চাই সবার জন্য স্বাধীনতা by আবুল মোমেন
বাংলাদেশের
অনিবার্যতা পাকিস্তানের ভ্রান্তির মধ্যেই নিহিত ছিল। দুই প্রদেশের ভৌগোলিক
দূরত্ব একটি বড় কারণ নিশ্চয়। তবে মূল কারণ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহসহ
শাসকশ্রেণির পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আদর্শের ধারণার মধ্যে নিহিত। তাঁদের
ধারণা অনুযায়ী পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আদর্শ নির্মিত হবে ভারতবিরোধী
প্রত্যয় থেকে। পাকিস্তান বনাম ভারত এই বৈপরীত্যের রূপ দিতে গিয়ে পাকিস্তান
এমন সব বিপরীত জোট তৈরি করেছে, যার প্রণোদনা হলো বিদ্বেষ ও বৈরিতা। যেমন
পাকিস্তানের বিপরীত দেশ ভারত, মুসলমানের বিপরীত জাতি হিন্দু, মুসলমানদের
ভাষা উর্দু আর হিন্দি ও বাংলা হলো হিন্দুর ভাষা, রবীন্দ্রনাথ হিন্দু কবি,
নজরুল তাঁর বিপরীতে মুসলিম কবি (তাও খণ্ডিতভাবে উপস্থাপিত)। এভাবে
পাকিস্তান-ভারত, হিন্দু-মুসলমান, উর্দু-বাংলা, রবীন্দ্র-নজরুল বৈপরীত্যের
ধারণার মধ্যে একদিকে সমকক্ষতার জেদ, তো অন্যদিকে পারস্পরিক বৈরিতার ইন্ধন
কাজ করে। এটি হীনম্মন্য মনোভাবের প্রকাশও বটে। মানুষের নানান আবেগের মধ্যে
ধর্মভিত্তিক আবেগ সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং একই কারণে সহজেই তা অন্ধ শক্তিতে
রূপ নিতে পারে। পাকিস্তান দেশ ও জাতির যে সাংস্কৃতিক পরিচয় দাঁড় করাতে
চেয়েছিল, তার ভিত্তিতে প্রতিপক্ষের নেতিকরণ ও তার প্রতি সার্বিক বৈরিতার
প্রকাশ ঘটেছিল, কোনো গঠনমূলক ইতিবাচক দর্শন কাজ করেনি। এমন দর্শনহীন
ঋণাত্মক আদর্শের বিকাশ ঘটে না, তার ভিত্তিতে জাতি গঠন, দেশ গঠন অসম্ভব,
পাকিস্তানের বাংলাদেশ-বিপর্যয় বা সত্তর বছর ধরে চলমান অব্যবস্থার কারণ
এটিই।
বাঙালির পক্ষে এর মধ্যে বিকশিত হওয়া সম্ভব ছিল না, যেমন পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না। বাঙালির ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি শক্তিশালী। ব্রিটিশ আমল থেকে এ ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়ায় এর ভিত্তি ছিল দৃঢ়, বিস্তার ঘটেছে ব্যাপক। তার ওপর বাংলা ভাষায় দ্রুত অত্যন্ত উন্নতমানের সাহিত্য রচিত হওয়ায় এবং সেই সাহিত্য মাতৃভূমির বন্দনায়, স্বাধীনতার উদ্দীপনায় বরাবর অত্যন্ত মানসম্পন্ন ও কার্যকর রসদ জুগিয়ে গেছে, যার আবেদন আজও সমানভাবে বজায় রয়েছে। ফলে বাঙালির ওপর পাকিস্তানের উর্দু ভাষা কিংবা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা চাপিয়ে দেওয়া এবং একতরফা অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসন মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। আর তারই ফলে মুক্তিযুদ্ধ যেমন, তেমনি স্বাধীনতাও হয়ে পড়েছিল অনিবার্য।
২.
