মার্কিন নির্বাচন বাংলাদেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুধু আমেরিকার জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্য তাৎপর্যপূর্ণ। চলতি বছর ৮ নভেম্বর আমেরিকার ৫৮তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ইতিমধ্যে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল তাদের নিজ নিজ প্রার্থীর চূড়ান্ত মনোনয়ন দিয়েছে। রিপাবলিকান দল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে এবং ডেমোক্রেটিক দল হিলারি ক্লিনটনকে চূড়ান্ত প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এই প্রথম কোনো নারী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বড় কোনো দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন লাভ করেছেন। অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো কোনো ব্যক্তির চূড়ান্ত রিপাবলিকান প্রার্থী হতে পারাও অভূতপূর্ব। সঙ্গত কারণেই এবারের নির্বাচনী লড়াই পেয়েছে ভিন্নমাত্রা। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে নতুন প্রেসিডেন্ট আমেরিকার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। নির্বাচনে জিতে কে হবেন নতুন প্রেসিডেন্ট? হিলারি ক্লিনটন কি প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করতে পারবেন? শেষ পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে সামগ্রিক পরিণতি কী হবে? নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে? বিশ্বে তার প্রভাব কেমন হবে? বাংলাদেশের ব্যাপারে দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হবে?
এসব প্রশ্ন নিয়ে সবার কৌতূহল রয়েছে। চলতি সপ্তাহে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের লড়াইটা ভিন্নমাত্রায় পৌঁছেছে। এতদিন প্রার্থীরা নিজ দলের মনোনয়নের জন্য লড়াই করেছেন। এখন তারা দলীয় চূড়ান্ত মনোনয়ন নিয়ে সর্বশেষ ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে আছেন রানিংমেট ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরাও। প্রসঙ্গত, মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী জš§সূত্রে যে কোনো মার্কিন নাগরিক যিনি ন্যূনতম ১৪ বছর ধরে আমেরিকায় বসবাস করছেন এবং যার বয়স কমপক্ষে ৩৫ বছর, তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন। উল্লেখ্য, কেউ দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট পদে দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না। আমেরিকার নির্বাচনী প্রক্রিয়া অন্য অনেক গণতান্ত্রিক দেশের চেয়ে ভিন্ন। কোনো একক নেতা বা কর্তৃপক্ষ দলীয় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী মনোনয়ন করে না। বরং বড় রাজনৈতিক দলগুলোর নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দলীয় প্রার্থীরা চূড়ান্ত মনোনয়ন অর্জন করেন। এরপর শুরু হয় সব রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচনী লড়াই। প্রেসিডেন্ট নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ইলেক্টোরাল কলেজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ইলেক্টোরাল কলেজের সমর্থন লাভ করবেন তিনিই হবেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট। তবে যদি কোনো প্রার্থীই অন্তত ২৭০ ইলেক্টোরাল কলেজ সমর্থন অর্জন করতে না পারেন, তখন হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে ভোটাভুটির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বাছাই করা হয়। আমেরিকায় নির্বাচনী লড়াইটা হয় মূলত ডেমোক্রেটিক ও রিপাবলিকান দলের মধ্যে।
যদিও ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও নির্বাচনে অংশ নেন। মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিলারি ক্লিনটন ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে একজন হবেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট। শেষমেশ কে বিজয়ী হবেন তা নির্ভর করবে প্রার্থীদের নির্বাচনী কৌশল এবং ভোটারদের রায়ের ওপর। এখন পর্যন্ত কোনো নারী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হননি। ডেমোক্রেটিক প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন একজন সফল রাজনীতিক ও সংগঠক হিসেবে সুপরিচিত। তিনি আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। নিউইয়র্কের সিনেটর ছিলেন। তার স্বামী প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময় ফার্স্টলেডি হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। তিনি মেধাবী আইনজীবী, ভালো বক্তা, নারী অধিকার, নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। নারী ভোটারদের মধ্যে রয়েছে তার বিশেষ জনপ্রিয়তা। এছাড়া মধ্যপন্থী ও উদারপন্থী মার্কিনিদের সমর্থন রয়েছে তার প্রতি। তিনি নির্বাচিত হলে আমেরিকার ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট হিসেবে রেকর্ড সৃষ্টি হবে। অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত মনোনয়ন অর্জন করেছেন তার নিজ ক্যারিশমার গুণে। তিনি জানেন কীভাবে সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যুকে দক্ষভাবে ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার করা যায়। সামনের দিনগুলোতে তিনি নতুন নতুন রাজনৈতিক কার্ড খেলে ভোটারদের সমর্থন আদায়ের সর্বাÍক চেষ্টা করবেন। তাছাড়া মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সাধারণত কোনো দল পরপর দু’বারের বেশি ক্ষমতায় আসতে পারে না। ডেমোক্রেট দলের বারাক ওবামা পরপর দু’বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেক্ষেত্রে এবার রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ভালো সম্ভাবনা রয়েছে।
নির্বাচনে যিনি নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন তার পররাষ্ট্রনীতি সারা বিশ্বে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে চীন ও আমেরিকা পরস্পরবিরোধী মুখোমুখি অবস্থান নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালত দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের একক মালিকানার দাবি নাকচ কর দিয়েছে। হোয়াইট হাউসে নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব নেয়ার পর আমেরিকা দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেবে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী ইসলামিক স্টেটের কার্যক্রম মোকাবেলায় নতুন কর্মপন্থা নিতে হবে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। নতুন মার্কিন প্রশাসন যদি এসব ব্যাপারে বল প্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় এবং সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে, তাহলে বিশ্বব্যাপী অস্থিরতা আরও বাড়বে। ব্রেক্সিটের ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিশ্ব অর্থনীতি এক অনিশ্চিত সময় পার করছে। নতুন যে কোনো সংঘাত-অস্থিরতা বিশ্ব অর্থনীতিকে আরও ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে। আবার, সুচিন্তিত নীতি-কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার অনবদ্য সুযোগও রয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোও দারুণ আগ্রহী। বাংলাদেশের জন্য আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্টের দৃষ্টিভঙ্গি খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সম্প্রতিক গুলশান ও শোলাকিয়া ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন মার্কিন প্রশাসন যে নীতি গ্রহণ করবে, তার সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভবিষ্যৎ জড়িয়ে যাবে। নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশের পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন ও গণতন্ত্র নিয়ে আমেরিকার অবস্থান কী হবে, তা নিয়ে বাংলাদেশী রাজনৈতিক নেতাদের প্রচুর কৌতূহল রয়েছে। জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বের বড় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটি। সেক্ষেত্রে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশে অর্থবহ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের উদ্দেশে কোনো প্রকাশ্য নীতি-কৌশল গ্রহণ করলে তা বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক দৃশ্যপট পাল্টে দেবে। যদিও গণতান্ত্রিক রীতি অনুযায়ী অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জড়ানো অনাকাক্সিক্ষত। যা হোক, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত কিছু বলার সময় এখনও আসেনি। সামনের দিনগুলোতে খুব দ্রুত নির্বাচনী দৃশ্যপট বদলাতে থাকবে। পরিস্থিতিকে নিজের অনুকূলে নিতে প্রার্থীরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। এতে রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর, ধর্মীয় বিতর্ক, এমনকি ব্যক্তিগত আক্রমণও দেখা যেতে পারে। তবে শেষ কথা বলবেন ভোটাররা। তাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে কে হবেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
মো. সাজজাদ হোসেন : সহকারী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
sazzad.ir.du@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.