ভোটারদের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দিন by মিজানুর রহমান খান
এটা
প্রমাণিত হয়ে চলেছে যে, যেকোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রধান শক্তি
হলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা। কারণ, দুই বা ততোধিক প্রার্থীর মধ্যে
প্রতিযোগিতাই সমাজে একটি পরিবেশ তৈরি করে। আর এই পরিবেশটাই ধীরে ধীরে লোপ
পেতে বসেছে। আবার এরই মধ্যে মাতারবাড়ী মডেলের কথাও বলতে হবে। মহেশখালীর
সমুদ্ররেখা ছুঁয়ে যাওয়া মাতারবাড়ীতে গিয়ে ১৯৯৫ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ
হাসিনা বলেছিলেন, এটা হলো ‘দ্বিতীয় টুঙ্গিপাড়া’। সেখানে একটি অসাধারণ
নির্বাচন হয়েছে, সে কথা সবশেষে বলব।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড শব্দটি জবরদস্তি মুছে ফেলা গেলে কেবল সরকারি দলেরই লাভ হবে, কোনো গোলযোগ নৈরাজ্য থাকবে না, শান্তি থাকবে, তাদের ভ্রান্তি ঘুচবে কি। সহিংসতায় অন্তত ২১ জন নিহত হওয়া ও বিদ্রোহী প্রার্থীর হিড়িক পড়ার ঘটনায় নির্বাচন কমিশন কি বিচলিত ? সে কি এখনও বলবে, তার নাম সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তার কাজ হবে পোস্টবক্সের মতো। তার ডাকবাক্সে চিঠি জমা পড়বে। সেটা তিনি প্রাপককে পৌঁছে দেবেন। প্রেরক বা প্রাপক কারও নাম-পরিচয় তাঁর জানার দরকার নেই। কিন্তু এবারে কার্যত বিএনপি-জামায়াত বা তাদের কর্মী-সমর্থক যেখানে এতটাই কোণঠাসা, যা ক্ষমতাসীন দল অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে গলা ফাটিয়ে দাবি করতে পারছে যে, বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পেট্রলবোমা ও জঙ্গি রাজনীতির কারণে তাদের ওপর থেকে আমজনতা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। দৃশ্যত তেমন একটা পরিবেশেও প্রত্যাশিত শান্তি মিলল না। বিএনপি সমাজে থেকেও নেই। মিছিলের জবাবে মিছিল, স্লোগানের জবাবে স্লোগান, সংঘাতের জবাবে সংঘাত করতে তাদের সামর্থ্য লাটে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তা হলেও আমরা অহিংস ভোট পাচ্ছি না কেন। দলে শৃঙ্খলা থাকলে শতাধিক বিদ্রোহী কী করে জয়ী হলেন?
