শুধু জামায়াতে ইসলামির কর্মকাণ্ড দিয়েই বৈচিত্রময় আবিশ্ব ইসলামপন্থার বিচার সম্ভব? by আ-আল মামুন
কেমব্রিজ
ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত মইদুল ইসলামের গবেষণাগ্রন্থ ‘লিমিট্স অব
ইসলামিজম : জামায়ত -ই-ইসলামি ইন কনটেম্পোরারি ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশ ’
অ্যাকাডেমিক পরিসরে ও পণ্ডিতসমাজে নিশ্চিত ভাবেই বিশেষ আগ্রহ জন্ম দেবে৷
প্রথমত এ কারণে যে , নয়া উদারবাদের চাপ ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক
মতাদর্শ হিসেবে ইসলামপন্থা , বিশেষত যেটাকে মইদুল ‘জামায়াতে ইসলামপন্থা ’
আখ্যায়িত করেছেন , কোনও বিকল্প দর্শন হাজির করতে ও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে
কি না , নাকি ইসলামপন্থা অন্তর্গত ভাবেই অসঙ্গতিতে ভরা তিনি সেই উত্তর
খুঁজেছেন৷ এ কারণেও যে , ইসলামপন্থা নিয়ে গবেষণা ও আলোচনার বেশির ভাগটাই
পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলো থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত সীমাবদ্ধ৷ ভারত ও বাংলাদেশে
ইসলামপন্থার মতাদর্শ ও চর্চা নিয়ে গুরুত্ববহ কোনও কাজই হয়নি৷ যদিও বিশ্বের
মুসলমান জনগোষ্ঠীর ২০ ভাগ বাস করেন এই দু’টি দেশে৷ এই সব বিবেচনায় , মইদুল
ইসলামের গবেষণাগ্রন্থটি বিশেষ অভাব পূরণ করেছে ; এবং বলতেই হবে এ কাজের
মাধ্যমে তিনি বৈশ্বিক পরিসরে ইসলামপন্থা নিয়ে গবেষণারত অগ্রসর চিন্তকদের
মাঝে স্থান করে নিয়েছেন৷
তবে বাংলাদেশে কেবল পণ্ডিতমহলে নয় , রাজনীতি -সক্রিয় সর্ব মহলেই আগ্রহ ও আলোচনা চোখে পড়ছে৷ এমন এক সময়ে বইটি প্রকাশিত হয়েছে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ নানা অছিলায় নানা রূপে হাজির হচ্ছে , জনপরিসর ভরে উঠেছে রাজনৈতিক পন্থা ও পদ্ধতির দ্বন্দ্বে৷ জামায়েতে ইসলামি নামের রাজনৈতিক দলটিও বর্তমানে সঙ্কটময় রূপান্তরের কাল অতিক্রম করছে৷ বাংলাদেশ আন্দোলনের বিরোধিতাকারী এবং মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী এই দলটি স্বাধীনতা -উত্তর বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে কেবল পুনঃপ্রতিষ্ঠিতই হয়নি , তৃতীয় বৃহত্ রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে , অর্থনৈতিক ভাবে প্রবল হয়েছে , এমনকী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতারও শরিক হয়েছে৷ আর , ইদানীং যুদ্ধাপরাধের দায়ে গোলাম আজমসহ শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা দণ্ড পেয়েছেন , আরও অনেকের বিচার চলছে ; রাজনৈতিক দল হিসেবেও সংগঠনটির বৈধতা আদালতে বিচারাধীন৷ অর্থাত্, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে এক টান টান উত্তেজনাকর সময়ে বইটি প্রকাশিত হয়েছে৷
