একজন তরিকুল ইসলাম by কাফি কামাল
রাজধানীর
শান্তিনগর মোড়ে ইস্টার্ন পয়েন্টের একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করেন বরেণ্য
রাজনীতিবিদ তরিকুল ইসলাম। জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র নীতিনির্ধারক ফোরামের
সদস্য তিনি। কিন্তু দলীয় কর্মকাণ্ড বা নীতিনির্ধারক ফোরামের বৈঠক, কোথাও
দেখা নেই তার। কেমন আছেন তিনি? কয়েকদিন আগে তার বাসায় গিয়ে দেখা মেলে
অন্যরকম এক তরিকুল ইসলামের। বার্ধক্যের পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে হৃদরোগ,
ডায়াবেটিস, শ্বাসকষ্ট, কিডনি জটিলতা কাবু করে ফেলেছে তার শরীর। সমপ্রতি
তিনি আক্রান্ত হয়েছেন ফুসফুসের ক্যানসারে। তার কিডনি ডায়ালিসিস করতে হয়
সপ্তাহে তিনদিন। দিনে চারবার নিতে হয় ডায়াবেটিসের ইনসুলিন। রক্তের
হিমোগ্লোবিন নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রতি সপ্তাহে নিতে হয় ইনজেকশন। ফলে এখন
প্রায় নীরবে-নিভৃতে দিন কাটাচ্ছেন বিএনপির অত্যন্ত প্রভাবশালী এ নেতা।
চলাফেরায় অক্ষমতার কারণে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন। কথা বলতেও কষ্ট হয় তার। বর্তমানে তার সময় কাটে সোফায় অলস শুয়ে-বসে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে নীতিনির্ধারক ফোরামের বৈঠকেও অংশ নিতে পারেন না। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার দুদিন আগে সর্বশেষ দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। বর্তমানে বাসা থেকে বের হন কেবল হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজনে। যদিও সামপ্রতিক বছরগুলোতে বাসার চেয়ে হাসপাতালেই বেশি সময় কেটেছে বর্ষীয়ান এ নেতার। চিকিৎসকদের পরামর্শে গত মে-জুন মাসে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।
তরিকুল ইসলাম দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। প্রতিদিন ঘুমোতে যান রাত ১১টার পর। যেদিন কিডনি ডায়ালাইসিস থাকে সেদিন ঘুম থেকে উঠতে হয় ভোর ৬টায়। অন্যদিনগুলোতে কিছুটা দেরিতে বিছানা ছাড়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা নাস্তা ও ওষুধ খাবার পর ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে বসেন। আগে নিয়মিত পত্রিকা পড়লেও এখন পারেন না। পরিবারের সদস্যরা সংবাদের শিরোনাম ও বিশেষ দুয়েকটি সংবাদ পড়ে শোনান। তারপর বাসায় আসা নেতাকর্মী বা শুভাকাঙক্ষীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটান। কথা বলতে যেমন কষ্ট হয়, তেমনি টানা বসেও থাকতে পারেন না। দুপুরে খাবার ও ওষুধ সেবনের পর বিশ্রাম নেন কিছুক্ষণ। শরীর ভালো লাগলে বিকালে কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখেন। সন্ধ্যার পর সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক গল্প করেন।
তার ছোট ছেলে অনিন্দ ইসলাম অমিত বলেন, ডায়ালাইসিসের কারণে শরীরে প্রোটিন কমে যায়। বর্জ্যের পাশাপাশি শারীরিক নানা উপাদান বেরিয়ে যায়। ফলে তার পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। কিন্তু তার খাবার রুচি থাকে না প্রায়। তিনি খাবার খান বেঁচে থাকার তাগিদে, ওষুধ সেবনের নিয়মরক্ষার প্রয়োজনে। খাবার খাওয়াতে হয় জোর করে। খাবারের সময় হলে এবং তাগিদ দেয়া হলে তিনি বিরক্ত হন। অমিত জানান, রেড মিটসহ দুধ ও দুগ্ধজাত সবধরনের খাবারে নিষেধ রয়েছে চিকিৎসকের। নিষেধ রয়েছে পটাশিয়াম ও ফসফেট প্রধান ফলমূল এবং শাক-সবজির ক্ষেত্রেও। খাবারে নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে ডায়াবেটিস ও সমপ্রতি ফুসফুস ক্যানসার ধরা পড়ার পর। সবচেয়ে জটিলতা হচ্ছে তার পানি পান নিয়ে। চিকিৎসকরা বলে দিয়েছেন, ওষুধ সেবন, চা-কফি ও তরকারির ঝোলসহ সবমিলিয়ে প্রতিদিন ৭৫০ মি.লি’র বেশি পানি পান করতে পারবেন না। দিনে ১০-১২ রকমের অন্তত ৩০টির মতো ওষুধ সেবন করতে হয়। ফলে কঠিন হয়ে পড়ে পানি পানের রেস্ট্রিকশনটি সবসময় মেনে চলা।
তরিকুল ইসলামের পারিবারিক সূত্র জানায়, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন। মাঝে মাঝেই তার বাসায় ছুটে আসেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে নিজ এলাকা যশোরসহ সারাদেশ থেকে প্রতিদিনই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন নানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। বাসায় আগত রাজনৈতিক সহকর্মীসহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের কথা শোনেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার মতো শারীরিক সামর্থ্য নেই তার। নেতাকর্মীরা পরামর্শ চাইলে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে তাদের সাহস যোগান, ধৈর্য ধারণ ও কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দেন।
