ইরান চুক্তির তিন বছর: উত্তেজনাকর অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র-ইরান প্রভাব পড়বে তেলের বাজারে
যুক্তরাষ্ট্র
ইরানের মধ্যে বিরোধ এক উত্তেজনাকর পর্যায়ে চলে গেছে। এ বছরের ৫ই নভেম্বর
থেকে বিশ্ববাজারে ইরানি তেল রপ্তানি বন্ধ করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। তার
জবাবে পারস্য উপসাগর দিয়ে তেল রপ্তানির রুট হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার
হুমকি দিয়েছে ইরান। এতে বিশ্ববাজারে তেলের সংকট আরো বাড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা
বলছেন, তেহরানের অপ্রত্যাশিত এমন আচরণে বাজারে তেলের সরবরাহে ঘাটতি পড়তে
পারে। তার প্রভাব পড়তে পারে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোতে। এর ফলে তেলের দাম ১০০
ডলার বা তারও বেশি বেড়ে যেতে পারে। এ খবর দিয়েছে রাশিয়ার অনলাইন প্রাভদা।
এতে বলা হয়েছে, বিংশ শতাব্দীতে ইরান তার ভৌগোলিক অবস্থানের সুবিধা ব্যবহার
করেনি কখনও। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে ইরান এই হরমুজ প্রণালী দিয়ে নৌযান চলাচল
নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ১৯৭৩ সালের ৬ই অক্টোবর শুরু হয়েছিল ইয়োক কিপ্পুর
যুদ্ধ। সেই যুদ্ধের সময় পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে তেল সরবরাহের বিরুদ্ধে মিশর ও
সিরিয়াসহ ওএপিইসিভুক্ত সব আরব সদস্য দেশ নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। আর তাতে
সমর্থন ছিল ইসরাইলের। ওই সময় ১৯৭৩ সালের ১৭ই অক্টোবর তেহরানের সামনে এমন
একটি সুযোগ এসেছিল। তখন আরব দুনিয়ার সঙ্গে ছিল ইসরাইল। সামরিক সংঘাতের মুখে
তেহরান ছিল নিরপেক্ষ। কারণ, ওই সময় ইরানে ক্ষমতাসীন শাহ শাসকগোষ্ঠী ছিল
ওয়াশিংটনের সামরিক ও রাজনৈতিক মিত্র। কিন্তু ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবের
পরে সেই পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে পাল্টে যায়। ১৯৭৯ সালে ইসলামিক বিপ্লবে রেজা
শাহ পাহলভি ক্ষমতা হারিয়ে পালিয়ে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ইরানে ক্ষমতায় আসে
নতুন সরকার। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। তারা এ
দেশটিকে প্রধান শত্রু হিসেবে ঘোষণা দেয়। এরপর ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত
যুদ্ধ হয় ইরান ও ইরাকের মধ্যে। তখন প্রথমবারের মতো হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে
দেয়ার হুমকি দেয় তেহরান। কিন্তু পারস্য উপসাগরে যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করে
ইরানকে এক্ষেত্রে বিরত রাখে পেন্টাগন। ওই যুদ্ধজাহাজ এমন অবস্থানে রাখা হয়
যাতে যেকোনো সময় সেখান থেকে ইরানের নৌবাহিনীর ওপর হামলা চালাতে প্রস্তুত
থাকে তারা। বর্তমানে হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছে ইরানের
প্রশাসন। এরই প্রেক্ষিতে পারস্য উপসাগরে সতর্কতামূলকভাবে মহড়া দিয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ আব্রাহাম লিঙ্কন। এর মধ্য দিয়ে
তেহরানকে দ্ব্যর্থহীন এক বার্তা পাঠিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তা হলো: হরমুজ
প্রণালী দিয়ে মুক্তভাবে জাহাজ চলাচল যদি বন্ধ করার চেষ্টা করে ইরান তাহলে
যুদ্ধ অপরিহার্য। ১৯৮২ সালের জাতিসংঘ কনভেনশন অন দ্য ল অব দ্য সি- অনুযায়ী
আন্তর্জাতিক পানিপথ হিসেবে একটি মর্যাদা আছে হরমুল প্রণালীর। এর আশেপাশে
যেসব দেশ আছে তাদের কারো এখান দিয়ে কোনো নৌযান বা ট্যাংকার চলাচলে
বিধিনিষেধ দেয়ার অধিকার নেই। বিশ্লেষকরা মনে করেন, তেহরানের কাছ থেকে ভয়াবহ
বিবৃতি পাওয়া সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে উত্তেজনাকর করে
তুলতে চায় না ইরান। এরই মধ্যে ইরান কূটনৈতিক সফলতাকে উদযাপন করেছে। কারণ,
এর আগে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যকার বজ্রকঠিন সম্পর্কে ভেঙে
দিতে সক্ষম হয়েছে তেহরান। সার্বিয়া, ইরাক, লিবিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের বোমা
হামলার সময়ে ইউরোপীয়ান ন্যাটোর অংশীদাররা ওয়াশিংটনের কর্মকাণ্ডের পূর্ণাঙ্গ
সমর্থন দিয়েছিল। ২০১৫ সালে সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তিকে প্রত্যাহার করে
নেয়ার ঘোষণা দেন ডনাল্ড ট্রাম্প এ বছরের ৮ই মে। তখন প্রথমবারের মতো কয়েক
দশকের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যায় ইউরোপিয়ান দেশগুলো।
তারা ওয়াশিংটনের বিরুদ্ধে একীভূত ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করে। ইরানের সঙ্গে
সম্পাদিত পারমাণবিক চুক্তি রক্ষা করা নিয়ে ভিয়েনাতে গত ৬ই জুলাই ইউরোপীয়
ইউনিয়ন, রাশিয়া ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের এক বৈঠক হয়। এতে
যুক্তরাষ্ট্রকে আমন্ত্রণ না জানানোর মনোভাব প্রকাশ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত
দেশগুলো। ওই সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা ইরানকে একঘরে করে ফেলার ডনাল্ড
ট্রাম্পের নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা তেহরানের সঙ্গে ব্যবসা ও
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিস্তৃত করার খায়েস প্রকাশ করেন। বিশ্লেষকদের মতে,
বর্তমান পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও চীন কাজ করছে ইরানের মিত্র
হিসেবে। তাই তেহরান এবার ওয়াশিংটনকে একটি যুদ্ধের হুমকিতে ছেড়ে দেবে বলে
মনে হয় না। এক্ষেত্রে তারা হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দেয়ার যে হুমকি দিয়েছে
তা যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি বড় পাল্টা হুমকি।
No comments