মেট্রোরেল: জনগণের জন্য কিছু দুর্ভোগ থেকে যাওয়ার আশঙ্কা! by শাহেদ শফিক
যানজট
ও জনদুর্ভোগ কমানোর উদ্দেশ্যে রাজধানীতে যে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন
হচ্ছে তাতে স্টেশনে আসা ও নেমে গন্তব্যে যাওয়া যাত্রীদের সড়কপথে যাতায়াতের
সুনির্দিষ্ট পথ নির্দেশ নেই। এর ফলে মেট্রোরেল স্টেশনে আসা ও নামা যাত্রীরা
মানুষ ও যানবাহনের জটলায় উল্টো দুর্ভোগের শিকার হবেন এমন আশঙ্কা করছেন
বিশেষজ্ঞরা। তাদের ধারণা, এই জটলা ব্যস্ত শহর ঢাকায় কয়েক ঘণ্টা থাকলেই তা
শহরময় ছড়িয়ে পড়বে। এতে যানজট না কমে উল্টো জনদুর্ভোগ বাড়তে পারে। তাই
মেট্রোরেল স্টেশনগুলোতে যাত্রী ও তাদের বহন করে আনা যানবাহনের প্রবেশ ও বের
হওয়ার বিষয়গুলো কেমন হবে তার পরিকল্পনা খুব তাড়াতাড়ি না করলে মেট্রোরেল
প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে পারে। ফলে সড়ককেন্দ্রিক যে যানজট তা
লেগে থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর স্টেশনে আসা যাত্রীদের যাতায়াতে নিরাপদ ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু,ঢাকায় যে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেখানে এ বিষয়টিতে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
প্রকল্পসূত্র জানিয়েছে,যানজট নিরসনে নির্মিত এই প্রকল্পের সুফল আগামী বছর থেকেই জনগণ পাবে বলে আশা করছে সরকার। আর ২০২০ সালের মধ্যে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এলাকায় ২০১৯ সালের মধ্যে মেট্রোরেল দৃশ্যমান হবে। পুরো প্রকল্পটি আটটি প্যাকেজের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে উত্তরা-মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল পথে ৭৭০টি স্প্যান বসবে। পুরো পথে থাকবে ১৬টি স্টেশন। এ পথে ১৪ জোড়া ট্রেন চলাচল করবে। প্রতিটি ট্রেন এক হাজার ৬৯৬ জন যাত্রী বহন করতে পারবে। এর মধ্যে ৯৪২ জন বসে এবং ৭৫৪ জন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন। ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন মেট্রোরেল ৩৭ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাবে। প্রতি চার মিনিট অন্তর ট্রেন ছেড়ে যাবে। উভয় দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবে। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে জাইকা। পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় করছে সরকার।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে,প্রকল্প এলাকায় ১৬টি স্টেশন স্থাপন করা হবে। দ্বিতল ভবনের সমান উচ্চতার প্রতিটি স্টেশনের নিচতলায় থাকবে টিকিট ঘর। প্রবেশ পথ হবে স্বয়ংক্রিয়। স্টেশনগুলো হচ্ছে- উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিলে। এ থেকে উত্তরা-আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের ৯টি স্টেশন নির্মাণ কাজের মধ্যে ২, ৩ ও ৪ নম্বর স্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মেট্রোরেল নির্মাণে সড়ককেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনাগুলো মাথায় রাখা হয়নি। এ কারণে এর সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। দ্রুত এগুলোর সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘বলা হচ্ছে- প্রতি তিন মিনিট পরপর একটা ট্রেন স্টেশনে আসবে। আমরা ধরে নিলাম প্রতি ৮ মিনিটে যদি দুইটা ট্রেন একটা স্টেশনে আসে প্রতিটি স্টেশনে ননপিক আওয়ারে কমপক্ষে ২০০ থেকে ৪০০ পর্যন্ত লোক দুই দিক থেকে আসা ট্রেনে ওঠা-নামা করবে। আর পিক আওয়ারে কমপক্ষে ৭০০-৮০০ লোক হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই মানুষগুলো গ্রাউন্ড থেকে স্টেশনে উঠবে। এই যদি হয় তা হলে প্রতি মুহূর্তে ৫০০ থেকে ৬০০ লোক স্টেশনে আসার জন্য ফুটপাতে জমায়েত হবে। লাইন দিয়ে উঠবে এবং নামবে।’