ফলত , মইদুল কী বলতে চেয়েছেন তা নিয়ে অনেকেই জিজ্ঞাসু হয়ে আছেন৷ তিনি গ্রন্থের শুরুতেই ইসলামপন্থা ও এর উত্থানের ইতিহাস , নয়া উদারবাদ , জাতি -রাষ্ট্র , রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদি ধারণা নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে নিয়েছেন৷ এও পরিষ্কার করে নিয়েছেন যে , বিশ্বাসের জগত ও রাজনীতির জগতকে আলাদা করার সনাতন অভ্যাস থেকে অনেক গবেষকের মতো তিনিও সরে এসেছেন৷ ইতোপূর্বে ধারণা করা হত , মতাদর্শ সেকুলার ব্যাপারস্যাপার এবং সেহেতু ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রাইভেট পরিসরে ঠেলে দাও৷ মইদুল বলছেন , মতাদর্শ নিয়ে সাম্প্রতিক ধ্যানধারণা অনুযায়ী একটা সর্বাত্মক ভুবনদৃষ্টির কারণে ইসলামপন্থাকে অবশ্যই আধুনিক রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে গণ্য করতে হবে৷ ব্যাপারটাকে তিনি এই ভাবে হাজির করেছেন , অ্যারিস্টটল আমাদের শিখিয়েছেন , ‘মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী৷ ’ এই বিবেচনাতেই মানুষের সমবায়ে গঠিত ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বস্ত্তত রাজনৈতিক৷
কিন্ত্ত ইসলামপন্থী কে? ইসলাম ধর্মের সকল মানুষই কি ? ইসলামপন্থী বা ইসলামিস্ট বলে মইদুল তাঁদেরকেই চিহ্নিত করেছেন যাঁরা মনে করেন ইসলাম পৃথিবীর তাবত্ মানুষের জন্যই একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান এবং দাবি করেন যে , এটি এমনই এক রাজনৈতিক মতাদর্শ যার উদ্দেশ্য শরিয়তভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম৷ অর্থাত্ ইসলামপন্থীদের কাছে ইসলাম কেবল ধর্ম নয় , রাজনৈতিক মতাদর্শ৷ ইসলামপন্থীদের তিনটি ভাগে মইদুল ভাগ করেন : মডারেট ইসলামিস্ট , মেইনস্ট্রিম ইসলামিস্ট এবং এক্সট্রিমিস্ট ইসলামিস্ট৷ এ বিবেচনায় , জামায়েত ইসলামিকে মডারেট ইসলামিস্ট দল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় , যেমন করা যায় মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে৷ মাহমুদ মাদানির সঙ্গে একমত হয়ে তিনি বলেন , ইসলামপন্থীর জন্ম ঔপনিবেশিক আধুনিকতার অন্তরে এবং পশ্চিমের সাপেক্ষে৷ ইসলামপন্থাকে মুসলমান সমাজগুলোতে ইউরো -আমেরিকান আধুনিকতা চর্চার ফলশ্রীতিতে তৈরি অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা যায়৷ পশ্চিমি আধুনিকতা ও পুঁজিবাদের বিকল্প হিসেবে ইসলামপন্থীরা ‘ইসলামি আধুনিকতা ’ বা ‘ইসলামি রাষ্ট্র ’র কথা বলেন, অথচ সে আধুনিকতা বা রাষ্ট্রকল্প পশ্চিমের কাছে ধার -করা ধারণা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হয়ে ওঠে না৷
পাবলিক পরিসরে ধর্মের রাজনৈতিক উপস্থিতি নিয়ে মইদুলের কোনও আপত্তি , সেহেতু, নেই৷ তিনি বরং রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে ইসলামপন্থা , বিশেষত জামায়াতে ইসলামপন্থার কড়িবর্গা মাপজোক করে দেখেছেন৷ আর , এই বিচারের জন্য তিনি উদারনৈতিকতার পথে ক্রমাগত হাঁটতে থাকা সাম্প্রতিক ভারত ও বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামির মতাদর্শ ও কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করেছেন৷ দেশে দেশে ‘ইসলামি রাষ্ট্র ’ কায়েমের ইউটোপিয়া নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলোর অন্যতম তত্ত্বগুরু আবুল আলা মওদুদির নেতৃত্বে ১৯৪৭ -এর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ -ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে ওঠা এই রাজনৈতিক দলটি ত্রিখণ্ড মহাভারতে নিজেও ত্রিধাবিভক্ত হয়েছে৷ মইদুল দেখতে পাচ্ছেন , ভারত ও বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামির চলন -বলন আলাদা , বলা চলে বিপরীতমুখী৷ ভারতে জামায়াতে ইসলামি নিম্নবর্গীয় চরিত্রের হলেও বাংলাদেশে তারা ক্ষমতাচক্রেরই অংশীদার , ভারতে নয়া উদারপন্থার বিরোধী হলেও বাংলাদেশে সহচর এমনকী বলা চলে নয়া উদারবাদের সুবিধাভোগী৷ ভারতে সেকুলার জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থীরা জামায়াতে ইসলামির মিত্রপক্ষ , অন্য দিকে বাংলাদেশে সেকুলার জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থীরা তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ৷ মইদুল দাবি করেন , এইসব বৈপরীত্য মূলত জামায়াতের মতাদর্শিক অসঙ্গতিরই প্রতিফলন৷
ভারতে মুসলমানদের অবস্থান সমাজের সবচেয়ে নিচুতলায় , দলিত ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাতারে৷ নয়া উদারবাদী পদক্ষেপগুলোর কারণে মুসলমানদের অবস্থা আরও তলানিতে গিয়ে ঠেকছে৷ ফলে , জামায়াত বামপন্থী ও দলিত বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে৷ কেবল মুসলমান নয় , দলিত নিম্নবর্গীয় মানুষদেরও স্বার্থে৷ তাদের অবস্থান ক্ষমতাগোষ্ঠীর বিপক্ষে৷ এমনকী , জামায়াতের ২৫০০০ বা তারও বেশি সদস্য ভিন্ন ধর্মের মানুষ৷ ফলে , জামায়াতের ‘ইসলামি উম্মাহ ’ ধারণা , যেখানে অমুসলিমরা বাদ পড়ে যায় এবং ভারতের বঞ্চিত সকল জনগণের হয়ে তাদের রাজনীতি বৈপরীত্যময় অবস্থানে গিয়ে পৌঁছায়৷ আবার , সংখ্যালঘু ‘অপর ’ হিসেবে মুসলমানদের বিশেষ স্বার্থ রক্ষা করতে জামায়াত ‘হিন্দুত্ববাদ ’কেই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে শনাক্ত করতে বাধ্য হয়৷ অন্য দিকে তারা যে পাশ্চাত্যবিরোধী সেই পাশ্চাত্য থেকে আসা সেকুলারপন্থাকেই নিজেদের পথ হিসেবে গ্রহণ করে নেয় , সেকুলার ও বামপন্থী দলগুলো তাদের মিত্র হয়ে ওঠে৷ এমনকী ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রধান গন্তব্য ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ নামের কল্পরাজ্য তৈরির বাসনাও ত্যাগ করতে হয়৷
অন্য দিকে, সংখ্যাগুরু মুসলমানের বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামির কাছে ‘ইসলামি রাষ্ট্র ’ কায়েম করা এক প্রবল মতাদর্শিক প্রবচন৷ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের মতোই জামায়াত বাংলাদেশে শরিয়তভিত্তিক ‘খাঁটি ’ ‘ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা’ কায়েম করতে চায়৷ অনুসারীদের কাছে পুঁজিবাদের বিপরীতে এই স্বপ্ন বিলি করে৷ অথচ , পুঁজিবাদের এই পর্যায়ের নয়া উদারবাদী প্রকল্পকেই তারা বাংলাদেশে এগিয়ে নিয়ে চলেছে৷ আর এ কারণেই নয়া উদারপন্থা সমর্থক প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগ ও বিএনপি ’র সীমা ছাড়িয়ে তারা এগোতে পারে না , কোনও বিকল্প রাজনৈতিক পন্থাও জনগণের সামনে হাজির করতে পারে না৷ নির্বাচনে তাদের জনসমর্থন ৩ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খায়৷ বাংলাদেশে জনস্বার্থ পরিপন্থী নয়া উদারবাদী পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে জামায়াত সোচ্চার হয় না , বরং সুবিধা ভোগ করে৷ কিন্ত্ত নয়া উদারবাদ উপজাত সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশ যেমন নাস্তিকতা , যৌনতা ইত্যাদি নিয়ে মাঠ গরম করে রাখে , নীতিপুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়৷ মইদুল এ সব বৈপরীত্যকেও তুলে ধরে দাবি করেছেন , এর উত্স নিহিত আছে মূলত দলটির মতাদর্শিক অসঙ্গতির মধ্যে৷