যখন ব্রিটেন ও ভারতকে দেখিয়ে স্থানীয় সরকারে দলীয় টিকিটে নির্বাচনের আইন করা হলো, তখনই আমরা আশঙ্কা করেছি যে, এই পরিবর্তনের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক নেই। বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে লাইসেন্স প্রথা চালু করা হয়েছে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, এটা সুফল দেয়নি। বরং সমাজ ও নির্বাচনী ব্যবস্থার পবিত্রতা বলতে যেখানে যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা আরও দুর্বলতর হচ্ছে, কোথাও কোথাও মুখ থুবড়ে পড়ছে। মঠবাড়িয়ায় পাঁচজন ও টেকনাফে তিনজন নিহত ও মহেশখালীতে অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে যে বিবরণ পাচ্ছি, তাতে তিনটি স্থানেই গুলি এড়ানো সম্ভব ছিল। ইসির কাছে আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট না পেতে পারি। কিন্তু ভোটারদের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দাবি করতে পারি। বিজিবির মহাপরিচালক জাতিকে জানিয়েছেন, তাঁর সৈন্যরা ম্যাজিস্ট্রেটের লিখিত আদেশে গুলি চালিয়েছে। যেহেতু আইন মেনে হয়েছে, তাই এই গুলি বৈধ। কিন্তু আইন মান্য করা কাকে বলে। ম্যাজিস্ট্রেটকে কতগুলো শর্তসাপেক্ষ এই আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি মোটেই এমন নয় যে, পদাধিকারবলে যেকোনো পরিস্থিতিতে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করতে হবে। কারণ, ম্যাজিস্ট্রেট বলেই মর্জিমাফিক সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর এখতিয়ার নেই।
এখন ইসি কি বলবে, সহিংসতা তাদের দেখার বিষয় নয়। কারণ এর সঙ্গে ভোট গ্রহণ, গণনা ও তা প্রকাশের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু মঠবাড়িয়া ও টেকনাফে একটি করে কেন্দ্রের ফল প্রকাশ করা নিয়েই কিন্তু গুলির ঘটনা ঘটল।
মঠবাড়িয়ায় গোলযোগ হওয়া ইউনিয়নটির একটি কেন্দ্রে যেখানে ১ হাজার ৫৫৪ ভোট, সেটিই কেবল স্থগিত আছে, কিন্তু যে কেন্দ্রের ফল ঘোষণা নিয়ে এতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেল, সেই কেন্দ্রের প্রশ্নবিদ্ধ ফলাফল ঘোষণা করা হলই। যে বিবরণ আমি দিচ্ছি, সেটা সঠিক হলে ওই কেন্দ্রের ফলাফল অবশ্যই বাতিল করতে হবে। বিএনপি এখানকার দৃশ্যপটে নেই। মঠবাড়িয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর। স্বতন্ত্র প্রার্থী বিরোধপূর্ণ কেন্দ্র সাফা মহাবিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক। সুতরাং সেখানে তিনি আর যা-ই হোন, কোনো আগন্তুক নন। উপরন্তু তাঁর স্বজনদের মধ্যে একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন টাকাওয়ালা ব্যক্তি আছেন। তাঁরা কী প্রভাব ফেলেছেন, সেটা আমরা নিশ্চিত নই। তবে ম্যাজিস্ট্রেট কী পরিস্থিতিতে বিজিবিকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা মূল বিবেচ্য।
সাফা কলেজ কেন্দ্রে মোট ভোট ২ হাজার ৫৭৮। এর মধ্যে ১ হাজার ৬০৯টি ভোট পড়েছে। দেখার বিষয় হলো, প্রিসাইডিং অফিসার নৌকা মার্কায় সিল মারা ৭৪৬টি ভোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর যুক্তি আইনগতভাবে সিদ্ধ। কারণ, ওই ব্যালট পেপারের মুড়িতে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সই নেই। এই বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ক্ষুব্ধ করে। কিন্তু বড় করে দেখার বিষয় হলো, যে কেন্দ্রে সারা দিনে প্রায় অর্ধেক অবৈধ ভোট পড়েছে, সেটা প্রিসাইডিং অফিসারের গণনা করতে বসে নজরে আসার বিষয় ছিল না। এই কেন্দ্রের ফল যদি বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হতো, তা হলে তা উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক হত কি না, সেটাও বিবেচ্য ছিল। বাস্তবে পাঁচজন মানুষের প্রাণহানির পরও কিন্তু ওই কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করা হয়নি; বরং ওই ৭৪৬ ভোট বাতিল করা হয়েছে।
রূঢ় বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগের পাঁচ সমর্থক নিহত হলেন। অথচ প্রমাণ হলো না যে প্রশাসন নিরপেক্ষ বা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। যদিও এখানে বিএনপি নেই। বিএনপির প্রার্থী মাত্র ১ হাজার ৮২ ভোট পেয়ে নিরব আছেন। মঠবাড়িয়ায় বরং বলা যায়, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীই তাঁদের দলের প্রার্থীর বড় ক্ষতির কারণ হয়েছেন। কারণ, বিদ্রোহী প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ২৬ ভোট। এটা একটা অবাক করা বিষয় যে, যে কেন্দ্রে অর্ধেক ব্যালট ছিনতাই হওয়ার সন্দেহ দালিলিকভাবে প্রমাণিত, সেই কেন্দ্রে যথাসময়ে ফল ঘোষণা নিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারকে অবরুদ্ধ হতে হয়েছে। তিনি যদি ওই কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে অবরুদ্ধ হতেন, তা হলেও একটা সান্ত্বনা ছিল। কিন্তু তিনি একটি অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে অবরুদ্ধ হন।
এরপর কথা হলো গুলির বিকল্প ছিল কি না?
পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের পরে এলাকায় কোনো বিক্ষোভ হয়নি, কোনো জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ করেনি, এসব কী নির্দেশ করে? সন্ধ্যা সাতটা ২০ মিনিট থেকে রাত সাড়ে আটটা—মাঝখানে মাত্র ৭০ মিনিট সময়, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা কী এমন করেছিলেন, যাতে গুলির কোনো বিকল্প ছিল না? মাইকে তাঁদের সতর্ক করা হয়নি।
মহেশখালীতে বিক্ষুব্ধ কর্মী, যাঁরা সেখানে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে কমপক্ষে ১০০টি ফাঁকা গুলি চালানো হয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি, বৃষ্টির মতো গুলি হয়েছে। ৫০০টির কম হবে না। বড় মহেশখালীতে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন না। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় হামলা হয়েছে; তাঁরা নিজেরাও গুলিবিনিময় করেছেন। উভয় পক্ষের ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু কেউ নিহত হননি।
মঠবাড়িয়ায় একজন ভোটার বিবিসিকে বলেছেন, বিক্ষুব্ধ লোকজন লগি-বৈঠা ব্যবহার করেছেন। তাঁরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেননি। মঠবাড়িয়ার গুলি চালানোর সপক্ষে দেখাতে হবে যে, অবরুদ্ধ কর্মকর্তাদের জীবন সত্যিই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। অনেক সময় ৭০ মিনিট কেন, ১০ মিনিটের এদিক-সেদিকেও কারও জীবন বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু খতিয়ে দেখার বিষয় হলো, সেখানে কাঁদানে গ্যাস বা রাবার বুলেট ব্যবহারের কোনো চেষ্টা ছিল কি না। দু-চারটি ফাঁকা গুলি না চালিয়ে কয়েক হাজার গুলি খরচ করেও যদি ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ’ করা যায়, পাঁচ-পাঁচটি অমূল্য প্রাণের একটিকেও যদি কম ঝরানো যেত, তা হলে তো আমাদের সেই বিকল্পটাই বেছে নিতে হতো। সেই প্রচেষ্টা ছিল কি না, জাতির সেটা জানার অধিকার আছে। নাকি কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেটের মতো তুচ্ছ অস্ত্রের সরবরাহ ছিল না! নির্বাচন কমিশনের ফরমাশপত্রে নির্বাচনী উপকরণ হিসেবে ব্যালট বাক্স ও অমোচনীয় কালির সঙ্গে পর্যাপ্ত রাবার বুলেট আর কাঁদানে গ্যাসের উল্লেখ ছিল কি না? যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ কোনো বাহিনী লাগবে কি লাগবে না, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তারা কেন রাবার বুলেট বা কাঁদানে গ্যাসের জোগানে ঘাটতি থাকলে তার কৈফিয়ত চাইবে না।
আমরা এখন ইসির মাধ্যমে জানতে চাই যে, মঠবাড়িয়ায় সত্যিই কি ‘ট্রিগ্যার হ্যাপি’ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না? ওই গ্রামের মানুষেরা যদি এতটাই দুর্দান্ত-প্রকৃতির হবে, তা হলে তারা টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করল না কেন? ১৯৫০ সালের এনকোয়ারি অ্যাক্টের আওতায় মঠবাড়িয়ায় গুলিবর্ষণের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করি।