মোবাশ্বের হোসেনের মতে, কর্তৃপক্ষ যে নকশা করেছে তাতে দেখা গেছে প্রতিটি স্টেশনে নামা এবং ওঠার জন্য দু’টি চলন্ত স্কেলেটর থাকবে। আমরা ঘুরে দেখেছি মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় এক সঙ্গে দু’টি স্কেলেটর লাগানোর মতো পথ আমাদের নেই। যদি লাগাতে হয় তাহলে ফুটপাতে লাগাতে হবে। ফুটপাতে লাগালে মানুষকে হাঁটতে হবে রাস্তা দিয়ে। এই স্কেলেটর লাগানোর জন্য জায়গা অধিগ্রহণও করা হয়নি। যেসব স্থানে স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে এর অধিকাংশ স্থানে স্কেলেটর নামানোর জায়গাই নেই। জায়গা যদি না থাকে তাহলে আশপাশের কোনও বড় বিল্ডিংয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোর ভাড়া বা অধিগ্রহণ করা যেতে পারে। এরপরেও যদি জোর করে আশপাশে স্কেলেটর বসানো হয় তাহলে এই ফুটপাত দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষকে ফুটপাতের বাইরে রাস্তায় চলাচল করতে হবে।
তিনি আরও বলেন,যেহেতু মেট্রোরেলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই খুব সহজে গন্তব্যে পৌঁছা যাবে তাই সবাই চাইবে অল্পসময়ের মধ্যে মেট্রোরেলে করে গন্তব্যে পৌঁছাতে। এজন্য স্টেশনের আশপাশের সব মানুষ তার নিজস্ব গাড়ি বা রিকশা, ট্যাক্সি বা সিএনজি করে স্টেশনে আসবে। স্টেশনকেন্দ্রিক এগুলোর যাতায়াত থাকবে। এর ফলে প্রতিটি স্টেশনের কাছে এসব যানবাহনের ভিড় জমবে। অথচ যে জায়গাগুলোতে এসব স্টেশন হচ্ছে সেসব এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে সেখানে মানুষ দাঁড়ানোর জায়গাই হবে না, অন্য যানবাহনগুলো দাঁড়াবে কী করে? এছাড়াও এসব মেট্রোরেল স্টেশন করা হচ্ছে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোর পাশে,ফলে মেট্রোরেল স্টেশন এলাকাগুলোতে যানচলাচল প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হবে।
তিনি আরও বলেন, ফুটপাতে স্কেলেটর বসাতে গেলে রাস্তা সংকুচিত হবে। যদি আমরা স্টেশনের জন্য ফুটপাতের সঙ্গে ৮ হাজার বা ১০ হাজার স্কয়ার ফুটের উন্মুক্ত স্থান তৈরি করতে না পারি, তাহলে এই গাড়িগুলো রাস্তায় থাকবে। তখন সড়কের স্বাভাবিক যানচলাচল ব্যাহত হবে। আমরা যে তথ্য এখন পর্যন্ত জোগাড় করতে পেরেছি তা হচ্ছে এ ধরনের কোনও জায়গা সিটি করপোরেশন বা অন্য কোনও সংস্থা স্টেশনের জন্য দেয়নি বা মেট্রোরেলও জোগাড় করেনি। মেট্রোরেলের কর্মকর্তারা গ্রাউন্ড স্টেশনের যে ইফেক্ট হবে সে সম্পর্কে কোনও তথ্যই জানেন না। স্টেশনে ৪০০ থেকে ৫০০ লোক একসঙ্গে ওঠানামা করলে এ সময় যে যানজট তৈরি হবে তা নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থা নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,মেট্রোরেল স্টেশনকেন্দ্রিক অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থার একটা সংযোগ থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন নজির রয়েছে। কিন্তু ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে এ বিষয়গুলো একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর স্টেশন কেন্দ্রিক যানজটসহ নানা জটিলতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তাদের।