জেনারেল ওসমানী : মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান রণকৌশলবিদ by মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আস্হাব উদ্দীন, এনডিসি,পিএসসি
দেশের
নারী-পুরুষের জীবন এবং সম্মান বাঁচাতে, নাগরিকের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে,
আমার দেশবাসীকে এগিয়ে আসতে হবে। তাদের ধর্ম, বর্ণ এবং মত যা-ই হোক না কেনো,
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য তাদেরকে রক্ষা করতে হবে।’- এম.এ.জি ওসমানী।
মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। জেনারেল ওসমানী নামে তিনি অধিক পরিচিত থাকলেও মানুষ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় তাঁকে বঙ্গবীর উপাধিতে ভূষিত করে।
বঙ্গবীর ওসমানী মানে একটি যুগের নাম, একটি ইতিহাসের নাম এবং আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের নাম। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে ওসমানী এমন একটি নাম, যে নাম আমরা শ্রদ্ধায়,ভালোবাসায় বারবার গর্বের সঙ্গে স্মরণ করি। ওসমানী এমন এক মহান ব্যক্তি যিনি বাঙালির হৃদয়ে, বাংলাদেশীর মনে চির জাগরুক। তাঁর কর্মের গৌরবের প্রেরণায়, আমরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আদর্শবান হতে পারি। হতে পারি সাহসী ও দেশের জন্য নিবেদিত। তিনি হচ্ছেন দেশের জন্য সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক। তিনি বিজয়ের প্রতীক। সর্বোপরি আশা ও ন্যায়-বিচারের অনুপ্রেরণা।
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল এম.এ.জি. ওসমানী মন্ত্রীর সমমর্যাদায় বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর দূরদর্শি চিন্তা চেতনা ও তেজোদীপ্ত নির্দেশনায় মুক্তিবাহিনীর মধ্যে জেগে ওঠে দেশ মুক্ত করার অমিয় স্পৃহা। তিনি দেশের মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়েছিলেন যুদ্ধ জয়ের। এরই ধারাবাহিকতায় এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এলাকা পরিদর্শন করেন। মূলত সেখানেই পরিকল্পনা করেন, কোথায় কীভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। এজন্য ঘুরে ঘুরে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি, তথ্য সংগ্রহ ও কৌশল আয়ত্ব করেন। এসময় তিনি ভারতীয় সেনানায়কদের সঙ্গে সমন্বয় সভায় মতবিনিময় করেন। একই সময় আমাদের মুক্তিবাহিনীর রণকৌশল ও গঠন প্রক্রিয়া তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। অবশ্য নিয়মিত ও গেরিলা বাহিনীকে দক্ষ করে তুলতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ওসমানী অসামান্য প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। যুদ্ধ চলাকালে প্রদর্শন করেন অভূতপূর্ব সমরকৌশল। তাঁর মেধা ও সামরিক যুদ্ধ কৌশলে শুরু হয় মুজিবনগর সরকারে যুদ্ধ পরিকল্পনা। আμমণ শাণিত করতে সমগ্র বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থা বিবেচনা করে তিনি ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন। প্রতিটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে এক একজন সেনাবাহিনীর অফিসারকে নিযুক্ত করেন। বিভিনড়ব সেক্টর ও বাহিনীর মাঝে সমন্বয় সাধন করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, অস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করা, গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা - প্রভৃতি কাজ দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন ওসমানী। রণনীতির কৌশল হিসেবেই তিনি এ পরিকল্পনা আঁটেন। তাঁর অসীম সাহস আর বিচক্ষণতায় সুনিয়ন্ত্রিত হতে থাকে সেক্টরগুলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল যুদ্ধ পারদর্শী ও সংখ্যায় অনেক বেশি। তাই বঙ্গবীর ওসমানী মাথায় রাখেন এক অভাবনীয় রণকৌশল। তাঁর কৌশল ছিল প্রথমে শত্রুকে নিজেদের ছাউনিতে আটকে রেখে যোগাযোগের সবগুলো মাধ্যম হতে বিচ্ছিনড়ব করে ফেলা। মে মাস পর্যন্ত এ পদ্ধতিতেই যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মে মাসের পর বদলে ফেলেন রণকৌশল। কারণ প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের সৈন্য ছিল কম। এবারে প্রাক্তন ইপিআর এর বাঙালি সদস্য, আনসার, মোজাহেদ,
