মুদ্রানীতির লক্ষ্য পূরণ হবে বলে মনে হয় না
সম্প্রতি ঘোষণা করা হয়েছে নতুন মুদ্রানীতি। তাতে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ, মুদ্রার বিনিময় হারসহ বেশ কিছু বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছে। প্রসঙ্গ হিসেবে এসেছে শেয়ারবাজারও। মুদ্রানীতি ও শেয়ারবাজারের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুজয় মহাজন
প্রথম আলো: নতুন যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: মুদ্রানীতি মূল্যায়ন করতে গেলে সবার আগে দেখতে হবে এ নীতি কোন সূচকগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে এবং সেই সম্পর্কে ওই নীতিতে কী বলা হয়েছে। সাধারণত মুদ্রানীতি দিয়ে তিনটি সূচককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। প্রথমটি হলো সার্বিক মুদ্রা সরবরাহ (বিশেষ করে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ), দ্বিতীয়টি সুদের হার এবং শেষটি হলো মুদ্রার বিনিময় হার। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সার্বিক মুদ্রা সরবরাহের যে লক্ষ্য বা টার্গেট ধরা হয়েছে (সাড়ে ১৫ শতাংশ) তা গ্রহণযোগ্য। কারণ এ লক্ষ্য অর্জিত হলে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি (৭ দশমিক ২ শতাংশ) ও মূল্যস্ফীতির (৫ দশমিক ৮) লক্ষ্যপূরণের পরও উদ্বৃত্ত থাকবে।
প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন মুদ্রা সরবরাহসহ মুদ্রানীতিতে ঘোষিত অন্যান্য লক্ষ্য পূরণ হবে?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: গত বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তথ্য তাতে দেখা যাচ্ছে মুদ্রা সরবরাহ পরিস্থিতি নির্ধারিত লক্ষ্যের নিচে রয়েছে। সার্বিক মুদ্রা সরবরাহ ও বেসরকারি ঋণপ্রবাহের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। সাম্প্রতিক বাস্তবতায় আমার মনে হয় না মুদ্রানীতিতে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে তা পূরণ হবে। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী সুদের হার (রেপো ও রিভার্স রেপো) অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে অতি তারল্য রয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। ঋণের চাহিদা বাড়াতে হলে সুদের হার কমাতে হবে। যদিও সম্প্রতি ঋণের সুদ হার কিছুটা কমেছে, তবে তার পাশাপাশি আমানতের সুদও কমেছে। কিন্তু ঋণ-আমানতের সুদ হারের ব্যবধান কমেনি। আমানতকারীদের সুদের হার বজায় রেখে ঋণের সুদ কমাতে হবে। এ ব্যাপারে মুদ্রানীতিতে কোনো ঘোষণা ও উদ্যোগ দেখা যায়নি। ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হওয়াও ঋণের সুদ হার না কমার একটি বড় কারণ। ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু বলছে না। তবে অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে একীভূতকরণ বা মার্জার আইনের কথা বলেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কতটা সফল হবেন, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ নতুন ব্যাংক দেওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া মার্জার আইন পাস করাও সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। আর এ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমি আশাবাদী নই।
প্রথম আলো: আমরা তো জানি, মন্দ ঋণ বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তা কি সুদের হারে প্রভাব ফেলছে না?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমাদের শ্রেণিকৃত ঋণ বা খেলাপি ঋণের হার অনেক বেশি। ক্রমশ এটা বেড়ে চলেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট বিতরণ করা ঋণের ৮.৮ শতাংশ। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৩৪ শতাংশ। খেলাপি ঋণের হার কমাতে হলে ব্যাংকগুলোর নিজেদের ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে ঋণ প্রস্তাব ঠিকমতো মূল্যায়ন করা, জামানতের মূল্যায়ন ঠিক আছে কি না, ঋণ বিতরণের পর ঋণের সঠিক ব্যবহার যাচাইয়ে নিয়মিত তদারকি এবং খেলাপি হয়ে গেলে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া ও তার দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এসব বিষয়ে মুদ্রানীতিতে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। তাই আমার মনে হয়, মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। একই কারণে সুদের হারও খুবই কমবে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: মুদ্রানীতিতে মুদ্রার বিনিময় হারের বিষয়ে যা বলা হয়েছে সেটিকে যথাযথ মনে করেন কি?