১৯৬২ সালের কথা। তরিকুল ইসলাম তখন যশোর এমএম কলেজের শিক্ষার্থী। যশোর শহরের শহীদ মিনারটি ছিল ভাঙাচোরা। তরিকুল ইসলাম ও তার বন্ধু ও সহপাঠীরা একটি শহীদ মিনার তৈরি করেছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকারের রোষানলে পড়ে গ্রেপ্তার হন তরিকুল। কারাগারে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় হলো তার। কারাগারেই দীক্ষা নেন বাম রাজনীতির। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন এমএনএ আহম্মদ আলী সর্দারের দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় কিছুদিন কারাভোগ করেন। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জন্য রাজবন্দি হিসেবে যশোর ও রাজশাহীতে কারাভোগ করেন দীর্ঘ নয় মাস। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় গ্রেপ্তার হন।
পরে কমিউনিস্ট পার্টির নীতি-আদর্শের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে না পেরে বেছে নেন নতুন পথ। ১৯৭০ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ভাসানী আহূত ফারাক্কা লং মার্চেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কথা বলে যেমন কারাভোগ করেছেন, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হিসেবেও তাকে যেতে হয়েছে জেলে।
ভাসানী ন্যাপ থেকে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) হয়ে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন বরেণ্য এ রাজনীতিক। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির ৭৬ সদস্যবিশিষ্ট প্রথম আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য তরিকুল ইসলাম। সেই সঙ্গে বিএনপির যশোর জেলা আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। ১৯৮০ সালে জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে পর্যায়ক্রমে তিনি দলের যুগ্ম মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যান ও ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে স্থায়ী কমিটির সদস্য পদে পদোন্নতি পান।
রাজনীতিতে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছাতে তরিকুল ইসলামকে মাড়িয়ে আসতে হয়েছে কাঁটা বিছানো পথ। রাজনীতিতে দৃঢ়চেতা এ নেতা স্বৈরাচার এরশাদ আমলে গ্রেপ্তারের পর তিন মাস অজ্ঞাতস্থানে আটক ছিলেন। পরে তাকে এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। শিকার হন নিষ্ঠুর নির্যাতনের। রাজনীতিতে বিএনপি নেতাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা বলতে গিয়ে অনেক সিনিয়র নেতাই তুলে ধরেন তরিকুল ইসলামের ওপর সে নির্যাতনের কথা। কারাভোগের মাধ্যমে রাজনীতিতে পা রেখেছিলেন।
রাজনৈতিক জীবনে মিথ্যা মামলা ও কারাভোগের শিকার হয়েছেন বারবার। যশোরে উদীচী হত্যা মামলা, অধুনালুপ্ত রানার পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল হত্যাকাণ্ডসহ নানা মামলায় আসামির তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে তার নাম। ওয়ান ইলেভেনের সময় অন্য সিনিয়র রাজনীতিকদের মতো গ্রেপ্তার হন তরিকুল ইসলাম। কারাভোগ করেন দীর্ঘ দেড় বছর। মহাজোট সরকারের আমলেও নতুন নতুন মামলার আসামি হয়ে গ্রেপ্তার ও কারাভোগ করেছেন। বিএনপিতে তার প্রভাব ও গুরুত্বের কারণে মামলা ও গ্রেপ্তারে বারবার টার্গেট হয়েছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের।
বিএনপি নেতারা জানান, বিএনপির রাজনীতিতে নেতাকর্মীদের কাছে অত্যন্ত আস্থা ও শ্রদ্ধাভাজন নেতা তরিকুল ইসলাম। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে নানা সময়ে দলের মহাসচিব হিসেবে আলোচিত হয়েছে তার নাম। খোদ চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও তাকে কয়েকবার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে বারবার এড়িয়ে গেছেন তিনি।