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সড়ককেন্দ্রিক কোনও পরিকল্পনাই নেই। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ও রাখা হয়নি। তাদের শুধু দায়িত্ব মেট্রোরেল নির্মাণ করে দেওয়া। এই প্রকল্পের জন্য শহরের ‘ইন্টার মোডাল সার্ভিস’ গুলোর সঙ্গে মেট্রোরেলের যে সম্পর্ক থাকা দরকার সেগুলো নেই। সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ না করায় এর খেসারত দিতে হবে। তাছাড়া যারা এই সংস্থাগুলোর সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গেও কোনও বৈঠক বা সমন্বয় করা হয়নি।
তিনি বলেন, এখনও সময় আছে- এটাকে যদি কার্যকরী করতে হয় তাহলে বিস্তারিত পরিকল্পনা নিতে হবে।
এই পরিকল্পনাবিদের মতে যানজট নিরসনে রাজধানীর সড়ক পরিবহন সেক্টর নিয়ে ২০০৫ সালে তৈরি করা স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানে (এসটিপি) মেট্রোরেলের অবস্থান ছিল ৬ নম্বরে। কিন্তু বর্তমানে আমরা ৬ নম্বর পরিকল্পনাকে এক নম্বরে এনে কাজ করছি। আমরা সন্দিহান, মেট্রোরেল বাস্তবায়ন হলেও সব সমাধান হচ্ছে না।’
একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মেট্রো স্টেশনকেন্দ্রিক অনেক মানুষকে ঝড়ো হবে। একটা প্রকল্প হলে সে যেমন উপকার দেয় সঙ্গে কিছু সমস্যা তৈরি করে। এগুলো আগে থেকে জেনে পরে সমন্বয় করতে হয়। বিরূপ প্রভাব যাতে না দেখা দেয় সেজন্য কাজ করতে হয়। দুর্ভাগ্য আমাদের, সেটা হচ্ছে না। স্টেশনগুলোর ল্যান্ডিংটা ফুটপাতের মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন ফুটপাতে যারা হাঁটেন তারা তখন কি দিয়ে হাঁটবেন?
তার মতে স্টেশনকেন্দ্রিক মানুষের যাতায়াতের সুবিধাগুলো এই প্রকল্পে বিবেচনা করা হয়নি। এক সঙ্গে এক দেড় হাজার মানুষ স্টেশনে নামার পর তাদের গন্তব্যে যাওয়ার একটা চাহিদা থাকবে। কিন্তু তারা কিভাবে যাবেন তার ব্যবস্থা নেই। আর এই যাত্রীগুলোকে পরিবহন করার জন্য স্টেশনকেন্দ্রিক রিকশা, সিএনজি, মটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাসসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবহন অপেক্ষা করবে। ফলে যানজটের একটা ঝটলা লেগেই থাকবে।
তিনি বলেন, আমাদের উন্নয়নকাজগুলো টার্গেটভিত্তিক সময়সীমা বেঁধে দিয়ে নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে ত্রুটিগুলোর সমাধান হয় না। মেট্রোরেলের অন্যতম কাজ হচ্ছে স্টেশনে আগত যাত্রীদের ট্রান্সফার সুবিধা রাখতে হবে। প্রয়োজনবোধে যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য এলিভেটেড ওয়াকওয়ে রাখতে হবে। এর মাধ্যমে স্টেশন থেকে সরাসরি বড়বড় অফিস ও মার্কেটগুলোতে যাতায়াত করা যাবে। না হয় প্রকল্পটির সুফল পাওয়া যাবে অন্য কিছুকে ক্ষতি করে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য মেট্রোরেলের প্রকল্প পরিচালক আফতাব উদ্দিন তালুকদারের সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তাকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলার জন্য নিষেধ রয়েছে বলে প্রকল্পের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন।
এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিকের সঙ্গেও বারবার চেষ্টা করে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার প্রকল্প অফিসে গিয়েও তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি।