পুলিশ বাহিনী ও যুবকদের নিয়ে গঠন করেন গেরিলাবাহিনী। যুদ্ধকালীন মাঝামাঝি সময়ে তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা সদস্যদের নিয়ে গঠন করেন নিয়মিত বাহিনী। তাদের কমান্ডারদের নামানুসারে নামকরণ করা হয় ‘এস’, ‘জেড’, এবং ‘কে’ ফোর্স। কিছুদিন পর তিনি কিছু সংখ্যক প্রাক্তন নৌ সদস্য ও গেরিলা যুবক নিয়ে একটি নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করেন। আগস্টের মাঝামাঝিতে তাঁরা নদীপথে শত্রুর চলাচল প্রায় রুদ্ধ করে দেন। নৌবাহিনী গঠনের পরও বিমানবাহিনী অভাব অনুভব করেন। শেষের দিকে দুটি হেলিকপ্টার, ও একটি অটার আর তাঁর নিজের চলাচলের জন্য একটি ডাকোটা নিয়ে ছোট্ট একটি বিমানবাহিনীও গঠন করেন।
জেনারেল ওসমানী ছিলেন এমন একজন দৃঢ়চেতা সামরিক রণকৌশলবিদ, তিনি মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে মুক্তিপাগল জনগনকে যুদ্ধ জয়ের স্বাদ এনে দিয়েছিলেন। যুদ্ধে তাঁর অন্যতম ফলপ্রসূ কৌশল ছিল, শত্রুকে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত রাখা। আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত করে তোলা। এজন্য নিয়মিত বাহিনী দিয়ে তিনি শত্রুদের বিস্তৃত এলাকায় নিয়োজিত রেখে দুর্বল করে দিতেন। প্রথমদিকে ভারতীয় সমরবিদদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ কৌশলের কিছু দ্বিমত থাকলেও জেনারেল ওসমানী পরবর্তী সময়ে তা সমন্বিত করে নেন। এটাও তাঁর নেতৃত্বের কারিশমা। তাঁর সামরিক চিন্তা চেতনা ছিল, বাঙালি নিয়মিত বাহিনী ও গেরিলা বাহিনী দিয়ে বাংলাদেশের যেকোন একটি নির্দিষ্ট জায়গা দখল পূর্বক মুজিবনগর সরকারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক পরিচিতি এনে দেওয়া। এ লক্ষে তিনি যত বেশি সম্ভব গেরিলা বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরে রাখেন। এখানে তিনি ‘হিট এন্ড রান ’ নীতে গ্রহণ করেন। এতে আমাদের বাহিনী কম হতাহত হত। অপরদিকে শত্রু পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণ যেত বেশি। শত্রুরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত এ রকম আকস্মিক আঘাতে। এ ছাড়া দেশের ভেতরের বিভিনড়ব পাওয়ার স্টেশন, রেললাইন, স্টোরেজ ডিপো, ব্রিজ, কালভার্টসহ যোগাযোগের সকল মাধ্যম গেরিলা বাহিনী দিয়ে ধ্বংস করে দিতেন। আর এভাবেই তিনি শত্রুর অর্থনৈতিক ও মানসিক শক্তি দুর্বল করে দিতে পেরেছিলেন। মুক্তিবাহিনীর অনিয়মতি যুদ্ধ কৌশল ও নিয়মিত বাহিনীর কনভেনশনাল যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী অনেকাংশে দুর্বল ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যা মিত্রবাহিনীর অভিযানকে ত্বরান্বিত ও সাফল্য এনে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর মতো নীতিবোধ, মানবিক গুণাবলী আর সামরিক বিদ্যায় উচ্চ শিক্ষিত জাতীয় নেতা আর কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীতে উচ্চ শিক্ষায়, রণকৌশলে,ব্যক্তিত্বে ও সেবার মানসিকতায় সবার সেরা। তিনি ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারঙ্গম। দেশের প্রতি অসীম মমতা তিনি সর্বদা হৃদয়ে লালন করতেন। স্বাধীন দেশে সব সময় তিনি তাঁর নীতিতে অটল থেকেছেন। সময়ের প্রয়োজনে দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। নিস্বার্থভাবে জনগনের মঙ্গলের জন্য যা ভালো মনে করেছেন তা করেছেন। তিনি দেশের জন্য সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে কভু পিছ পা হননি। শুধু মুক্তিযুদ্ধে নয়, বঙ্গবীর ওসমানী আজীবন নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে দেশকে ভালোবেসে গেছেন।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা
মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি ছিলেন। জেনারেল ওসমানী নামে তিনি অধিক পরিচিত থাকলেও মানুষ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় তাঁকে বঙ্গবীর উপাধিতে ভূষিত করে।
বঙ্গবীর ওসমানী মানে একটি যুগের নাম, একটি ইতিহাসের নাম এবং আমাদের জাতীয় ইতিহাসের একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের নাম। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে ওসমানী এমন একটি নাম, যে নাম আমরা শ্রদ্ধায়,ভালোবাসায় বারবার গর্বের সঙ্গে স্মরণ করি। ওসমানী এমন এক মহান ব্যক্তি যিনি বাঙালির হৃদয়ে, বাংলাদেশীর মনে চির জাগরুক। তাঁর কর্মের গৌরবের প্রেরণায়, আমরা দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আদর্শবান হতে পারি। হতে পারি সাহসী ও দেশের জন্য নিবেদিত। তিনি হচ্ছেন দেশের জন্য সংগ্রামের মূর্ত প্রতীক। তিনি বিজয়ের প্রতীক। সর্বোপরি আশা ও ন্যায়-বিচারের অনুপ্রেরণা।
১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল এম.এ.জি. ওসমানী মন্ত্রীর সমমর্যাদায় বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রধান সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর দূরদর্শি চিন্তা চেতনা ও তেজোদীপ্ত নির্দেশনায় মুক্তিবাহিনীর মধ্যে জেগে ওঠে দেশ মুক্ত করার অমিয় স্পৃহা। তিনি দেশের মুক্তির জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়েছিলেন যুদ্ধ জয়ের। এরই ধারাবাহিকতায় এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ এলাকা পরিদর্শন করেন। মূলত সেখানেই পরিকল্পনা করেন, কোথায় কীভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। এজন্য ঘুরে ঘুরে যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি, তথ্য সংগ্রহ ও কৌশল আয়ত্ব করেন। এসময় তিনি ভারতীয় সেনানায়কদের সঙ্গে সমন্বয় সভায় মতবিনিময় করেন। একই সময় আমাদের মুক্তিবাহিনীর রণকৌশল ও গঠন প্রক্রিয়া তৈরিতে মনোনিবেশ করেন। অবশ্য নিয়মিত ও গেরিলা বাহিনীকে দক্ষ করে তুলতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণ করে। গঠিত হয় মুজিবনগর সরকার। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ওসমানী অসামান্য প্রজ্ঞার পরিচয় দেন। যুদ্ধ চলাকালে প্রদর্শন করেন অভূতপূর্ব সমরকৌশল। তাঁর মেধা ও সামরিক যুদ্ধ কৌশলে শুরু হয় মুজিবনগর সরকারে যুদ্ধ পরিকল্পনা। আμমণ শাণিত করতে সমগ্র বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থা বিবেচনা করে তিনি ১১টি সেক্টরে ভাগ করেন। প্রতিটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে এক একজন সেনাবাহিনীর অফিসারকে নিযুক্ত করেন। বিভিনড়ব সেক্টর ও বাহিনীর মাঝে সমন্বয় সাধন করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, অস্ত্রের যোগান নিশ্চিত করা, গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা - প্রভৃতি কাজ দক্ষতা ও সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন ওসমানী। রণনীতির কৌশল হিসেবেই তিনি এ পরিকল্পনা আঁটেন। তাঁর অসীম সাহস আর বিচক্ষণতায় সুনিয়ন্ত্রিত হতে থাকে সেক্টরগুলো। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ছিল যুদ্ধ পারদর্শী ও সংখ্যায় অনেক বেশি। তাই বঙ্গবীর ওসমানী মাথায় রাখেন এক অভাবনীয় রণকৌশল। তাঁর কৌশল ছিল প্রথমে শত্রুকে নিজেদের ছাউনিতে আটকে রেখে যোগাযোগের সবগুলো মাধ্যম হতে বিচ্ছিনড়ব করে ফেলা। মে মাস পর্যন্ত এ পদ্ধতিতেই যুদ্ধ পরিচালনা করেন। মে মাসের পর বদলে ফেলেন রণকৌশল। কারণ প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের সৈন্য ছিল কম। এবারে প্রাক্তন ইপিআর এর বাঙালি সদস্য, আনসার, মোজাহেদ,