এ ঘটনা কেবল বিজিবিপ্রধান এবং ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব স্বীকার বা ‘আইনসম্মত’ দাবি করার মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া উচিত নয়। নির্বাচনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব কর্মকর্তার চাকরি নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত থাকে; যাতে জবাবদিহিটা দ্রুত কার্যকর করা যায়। সংবিধানের এই রক্ষাকবচের সুফল আমরা পেতে চাই। অন্যথায় ভবিষ্যতে নির্বাচনে গোলাগুলি একটি সাংঘাতিক উপদ্রব হিসেবে দেখা দিতে পারে। বহু জায়গায় পেশিশক্তি একতরফা বলে সংঘাত কম হয়েছে। যেমন মহেশখালীর কুতুবজুমে বিএনপির প্রার্থী মাঝপথে ভোট বর্জন করেছেন। আবার টেকনাফে সামান্য দুই মেম্বার প্রার্থীর মধ্যকার সংঘাতেও পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন।
আবার প্রশাসন ও প্রার্থীরা মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন থাকলে রোল মডেল নির্বাচনও হতে পারে। শুরুতেই বলেছি, মাতারবাড়ীতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ৮ হাজার ৩৪৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৬ হাজার ৩৭২ এবং তাঁর থেকে মাত্র ৪০ ভোট কম পেয়ে বিএনপির প্রার্থী তৃতীয় হয়েছেন। একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ নির্বচন হয়েছে। সেখানকার জনগণ ও কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাই।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড শব্দটি জবরদস্তি মুছে ফেলা গেলে কেবল সরকারি দলেরই লাভ হবে, কোনো গোলযোগ নৈরাজ্য থাকবে না, শান্তি থাকবে, তাদের ভ্রান্তি ঘুচবে কি। সহিংসতায় অন্তত ২১ জন নিহত হওয়া ও বিদ্রোহী প্রার্থীর হিড়িক পড়ার ঘটনায় নির্বাচন কমিশন কি বিচলিত ? সে কি এখনও বলবে, তার নাম সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। তার কাজ হবে পোস্টবক্সের মতো। তার ডাকবাক্সে চিঠি জমা পড়বে। সেটা তিনি প্রাপককে পৌঁছে দেবেন। প্রেরক বা প্রাপক কারও নাম-পরিচয় তাঁর জানার দরকার নেই। কিন্তু এবারে কার্যত বিএনপি-জামায়াত বা তাদের কর্মী-সমর্থক যেখানে এতটাই কোণঠাসা, যা ক্ষমতাসীন দল অত্যন্ত আস্থার সঙ্গে গলা ফাটিয়ে দাবি করতে পারছে যে, বিএনপি জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পেট্রলবোমা ও জঙ্গি রাজনীতির কারণে তাদের ওপর থেকে আমজনতা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। দৃশ্যত তেমন একটা পরিবেশেও প্রত্যাশিত শান্তি মিলল না। বিএনপি সমাজে থেকেও নেই। মিছিলের জবাবে মিছিল, স্লোগানের জবাবে স্লোগান, সংঘাতের জবাবে সংঘাত করতে তাদের সামর্থ্য লাটে উঠেছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তা হলেও আমরা অহিংস ভোট পাচ্ছি না কেন। দলে শৃঙ্খলা থাকলে শতাধিক বিদ্রোহী কী করে জয়ী হলেন?