পাকিস্তানে পাঞ্জাবি মুসলমানদের একাধিপত্য বজায় ছিল। আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে মূল্যায়ন করতে বসে মনে হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে যেন তারই অনুকরণে বাঙালি মুসলমানের একাধিপত্য তৈরি হয়েছে। এখানে আমাদের পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আদর্শে পরাভব ঘটে। ১৯৪৭-এ যখন দেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়, তখন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ ছিল হিন্দু। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় তা ছিল ২২ শতাংশের মতো। আর বাংলাদেশের বিগত ৪৫ বছরের ইতিহাসে দেশের হিন্দু জনসংখ্যা কমে মাত্র ৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। কেন হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে, তা নিয়ে প্রতিবেশী মুসলমান যথেষ্ট সচেতন নয়, বরং অধিকাংশের ধারণা বিভ্রান্তিকর। এদের অনেকেই এর মধ্যে একধরনের ভারতপ্রীতির হিন্দু মানসিকতাকেই কেবল দেখতে পায়। তার অস্তিত্ব হয়তো আছে, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতাই এই মনোভাব তৈরিতে ও তা জিইয়ে রাখতে সাহায্য করে। ১৯৬৫ সালের শত্রুসম্পত্তি আইনের অভিশাপ কেন স্বাধীন দেশেও বয়ে বেড়াতে হবে, এর জবাব স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি দেয়নি। আমরা সংখ্যালঘুর সম্পত্তির জবরদখলের নানা চিত্র উত্তরোত্তর বাড়তে দেখছি। সংখ্যালঘু এ দেশে স্বস্তিতে বসবাস করতে পারছে কি না, সেটা যতক্ষণ না সংখ্যাগুরুর বিবেচ্য বিষয় হবে, ততক্ষণ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আর তা ঘটেনি বলে বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য একাত্তরের স্বাধীনতা যে সুফল এনেছে, তা দেশের সব ধরনের সংখ্যালঘুর জন্য সেই মানে আনেনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা, যা দ্রুত শোধরানো দরকার।
দেশে যেসব আদিবাসী সংখ্যালঘু আছেন—প্রায় ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তাদের পক্ষে ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা তো কঠিন বটেই; ভিটেমাটি, জমি ও স্থাবর সম্পত্তি রক্ষা করাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তাদের এমন মনে হওয়ার উপলক্ষ বারবার তৈরি হয়েছে যে তারা জাতি পরিচয়ের কারণে এ দেশে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় নিত্যদিন খবর বেরোচ্ছে।
আমরা বিশ্বাস করি উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আরও উন্নতি হবে, আয় ও আয়ু বাড়বে, শিক্ষিতের হার বাড়বে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কী হবে?
এই বাস্তবতা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। একই সঙ্গে আমরা অস্বীকার করব না, সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, দারিদ্র্যবিমোচন ইত্যাদিতে উন্নয়ন বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বাড়িয়েছে। বর্তমান সরকারের জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকাও প্রশংসনীয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতগুলো, বিশেষত অভিবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স এবং তৈরি পোশাক খাতের আয় টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। কেবল কৃষির ভিত্তিটা মজবুত হয়েছে। তৈরি পোশাক ও অভিবাসী এই খাতের শ্রমিকদের অধিকাংশের জীবন এখনো আয় ও অধিকারের দিক থেকে মানবেতরই রয়ে গেছে। তাদের দক্ষতা, আয় বৃদ্ধি ও জীবনমান বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ আমরা নিতে পারিনি।
৩.
