বুকে পাথর চাপার গল্প by ইকবাল আহমদ সরকার
সিরাজুল
ইসলাম ছিলেন বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার। অন্যদিকে কুমিল্লার জাহানারা
বেগমের স্বামীও ছিলেন বিমানবাহিনীতে কর্মরত। দুজনের জীবনের নানা
সুখ-স্মৃতি থাকলেও জীবনের শেষ প্রান্তের গল্প বাধা পড়ে গেছে গিভেন্সি
গ্রুপের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সিরাজুল ইসলামকে ভুয়া সনদ বানিয়ে মৃত
দেখিয়ে ব্যাংকে গচ্ছিত জীবনের সবটুকু সঞ্চয় তুলে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে
দিয়েছে তার প্রিয় স্ত্রী। একইসঙ্গে নিজের মাসিক পেনশনের টাকা উত্তোলনের
ক্ষমতাও নিয়ে নেন স্ত্রী। বৃদ্ধাশ্রমে বসে সিরাজুল ইসলাম এখন শুধু ডুকরে
ডুকরে কাঁদেন আর ভাবেন সোনালি অতীতের কথা। আর চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে রেখে
জাহানারা বেগমের স্বামী মারা যাবার পর দিনে দিনে সন্তানরা আলাদা হয়ে যায়।
একদিন ছোট ছেলে ও তার স্ত্রী প্রয়োজনের কথা বলে পাঁচ লাখ টাকার চেকে
স্বাক্ষর নিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়।
এরপর জাহানারার ঠাঁই মেলে একই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এমনি শত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বুকে পাথর চাপার গল্প আটকে আছে ওই কেন্দ্রের পড়তে পড়তে। এর মধ্যে প্রবীণ দিবসটি অন্য দিনগুলোর চেয়ে একটু আলাদা-আনন্দে কাটিয়েছেন তারা।
গাজীপুরের বিকে বাড়ি এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে জানা গেছে সেখানে থাকা দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের শেষ জীবনের কষ্টের কাহিনী। যাদের অনেকেরই আছে সোনালি অতীত। ছেলে মেয়েরাও প্রতিষ্ঠিত। বিদেশেও আছেন ভালো অবস্থানে। কেউ কেউ স্ত্রী-সন্তানের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে কিংবা প্রতারিত হয়ে শুধু পরপারে যাবার অপেক্ষায় দিন পার করছেন এখানে।
পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকা ৬৮ বছর বয়সী সিরাজুল ইসলাম জানান, সংসারে স্ত্রী ও চার মেয়ে থাকলেও কোনো ছেলে সন্তান ছিল না। সুখেই কাটছিল বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার সিরাজুল ইসলামের চাকরি জীবন। পরে চাকরি নেন ঢাকার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক অফিসে। কিন্তু চাকরির শেষ দিকে ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে এবং অবসরে যাওয়ার কয়েক বছর পরই দেখা দেয় অশান্তি। স্ত্রী কৌশলে পৈতৃক ভিটা বাড়ি বিক্রি করে দেন। এক সময় স্ত্রী-সন্তানদের রোষানলে পড়তে হয় তাকে। শেষমেশ সিরাজুল ইসলামের ভুয়া মৃত্যু সনদ বানিয়ে ব্যাংকে গচ্ছিত জীবনের সবটুকু আয় তুলে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে। একইসঙ্গে নিজের মাসিক পেনশনের টাকা উত্তোলনের ক্ষমতাও নিয়ে নেন স্ত্রী। এর আগে স্ত্রীর পরামর্শে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে গাজীপুর রাজেন্দ্রপুরের আতলরা এলাকায় শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি কেনেন স্ত্রী ও মেয়েদের নামে। এতে তার নিজের ভাই-বোনদের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হয়। কিছুদিন যাওয়ার পর ছোটভাইও তার নামে থাকা অবশিষ্ট ১০ কাঠা জমি লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সেখান থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ির এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়া হয় এবং সুস্থ হলে গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে অফিসে গেলে ঘটনাটি আদালতের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পরামর্শ দেয়া হয়। এখন শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে থেকে আইনি লড়াই করার শক্তি নেই বলেও জানান তিনি।