‘বাঁচবে সময় বাঁচবে তেল, জ্যাম কমাবে মেট্রোরেল’-এ স্লোগানে শুরু হওয়া দেশের প্রথম মেট্রোরেল এরইমধ্যে বাস্তবে রূপ পেতে শুরু করেছে। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকার এ প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। প্রাথমিক মেয়াদকাল ছিল ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। ২০১৬ সালের ২৬ জুন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্রুত গতিতে কাজ করায় নির্ধারিত সময়ের প্রায় চার বছর আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেট্রোরেলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এর স্টেশনে আসা যাত্রীদের যাতায়াতে নিরাপদ ব্যবস্থা থাকবে। কিন্তু,ঢাকায় যে মেট্রোরেল প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে সেখানে এ বিষয়টিতে তেমন একটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
প্রকল্পসূত্র জানিয়েছে,যানজট নিরসনে নির্মিত এই প্রকল্পের সুফল আগামী বছর থেকেই জনগণ পাবে বলে আশা করছে সরকার। আর ২০২০ সালের মধ্যে প্রকল্পের পুরো কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এলাকায় ২০১৯ সালের মধ্যে মেট্রোরেল দৃশ্যমান হবে। পুরো প্রকল্পটি আটটি প্যাকেজের মাধ্যমে সম্পন্ন করা হচ্ছে। এর মধ্যে উত্তরা-মতিঝিল পর্যন্ত ২০ দশমিক ১ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল পথে ৭৭০টি স্প্যান বসবে। পুরো পথে থাকবে ১৬টি স্টেশন। এ পথে ১৪ জোড়া ট্রেন চলাচল করবে। প্রতিটি ট্রেন এক হাজার ৬৯৬ জন যাত্রী বহন করতে পারবে। এর মধ্যে ৯৪২ জন বসে এবং ৭৫৪ জন দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেন। ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন মেট্রোরেল ৩৭ মিনিটে উত্তরা থেকে মতিঝিল পৌঁছাবে। প্রতি চার মিনিট অন্তর ট্রেন ছেড়ে যাবে। উভয় দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী চলাচল করতে পারবে। প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকার এই প্রকল্পে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকার আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে জাইকা। পাঁচ হাজার ৩৯০ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয় করছে সরকার।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে,প্রকল্প এলাকায় ১৬টি স্টেশন স্থাপন করা হবে। দ্বিতল ভবনের সমান উচ্চতার প্রতিটি স্টেশনের নিচতলায় থাকবে টিকিট ঘর। প্রবেশ পথ হবে স্বয়ংক্রিয়। স্টেশনগুলো হচ্ছে- উত্তরা উত্তর, উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ সচিবালয় ও মতিঝিলে। এ থেকে উত্তরা-আগারগাঁও পর্যন্ত অংশের ৯টি স্টেশন নির্মাণ কাজের মধ্যে ২, ৩ ও ৪ নম্বর স্টেশন নির্মাণ কাজ চলছে।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, মেট্রোরেল নির্মাণে সড়ককেন্দ্রিক ব্যবস্থাপনাগুলো মাথায় রাখা হয়নি। এ কারণে এর সুফল পাওয়া নিয়ে সংশয় রয়েছে। দ্রুত এগুলোর সমাধান করতে হবে।
তিনি বলেন, ‘বলা হচ্ছে- প্রতি তিন মিনিট পরপর একটা ট্রেন স্টেশনে আসবে। আমরা ধরে নিলাম প্রতি ৮ মিনিটে যদি দুইটা ট্রেন একটা স্টেশনে আসে প্রতিটি স্টেশনে ননপিক আওয়ারে কমপক্ষে ২০০ থেকে ৪০০ পর্যন্ত লোক দুই দিক থেকে আসা ট্রেনে ওঠা-নামা করবে। আর পিক আওয়ারে কমপক্ষে ৭০০-৮০০ লোক হবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই মানুষগুলো গ্রাউন্ড থেকে স্টেশনে উঠবে। এই যদি হয় তা হলে প্রতি মুহূর্তে ৫০০ থেকে ৬০০ লোক স্টেশনে আসার জন্য ফুটপাতে জমায়েত হবে। লাইন দিয়ে উঠবে এবং নামবে।’