জাতিসংঘ আগামী ২০৩০ সালে অর্জনের জন্য যে ১৭টি খাতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে, তা অর্জন আমাদের জন্য সত্যিই কঠিন হবে। কেননা, এটি আর পরিমাণগত উন্নয়নের বিষয় থাকছে না। এবার গুণগত পরিবর্তনের ওপর জোর দিতে হবে। গুণ ও মান সাধারণত সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। অবস্থার, কাজের ও ফলাফলের বিচারে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়, বোঝা যায়।
আমরা সব সময় দ্রুত সাফল্য চেয়েছি। জাতিগতভাবে আমরা লম্বা দৌড়ের জন্য মানসিক-শারীরিক কোনোভাবেই তৈরি নই। বাস্তবতা বলে, মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসের বেশি স্থায়ী হলে, ধরা যাক যদি তা কয়েক বছর গড়াত, তাহলে স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতির ঐক্য ধরে রাখা যেত না। কেননা, আমাদের সেই প্রস্তুতি ছিল না। স্বাধীনতা কীভাবে কখন হতো, বলা মুশকিল।
গণতন্ত্র সব নাগরিকের জন্য মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করে। আর তা বাস্তবায়ন করতে হলে চাই দুটি ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন—সর্বস্তরে যথার্থ মানসম্পন্ন শিক্ষায় উন্নত নাগরিক এবং দক্ষ দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান। তৃতীয় যে বিষয়টি প্রয়োজন, তা সরকারের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার বাধ্যবাধকতার ব্যবস্থা করা। এসব ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আমরা কোনো কাজই শুরু করিনি। আমজনতার এতে কোনো আপত্তি নেই, বস্তুত এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তবে এর ফলাফল পেলে এতে তাদের নিশ্চয় আগ্রহ থাকবে। কিন্তু যাঁরা ক্ষমতাসীন এবং যাঁরা ক্ষমতাকে ঘিরে শাসকশ্রেণির অংশে পরিণত হয়েছেন, তাঁরা এমন ব্যবস্থা সম্পর্কে আন্তরিক নন। বড় দুই দলে এ বিষয়ে মতভিন্নতা আছে বলে মনে হয় না।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার জন্য স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরেও নাগরিক সমাজ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেনি। তাদের নৈতিক দুর্বলতাই এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে। তার ওপর আরেক দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশের উপযোগী দল হয়ে উঠতে পারছে না বিএনপি। তারা যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে ছাড়বে কি না, তা অস্পষ্ট। খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তাঁদের আওয়ামী লীগবিরোধিতা যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার মূলধারার বিপরীতে অবস্থান নেয়, উল্টো বহুলাংশে পাকিস্তানের সঙ্গেই মেলে, তাহলে সাধারণ মানুষ, বিশেষত তরুণ সমাজ তো বিভ্রান্ত হবেই। আর এর ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে একধরনের একচ্ছত্র ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আখেরে ক্ষতি হচ্ছে গণতন্ত্রের। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তো অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ—সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
আমাদের শেষ ভরসা মানুষ। কারণ মানুষ স্বভাবগতভাবে সামনেই এগোতে চায়, তরুণ সমাজ সব বাধা ঠেলে এগিয়েই যাবে। আমরা বিশ্বাস করি উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আরও উন্নতি হবে, আয় ও আয়ু বাড়বে, শিক্ষিতের হার বাড়বে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কী হবে? ধর্ম-বর্ণবৈষম্যহীন আইনের শাসনের? গণতন্ত্রের? এসবও যে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন থেকে যাচ্ছে? এটাই আমাদের আজ বড় দুর্বলতা, দুর্ভাবনার বিষয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
বাঙালির পক্ষে এর মধ্যে বিকশিত হওয়া সম্ভব ছিল না, যেমন পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পক্ষেও সম্ভব হচ্ছে না। বাঙালির ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি শক্তিশালী। ব্রিটিশ আমল থেকে এ ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়ায় এর ভিত্তি ছিল দৃঢ়, বিস্তার ঘটেছে ব্যাপক। তার ওপর বাংলা ভাষায় দ্রুত অত্যন্ত উন্নতমানের সাহিত্য রচিত হওয়ায় এবং সেই সাহিত্য মাতৃভূমির বন্দনায়, স্বাধীনতার উদ্দীপনায় বরাবর অত্যন্ত মানসম্পন্ন ও কার্যকর রসদ জুগিয়ে গেছে, যার আবেদন আজও সমানভাবে বজায় রয়েছে। ফলে বাঙালির ওপর পাকিস্তানের উর্দু ভাষা কিংবা ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা চাপিয়ে দেওয়া এবং একতরফা অগণতান্ত্রিক স্বৈরশাসন মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। আর তারই ফলে মুক্তিযুদ্ধ যেমন, তেমনি স্বাধীনতাও হয়ে পড়েছিল অনিবার্য।
২.