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বেশ কিছুদিন ধরে আমরা দেখছি মার্কিন ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। তবে ডলারের বৈশ্বিক ঝুঁকি রয়েছে। সেই বিষয়ে মুদ্রানীতিতে খুব বেশি আলোচনা নেই। আমার মতে, ব্রেক্সিট এবং ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর যেসব সংকেত পাওয়া যাচ্ছে তার ফলে ডলারের বিপরীতে পাউন্ড ও ইউরোর মানের অবমূল্যায়ন হবে। কাজেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান যদি একই রকম থাকে তারপরও পাউন্ড ও ইউরোর বিপরীতে টাকার মান বাড়বে। সেটা রপ্তানি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গত ছয় মাসে রপ্তানি খাতে আমেরিকার বাজারে ১১ শতাংশের মতো ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সার্বিকভাবে গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ৪.৪৪ শতাংশ। আগের বছর এই সময়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৮৪ শতাংশ। এ অবস্থায় মুদ্রানীতিতে মুদ্রার বিনিময় হার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘ফ্লেক্সিবল’ নীতি অনুসরণ করা হবে। কিন্তু ফ্লেক্সিবলের বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি। আমি মনে করি এই মুহূর্তে ডলারের বিপরীতে আমাদের মুদ্রা বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন করা উচিত। অনেক অর্থনীতিবিদ বলে থাকেন আমাদের দেশে শুধু ডলারের ভিত্তিতে হিসাব না করে ‘প্রকৃত কার্যকর মুদ্রা বিনিময়’ ব্যবস্থায় যাওয়া উচিত। আমিও তার সঙ্গে একমত।
প্রথম আলো: দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখছি বিনিয়োগে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। যার কারণে ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদাও কমে গেছে। বিনিয়োগে কেন এ স্থবিরতা?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: সুদের হার কমলেই যে বিনিয়োগ বাড়বে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। বিনিয়োগের সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা জড়িত। প্রথমত অবকাঠামোর দুর্বলতা, বিশেষ করে যোগাযোগ খাতে। বন্দরের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও দুর্বলতা আছে। তারপর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানি বড় প্রতিবন্ধকতা। জমির প্রাপ্যতা নিয়েও সমস্যা আছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হলেও শিল্পাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের সমস্যা রয়ে গেছে। সার্বিকভাবে দেশে সুশাসন ও দুর্নীতির সমস্যা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সুশাসন সূচক, সহজে ব্যবসা করার সুযোগসংক্রান্ত সূচকে এখনো আমরা অনেক পিছিয়ে। এসব সমস্যা দূর করা না হলে বিনিয়োগে গতি আসবে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের কথা বলছিলেন। সাম্প্রতিক শেয়ারবাজারের উত্থান কি সে কারণেই?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: অতিরিক্ত তারল্য শেয়ারবাজারমুখী হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। ব্যাংকে আমানতের যে সরবরাহ সেটা বেশ কমে গেছে। ডিমান্ড ডিপোজিট বা চলতি হিসাবের ক্ষেত্রেও ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। তার মানে সাধারণ মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা না রেখে শেয়ারবাজারের দিকে যাচ্ছে। তারই প্রতিফলন ঘটছে।
প্রথম আলো: শেয়ারবাজারের এ উত্থান কে তাহলে আপনি কি স্বাভাবিকই বলছেন?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: একদিক থেকে বিবেচনায় শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক উত্থানে মোটেই উদ্বেগের কোনো কারণ না। তবে দুই-একটি উদ্বেগের বিষয় আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে বাজার যখন স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হয় তখন দেখা যায়, একদিন-দুদিন বাড়ে আবার কমে। মোটামুটি স্থিতিশীলভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়। আমাদের এখানে এ পরিস্থিতিটাই বিদ্যমান ছিল, কিন্তু বেশ কয়েক দিন আগে বেশ বড় ধরনের উত্থান হয়েছে। সেটা একটা উদ্বেগের কারণ ছিল। যা-ই হোক, এখন কিছুটা কারেকশন হয়েছে। দুর্বল কিছু কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিকভাবে দাম বেড়েছে, সেটা কাঙ্ক্ষিত না। তবে সার্বিকভাবে আমি মনে করি, বর্তমানে শেয়ারবাজারের যে সূচক তা এখনো অবমূল্যায়িত পর্যায়ে। এটা আরও বাড়ার সুযোগ আছে, তবে সেই বৃদ্ধিটা যেন স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে আসে। খারাপ শেয়ারের দাম যেন অস্বাভাবিকভাবে না বাড়ে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
