধাপ্পাবাজ আর তার সঙ্গিনী নিয়ে এই সিরিজের গল্পটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হচ্ছে। ছবিটি তৈরি করছেন অরিন্দম শীল। উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে বাস্তব চরিত্র নির্ভর এই সিরিজের চিত্রনাট্য তৈরির কাজে গবেষণার উপর জোর দেওয়া হয়েছে। ভারতের প্রথম মহিলা সিরিয়াল কিলারের কাহিনী এটি। জয়াকে ভিলেন চরিত্রে নেয়া প্রসঙ্গে অরিন্দম বলেছেন, আমার প্রথম ছবি ‘আবর্ত’র মধ্য দিয়ে প্রথম কলকাতার বাংলা ছবিতে জয়া কাজ করেছিলেন। আমার নতুন প্রজেক্ট ‘ত্রৈলোক্য’-তে একজন শক্তিশালী অভিনেত্রীর দরকার ছিল। চরিত্রটির মধ্যে চার পাঁচটি স্তর রয়েছে। তাই জয়া ছাড়া আর কারো কথা আমার মাথায় আসেনি। সিরিজে ত্রৈলোক্য চরিত্রে জয়া অভিনয় করলেও তার প্রেমিক হিসেবে ভাবা হচ্ছে বলিউডের কাউকে। আর ডিটেকটিভের চরিত্রে অভিনয় করছেন টোটা রায় চৌধুরী। পরিচালক অরিন্দম আরও জানিয়েছেন, এটা আমার প্রথম হিন্দি কাজ। দুই সিজন ধরে চলবে এই সিরিজ। পূজার আগেই শুটিং শুরু হওয়ার কথা। এ বছরের শেষ দিকে দেখা যাবে সিরিজটি।
No comments