পাকিস্তানে পাঞ্জাবি মুসলমানদের একাধিপত্য বজায় ছিল। আজ স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে মূল্যায়ন করতে বসে মনে হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে যেন তারই অনুকরণে বাঙালি মুসলমানের একাধিপত্য তৈরি হয়েছে। এখানে আমাদের পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আদর্শে পরাভব ঘটে। ১৯৪৭-এ যখন দেশ ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়, তখন পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশে জনসংখ্যার ৩৩ শতাংশ ছিল হিন্দু। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার সময় তা ছিল ২২ শতাংশের মতো। আর বাংলাদেশের বিগত ৪৫ বছরের ইতিহাসে দেশের হিন্দু জনসংখ্যা কমে মাত্র ৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। কেন হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে, তা নিয়ে প্রতিবেশী মুসলমান যথেষ্ট সচেতন নয়, বরং অধিকাংশের ধারণা বিভ্রান্তিকর। এদের অনেকেই এর মধ্যে একধরনের ভারতপ্রীতির হিন্দু মানসিকতাকেই কেবল দেখতে পায়। তার অস্তিত্ব হয়তো আছে, কিন্তু পারিপার্শ্বিকতাই এই মনোভাব তৈরিতে ও তা জিইয়ে রাখতে সাহায্য করে। ১৯৬৫ সালের শত্রুসম্পত্তি আইনের অভিশাপ কেন স্বাধীন দেশেও বয়ে বেড়াতে হবে, এর জবাব স্বাধীন বাংলাদেশের শাসকশ্রেণি দেয়নি। আমরা সংখ্যালঘুর সম্পত্তির জবরদখলের নানা চিত্র উত্তরোত্তর বাড়তে দেখছি। সংখ্যালঘু এ দেশে স্বস্তিতে বসবাস করতে পারছে কি না, সেটা যতক্ষণ না সংখ্যাগুরুর বিবেচ্য বিষয় হবে, ততক্ষণ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। আর তা ঘটেনি বলে বাংলাদেশের মুসলমানদের জন্য একাত্তরের স্বাধীনতা যে সুফল এনেছে, তা দেশের সব ধরনের সংখ্যালঘুর জন্য সেই মানে আনেনি। এটি আমাদের ব্যর্থতা, যা দ্রুত শোধরানো দরকার।
দেশে যেসব আদিবাসী সংখ্যালঘু আছেন—প্রায় ৪৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তাদের পক্ষে ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা তো কঠিন বটেই; ভিটেমাটি, জমি ও স্থাবর সম্পত্তি রক্ষা করাও দুষ্কর হয়ে পড়েছে। তাদের এমন মনে হওয়ার উপলক্ষ বারবার তৈরি হয়েছে যে তারা জাতি পরিচয়ের কারণে এ দেশে বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় নিত্যদিন খবর বেরোচ্ছে।
আমরা বিশ্বাস করি উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আরও উন্নতি হবে, আয় ও আয়ু বাড়বে, শিক্ষিতের হার বাড়বে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কী হবে?
এই বাস্তবতা আমরা অস্বীকার করতে পারব না। একই সঙ্গে আমরা অস্বীকার করব না, সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন খাতে উন্নয়ন ঘটেছে ব্যাপকভাবে। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, দারিদ্র্যবিমোচন ইত্যাদিতে উন্নয়ন বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি বাড়িয়েছে। বর্তমান সরকারের জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী ভূমিকাও প্রশংসনীয়। কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতগুলো, বিশেষত অভিবাসী শ্রমিকদের রেমিট্যান্স এবং তৈরি পোশাক খাতের আয় টেকসই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই। কেবল কৃষির ভিত্তিটা মজবুত হয়েছে। তৈরি পোশাক ও অভিবাসী এই খাতের শ্রমিকদের অধিকাংশের জীবন এখনো আয় ও অধিকারের দিক থেকে মানবেতরই রয়ে গেছে। তাদের দক্ষতা, আয় বৃদ্ধি ও জীবনমান বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ আমরা নিতে পারিনি।
৩.