সর্বোপরি জামায়াতে ইসলামি এবং এরকম ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে যে , সকল ‘মনুষ্য -তৈরি মতাদর্শ’ এবং ধর্ম ব্যর্থ হবে ; কারণ সেগুলো মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলোর (অসাম্য ও অবিচার ) কোনও সমাধান দিতে পারে না, কিন্ত্ত ‘মুক্তিদায়ী মতাদর্শ’ হিসেবে ইসলাম সকল সমাধান দিতে পারে৷ মওদুদি বলতেন ইসলামপন্থা সমাজতন্ত্রও নয় পুঁজিবাদও নয় বরং মধ্যপন্থা৷ কিন্ত্ত মইদুল দেখতে পান , ‘মধ্যপন্থা ’ বলে তিনি এবং অন্যান্য তাত্ত্বিকরা যে ইসলামি রাষ্ট্রকল্প খাড়া করেছেন তা বস্ত্তত পুঁজিবাদেরই অধীন , যাকে বড়োজোর কল্যাণমূলক ‘নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ ’ আখ্যা দেওয়া চলে৷ মার্কেট হবে নিয়ন্ত্রিত , কিন্ত্ত কিছুতেই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধ নয়৷ ব্যক্তিমালিকানা ও মজুরি শ্রম সমান ভাবেই সচল থাকবে৷ সুদের বিরুদ্ধে কথা বললেও লভ্যাংশ নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই জামায়াতের৷ কিন্ত্ত মার্কস আমাদের দেখিয়ে গেছেন , সুদ ও লভ্যাংশ দুইই উদ্বৃত্ত তৈরি করে --- যা পুুঁজিবাদের প্রাণভোমরা৷ উপরন্ত্ত নিরঙ্কুশ আধিপত্যবাদী সেই রাষ্ট্রে নারী , বিধর্মী এবং অন্যান্য অপরদের অবস্থান আবশ্যিক ভাবেই দ্বিতীয় কাতারে৷ এও এক গুরুতর অসঙ্গতি বটে৷
জামায়াতে ইসলামির মতাদর্শগত সীমাবদ্ধতা , বাংলাদেশ ও ভারতে দলটির রাজনৈতিক শত্রু ও মিত্রপক্ষ নির্ধারণের বৈপরীত্য এবং বিশেষত ভারতে নয়া উদারবাদের বিরোধিতা অথচ বাংলাদেশে সহচরী ভূমিকা মইদুল যথার্থই শনাক্ত করতে পেরেছেন৷ তবে , জামায়াতে ইসলামির মতাদর্শ ও কর্মকাণ্ড বিচার করেই বিশ্বব্যাপী বৈচিত্রময় ইসলামপন্থী রাজনীতির সীমানা দেগে দেওয়া যায় কি ? বইটির শিরোনামের প্রথম অংশে সেই রকম প্রস্তাবনা থাকলেও আমরা উত্তর পাই কেবল জামায়াতে ইসলামি প্রসঙ্গে৷ তা ছাড়া , সীমানাভাঙা বর্তমানে কেবল ইসলামপন্থা না , সঙ্কটে আছে সর্বজনমান্যতা দাবিকারি সকল মতাদর্শই, এমনকী ‘রাজনীতি ’ বলে এত কাল আমরা যে ধারণাটি চিনতাম তাও৷ মইদুল ইসলাম বার বার ‘প্রগতিশীল ’ রাজনীতির কথা বলেছেন , যা বইটির শেষভাগে স্পষ্ট হয় : পশ্চিমের বিপরীতে প্রতিবাদী মতাদর্শ হিসেবে ইসলামপন্থাকে অনেকেই উদ্যাপন করেন৷ কিন্ত্ত এই বিপরীত ক্যাম্পের কোনও একটিকে আস্থা রাখার বদলে বরং আমাদের উচিত এমন এক সমালোচনাত্মক বুদ্ধিবৃত্তিক ডিসকোর্স গড়ে তোলা যা একইসঙ্গে প্রাচ্যবাদ , নয়াউদারবাদ , এবং সর্বোপরি ইসলামপন্থার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে৷ কারণ , মুক্তিদায়ী আদর্শের কথা বললেও ইসলামপন্থা এমন এক রাজনৈতিক প্রকল্প খাড়া করে যা বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চলমান শোষণ -পীড়নকেই ভিন্ন নামে সচল রাখতে চায়৷