১৯৭৩ সালে যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তরিকুল ইসলাম নাম লেখান জনপ্রতিনিধির খাতায়। ১৯৭৮ সালে যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে যশোর সদর আসন থেকে এমপি নির্বাচিত ও ১৯৮১ সালে সড়ক ও রেলপথ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী চরিত্র হলেও ভোটের রাজনীতিতে তার রয়েছে মিশ্র অভিজ্ঞতা। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন তিনি। তবে বিএনপি সরকার গঠন করলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান টেকনোক্র্যাট কোটায়। পরের বছর হন পূর্ণমন্ত্রী।
১৯৯৪ সালের উপ-নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর দায়িত্ব পান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এককালের দুই বন্ধুর মুখোমুখি হন তিনি। বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যাওয়া আলী রেজা রাজু ও জাতীয় পার্টির খালেদুর রহমান টিটোর সঙ্গে লড়ে পরাজিত হন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে আসা টিটো যশোর সদর আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশা করলেও দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা তরিকুলকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয়ার চিন্তাও করেননি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। টিটো রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী আলী রেজা রাজুকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন তরিকুল। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পর্যায়ক্রমে খাদ্য, তথ্য ও সর্বশেষ বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেন। ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ঘুরে আওয়ামী লীগে ঠাঁই নেয়া এককালের বন্ধু খালেদুর রহমান টিটোর কাছে পরাজিত হন তিনি। বিএনপি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় প্রার্থী হননি তিনি।
বিএনপি সরকারের আমলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর মেডিকেল কলেজ, যশোর কারিগরি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ও করোনারি কেয়ার ইউনিট, বিভাগীয় কাস্টমস অফিস, বেনাপোল স্থল বন্দর, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, যশোর মডেল পৌরসভা, আঞ্চলিক পাঠাগার, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপনে। যশোরের শিক্ষা, সামাজিক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সভাপতি ও উপদেষ্টা হিসেবে দশকের পর দশক দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতির পাশাপাশি যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার প্রকাশক তিনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম ও তার রাজনৈতিক দুই বন্ধুকে নিয়ে রয়েছে এক অম্ল-মধুর গল্প। তরিকুল ইসলাম, আলী রেজা রাজু ও খালেদুর রহমান টিটো। তিনজনই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতির ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মহিমায় সমুজ্জ্বল। স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন সকলে। চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলর হিসেবে তিনজনই দায়িত্ব পালন করেছেন বৃটিশ ভারতের প্রথম পৌরসভা যশোরে। যশোরের উন্নয়নে তিন বন্ধুর রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। পাকিস্তানবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তাদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই তিন বন্ধুর রয়েছে অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তারা জাতির ক্রান্তিলগ্নে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমে তিন বন্ধু এক পতাকাতলে থাকলেও সময়ের ব্যবধানে তারা প্রত্যেকেই হয়েছেন পৃথক রাজনীতির অগ্রপথিক। ভাসানী ন্যাপ থেকে বিএনপিতে এসেছিলেন তরিকুল ও রাজু কিন্তু পরে রাজু চলে যান আওয়ামী লীগে। টিটো জাতীয় পার্টি ঘুরে বিএনপিতে এলেও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে থিতু হতে পারেননি। কেবল প্রথম থেকেই নিঃশঙ্ক ও অবিচল রয়ে গেছেন তরিকুল ইসলাম।