সিরাজুলের মতো বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন কুমিল্লার জাহানারা বেগম (৭৫)। তিনি জানান, তার স্বামী বিমানবাহিনীতে চাকরি করতেন। তার স্বামী চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে রেখে মারা গেছেন। সকলের বিয়ে হওয়ার পর যে যার মতো আলাদা হয়ে গেছে। জাহানারা বলেন, একসময় আমার ছোট ছেলের বাসায় থাকতাম। একদিন ছোট ছেলে ও তার স্ত্রী প্রয়োজনের কথা বলে পাঁচ লাখ টাকার চেকে স্বাক্ষর করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। পরে তাকে বকাঝকা শুরু করে এবং বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ওই টাকা অন্যদের না দিয়ে শুধু ছোট ছেলেকে টাকা দেয়ায় অন্য সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত তিনি চলে আসেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে চার বছর ধরে আছেন তিনি। সন্তানরা খোঁজ নেন না তার। প্রথম প্রথম সন্তানদের ছেড়ে এখানে থাকতে খুব খারাপ লাগলেও এখন মানিয়ে নিয়েছেন।
গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার মনোরঞ্জন (৬৮) ছয় মাস ধরে আছেন এখানে। তিনি ছিলেন একজন সরকারি চাকুরে। অবসরের বয়স সীমার আগেই ইস্তফা দেন চাকরি থেকে। দুই ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে ছিল তার সংসার। গ্রামে বিশাল পুকুরে মাছ চাষসহ সহায়-সম্বল সবই ছিল তার। হঠাৎ তার এক ছেলে জুয়ায় আসক্ত হয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। ছেলের ঋণ পরিশোধে সমাজপতিদের হুমকিতে নিজের সহায় সম্বল সবই বিক্রি করতে বাধ্য হন। চোখের সামনে সবকিছু শেষের দৃশ্য নিজে মেনে নিতে পারলেন না। স্বজনদের আড়ালেই এসে আশ্রয় নেন এই বৃদ্ধাশ্রমে।
গাজীপুর সদর উপজেলার বিকে বাড়ি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল জানান, উপার্জনে অক্ষম বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যারা দুবেলা দুমুঠো খাবার পান না, যাদের থাকার জায়গা নেই কিংবা যাদের সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও বাবা-মার ভরণ পোষণ দেয় না বা সামর্থ্য নেই কিংবা যাদের কেউ নেই তাদের লালন পালন করা হচ্ছে এই কেন্দ্রে। এখানে যারা আছেন তাদের জন্য কোনো খরচ দিতে হয় না। নিবাসীদের বিনামূল্যে কাপড় ও চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়, যার যার ধর্ম পালনের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার নিবাসীদের বিনোদনের জন্য খেলাধুলা ও টেলিভিশন এবং পত্রিকা ও বই পড়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। মৃত্যুর পর এখানেই তাদের দাফন ও সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. আবু শরিফ জানান, তবে যারা এখানে আসতে চান তাদের চলাফেরায় সক্ষম ও বয়স ৬০ বছর বা বেশি হতে হবে এবং কিছু শর্ত মেনে থাকতে হবে। বর্তমানে এই বয়স্ক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০৭ জন নিবাসী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০৭ জন পুরুষ এবং ১০০ জন নারী।
এরপর জাহানারার ঠাঁই মেলে একই বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে। এমনি শত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার বুকে পাথর চাপার গল্প আটকে আছে ওই কেন্দ্রের পড়তে পড়তে। এর মধ্যে প্রবীণ দিবসটি অন্য দিনগুলোর চেয়ে একটু আলাদা-আনন্দে কাটিয়েছেন তারা।
গাজীপুরের বিকে বাড়ি এলাকার বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে জানা গেছে সেখানে থাকা দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের শেষ জীবনের কষ্টের কাহিনী। যাদের অনেকেরই আছে সোনালি অতীত। ছেলে মেয়েরাও প্রতিষ্ঠিত। বিদেশেও আছেন ভালো অবস্থানে। কেউ কেউ স্ত্রী-সন্তানের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে কিংবা প্রতারিত হয়ে শুধু পরপারে যাবার অপেক্ষায় দিন পার করছেন এখানে।
পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকা ৬৮ বছর বয়সী সিরাজুল ইসলাম জানান, সংসারে স্ত্রী ও চার মেয়ে থাকলেও কোনো ছেলে সন্তান ছিল না। সুখেই কাটছিল বিমান বাহিনীর ওয়ারেন্ট অফিসার সিরাজুল ইসলামের চাকরি জীবন। পরে চাকরি নেন ঢাকার বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার এক অফিসে। কিন্তু চাকরির শেষ দিকে ভুল বোঝাবুঝি নিয়ে এবং অবসরে যাওয়ার কয়েক বছর পরই দেখা দেয় অশান্তি। স্ত্রী কৌশলে পৈতৃক ভিটা বাড়ি বিক্রি করে দেন। এক সময় স্ত্রী-সন্তানদের রোষানলে পড়তে হয় তাকে। শেষমেশ সিরাজুল ইসলামের ভুয়া মৃত্যু সনদ বানিয়ে ব্যাংকে গচ্ছিত জীবনের সবটুকু আয় তুলে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয় তাকে। একইসঙ্গে নিজের মাসিক পেনশনের টাকা উত্তোলনের ক্ষমতাও নিয়ে নেন স্ত্রী। এর আগে স্ত্রীর পরামর্শে নিজের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে গাজীপুর রাজেন্দ্রপুরের আতলরা এলাকায় শ্বশুরবাড়ির সম্পত্তি কেনেন স্ত্রী ও মেয়েদের নামে। এতে তার নিজের ভাই-বোনদের সঙ্গেও সম্পর্কের অবনতি হয়। কিছুদিন যাওয়ার পর ছোটভাইও তার নামে থাকা অবশিষ্ট ১০ কাঠা জমি লিখে নিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। সেখান থেকে গাজীপুরের কোনাবাড়ির এক আত্মীয়ের বাসায় উঠেন। সেখানে থাকা অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়া হয় এবং সুস্থ হলে গাজীপুরের বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেয়া হয়। বিষয়টি নিয়ে অফিসে গেলে ঘটনাটি আদালতের মাধ্যমে প্রমাণ করতে পরামর্শ দেয়া হয়। এখন শেষ বয়সে বৃদ্ধাশ্রমে থেকে আইনি লড়াই করার শক্তি নেই বলেও জানান তিনি।
সিরাজুলের মতো বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন কুমিল্লার জাহানারা বেগম (৭৫)। তিনি জানান, তার স্বামী বিমানবাহিনীতে চাকরি করতেন। তার স্বামী চার ছেলে ও পাঁচ মেয়ে রেখে মারা গেছেন। সকলের বিয়ে হওয়ার পর যে যার মতো আলাদা হয়ে গেছে। জাহানারা বলেন, একসময় আমার ছোট ছেলের বাসায় থাকতাম। একদিন ছোট ছেলে ও তার স্ত্রী প্রয়োজনের কথা বলে পাঁচ লাখ টাকার চেকে স্বাক্ষর করে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেয়। পরে তাকে বকাঝকা শুরু করে এবং বাড়ি থেকে বের করে দেয়। ওই টাকা অন্যদের না দিয়ে শুধু ছোট ছেলেকে টাকা দেয়ায় অন্য সন্তানদের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি দেখা দেয়। শেষ পর্যন্ত তিনি চলে আসেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে চার বছর ধরে আছেন তিনি। সন্তানরা খোঁজ নেন না তার। প্রথম প্রথম সন্তানদের ছেড়ে এখানে থাকতে খুব খারাপ লাগলেও এখন মানিয়ে নিয়েছেন।
গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ার মনোরঞ্জন (৬৮) ছয় মাস ধরে আছেন এখানে। তিনি ছিলেন একজন সরকারি চাকুরে। অবসরের বয়স সীমার আগেই ইস্তফা দেন চাকরি থেকে। দুই ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে ছিল তার সংসার। গ্রামে বিশাল পুকুরে মাছ চাষসহ সহায়-সম্বল সবই ছিল তার। হঠাৎ তার এক ছেলে জুয়ায় আসক্ত হয়ে ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়েন। ছেলের ঋণ পরিশোধে সমাজপতিদের হুমকিতে নিজের সহায় সম্বল সবই বিক্রি করতে বাধ্য হন। চোখের সামনে সবকিছু শেষের দৃশ্য নিজে মেনে নিতে পারলেন না। স্বজনদের আড়ালেই এসে আশ্রয় নেন এই বৃদ্ধাশ্রমে।
গাজীপুর সদর উপজেলার বিকে বাড়ি বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা খতিব আব্দুল জাহিদ মুকুল জানান, উপার্জনে অক্ষম বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যারা দুবেলা দুমুঠো খাবার পান না, যাদের থাকার জায়গা নেই কিংবা যাদের সচ্ছল হওয়া সত্ত্বেও বাবা-মার ভরণ পোষণ দেয় না বা সামর্থ্য নেই কিংবা যাদের কেউ নেই তাদের লালন পালন করা হচ্ছে এই কেন্দ্রে। এখানে যারা আছেন তাদের জন্য কোনো খরচ দিতে হয় না। নিবাসীদের বিনামূল্যে কাপড় ও চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়, যার যার ধর্ম পালনের ব্যবস্থা রয়েছে। এখানকার নিবাসীদের বিনোদনের জন্য খেলাধুলা ও টেলিভিশন এবং পত্রিকা ও বই পড়ারও ব্যবস্থা রয়েছে। মৃত্যুর পর এখানেই তাদের দাফন ও সৎকারের ব্যবস্থা করা হয়। কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক মো. আবু শরিফ জানান, তবে যারা এখানে আসতে চান তাদের চলাফেরায় সক্ষম ও বয়স ৬০ বছর বা বেশি হতে হবে এবং কিছু শর্ত মেনে থাকতে হবে। বর্তমানে এই বয়স্ক ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে ২০৭ জন নিবাসী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০৭ জন পুরুষ এবং ১০০ জন নারী।
No comments