যুদ্ধ এখনও অসমাপ্ত!
শ্রাবণ মাসের অর্ধেকটা চলে গেল। প্রকৃতিও এ মাসের চেহারা দেখাতে কার্পণ্য করছে না। কিন্তু কিছুতেই যেন বৃষ্টিমুখর এই ঋতুর অনুভূতি মনের ভেতরে প্রবেশ করাতে পারছি না। কিছুদিন আগেও বর্ষাকাল এলে একটু বৃষ্টিতে ভিজতাম অথবা খোলা বারান্দায় গিয়ে বসতাম। প্রাণভরে উপভোগ করতাম রিমঝিম রিমঝিম বৃষ্টির গান। এই মুহূর্তে মনের সেই অনুভূতি নেই। নেই মানে একেবারেই নেই। এমনকি গান শোনার জন্য পেনড্রাইভে নতুন যে গানগুলো ডাউনলোড করিয়েছিলাম সেসবও শুনে ওঠা হচ্ছে না। মনের ভেতরে এক ধরনের অস্থিরতা, এক ধরনের অশান্তি কাজ করছে! জঙ্গি হামলা, জঙ্গিদের সঙ্গে পুলিশের যুদ্ধ, জঙ্গিদের মৃতদেহের ছবির সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে উঠছে ডাচ্-বাংলা চেম্বারের সভাপতি হাসানের ছবি। এমন একজন ব্যবসায়ী কয়েক দিন উধাও থাকার পর বুড়িগঙ্গায় তার লাশ ভেসে উঠেছে। হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টের লাশগুলো কুপিয়ে বীভৎস করার কথা শুনে মনে হয়েছে খুনিরা লাশের ওপরও প্রতিশোধ নিয়েছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশেও এসব খুনি তাণ্ডব চালাচ্ছে। ৫-৬ বছর আগে মালয়েশিয়ার পেনাং বন্দরে একজন পাকিস্তানি জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। হঠাৎ করে তার কথা আবার মনে পড়ে গেল।
তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করে ভালো করেছ। আমি এই বন্দর থেকে করাচিতে আমার পরিবারের কাছে কিছু টাকা পাঠাতে ব্যাংকে এসেছিলাম। আমার ভয় হয়, করাচিতে আমার স্ত্রী ব্যাংকে এসে সে টাকা তুলে নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবেন কিনা। কারণ ব্যাংকের গেটে, রাস্তায় যে বোমাবাজি হবে না আর সে বোমায় যে আমার স্ত্রী উড়ে যাবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। একসঙ্গে থাকলে তোমাদেরও এসব ধকল সামলাতে হতো।’ এখন দেখছি আমাদের দেশটাকেও কারা যেন সেই দিকে নিতে চাচ্ছে। আমাদের দেশে পাকিস্তানি আইএসআই এসব করাচ্ছে কিনা সে কথাও মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। এই মুহূর্তে ধানমণ্ডির ব্যবসায়ী মানুষটির কথাই বেশি করে মনে হচ্ছে। ভদ্রলোক সপরিবারে সেখানে বসবাস করতেন। শনিবার সকালে ওষুধ কেনার কথা বলে নিচে নেমেছিলেন। মঙ্গলবার তার লাশ বুড়িগঙ্গায় পাওয়া গেল। ভেসে উঠেছে তার পচে-গলে ফুলে ওঠা বীভৎস লাশ। এমন একটি মৃত্যুই বোধহয় তার ভাগ্যে লেখা ছিল? কী জানি হতেও পারে! কিন্তু আমি যেহেতু ভাগ্যে বিশ্বাস না করে কর্মে বিশ্বাস করি, সে বিশ্বাসে কর্মের বিষয়টিই এসে যায়। কর্মদোষে যদি তার জীবন যায় তাহলে সে বিষয়টিও তো জানা দরকার।