জাতিসংঘ আগামী ২০৩০ সালে অর্জনের জন্য যে ১৭টি খাতে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করেছে, তা অর্জন আমাদের জন্য সত্যিই কঠিন হবে। কেননা, এটি আর পরিমাণগত উন্নয়নের বিষয় থাকছে না। এবার গুণগত পরিবর্তনের ওপর জোর দিতে হবে। গুণ ও মান সাধারণত সংখ্যা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। অবস্থার, কাজের ও ফলাফলের বিচারে তা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়, বোঝা যায়।
আমরা সব সময় দ্রুত সাফল্য চেয়েছি। জাতিগতভাবে আমরা লম্বা দৌড়ের জন্য মানসিক-শারীরিক কোনোভাবেই তৈরি নই। বাস্তবতা বলে, মুক্তিযুদ্ধ নয় মাসের বেশি স্থায়ী হলে, ধরা যাক যদি তা কয়েক বছর গড়াত, তাহলে স্বাধীনতার প্রশ্নে জাতির ঐক্য ধরে রাখা যেত না। কেননা, আমাদের সেই প্রস্তুতি ছিল না। স্বাধীনতা কীভাবে কখন হতো, বলা মুশকিল।
গণতন্ত্র সব নাগরিকের জন্য মানবাধিকার ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার ওপর নির্ভর করে। আর তা বাস্তবায়ন করতে হলে চাই দুটি ক্ষেত্রে গুণগত পরিবর্তন—সর্বস্তরে যথার্থ মানসম্পন্ন শিক্ষায় উন্নত নাগরিক এবং দক্ষ দুর্নীতিমুক্ত প্রতিষ্ঠান। তৃতীয় যে বিষয়টি প্রয়োজন, তা সরকারের জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার বাধ্যবাধকতার ব্যবস্থা করা। এসব ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আমরা কোনো কাজই শুরু করিনি। আমজনতার এতে কোনো আপত্তি নেই, বস্তুত এ সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। তবে এর ফলাফল পেলে এতে তাদের নিশ্চয় আগ্রহ থাকবে। কিন্তু যাঁরা ক্ষমতাসীন এবং যাঁরা ক্ষমতাকে ঘিরে শাসকশ্রেণির অংশে পরিণত হয়েছেন, তাঁরা এমন ব্যবস্থা সম্পর্কে আন্তরিক নন। বড় দুই দলে এ বিষয়ে মতভিন্নতা আছে বলে মনে হয় না।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এই ব্যবস্থার দিকে যাওয়ার জন্য স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশতক পরেও নাগরিক সমাজ সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মতো যথেষ্ট শক্তি অর্জন করেনি। তাদের নৈতিক দুর্বলতাই এ ক্ষেত্রে বড় বাধা হচ্ছে। তার ওপর আরেক দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বাংলাদেশের উপযোগী দল হয়ে উঠতে পারছে না বিএনপি। তারা যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতকে ছাড়বে কি না, তা অস্পষ্ট। খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের রাজনৈতিক দর্শনও ধোঁয়াশাপূর্ণ। তাঁদের আওয়ামী লীগবিরোধিতা যদি বাংলাদেশের স্বাধীনতার এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার মূলধারার বিপরীতে অবস্থান নেয়, উল্টো বহুলাংশে পাকিস্তানের সঙ্গেই মেলে, তাহলে সাধারণ মানুষ, বিশেষত তরুণ সমাজ তো বিভ্রান্ত হবেই। আর এর ফলে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গিয়ে একধরনের একচ্ছত্র ভূমিকা গ্রহণের সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। আখেরে ক্ষতি হচ্ছে গণতন্ত্রের। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন তো অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ—সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
আমাদের শেষ ভরসা মানুষ। কারণ মানুষ স্বভাবগতভাবে সামনেই এগোতে চায়, তরুণ সমাজ সব বাধা ঠেলে এগিয়েই যাবে। আমরা বিশ্বাস করি উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে আরও উন্নতি হবে, আয় ও আয়ু বাড়বে, শিক্ষিতের হার বাড়বে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের কী হবে? ধর্ম-বর্ণবৈষম্যহীন আইনের শাসনের? গণতন্ত্রের? এসবও যে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন থেকে যাচ্ছে? এটাই আমাদের আজ বড় দুর্বলতা, দুর্ভাবনার বিষয়।
আবুল মোমেন: কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক।
No comments