বরেণ্য রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম ১৯৪৬ সালের ১৬ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন যশোর শহরে। তার পিতা আলহাজ আবদুল আজিজ ছিলেন যশোর শহরের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। মা মোসাম্মৎ নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। পারিবারিক পরিবেশে বাল্যশিক্ষার মাধ্যমে পড়ালেখায় হাতেখড়ি হয় তার। ১৯৫৩ সালে তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন যশোর জিলা স্কুলে। ১৯৬১ সালে জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা, ১৯৬৩ সালে এমএম কলেজ থেকে আইএ, ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ও ১৯৬৯ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি দুই ছেলের পিতা। তার স্ত্রী প্রফেসর নার্গিস ইসলাম যশোর সরকারি সিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে যান ২০০৫-২০০৬ সালে। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নার্গিস ইসলাম চারদশক ধরে বিএনপির রাজনীতিতে নেপথ্যে ভূমিকা রেখে চলেছেন। কখনও পদপদবি না নিলেও জেলা বিএনপির নেতা তাকে দিয়েছেন জেলা বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব। তরিকুল ইসলামের বড় ছেলে শান্তনু ইসলাম সুমিত ব্যবসা ও ছোট ছেলে অনিন্দ ইসলাম অমিত রাজনীতি করেন। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত অমিত বর্তমানে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় কারাগারে নেয়ার পর সারা দেশে যে ধরপাকড় হয় তার অন্যতম শিকার ছিলেন তরিকুল ইসলামের দুই ছেলে।
বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, তরিকুল ইসলাম রাজশাহীতে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ছাত্র ইউনিয়নের দক্ষ সংগঠক ও ভালো নেতা ছিলেন। তিনি সম্ভবত হক সাহেবের (কমরেড আবদুল হক) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত হন। তবে, ন্যাপে খুব সক্রিয় কোনো ভূমিকায় তাকে দেখিনি। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। তার স্ত্রী নার্গিস ইসলাম ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এর বেশি কিছু জানি না, বলতে পারবো না।
তরিকুল ইসলাম সম্পর্কে ঐক্য ন্যাপ আহ্বায়ক ও প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ছাত্রজীবনে তরিকুল ইসলাম ছাত্র ইউনিয়ন করতেন এবং যশোর এমএম কলেজের নির্বাচিত জিএস ছিলেন। সিনিয়র হিসেবে তিনি আমাকে মানতেন এবং আমরা পরস্পরকে সম্মান করতাম। ১৯৬৫ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে দশম সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হয়। মেনন গ্রুপের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন তিনি। পরে ভাসানী ন্যাপ হয়ে বিএনপির জন্মলগ্নেই দলটির রাজনীতিতে যুক্ত হন।
তরিকুল ইসলামকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি হিসেবে একাধিক মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তরিকুল ইসলাম। কিন্তু সবসময় তার জীবনযাত্রা ছিল খুবই সাধারণ। আঙুল ফুলে কলাগাছ হননি, তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগও উঠেনি। যতদূর দেখেছি, তিনি আগাগোড়াই গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত একজন নেতা। নির্বাচনী এলাকার মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা যেমন, জাতীয় রাজনীতিতেও গ্রহণযোগ্য একজন। সার্বিকভাবে জনবান্ধব, সজ্জ্বন ও মার্জিত চরিত্রের একজন রাজনীতিক তিনি।
বাংলাদেশে বামরাজনীতির অন্যতম প্রাণপুরুষ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হায়দার আকবর খান রনো বলেন, প্রগতিশীল রাজনীতির ভেতর দিয়েই রাজনীতিক তরিকুল ইসলামের জন্ম ও উন্মেষ। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের অত্যন্ত দক্ষ একজন সংগঠক ছিলেন। পরে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের রাজনীতি করেছেন। বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই এ দলটির রাজনীতিতে যুক্ত রয়েছেন। আপনি পছন্দ করেন আর না করেন, বিএনপির রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে ও প্রগতিশীল চিন্তার একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বিএনপির বর্তমান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানসহ যে কয়েকজন প্রগতিশীল চিন্তার নেতা রয়েছেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য হচ্ছেন তরিকুল।
রনো বলেন, একজন রাজনীতিবিদের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি। আমার বিবেচনায় তরিকুল ইসলাম গণমানুষের নেতা। জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক গভীর। আমি নিজে দেখেছি, তার যশোর অঞ্চলসহ সারা দেশের বহু নেতাকর্মী ও মানুষকে সে বাইনেম চেনেন। খুব কম নেতা এ যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। রাজনৈতিক মানসিকতা, সামাজিকতা, জীবনাচারসহ সার্বিকভাবে আমি উনাকে একজন ইতিবাচক রাজনীতিক মনে করি।