মোবাশ্বের হোসেনের মতে, কর্তৃপক্ষ যে নকশা করেছে তাতে দেখা গেছে প্রতিটি স্টেশনে নামা এবং ওঠার জন্য দু’টি চলন্ত স্কেলেটর থাকবে। আমরা ঘুরে দেখেছি মেট্রোরেল স্টেশন এলাকায় এক সঙ্গে দু’টি স্কেলেটর লাগানোর মতো পথ আমাদের নেই। যদি লাগাতে হয় তাহলে ফুটপাতে লাগাতে হবে। ফুটপাতে লাগালে মানুষকে হাঁটতে হবে রাস্তা দিয়ে। এই স্কেলেটর লাগানোর জন্য জায়গা অধিগ্রহণও করা হয়নি। যেসব স্থানে স্টেশন নির্মাণ করা হচ্ছে এর অধিকাংশ স্থানে স্কেলেটর নামানোর জায়গাই নেই। জায়গা যদি না থাকে তাহলে আশপাশের কোনও বড় বিল্ডিংয়ের গ্রাউন্ড ফ্লোর ভাড়া বা অধিগ্রহণ করা যেতে পারে। এরপরেও যদি জোর করে আশপাশে স্কেলেটর বসানো হয় তাহলে এই ফুটপাত দিয়ে মানুষ চলাচল করতে পারবে না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষকে ফুটপাতের বাইরে রাস্তায় চলাচল করতে হবে।
তিনি আরও বলেন,যেহেতু মেট্রোরেলে স্বল্প সময়ের মধ্যেই খুব সহজে গন্তব্যে পৌঁছা যাবে তাই সবাই চাইবে অল্পসময়ের মধ্যে মেট্রোরেলে করে গন্তব্যে পৌঁছাতে। এজন্য স্টেশনের আশপাশের সব মানুষ তার নিজস্ব গাড়ি বা রিকশা, ট্যাক্সি বা সিএনজি করে স্টেশনে আসবে। স্টেশনকেন্দ্রিক এগুলোর যাতায়াত থাকবে। এর ফলে প্রতিটি স্টেশনের কাছে এসব যানবাহনের ভিড় জমবে। অথচ যে জায়গাগুলোতে এসব স্টেশন হচ্ছে সেসব এলাকার বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে সেখানে মানুষ দাঁড়ানোর জায়গাই হবে না, অন্য যানবাহনগুলো দাঁড়াবে কী করে? এছাড়াও এসব মেট্রোরেল স্টেশন করা হচ্ছে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোর পাশে,ফলে মেট্রোরেল স্টেশন এলাকাগুলোতে যানচলাচল প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হবে।
তিনি আরও বলেন, ফুটপাতে স্কেলেটর বসাতে গেলে রাস্তা সংকুচিত হবে। যদি আমরা স্টেশনের জন্য ফুটপাতের সঙ্গে ৮ হাজার বা ১০ হাজার স্কয়ার ফুটের উন্মুক্ত স্থান তৈরি করতে না পারি, তাহলে এই গাড়িগুলো রাস্তায় থাকবে। তখন সড়কের স্বাভাবিক যানচলাচল ব্যাহত হবে। আমরা যে তথ্য এখন পর্যন্ত জোগাড় করতে পেরেছি তা হচ্ছে এ ধরনের কোনও জায়গা সিটি করপোরেশন বা অন্য কোনও সংস্থা স্টেশনের জন্য দেয়নি বা মেট্রোরেলও জোগাড় করেনি। মেট্রোরেলের কর্মকর্তারা গ্রাউন্ড স্টেশনের যে ইফেক্ট হবে সে সম্পর্কে কোনও তথ্যই জানেন না। স্টেশনে ৪০০ থেকে ৫০০ লোক একসঙ্গে ওঠানামা করলে এ সময় যে যানজট তৈরি হবে তা নিয়ন্ত্রণের কোনও ব্যবস্থা নেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন,মেট্রোরেল স্টেশনকেন্দ্রিক অন্যান্য পরিবহন ব্যবস্থার একটা সংযোগ থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন নজির রয়েছে। কিন্তু ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পে এ বিষয়গুলো একেবারেই অনুপস্থিত। ফলে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর স্টেশন কেন্দ্রিক যানজটসহ নানা জটিলতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা তাদের।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের সড়ককেন্দ্রিক কোনও পরিকল্পনাই নেই। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ও রাখা হয়নি। তাদের শুধু দায়িত্ব মেট্রোরেল নির্মাণ করে দেওয়া। এই প্রকল্পের জন্য শহরের ‘ইন্টার মোডাল সার্ভিস’ গুলোর সঙ্গে মেট্রোরেলের যে সম্পর্ক থাকা দরকার সেগুলো নেই। সমন্বিত পরিকল্পনা নিয়ে মেট্রোরেল নির্মাণ না করায় এর খেসারত দিতে হবে। তাছাড়া যারা এই সংস্থাগুলোর সঙ্গে জড়িত তাদের সঙ্গেও কোনও বৈঠক বা সমন্বয় করা হয়নি।
