আশেপাশে আছে ধর্ষক, হত্যাকারী! by মনিজা রহমান
জানেন, ফেসবুকে কেউ যখন আমার ছবি দেখে ‘নাইস’ ‘সুন্দর লাগছে’ ‘দারুণ লাগছে’ লেখেন, আমার না খুব ভালো লাগে। আমি যেন আমার হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। হাসবেন না প্লিজ। এটা একদম সত্যি। বাংলাদেশে থাকার সময় এসব নিয়ে মাথা ঘামাতাম না। কিন্তু নিউ ইয়র্কে আসার পরে প্রথম প্রথম মনে হতো আমার মতো কুৎসিত প্রাণী মনে হয় প্রথিবীতে নেই।
কারণটা কি ?
কেউ আমার দিকে তাকায় না। চোখে চোখ পড়ে না কারো। কেউ অপাঙ্গে দেখে নেয় না শরীরের মাপ। পাশ দিয়ে যাবার সময় মন্তব্য ছুঁড়ে দেয় না। কেমন যেন খালি খালি লাগতো। ভেবে উঠতে পারতাম না, কীভাবে আমি রাতারাতি এমন বিশ্রী হয়ে গেলাম। সেজে বের হই কিংবা না সেজে প্রতিক্রিয়া দেখি একইরকম। আয়নার সামনে অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে নিজেকে দেখতাম। উত্তর পেতাম না। হঠাৎ করে আমার চেহারায় এমন কি অধপতন হলো যে কেউ একবার ফিরে তাকানোর সময় পায় না।
শৈশব থেকে দেখে এসেছি, অতি স্বাভাবিক বলে জেনে এসেছি, পথেঘাটে বের হলে পুরুষ মানুষ তাকিয়ে থাকে মেয়েদের দিকে। সেই মেয়ে সুন্দর হোক আর অসুন্দর হোক! কেউ এক কাঠি সরস হয়ে মন্তব্য ছুঁড়ে দেয়। কেউ কেউ তো আবার ভিড়ের মধ্যে অন্যরকম সুযোগ খোঁজে।
বাসা থেকে বের হবো তো, প্রথমে দারোয়ান-ড্রাইভার দিয়ে শুরু হয়। তারপর একে একে রাস্তার মোড়ের পান-বিড়ি বিক্রেতা, সবজিওয়ালা, মাছওয়ালা, মুরগি বিক্রেতা, দোকানের কর্মচারী, মুচি, মেথর, রাস্তার ভিখিরি, সুটেড বুটেড ভদ্রলোক, কম বয়সী-বেশি বয়সী সবাই এক পলকের জন্য হলেও তাকাবেই তাকাবে। আমিও সেটা জানতাম। জানতাম বলেই অকারণে চোখ-মুখ শক্ত করে পথ চলতাম। এভাবে চোখ-মুখ শক্ত করে চলতে চলতে চেহারায় বলিরেখা পড়ে যায়। তবু তাদের দৃষ্টির লেহন থেকে মুক্তি নেই !