চলাফেরায় অক্ষমতার কারণে ঘরবন্দি হয়ে পড়েছেন। কথা বলতেও কষ্ট হয় তার। বর্তমানে তার সময় কাটে সোফায় অলস শুয়ে-বসে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে নীতিনির্ধারক ফোরামের বৈঠকেও অংশ নিতে পারেন না। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার দুদিন আগে সর্বশেষ দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। বর্তমানে বাসা থেকে বের হন কেবল হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজনে। যদিও সামপ্রতিক বছরগুলোতে বাসার চেয়ে হাসপাতালেই বেশি সময় কেটেছে বর্ষীয়ান এ নেতার। চিকিৎসকদের পরামর্শে গত মে-জুন মাসে সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হসপিটালে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি।
তরিকুল ইসলাম দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। প্রতিদিন ঘুমোতে যান রাত ১১টার পর। যেদিন কিডনি ডায়ালাইসিস থাকে সেদিন ঘুম থেকে উঠতে হয় ভোর ৬টায়। অন্যদিনগুলোতে কিছুটা দেরিতে বিছানা ছাড়েন। সকালে ঘুম থেকে উঠে হালকা নাস্তা ও ওষুধ খাবার পর ড্রয়িং রুমের সোফায় গিয়ে বসেন। আগে নিয়মিত পত্রিকা পড়লেও এখন পারেন না। পরিবারের সদস্যরা সংবাদের শিরোনাম ও বিশেষ দুয়েকটি সংবাদ পড়ে শোনান। তারপর বাসায় আসা নেতাকর্মী বা শুভাকাঙক্ষীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটান। কথা বলতে যেমন কষ্ট হয়, তেমনি টানা বসেও থাকতে পারেন না। দুপুরে খাবার ও ওষুধ সেবনের পর বিশ্রাম নেন কিছুক্ষণ। শরীর ভালো লাগলে বিকালে কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখেন। সন্ধ্যার পর সারা দেশ থেকে আসা নেতাকর্মীদের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক গল্প করেন।
তার ছোট ছেলে অনিন্দ ইসলাম অমিত বলেন, ডায়ালাইসিসের কারণে শরীরে প্রোটিন কমে যায়। বর্জ্যের পাশাপাশি শারীরিক নানা উপাদান বেরিয়ে যায়। ফলে তার পুষ্টিকর খাবার প্রয়োজন। কিন্তু তার খাবার রুচি থাকে না প্রায়। তিনি খাবার খান বেঁচে থাকার তাগিদে, ওষুধ সেবনের নিয়মরক্ষার প্রয়োজনে। খাবার খাওয়াতে হয় জোর করে। খাবারের সময় হলে এবং তাগিদ দেয়া হলে তিনি বিরক্ত হন। অমিত জানান, রেড মিটসহ দুধ ও দুগ্ধজাত সবধরনের খাবারে নিষেধ রয়েছে চিকিৎসকের। নিষেধ রয়েছে পটাশিয়াম ও ফসফেট প্রধান ফলমূল এবং শাক-সবজির ক্ষেত্রেও। খাবারে নিয়ন্ত্রণ বেড়েছে ডায়াবেটিস ও সমপ্রতি ফুসফুস ক্যানসার ধরা পড়ার পর। সবচেয়ে জটিলতা হচ্ছে তার পানি পান নিয়ে। চিকিৎসকরা বলে দিয়েছেন, ওষুধ সেবন, চা-কফি ও তরকারির ঝোলসহ সবমিলিয়ে প্রতিদিন ৭৫০ মি.লি’র বেশি পানি পান করতে পারবেন না। দিনে ১০-১২ রকমের অন্তত ৩০টির মতো ওষুধ সেবন করতে হয়। ফলে কঠিন হয়ে পড়ে পানি পানের রেস্ট্রিকশনটি সবসময় মেনে চলা।
তরিকুল ইসলামের পারিবারিক সূত্র জানায়, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নিয়মিত খোঁজখবর রাখেন। মাঝে মাঝেই তার বাসায় ছুটে আসেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে নিজ এলাকা যশোরসহ সারাদেশ থেকে প্রতিদিনই তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন নানা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। বাসায় আগত রাজনৈতিক সহকর্মীসহ তৃণমূল নেতাকর্মীদের কথা শোনেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার মতো শারীরিক সামর্থ্য নেই তার। নেতাকর্মীরা পরামর্শ চাইলে দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা থেকে তাদের সাহস যোগান, ধৈর্য ধারণ ও কৌশলী হওয়ার পরামর্শ দেন।
১৯৬২ সালের কথা। তরিকুল ইসলাম তখন যশোর এমএম কলেজের শিক্ষার্থী। যশোর শহরের শহীদ মিনারটি ছিল ভাঙাচোরা। তরিকুল ইসলাম ও তার বন্ধু ও সহপাঠীরা একটি শহীদ মিনার তৈরি করেছিলেন। তৎকালীন পাকিস্তান সামরিক সরকারের রোষানলে পড়ে গ্রেপ্তার হন তরিকুল। কারাগারে কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পরিচয় হলো তার। কারাগারেই দীক্ষা নেন বাম রাজনীতির। ১৯৬৩-৬৪ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী হিসেবে যশোর এমএম কলেজ ছাত্র সংসদের জিএস নির্বাচিত হন। বৃহত্তর যশোর জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবে সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তৎকালীন এমএনএ আহম্মদ আলী সর্দারের দায়েরকৃত মিথ্যা মামলায় কিছুদিন কারাভোগ করেন। ১৯৬৮ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের জন্য রাজবন্দি হিসেবে যশোর ও রাজশাহীতে কারাভোগ করেন দীর্ঘ নয় মাস। ১৯৬৯ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ায় গ্রেপ্তার হন।