যখন ব্রিটেন ও ভারতকে দেখিয়ে স্থানীয় সরকারে দলীয় টিকিটে নির্বাচনের আইন করা হলো, তখনই আমরা আশঙ্কা করেছি যে, এই পরিবর্তনের সঙ্গে গণতন্ত্রের সম্পর্ক নেই। বিদ্রোহী প্রার্থী ঠেকাতে লাইসেন্স প্রথা চালু করা হয়েছে। কিন্তু এটা পরিষ্কার যে, এটা সুফল দেয়নি। বরং সমাজ ও নির্বাচনী ব্যবস্থার পবিত্রতা বলতে যেখানে যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা আরও দুর্বলতর হচ্ছে, কোথাও কোথাও মুখ থুবড়ে পড়ছে। মঠবাড়িয়ায় পাঁচজন ও টেকনাফে তিনজন নিহত ও মহেশখালীতে অন্তত ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।
প্রাথমিকভাবে যে বিবরণ পাচ্ছি, তাতে তিনটি স্থানেই গুলি এড়ানো সম্ভব ছিল। ইসির কাছে আমরা অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট না পেতে পারি। কিন্তু ভোটারদের স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি দাবি করতে পারি। বিজিবির মহাপরিচালক জাতিকে জানিয়েছেন, তাঁর সৈন্যরা ম্যাজিস্ট্রেটের লিখিত আদেশে গুলি চালিয়েছে। যেহেতু আইন মেনে হয়েছে, তাই এই গুলি বৈধ। কিন্তু আইন মান্য করা কাকে বলে। ম্যাজিস্ট্রেটকে কতগুলো শর্তসাপেক্ষ এই আদেশ দেওয়ার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি মোটেই এমন নয় যে, পদাধিকারবলে যেকোনো পরিস্থিতিতে গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া যায়। উদ্ভূত পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করতে হবে। কারণ, ম্যাজিস্ট্রেট বলেই মর্জিমাফিক সিদ্ধান্ত নিতে তাঁর এখতিয়ার নেই।
এখন ইসি কি বলবে, সহিংসতা তাদের দেখার বিষয় নয়। কারণ এর সঙ্গে ভোট গ্রহণ, গণনা ও তা প্রকাশের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু মঠবাড়িয়া ও টেকনাফে একটি করে কেন্দ্রের ফল প্রকাশ করা নিয়েই কিন্তু গুলির ঘটনা ঘটল।
মঠবাড়িয়ায় গোলযোগ হওয়া ইউনিয়নটির একটি কেন্দ্রে যেখানে ১ হাজার ৫৫৪ ভোট, সেটিই কেবল স্থগিত আছে, কিন্তু যে কেন্দ্রের ফল ঘোষণা নিয়ে এতগুলো তাজা প্রাণ ঝরে গেল, সেই কেন্দ্রের প্রশ্নবিদ্ধ ফলাফল ঘোষণা করা হলই। যে বিবরণ আমি দিচ্ছি, সেটা সঠিক হলে ওই কেন্দ্রের ফলাফল অবশ্যই বাতিল করতে হবে। বিএনপি এখানকার দৃশ্যপটে নেই। মঠবাড়িয়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো আওয়ামী লীগের সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর। স্বতন্ত্র প্রার্থী বিরোধপূর্ণ কেন্দ্র সাফা মহাবিদ্যালয়ের একজন প্রভাষক। সুতরাং সেখানে তিনি আর যা-ই হোন, কোনো আগন্তুক নন। উপরন্তু তাঁর স্বজনদের মধ্যে একজন অতিরিক্ত সচিব ও একজন টাকাওয়ালা ব্যক্তি আছেন। তাঁরা কী প্রভাব ফেলেছেন, সেটা আমরা নিশ্চিত নই। তবে ম্যাজিস্ট্রেট কী পরিস্থিতিতে বিজিবিকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন, সেটা মূল বিবেচ্য।