তিনি বলেন, এখনও সময় আছে- এটাকে যদি কার্যকরী করতে হয় তাহলে বিস্তারিত পরিকল্পনা নিতে হবে।
এই পরিকল্পনাবিদের মতে যানজট নিরসনে রাজধানীর সড়ক পরিবহন সেক্টর নিয়ে ২০০৫ সালে তৈরি করা স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যানে (এসটিপি) মেট্রোরেলের অবস্থান ছিল ৬ নম্বরে। কিন্তু বর্তমানে আমরা ৬ নম্বর পরিকল্পনাকে এক নম্বরে এনে কাজ করছি। আমরা সন্দিহান, মেট্রোরেল বাস্তবায়ন হলেও সব সমাধান হচ্ছে না।’
একই আশঙ্কা প্রকাশ করেন বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মেট্রো স্টেশনকেন্দ্রিক অনেক মানুষকে ঝড়ো হবে। একটা প্রকল্প হলে সে যেমন উপকার দেয় সঙ্গে কিছু সমস্যা তৈরি করে। এগুলো আগে থেকে জেনে পরে সমন্বয় করতে হয়। বিরূপ প্রভাব যাতে না দেখা দেয় সেজন্য কাজ করতে হয়। দুর্ভাগ্য আমাদের, সেটা হচ্ছে না। স্টেশনগুলোর ল্যান্ডিংটা ফুটপাতের মধ্যে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এখন ফুটপাতে যারা হাঁটেন তারা তখন কি দিয়ে হাঁটবেন?
তার মতে স্টেশনকেন্দ্রিক মানুষের যাতায়াতের সুবিধাগুলো এই প্রকল্পে বিবেচনা করা হয়নি। এক সঙ্গে এক দেড় হাজার মানুষ স্টেশনে নামার পর তাদের গন্তব্যে যাওয়ার একটা চাহিদা থাকবে। কিন্তু তারা কিভাবে যাবেন তার ব্যবস্থা নেই। আর এই যাত্রীগুলোকে পরিবহন করার জন্য স্টেশনকেন্দ্রিক রিকশা, সিএনজি, মটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাসসহ বিভিন্ন ধরনের পরিবহন অপেক্ষা করবে। ফলে যানজটের একটা ঝটলা লেগেই থাকবে।
তিনি বলেন, আমাদের উন্নয়নকাজগুলো টার্গেটভিত্তিক সময়সীমা বেঁধে দিয়ে নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে প্রতিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে ত্রুটিগুলোর সমাধান হয় না। মেট্রোরেলের অন্যতম কাজ হচ্ছে স্টেশনে আগত যাত্রীদের ট্রান্সফার সুবিধা রাখতে হবে। প্রয়োজনবোধে যাত্রীদের যাতায়াতের জন্য এলিভেটেড ওয়াকওয়ে রাখতে হবে। এর মাধ্যমে স্টেশন থেকে সরাসরি বড়বড় অফিস ও মার্কেটগুলোতে যাতায়াত করা যাবে। না হয় প্রকল্পটির সুফল পাওয়া যাবে অন্য কিছুকে ক্ষতি করে।
বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য মেট্রোরেলের প্রকল্প পরিচালক আফতাব উদ্দিন তালুকদারের সঙ্গে বারবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তাকে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলার জন্য নিষেধ রয়েছে বলে প্রকল্পের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন।
এ ছাড়া প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিকের সঙ্গেও বারবার চেষ্টা করে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কথা বলার জন্য বেশ কয়েকবার প্রকল্প অফিসে গিয়েও তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি।
‘বাঁচবে সময় বাঁচবে তেল, জ্যাম কমাবে মেট্রোরেল’-এ স্লোগানে শুরু হওয়া দেশের প্রথম মেট্রোরেল এরইমধ্যে বাস্তবে রূপ পেতে শুরু করেছে। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সরকার এ প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। প্রাথমিক মেয়াদকাল ছিল ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। ২০১৬ সালের ২৬ জুন নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দ্রুত গতিতে কাজ করায় নির্ধারিত সময়ের প্রায় চার বছর আগেই প্রকল্পের কাজ শেষ করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
No comments