পরে কমিউনিস্ট পার্টির নীতি-আদর্শের সঙ্গে পুরোপুরি একমত হতে না পেরে বেছে নেন নতুন পথ। ১৯৭০ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ভাসানী আহূত ফারাক্কা লং মার্চেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তিনি। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে কথা বলে যেমন কারাভোগ করেছেন, দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী হিসেবেও তাকে যেতে হয়েছে জেলে।
ভাসানী ন্যাপ থেকে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল (জাগদল) হয়ে বিএনপির রাজনীতিতে যুক্ত হন বরেণ্য এ রাজনীতিক। জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির ৭৬ সদস্যবিশিষ্ট প্রথম আহ্বায়ক কমিটির অন্যতম সদস্য তরিকুল ইসলাম। সেই সঙ্গে বিএনপির যশোর জেলা আহ্বায়কের দায়িত্ব পান। ১৯৮০ সালে জাতীয়তাবাদী দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। পরে পর্যায়ক্রমে তিনি দলের যুগ্ম মহাসচিব, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব, ভাইস চেয়ারম্যান ও ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত দলের পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিলে স্থায়ী কমিটির সদস্য পদে পদোন্নতি পান।
রাজনীতিতে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছাতে তরিকুল ইসলামকে মাড়িয়ে আসতে হয়েছে কাঁটা বিছানো পথ। রাজনীতিতে দৃঢ়চেতা এ নেতা স্বৈরাচার এরশাদ আমলে গ্রেপ্তারের পর তিন মাস অজ্ঞাতস্থানে আটক ছিলেন। পরে তাকে এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। শিকার হন নিষ্ঠুর নির্যাতনের। রাজনীতিতে বিএনপি নেতাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা বলতে গিয়ে অনেক সিনিয়র নেতাই তুলে ধরেন তরিকুল ইসলামের ওপর সে নির্যাতনের কথা। কারাভোগের মাধ্যমে রাজনীতিতে পা রেখেছিলেন।
রাজনৈতিক জীবনে মিথ্যা মামলা ও কারাভোগের শিকার হয়েছেন বারবার। যশোরে উদীচী হত্যা মামলা, অধুনালুপ্ত রানার পত্রিকার সম্পাদক সাইফুল আলম মুকুল হত্যাকাণ্ডসহ নানা মামলায় আসামির তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে তার নাম। ওয়ান ইলেভেনের সময় অন্য সিনিয়র রাজনীতিকদের মতো গ্রেপ্তার হন তরিকুল ইসলাম। কারাভোগ করেন দীর্ঘ দেড় বছর। মহাজোট সরকারের আমলেও নতুন নতুন মামলার আসামি হয়ে গ্রেপ্তার ও কারাভোগ করেছেন। বিএনপিতে তার প্রভাব ও গুরুত্বের কারণে মামলা ও গ্রেপ্তারে বারবার টার্গেট হয়েছেন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের।
বিএনপি নেতারা জানান, বিএনপির রাজনীতিতে নেতাকর্মীদের কাছে অত্যন্ত আস্থা ও শ্রদ্ধাভাজন নেতা তরিকুল ইসলাম। ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে নানা সময়ে দলের মহাসচিব হিসেবে আলোচিত হয়েছে তার নাম। খোদ চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াও তাকে কয়েকবার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে বারবার এড়িয়ে গেছেন তিনি।
১৯৭৩ সালে যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে তরিকুল ইসলাম নাম লেখান জনপ্রতিনিধির খাতায়। ১৯৭৮ সালে যশোর পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে যশোর সদর আসন থেকে এমপি নির্বাচিত ও ১৯৮১ সালে সড়ক ও রেলপথ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী চরিত্র হলেও ভোটের রাজনীতিতে তার রয়েছে মিশ্র অভিজ্ঞতা। ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন তিনি। তবে বিএনপি সরকার গঠন করলে সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান টেকনোক্র্যাট কোটায়। পরের বছর হন পূর্ণমন্ত্রী।