সাফা কলেজ কেন্দ্রে মোট ভোট ২ হাজার ৫৭৮। এর মধ্যে ১ হাজার ৬০৯টি ভোট পড়েছে। দেখার বিষয় হলো, প্রিসাইডিং অফিসার নৌকা মার্কায় সিল মারা ৭৪৬টি ভোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাঁর যুক্তি আইনগতভাবে সিদ্ধ। কারণ, ওই ব্যালট পেপারের মুড়িতে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের সই নেই। এই বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণই আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের ক্ষুব্ধ করে। কিন্তু বড় করে দেখার বিষয় হলো, যে কেন্দ্রে সারা দিনে প্রায় অর্ধেক অবৈধ ভোট পড়েছে, সেটা প্রিসাইডিং অফিসারের গণনা করতে বসে নজরে আসার বিষয় ছিল না। এই কেন্দ্রের ফল যদি বাতিল করে পুনর্নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হতো, তা হলে তা উত্তেজনা প্রশমনে সহায়ক হত কি না, সেটাও বিবেচ্য ছিল। বাস্তবে পাঁচজন মানুষের প্রাণহানির পরও কিন্তু ওই কেন্দ্রের ফলাফল বাতিল করা হয়নি; বরং ওই ৭৪৬ ভোট বাতিল করা হয়েছে।
রূঢ় বাস্তবতা হলো, আওয়ামী লীগের পাঁচ সমর্থক নিহত হলেন। অথচ প্রমাণ হলো না যে প্রশাসন নিরপেক্ষ বা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে। যদিও এখানে বিএনপি নেই। বিএনপির প্রার্থী মাত্র ১ হাজার ৮২ ভোট পেয়ে নিরব আছেন। মঠবাড়িয়ায় বরং বলা যায়, আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীই তাঁদের দলের প্রার্থীর বড় ক্ষতির কারণ হয়েছেন। কারণ, বিদ্রোহী প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ২৬ ভোট। এটা একটা অবাক করা বিষয় যে, যে কেন্দ্রে অর্ধেক ব্যালট ছিনতাই হওয়ার সন্দেহ দালিলিকভাবে প্রমাণিত, সেই কেন্দ্রে যথাসময়ে ফল ঘোষণা নিয়ে প্রিসাইডিং অফিসারকে অবরুদ্ধ হতে হয়েছে। তিনি যদি ওই কেন্দ্রের নির্বাচন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে অবরুদ্ধ হতেন, তা হলেও একটা সান্ত্বনা ছিল। কিন্তু তিনি একটি অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে অবরুদ্ধ হন।
এরপর কথা হলো গুলির বিকল্প ছিল কি না?
পাঁচটি হত্যাকাণ্ডের পরে এলাকায় কোনো বিক্ষোভ হয়নি, কোনো জ্বালাও-পোড়াওয়ের ঘটনা ঘটেনি। আওয়ামী লীগ প্রতিবাদ করেনি, এসব কী নির্দেশ করে? সন্ধ্যা সাতটা ২০ মিনিট থেকে রাত সাড়ে আটটা—মাঝখানে মাত্র ৭০ মিনিট সময়, এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা কী এমন করেছিলেন, যাতে গুলির কোনো বিকল্প ছিল না? মাইকে তাঁদের সতর্ক করা হয়নি।
মহেশখালীতে বিক্ষুব্ধ কর্মী, যাঁরা সেখানে ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে কমপক্ষে ১০০টি ফাঁকা গুলি চালানো হয়েছে। এলাকাবাসীর দাবি, বৃষ্টির মতো গুলি হয়েছে। ৫০০টির কম হবে না। বড় মহেশখালীতে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন না। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সঙ্গে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে দফায় দফায় হামলা হয়েছে; তাঁরা নিজেরাও গুলিবিনিময় করেছেন। উভয় পক্ষের ৩০ জন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু কেউ নিহত হননি।