নাকি কুমিল্লার তনু, চট্টগ্রামের মিতু এদের মতো মৃত্যু হয়েছে তার। তনু, মিতু কারোরই তো কর্মদোষের কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। তাদের ক্ষেত্রে কে কতটুকু বিচার পাবে তা জানি না। ব্যবসায়ী হাসানের ক্ষেত্রেইবা কী হবে তাও বলতে পারছি না। দ্রুত তদন্ত করে তার মৃত্যুর বিষয়টি স্পষ্ট করতে না পারলে আমরা আশ্বস্ত হতে পারছি না। জঙ্গি দমনে যেভাবে আইনশৃংখলা বাহিনীকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে, তাতে করে হাসানের মৃত্যু নিয়ে কার কতটুকু মাথাব্যথা আছে বা সময়-সুযোগ আছে সে কথাও বলা যাচ্ছে না। কারণ তনু ও মিতু হত্যার কথা মনে উঠলে হাসানের হত্যা রহস্যের কূলকিনারার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এসব হত্যা রহস্যের ঘটনা যখন মনে জায়গা করে নেয়, তখন মন আর সুস্থ থাকে না। সুস্থ চিন্তা-চেতনা বারবার বাধাগ্রস্ত হয়। কল্যাণপুরের জঙ্গিদের নিয়ে নানা লোকে নানা কথা বলছেন। সেসব কথা জল্পনা-কল্পনার নানা ডালপালা গজিয়ে চলেছে। মিডিয়াগুলো থেকে জঙ্গিদের ছবি প্রকাশের পর নানাধর্মী বিশ্লেষণের কথা কানে আসছে। এক ধরনের সরকারবিরোধী শক্তি ঘটনাটি নিয়ে পুলিশের সাফল্যকে ম্লান করতে চাচ্ছে। অথচ পুলিশ যদি সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি না করত, জঙ্গিদের রুখে না দিত তাহলে দেশ ও জাতি বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতো। ২-১টি ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রায়ই অতি চাতুর্যের সঙ্গে এমন সব কথা বা ঘটনা প্রচার করে যে,
তাতে জনমনে প্রশ্ন এবং সন্দেহের উদ্রেক ঘটে। তারা এক মণ দুধে এক ফোঁটা টক ফেলার মতো কাজ করে। আর তাতে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। সরকারের পক্ষে দেশের এতগুলো চ্যানেলের কে কোথায় এসব করে চলেছে সবসময় তা নজরদারি করা সম্ভব হয় না। আর যারা সরকারবিরোধী শক্তি, তারা তো এটাকে ‘একে তো নাচুনি বুড়ি তার ওপর আবার ঢোলের বাড়ি’ হিসেবে নিয়ে দেশ ও জাতিকে অশান্ত করার কাজটিই করে চলেছে। প্রকারান্তরে তারা আমাদের দেশটিকে পাকিস্তানের মতো জঙ্গি এবং অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর চেষ্টা করছে। এসব দুঃখবাদী (sadist) মানুষের সংখ্যা একেবারে কমও নয়। সরকারের ক্ষতিকেই আখেরে তারা লাভ হিসেবে বিবেচনা করছেন। অভিজ্ঞ মহলের কথা, মসজিদে মসজিদে যেমন জঙ্গিবাদে উৎসাহী খুতবা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, তেমনি কয়েকটি টেলিভিশন চ্যানেলের চাতুর্যপূর্ণ কথাবার্তাও বন্ধ হওয়া দরকার। কারণ এটা দলাদলি, বিভক্তি বা বিভেদের সময় না হলেও একটি গ্রুপ তাতে বিশ্বাসী নয়। তাই ওই শ্রেণী বা গোষ্ঠী থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে আবারও ’৭১-এর কথা মনে করতে হবে। ’৭১-কে সামনে এনে প্রগতিশীল শক্তিকে আবারও একজোট হতে হবে। কারণ যুদ্ধ এখনও অসমাপ্ত।
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট
মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন : মুক্তিযোদ্ধা, কলামিস্ট
No comments