প্রথম আলো: নতুন যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছে, অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে সেটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: মুদ্রানীতি মূল্যায়ন করতে গেলে সবার আগে দেখতে হবে এ নীতি কোন সূচকগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে এবং সেই সম্পর্কে ওই নীতিতে কী বলা হয়েছে। সাধারণত মুদ্রানীতি দিয়ে তিনটি সূচককে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। প্রথমটি হলো সার্বিক মুদ্রা সরবরাহ (বিশেষ করে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ), দ্বিতীয়টি সুদের হার এবং শেষটি হলো মুদ্রার বিনিময় হার। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে সার্বিক মুদ্রা সরবরাহের যে লক্ষ্য বা টার্গেট ধরা হয়েছে (সাড়ে ১৫ শতাংশ) তা গ্রহণযোগ্য। কারণ এ লক্ষ্য অর্জিত হলে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেটে ঘোষিত মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধি (৭ দশমিক ২ শতাংশ) ও মূল্যস্ফীতির (৫ দশমিক ৮) লক্ষ্যপূরণের পরও উদ্বৃত্ত থাকবে।
প্রথম আলো: আপনি কি মনে করেন মুদ্রা সরবরাহসহ মুদ্রানীতিতে ঘোষিত অন্যান্য লক্ষ্য পূরণ হবে?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: গত বছরের জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের যে তথ্য তাতে দেখা যাচ্ছে মুদ্রা সরবরাহ পরিস্থিতি নির্ধারিত লক্ষ্যের নিচে রয়েছে। সার্বিক মুদ্রা সরবরাহ ও বেসরকারি ঋণপ্রবাহের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। সাম্প্রতিক বাস্তবতায় আমার মনে হয় না মুদ্রানীতিতে যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে তা পূরণ হবে। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী সুদের হার (রেপো ও রিভার্স রেপো) অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোতে অতি তারল্য রয়েছে। বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। ঋণের চাহিদা বাড়াতে হলে সুদের হার কমাতে হবে। যদিও সম্প্রতি ঋণের সুদ হার কিছুটা কমেছে, তবে তার পাশাপাশি আমানতের সুদও কমেছে। কিন্তু ঋণ-আমানতের সুদ হারের ব্যবধান কমেনি। আমানতকারীদের সুদের হার বজায় রেখে ঋণের সুদ কমাতে হবে। এ ব্যাপারে মুদ্রানীতিতে কোনো ঘোষণা ও উদ্যোগ দেখা যায়নি। ব্যাংকের সংখ্যা বেশি হওয়াও ঋণের সুদ হার না কমার একটি বড় কারণ। ব্যাংকের সংখ্যা কমানোর বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু বলছে না। তবে অর্থমন্ত্রী কিছুদিন আগে একীভূতকরণ বা মার্জার আইনের কথা বলেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে তিনি কতটা সফল হবেন, তা নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ নতুন ব্যাংক দেওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তাই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছাড়া মার্জার আইন পাস করাও সম্ভব হবে বলে আমার মনে হয় না। আর এ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়ে আমি আশাবাদী নই।
প্রথম আলো: আমরা তো জানি, মন্দ ঋণ বা খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ছে। তা কি সুদের হারে প্রভাব ফেলছে না?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: আমাদের শ্রেণিকৃত ঋণ বা খেলাপি ঋণের হার অনেক বেশি। ক্রমশ এটা বেড়ে চলেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মোট বিতরণ করা ঋণের ৮.৮ শতাংশ। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০.৩৪ শতাংশ। খেলাপি ঋণের হার কমাতে হলে ব্যাংকগুলোর নিজেদের ব্যবস্থাপনা জোরদার করতে হবে। বিশেষ করে ঋণ প্রস্তাব ঠিকমতো মূল্যায়ন করা, জামানতের মূল্যায়ন ঠিক আছে কি না, ঋণ বিতরণের পর ঋণের সঠিক ব্যবহার যাচাইয়ে নিয়মিত তদারকি এবং খেলাপি হয়ে গেলে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া ও তার দ্রুত নিষ্পত্তির দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। এসব বিষয়ে মুদ্রানীতিতে কোনো দিকনির্দেশনা নেই। তাই আমার মনে হয়, মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা কম। একই কারণে সুদের হারও খুবই কমবে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: মুদ্রানীতিতে মুদ্রার বিনিময় হারের বিষয়ে যা বলা হয়েছে সেটিকে যথাযথ মনে করেন কি?