মঠবাড়িয়ায় একজন ভোটার বিবিসিকে বলেছেন, বিক্ষুব্ধ লোকজন লগি-বৈঠা ব্যবহার করেছেন। তাঁরা আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার করেননি। মঠবাড়িয়ার গুলি চালানোর সপক্ষে দেখাতে হবে যে, অবরুদ্ধ কর্মকর্তাদের জীবন সত্যিই সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। অনেক সময় ৭০ মিনিট কেন, ১০ মিনিটের এদিক-সেদিকেও কারও জীবন বিপন্ন হতে পারে। কিন্তু খতিয়ে দেখার বিষয় হলো, সেখানে কাঁদানে গ্যাস বা রাবার বুলেট ব্যবহারের কোনো চেষ্টা ছিল কি না। দু-চারটি ফাঁকা গুলি না চালিয়ে কয়েক হাজার গুলি খরচ করেও যদি ‘উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ’ করা যায়, পাঁচ-পাঁচটি অমূল্য প্রাণের একটিকেও যদি কম ঝরানো যেত, তা হলে তো আমাদের সেই বিকল্পটাই বেছে নিতে হতো। সেই প্রচেষ্টা ছিল কি না, জাতির সেটা জানার অধিকার আছে। নাকি কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেটের মতো তুচ্ছ অস্ত্রের সরবরাহ ছিল না! নির্বাচন কমিশনের ফরমাশপত্রে নির্বাচনী উপকরণ হিসেবে ব্যালট বাক্স ও অমোচনীয় কালির সঙ্গে পর্যাপ্ত রাবার বুলেট আর কাঁদানে গ্যাসের উল্লেখ ছিল কি না? যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিশেষ কোনো বাহিনী লাগবে কি লাগবে না, সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তারা কেন রাবার বুলেট বা কাঁদানে গ্যাসের জোগানে ঘাটতি থাকলে তার কৈফিয়ত চাইবে না।
আমরা এখন ইসির মাধ্যমে জানতে চাই যে, মঠবাড়িয়ায় সত্যিই কি ‘ট্রিগ্যার হ্যাপি’ হওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প ছিল না? ওই গ্রামের মানুষেরা যদি এতটাই দুর্দান্ত-প্রকৃতির হবে, তা হলে তারা টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করল না কেন? ১৯৫০ সালের এনকোয়ারি অ্যাক্টের আওতায় মঠবাড়িয়ায় গুলিবর্ষণের বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করি।
এ ঘটনা কেবল বিজিবিপ্রধান এবং ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব স্বীকার বা ‘আইনসম্মত’ দাবি করার মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হওয়া উচিত নয়। নির্বাচনকালে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব কর্মকর্তার চাকরি নির্বাচন কমিশনের কাছে ন্যস্ত থাকে; যাতে জবাবদিহিটা দ্রুত কার্যকর করা যায়। সংবিধানের এই রক্ষাকবচের সুফল আমরা পেতে চাই। অন্যথায় ভবিষ্যতে নির্বাচনে গোলাগুলি একটি সাংঘাতিক উপদ্রব হিসেবে দেখা দিতে পারে। বহু জায়গায় পেশিশক্তি একতরফা বলে সংঘাত কম হয়েছে। যেমন মহেশখালীর কুতুবজুমে বিএনপির প্রার্থী মাঝপথে ভোট বর্জন করেছেন। আবার টেকনাফে সামান্য দুই মেম্বার প্রার্থীর মধ্যকার সংঘাতেও পুলিশের গুলিতে একজন নিহত হয়েছেন।
আবার প্রশাসন ও প্রার্থীরা মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন থাকলে রোল মডেল নির্বাচনও হতে পারে। শুরুতেই বলেছি, মাতারবাড়ীতে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হলো। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী ৮ হাজার ৩৪৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। তাঁর নিকটতম আওয়ামী লীগ প্রার্থী ৬ হাজার ৩৭২ এবং তাঁর থেকে মাত্র ৪০ ভোট কম পেয়ে বিএনপির প্রার্থী তৃতীয় হয়েছেন। একটি সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ নির্বচন হয়েছে। সেখানকার জনগণ ও কর্মকর্তাদের ধন্যবাদ জানাই।
No comments