কিন্ত্ত সেই সমালোচনাত্মক ডিসকোর্স গড়ে ওঠার জন্য বোধ হয় আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে৷ বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলন , ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন কিংবা আরব বসন্ত বিচার করলে আমরা বলতে পারি , পুরাতন সকল রাজনৈতিক মতাদর্শই ‘এমটি সিগনিফায়ার ’ হয়ে উঠেছে , যেমন অর্থহীন হয়ে উঠেছে খোদ গণতন্ত্র ধারণা৷ আমরা এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি যার রাজনৈতিক ভাষা এখনও অঙ্কুরোদগমের অপেক্ষায়৷
লেখক বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকইসলামপন্থা কি দিতে পারে নয়া উদারবাদের বিকল্প রাজনৈতিক মতাদর্শ? উত্তরের খোঁজে একটি বই৷ পড়লেন আ -আল মামুনলিমিট্স অফ ইসলামিজম : জামায়ত -ই-ইসলামি ইন কনটেম্পোরারি ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশমইদুল ইসলামকেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস৷ ৬২০ টাকাইসলামপন্থী বা ইসলামিস্ট বলে মইদুল ইসলাম তাঁদেরকেই চিহ্নিত করেছেন যাঁরা মনে করেন ইসলাম পৃথিবীর তাবত্ মানুষের জন্যই একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান এবং দাবি করেন যে , এটি এমনই এক রাজনৈতিক মতাদর্শ যার উদ্দেশ্য শরিয়তভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম৷
সুত্রঃ এই সময়
তবে বাংলাদেশে কেবল পণ্ডিতমহলে নয় , রাজনীতি -সক্রিয় সর্ব মহলেই আগ্রহ ও আলোচনা চোখে পড়ছে৷ এমন এক সময়ে বইটি প্রকাশিত হয়েছে যখন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ ও ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ নানা অছিলায় নানা রূপে হাজির হচ্ছে , জনপরিসর ভরে উঠেছে রাজনৈতিক পন্থা ও পদ্ধতির দ্বন্দ্বে৷ জামায়েতে ইসলামি নামের রাজনৈতিক দলটিও বর্তমানে সঙ্কটময় রূপান্তরের কাল অতিক্রম করছে৷ বাংলাদেশ আন্দোলনের বিরোধিতাকারী এবং মুক্তিযুদ্ধকালে গণহত্যায় সরাসরি অংশগ্রহণকারী এই দলটি স্বাধীনতা -উত্তর বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতিতে কেবল পুনঃপ্রতিষ্ঠিতই হয়নি , তৃতীয় বৃহত্ রাজনৈতিক দল হয়ে উঠেছে , অর্থনৈতিক ভাবে প্রবল হয়েছে , এমনকী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতারও শরিক হয়েছে৷ আর , ইদানীং যুদ্ধাপরাধের দায়ে গোলাম আজমসহ শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকজন নেতা দণ্ড পেয়েছেন , আরও অনেকের বিচার চলছে ; রাজনৈতিক দল হিসেবেও সংগঠনটির বৈধতা আদালতে বিচারাধীন৷ অর্থাত্, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিসরে এক টান টান উত্তেজনাকর সময়ে বইটি প্রকাশিত হয়েছে৷