নিউ ইয়র্কে এসে জানলাম, পুরুষরা নারীদের দিকে তাকায় না। নারীরাও পুরুষদের দিকে তাকায় না। আসলে কেউ কারো দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করে না। সবাই সবাইকে নিয়ে ব্যস্ত। এমন ভাবার কারণ নেই, নিউ ইয়র্কে আমি যেখানে বাস করি, সেখানে সবাই খুব উচ্চশিক্ষিত, অভিজাত সম্প্রদায়ের। আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশীদের মধ্যে সাদা-কালো-এশিয়ান-স্প্যানিশ সবাই আছে।
এখানে স্প্যানিশ মানে স্পেনের নাগরিক নয়, মেক্সিকো, মধ্য আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের মানুষ, যারা স্প্যানিশ ভাষায় কথা বলে তাদেরকে বোঝায়। এরা প্রায় সবাই শ্রমিকশ্রেণির। শিক্ষাদীক্ষায় আমাদের চেয়ে পিছিয়ে। তবে নারীদের সম্মান করতে জানে। ভুলেও ফিরে তাকাবে না আপনার দিকে। আবার কোনো সাহায্য চাইলে নিজের কাজ বাদ দিয়ে ছুটে আসবে।
এখানে যে কেউ কারো দিকে তাকায় না, সেটা বুঝতে আমার কেটে গেছে কয়েক মাস। মনে পড়েছে শৈশবে পড়া সেইসব কাহিনী। অনেক আগে যখন সেবা প্রকাশনীর ওয়েস্টার্ন বই পড়তাম, খুব অবাক হতাম। পাহাড়-বনভূমির মাঝখানে নির্জন প্রান্তরে এক বাড়িতে একা থাকছে একটা মেয়ে। সম্পূর্ণ একা। আউটল’রা হয়ত ওর বাবা কিংবা স্বামী অথবা ভাইকে হত্যা করেছে। কিন্তু ওর চুল পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। আসলে নারীদের অপমান করা কিংবা গায়ে হাত তোলাকে তখন থেকেই মনে করা হতো চরম কাপুরুষোচিত কাজ। যেটা খুব খারাপ মানুষটিও করতো না। ওই মূল্যবোধ এখনও রয়ে গেছে।
আপনি ভাবছেন পোশাকের কথা! আমার বাড়ির ডান দিকে রুজভেল্ট এভিনিউয়ের রাস্তায় সামারের সময় প্রায় অর্ধ উলঙ্গ নারীদের হাঁটতে দেখি। কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। মাঝে মাঝে এমন সুন্দরীদের দেখি যে, তারা মিস ওয়ার্ল্ড কম্পিটিশনে অংশ নেবার মতো, তারা অনায়াসে টেক্কা দিতে পারে যে কোনো হলিউডের নায়িকাকে, তারাও দেখি উপেক্ষিত। কারো মাথাব্যথা নেই কে বিকিনি পরল আর কে বোরকা পরল সেই ভাবনায়।
আমি নিজেও কি অনায়াসে ট্রেনে উঠে দুইজন অপরিচিত পুরুষের মাঝখানের সিটে গিয়ে বসি। এমনকি মাঝে মাঝে ট্রেনের দুলুনিতে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়েও যাই। আমার পাশে কে বসেছে তার চেহারাটা দেখার প্রয়োজন বোধ করি না। অনেক রাতে নাটক দেখে একা বাড়ি ফিরি। নির্জন ফুটপাথ ধরে হাঁটি। একবিন্দু ভয় করে না।
জ্যাকসন হাইটসে অনেক বাঙালি মহিলা হিজাব করেন। সকালে এলাকার ফিটনেস সেন্টার গমগম করতে থাকে তাদের উপস্থিতিতে। ভিন্ন দেশের ভিন্ন সংস্কৃতির পুরুষদের পাশে তারা ট্রেডমিলে দৌড়ান। শরীরের ঘাম ঝরান। এক মুহূর্তের জন্য তাদের বিব্রত মনে হয় না। অথচ বাংলাদেশে থাকলে কি তারা পারতো এভাবে দেশি ভাইদের সঙ্গে একসঙ্গে জিম করতে !
কীভাবে পারবেন? সোহাগী জাহান তনুকে যারা ধর্ষণ করেছে, যারা তাকে হত্যা করেছে, তারা তো এদের মধ্যেই আছে। গিরগিটি যেভাবে ক্যামোফ্লেজ করে, সেভাবে কিছু অমানুষ রঙ পাল্টে মানুষ সেজে ঘুরে বেড়ায়। বিচারহীনতার সংস্কৃতি লালন-পালন করে তাদের। এই সব অমানুষ আর তাদের পৃষ্ঠপোষকতাদানকারীদের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম গালিটাও খুব সামান্য মনে হয়।
সবাইকে নারী দিবসের শুভেচ্ছা।
No comments