১৯৯৪ সালের উপ-নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর দায়িত্ব পান ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রীর। ১৯৯৬ সালের সপ্তম জাতীয় নির্বাচনে প্রথমবারের মতো এককালের দুই বন্ধুর মুখোমুখি হন তিনি। বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যাওয়া আলী রেজা রাজু ও জাতীয় পার্টির খালেদুর রহমান টিটোর সঙ্গে লড়ে পরাজিত হন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে আসা টিটো যশোর সদর আসন থেকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশা করলেও দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা তরিকুলকে বাদ দিয়ে অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয়ার চিন্তাও করেননি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। টিটো রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয় হলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী আলী রেজা রাজুকে বিপুল ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে এমপি নির্বাচিত হন তরিকুল। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে পর্যায়ক্রমে খাদ্য, তথ্য ও সর্বশেষ বন ও পরিবেশমন্ত্রীর দায়িত্বপালন করেন। ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী ২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে জাতীয় পার্টি, বিএনপি ঘুরে আওয়ামী লীগে ঠাঁই নেয়া এককালের বন্ধু খালেদুর রহমান টিটোর কাছে পরাজিত হন তিনি। বিএনপি ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন করায় প্রার্থী হননি তিনি।
বিএনপি সরকারের আমলে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর মেডিকেল কলেজ, যশোর কারিগরি প্রশিক্ষণ মহাবিদ্যালয়, যশোর ২৫০ শয্যা হাসপাতাল ও করোনারি কেয়ার ইউনিট, বিভাগীয় কাস্টমস অফিস, বেনাপোল স্থল বন্দর, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস, যশোর মডেল পৌরসভা, আঞ্চলিক পাঠাগার, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান স্থাপনে। যশোরের শিক্ষা, সামাজিক, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সভাপতি ও উপদেষ্টা হিসেবে দশকের পর দশক দায়িত্ব পালন করেছেন। রাজনীতির পাশাপাশি যশোর থেকে প্রকাশিত দৈনিক লোকসমাজ পত্রিকার প্রকাশক তিনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে তরিকুল ইসলাম ও তার রাজনৈতিক দুই বন্ধুকে নিয়ে রয়েছে এক অম্ল-মধুর গল্প। তরিকুল ইসলাম, আলী রেজা রাজু ও খালেদুর রহমান টিটো। তিনজনই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের রাজনীতির ইতিহাসে উজ্জ্বল নক্ষত্র। প্রত্যেকেই নিজ নিজ মহিমায় সমুজ্জ্বল। স্থানীয় সরকার থেকে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন সকলে। চেয়ারম্যান বা কাউন্সিলর হিসেবে তিনজনই দায়িত্ব পালন করেছেন বৃটিশ ভারতের প্রথম পৌরসভা যশোরে। যশোরের উন্নয়নে তিন বন্ধুর রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। পাকিস্তানবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে সর্বশেষ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তাদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।
দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই তিন বন্ধুর রয়েছে অসামান্য অবদান। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তারা জাতির ক্রান্তিলগ্নে গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথমে তিন বন্ধু এক পতাকাতলে থাকলেও সময়ের ব্যবধানে তারা প্রত্যেকেই হয়েছেন পৃথক রাজনীতির অগ্রপথিক। ভাসানী ন্যাপ থেকে বিএনপিতে এসেছিলেন তরিকুল ও রাজু কিন্তু পরে রাজু চলে যান আওয়ামী লীগে। টিটো জাতীয় পার্টি ঘুরে বিএনপিতে এলেও জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে থিতু হতে পারেননি। কেবল প্রথম থেকেই নিঃশঙ্ক ও অবিচল রয়ে গেছেন তরিকুল ইসলাম।
বরেণ্য রাজনীতিক তরিকুল ইসলাম ১৯৪৬ সালের ১৬ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন যশোর শহরে। তার পিতা আলহাজ আবদুল আজিজ ছিলেন যশোর শহরের একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। মা মোসাম্মৎ নূরজাহান বেগম ছিলেন গৃহিণী। পারিবারিক পরিবেশে বাল্যশিক্ষার মাধ্যমে পড়ালেখায় হাতেখড়ি হয় তার। ১৯৫৩ সালে তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন যশোর জিলা স্কুলে। ১৯৬১ সালে জিলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা, ১৯৬৩ সালে এমএম কলেজ থেকে আইএ, ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অর্থনীতিতে বিএ (অনার্স) ও ১৯৬৯ সালে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।