পুলিশ বাহিনী ও যুবকদের নিয়ে গঠন করেন গেরিলাবাহিনী। যুদ্ধকালীন মাঝামাঝি সময়ে তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা সদস্যদের নিয়ে গঠন করেন নিয়মিত বাহিনী। তাদের কমান্ডারদের নামানুসারে নামকরণ করা হয় ‘এস’, ‘জেড’, এবং ‘কে’ ফোর্স। কিছুদিন পর তিনি কিছু সংখ্যক প্রাক্তন নৌ সদস্য ও গেরিলা যুবক নিয়ে একটি নৌ-কমান্ডো বাহিনী গঠন করেন। আগস্টের মাঝামাঝিতে তাঁরা নদীপথে শত্রুর চলাচল প্রায় রুদ্ধ করে দেন। নৌবাহিনী গঠনের পরও বিমানবাহিনী অভাব অনুভব করেন। শেষের দিকে দুটি হেলিকপ্টার, ও একটি অটার আর তাঁর নিজের চলাচলের জন্য একটি ডাকোটা নিয়ে ছোট্ট একটি বিমানবাহিনীও গঠন করেন।
জেনারেল ওসমানী ছিলেন এমন একজন দৃঢ়চেতা সামরিক রণকৌশলবিদ, তিনি মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে মুক্তিপাগল জনগনকে যুদ্ধ জয়ের স্বাদ এনে দিয়েছিলেন। যুদ্ধে তাঁর অন্যতম ফলপ্রসূ কৌশল ছিল, শত্রুকে সার্বক্ষণিক ব্যস্ত রাখা। আঘাতে আঘাতে পর্যুদস্ত করে তোলা। এজন্য নিয়মিত বাহিনী দিয়ে তিনি শত্রুদের বিস্তৃত এলাকায় নিয়োজিত রেখে দুর্বল করে দিতেন। প্রথমদিকে ভারতীয় সমরবিদদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ কৌশলের কিছু দ্বিমত থাকলেও জেনারেল ওসমানী পরবর্তী সময়ে তা সমন্বিত করে নেন। এটাও তাঁর নেতৃত্বের কারিশমা। তাঁর সামরিক চিন্তা চেতনা ছিল, বাঙালি নিয়মিত বাহিনী ও গেরিলা বাহিনী দিয়ে বাংলাদেশের যেকোন একটি নির্দিষ্ট জায়গা দখল পূর্বক মুজিবনগর সরকারকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কূটনৈতিক পরিচিতি এনে দেওয়া। এ লক্ষে তিনি যত বেশি সম্ভব গেরিলা বাহিনীকে দেশের অভ্যন্তরে রাখেন। এখানে তিনি ‘হিট এন্ড রান ’ নীতে গ্রহণ করেন। এতে আমাদের বাহিনী কম হতাহত হত। অপরদিকে শত্রু পক্ষের ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণ যেত বেশি। শত্রুরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ত এ রকম আকস্মিক আঘাতে। এ ছাড়া দেশের ভেতরের বিভিনড়ব পাওয়ার স্টেশন, রেললাইন, স্টোরেজ ডিপো, ব্রিজ, কালভার্টসহ যোগাযোগের সকল মাধ্যম গেরিলা বাহিনী দিয়ে ধ্বংস করে দিতেন। আর এভাবেই তিনি শত্রুর অর্থনৈতিক ও মানসিক শক্তি দুর্বল করে দিতে পেরেছিলেন। মুক্তিবাহিনীর অনিয়মতি যুদ্ধ কৌশল ও নিয়মিত বাহিনীর কনভেনশনাল যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে অক্টোবর-নভেম্বরের মধ্যে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনী অনেকাংশে দুর্বল ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যা মিত্রবাহিনীর অভিযানকে ত্বরান্বিত ও সাফল্য এনে দিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী বাহিনী মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সামরিক বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।
যুদ্ধকালীন সময়ে তাঁর মতো নীতিবোধ, মানবিক গুণাবলী আর সামরিক বিদ্যায় উচ্চ শিক্ষিত জাতীয় নেতা আর কেউ ছিলেন না। তিনি ছিলেন সামরিক বাহিনীতে উচ্চ শিক্ষায়, রণকৌশলে,ব্যক্তিত্বে ও সেবার মানসিকতায় সবার সেরা। তিনি ছিলেন প্রত্যুৎপন্নমতি। তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিতে পারঙ্গম। দেশের প্রতি অসীম মমতা তিনি সর্বদা হৃদয়ে লালন করতেন। স্বাধীন দেশে সব সময় তিনি তাঁর নীতিতে অটল থেকেছেন। সময়ের প্রয়োজনে দেশ মাতৃকার ডাকে সাড়া দিয়েছেন। নিস্বার্থভাবে জনগনের মঙ্গলের জন্য যা ভালো মনে করেছেন তা করেছেন। তিনি দেশের জন্য সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে কভু পিছ পা হননি। শুধু মুক্তিযুদ্ধে নয়, বঙ্গবীর ওসমানী আজীবন নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে দেশকে ভালোবেসে গেছেন।
লেখক : সাবেক রাষ্ট্রদূত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা
No comments