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: বেশ কিছুদিন ধরে আমরা দেখছি মার্কিন ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার মোটামুটি স্থিতিশীল রয়েছে। তবে ডলারের বৈশ্বিক ঝুঁকি রয়েছে। সেই বিষয়ে মুদ্রানীতিতে খুব বেশি আলোচনা নেই। আমার মতে, ব্রেক্সিট এবং ট্রাম্পের দায়িত্ব গ্রহণের পর যেসব সংকেত পাওয়া যাচ্ছে তার ফলে ডলারের বিপরীতে পাউন্ড ও ইউরোর মানের অবমূল্যায়ন হবে। কাজেই ডলারের বিপরীতে টাকার মান যদি একই রকম থাকে তারপরও পাউন্ড ও ইউরোর বিপরীতে টাকার মান বাড়বে। সেটা রপ্তানি খাতকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। গত ছয় মাসে রপ্তানি খাতে আমেরিকার বাজারে ১১ শতাংশের মতো ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সার্বিকভাবে গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি ৪.৪৪ শতাংশ। আগের বছর এই সময়ে রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.৮৪ শতাংশ। এ অবস্থায় মুদ্রানীতিতে মুদ্রার বিনিময় হার প্রসঙ্গে বলা হয়েছে ‘ফ্লেক্সিবল’ নীতি অনুসরণ করা হবে। কিন্তু ফ্লেক্সিবলের বিষয়ে পরিষ্কার করে কিছু বলা হয়নি। আমি মনে করি এই মুহূর্তে ডলারের বিপরীতে আমাদের মুদ্রা বিনিময় হারের অবমূল্যায়ন করা উচিত। অনেক অর্থনীতিবিদ বলে থাকেন আমাদের দেশে শুধু ডলারের ভিত্তিতে হিসাব না করে ‘প্রকৃত কার্যকর মুদ্রা বিনিময়’ ব্যবস্থায় যাওয়া উচিত। আমিও তার সঙ্গে একমত।
প্রথম আলো: দীর্ঘদিন ধরে আমরা দেখছি বিনিয়োগে একধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। যার কারণে ব্যাংক খাতে ঋণের চাহিদাও কমে গেছে। বিনিয়োগে কেন এ স্থবিরতা?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: সুদের হার কমলেই যে বিনিয়োগ বাড়বে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে একটা সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। বিনিয়োগের সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা জড়িত। প্রথমত অবকাঠামোর দুর্বলতা, বিশেষ করে যোগাযোগ খাতে। বন্দরের সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রেও দুর্বলতা আছে। তারপর বিনিয়োগের ক্ষেত্রে জ্বালানি বড় প্রতিবন্ধকতা। জমির প্রাপ্যতা নিয়েও সমস্যা আছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হলেও শিল্পাঞ্চলে লোডশেডিংয়ের সমস্যা রয়ে গেছে। সার্বিকভাবে দেশে সুশাসন ও দুর্নীতির সমস্যা রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের সুশাসন সূচক, সহজে ব্যবসা করার সুযোগসংক্রান্ত সূচকে এখনো আমরা অনেক পিছিয়ে। এসব সমস্যা দূর করা না হলে বিনিয়োগে গতি আসবে বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্যের কথা বলছিলেন। সাম্প্রতিক শেয়ারবাজারের উত্থান কি সে কারণেই?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: অতিরিক্ত তারল্য শেয়ারবাজারমুখী হচ্ছে বলে আমার মনে হয় না। ব্যাংকে আমানতের যে সরবরাহ সেটা বেশ কমে গেছে। ডিমান্ড ডিপোজিট বা চলতি হিসাবের ক্ষেত্রেও ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। তার মানে সাধারণ মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা না রেখে শেয়ারবাজারের দিকে যাচ্ছে। তারই প্রতিফলন ঘটছে।
প্রথম আলো: শেয়ারবাজারের এ উত্থান কে তাহলে আপনি কি স্বাভাবিকই বলছেন?
মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম: একদিক থেকে বিবেচনায় শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক উত্থানে মোটেই উদ্বেগের কোনো কারণ না। তবে দুই-একটি উদ্বেগের বিষয় আছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে বাজার যখন স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত হয় তখন দেখা যায়, একদিন-দুদিন বাড়ে আবার কমে। মোটামুটি স্থিতিশীলভাবে ঊর্ধ্বমুখী হয়। আমাদের এখানে এ পরিস্থিতিটাই বিদ্যমান ছিল, কিন্তু বেশ কয়েক দিন আগে বেশ বড় ধরনের উত্থান হয়েছে। সেটা একটা উদ্বেগের কারণ ছিল। যা-ই হোক, এখন কিছুটা কারেকশন হয়েছে। দুর্বল কিছু কোম্পানির শেয়ারের অস্বাভাবিকভাবে দাম বেড়েছে, সেটা কাঙ্ক্ষিত না। তবে সার্বিকভাবে আমি মনে করি, বর্তমানে শেয়ারবাজারের যে সূচক তা এখনো অবমূল্যায়িত পর্যায়ে। এটা আরও বাড়ার সুযোগ আছে, তবে সেই বৃদ্ধিটা যেন স্থিতিশীলতার মধ্য দিয়ে আসে। খারাপ শেয়ারের দাম যেন অস্বাভাবিকভাবে না বাড়ে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে।
No comments