পারিবারিক জীবনে তিনি দুই ছেলের পিতা। তার স্ত্রী প্রফেসর নার্গিস ইসলাম যশোর সরকারি সিটি কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে অবসরে যান ২০০৫-২০০৬ সালে। ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নার্গিস ইসলাম চারদশক ধরে বিএনপির রাজনীতিতে নেপথ্যে ভূমিকা রেখে চলেছেন। কখনও পদপদবি না নিলেও জেলা বিএনপির নেতা তাকে দিয়েছেন জেলা বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব। তরিকুল ইসলামের বড় ছেলে শান্তনু ইসলাম সুমিত ব্যবসা ও ছোট ছেলে অনিন্দ ইসলাম অমিত রাজনীতি করেন। ছাত্রজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সঙ্গে যুক্ত অমিত বর্তমানে বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় কারাগারে নেয়ার পর সারা দেশে যে ধরপাকড় হয় তার অন্যতম শিকার ছিলেন তরিকুল ইসলামের দুই ছেলে।
বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, তরিকুল ইসলাম রাজশাহীতে ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। ছাত্র ইউনিয়নের দক্ষ সংগঠক ও ভালো নেতা ছিলেন। তিনি সম্ভবত হক সাহেবের (কমরেড আবদুল হক) সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি ন্যাপের রাজনীতিতে যুক্ত হন। তবে, ন্যাপে খুব সক্রিয় কোনো ভূমিকায় তাকে দেখিনি। পরে বিএনপিতে যোগ দেন। তার স্ত্রী নার্গিস ইসলাম ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। এর বেশি কিছু জানি না, বলতে পারবো না।
তরিকুল ইসলাম সম্পর্কে ঐক্য ন্যাপ আহ্বায়ক ও প্রবীণ রাজনীতিক পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, ছাত্রজীবনে তরিকুল ইসলাম ছাত্র ইউনিয়ন করতেন এবং যশোর এমএম কলেজের নির্বাচিত জিএস ছিলেন। সিনিয়র হিসেবে তিনি আমাকে মানতেন এবং আমরা পরস্পরকে সম্মান করতাম। ১৯৬৫ সালে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে দশম সম্মেলনে ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হয়। মেনন গ্রুপের কেন্দ্রীয় নেতা ছিলেন তিনি। পরে ভাসানী ন্যাপ হয়ে বিএনপির জন্মলগ্নেই দলটির রাজনীতিতে যুক্ত হন।
তরিকুল ইসলামকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, যশোর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি হিসেবে একাধিক মন্ত্রণালয়ের পূর্ণমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তরিকুল ইসলাম। কিন্তু সবসময় তার জীবনযাত্রা ছিল খুবই সাধারণ। আঙুল ফুলে কলাগাছ হননি, তার বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগও উঠেনি। যতদূর দেখেছি, তিনি আগাগোড়াই গণমানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত একজন নেতা। নির্বাচনী এলাকার মানুষের কাছে তার জনপ্রিয়তা যেমন, জাতীয় রাজনীতিতেও গ্রহণযোগ্য একজন। সার্বিকভাবে জনবান্ধব, সজ্জ্বন ও মার্জিত চরিত্রের একজন রাজনীতিক তিনি।
বাংলাদেশে বামরাজনীতির অন্যতম প্রাণপুরুষ ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য হায়দার আকবর খান রনো বলেন, প্রগতিশীল রাজনীতির ভেতর দিয়েই রাজনীতিক তরিকুল ইসলামের জন্ম ও উন্মেষ। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের অত্যন্ত দক্ষ একজন সংগঠক ছিলেন। পরে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের রাজনীতি করেছেন। বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই এ দলটির রাজনীতিতে যুক্ত রয়েছেন। আপনি পছন্দ করেন আর না করেন, বিএনপির রাজনীতিতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে ও প্রগতিশীল চিন্তার একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব। বিএনপির বর্তমান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমানসহ যে কয়েকজন প্রগতিশীল চিন্তার নেতা রয়েছেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য হচ্ছেন তরিকুল।
রনো বলেন, একজন রাজনীতিবিদের সবচেয়ে বড় যোগ্যতা হচ্ছে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি। আমার বিবেচনায় তরিকুল ইসলাম গণমানুষের নেতা। জনগণের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক গভীর। আমি নিজে দেখেছি, তার যশোর অঞ্চলসহ সারা দেশের বহু নেতাকর্মী ও মানুষকে সে বাইনেম চেনেন। খুব কম নেতা এ যোগ্যতা অর্জন করতে পারেন। রাজনৈতিক মানসিকতা, সামাজিকতা, জীবনাচারসহ সার্বিকভাবে আমি উনাকে একজন ইতিবাচক রাজনীতিক মনে করি।
No comments