ফলত , মইদুল কী বলতে চেয়েছেন তা নিয়ে অনেকেই জিজ্ঞাসু হয়ে আছেন৷ তিনি গ্রন্থের শুরুতেই ইসলামপন্থা ও এর উত্থানের ইতিহাস , নয়া উদারবাদ , জাতি -রাষ্ট্র , রাজনৈতিক মতাদর্শ ইত্যাদি ধারণা নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে নিয়েছেন৷ এও পরিষ্কার করে নিয়েছেন যে , বিশ্বাসের জগত ও রাজনীতির জগতকে আলাদা করার সনাতন অভ্যাস থেকে অনেক গবেষকের মতো তিনিও সরে এসেছেন৷ ইতোপূর্বে ধারণা করা হত , মতাদর্শ সেকুলার ব্যাপারস্যাপার এবং সেহেতু ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রাইভেট পরিসরে ঠেলে দাও৷ মইদুল বলছেন , মতাদর্শ নিয়ে সাম্প্রতিক ধ্যানধারণা অনুযায়ী একটা সর্বাত্মক ভুবনদৃষ্টির কারণে ইসলামপন্থাকে অবশ্যই আধুনিক রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে গণ্য করতে হবে৷ ব্যাপারটাকে তিনি এই ভাবে হাজির করেছেন , অ্যারিস্টটল আমাদের শিখিয়েছেন , ‘মানুষ রাজনৈতিক প্রাণী৷ ’ এই বিবেচনাতেই মানুষের সমবায়ে গঠিত ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বস্ত্তত রাজনৈতিক৷
কিন্ত্ত ইসলামপন্থী কে? ইসলাম ধর্মের সকল মানুষই কি ? ইসলামপন্থী বা ইসলামিস্ট বলে মইদুল তাঁদেরকেই চিহ্নিত করেছেন যাঁরা মনে করেন ইসলাম পৃথিবীর তাবত্ মানুষের জন্যই একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান এবং দাবি করেন যে , এটি এমনই এক রাজনৈতিক মতাদর্শ যার উদ্দেশ্য শরিয়তভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম৷ অর্থাত্ ইসলামপন্থীদের কাছে ইসলাম কেবল ধর্ম নয় , রাজনৈতিক মতাদর্শ৷ ইসলামপন্থীদের তিনটি ভাগে মইদুল ভাগ করেন : মডারেট ইসলামিস্ট , মেইনস্ট্রিম ইসলামিস্ট এবং এক্সট্রিমিস্ট ইসলামিস্ট৷ এ বিবেচনায় , জামায়েত ইসলামিকে মডারেট ইসলামিস্ট দল হিসেবে চিহ্নিত করা যায় , যেমন করা যায় মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডকে৷ মাহমুদ মাদানির সঙ্গে একমত হয়ে তিনি বলেন , ইসলামপন্থীর জন্ম ঔপনিবেশিক আধুনিকতার অন্তরে এবং পশ্চিমের সাপেক্ষে৷ ইসলামপন্থাকে মুসলমান সমাজগুলোতে ইউরো -আমেরিকান আধুনিকতা চর্চার ফলশ্রীতিতে তৈরি অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই দেখা যায়৷ পশ্চিমি আধুনিকতা ও পুঁজিবাদের বিকল্প হিসেবে ইসলামপন্থীরা ‘ইসলামি আধুনিকতা ’ বা ‘ইসলামি রাষ্ট্র ’র কথা বলেন, অথচ সে আধুনিকতা বা রাষ্ট্রকল্প পশ্চিমের কাছে ধার -করা ধারণা ছাড়া কিছুতেই সম্ভব হয়ে ওঠে না৷
পাবলিক পরিসরে ধর্মের রাজনৈতিক উপস্থিতি নিয়ে মইদুলের কোনও আপত্তি , সেহেতু, নেই৷ তিনি বরং রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে ইসলামপন্থা , বিশেষত জামায়াতে ইসলামপন্থার কড়িবর্গা মাপজোক করে দেখেছেন৷ আর , এই বিচারের জন্য তিনি উদারনৈতিকতার পথে ক্রমাগত হাঁটতে থাকা সাম্প্রতিক ভারত ও বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামির মতাদর্শ ও কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করেছেন৷ দেশে দেশে ‘ইসলামি রাষ্ট্র ’ কায়েমের ইউটোপিয়া নিয়ে গড়ে ওঠা আন্দোলনগুলোর অন্যতম তত্ত্বগুরু আবুল আলা মওদুদির নেতৃত্বে ১৯৪৭ -এর পূর্ববর্তী ব্রিটিশ -ভারতীয় উপমহাদেশে গড়ে ওঠা এই রাজনৈতিক দলটি ত্রিখণ্ড মহাভারতে নিজেও ত্রিধাবিভক্ত হয়েছে৷ মইদুল দেখতে পাচ্ছেন , ভারত ও বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামির চলন -বলন আলাদা , বলা চলে বিপরীতমুখী৷ ভারতে জামায়াতে ইসলামি নিম্নবর্গীয় চরিত্রের হলেও বাংলাদেশে তারা ক্ষমতাচক্রেরই অংশীদার , ভারতে নয়া উদারপন্থার বিরোধী হলেও বাংলাদেশে সহচর এমনকী বলা চলে নয়া উদারবাদের সুবিধাভোগী৷ ভারতে সেকুলার জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থীরা জামায়াতে ইসলামির মিত্রপক্ষ , অন্য দিকে বাংলাদেশে সেকুলার জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থীরা তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ৷ মইদুল দাবি করেন , এইসব বৈপরীত্য মূলত জামায়াতের মতাদর্শিক অসঙ্গতিরই প্রতিফলন৷
ভারতে মুসলমানদের অবস্থান সমাজের সবচেয়ে নিচুতলায় , দলিত ও পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কাতারে৷ নয়া উদারবাদী পদক্ষেপগুলোর কারণে মুসলমানদের অবস্থা আরও তলানিতে গিয়ে ঠেকছে৷ ফলে , জামায়াত বামপন্থী ও দলিত বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে একই প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে৷ কেবল মুসলমান নয় , দলিত নিম্নবর্গীয় মানুষদেরও স্বার্থে৷ তাদের অবস্থান ক্ষমতাগোষ্ঠীর বিপক্ষে৷ এমনকী , জামায়াতের ২৫০০০ বা তারও বেশি সদস্য ভিন্ন ধর্মের মানুষ৷ ফলে , জামায়াতের ‘ইসলামি উম্মাহ ’ ধারণা , যেখানে অমুসলিমরা বাদ পড়ে যায় এবং ভারতের বঞ্চিত সকল জনগণের হয়ে তাদের রাজনীতি বৈপরীত্যময় অবস্থানে গিয়ে পৌঁছায়৷ আবার , সংখ্যালঘু ‘অপর ’ হিসেবে মুসলমানদের বিশেষ স্বার্থ রক্ষা করতে জামায়াত ‘হিন্দুত্ববাদ ’কেই প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে শনাক্ত করতে বাধ্য হয়৷ অন্য দিকে তারা যে পাশ্চাত্যবিরোধী সেই পাশ্চাত্য থেকে আসা সেকুলারপন্থাকেই নিজেদের পথ হিসেবে গ্রহণ করে নেয় , সেকুলার ও বামপন্থী দলগুলো তাদের মিত্র হয়ে ওঠে৷ এমনকী ইসলামপন্থী রাজনীতির প্রধান গন্তব্য ‘ইসলামি রাষ্ট্র’ নামের কল্পরাজ্য তৈরির বাসনাও ত্যাগ করতে হয়৷
অন্য দিকে, সংখ্যাগুরু মুসলমানের বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামির কাছে ‘ইসলামি রাষ্ট্র ’ কায়েম করা এক প্রবল মতাদর্শিক প্রবচন৷ অন্যান্য ইসলামপন্থী দলের মতোই জামায়াত বাংলাদেশে শরিয়তভিত্তিক ‘খাঁটি ’ ‘ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা’ কায়েম করতে চায়৷ অনুসারীদের কাছে পুঁজিবাদের বিপরীতে এই স্বপ্ন বিলি করে৷ অথচ , পুঁজিবাদের এই পর্যায়ের নয়া উদারবাদী প্রকল্পকেই তারা বাংলাদেশে এগিয়ে নিয়ে চলেছে৷ আর এ কারণেই নয়া উদারপন্থা সমর্থক প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামি লিগ ও বিএনপি ’র সীমা ছাড়িয়ে তারা এগোতে পারে না , কোনও বিকল্প রাজনৈতিক পন্থাও জনগণের সামনে হাজির করতে পারে না৷ নির্বাচনে তাদের জনসমর্থন ৩ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খায়৷ বাংলাদেশে জনস্বার্থ পরিপন্থী নয়া উদারবাদী পদক্ষেপগুলোর বিরুদ্ধে জামায়াত সোচ্চার হয় না , বরং সুবিধা ভোগ করে৷ কিন্ত্ত নয়া উদারবাদ উপজাত সাংস্কৃতিক অভিপ্রকাশ যেমন নাস্তিকতা , যৌনতা ইত্যাদি নিয়ে মাঠ গরম করে রাখে , নীতিপুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়৷ মইদুল এ সব বৈপরীত্যকেও তুলে ধরে দাবি করেছেন , এর উত্স নিহিত আছে মূলত দলটির মতাদর্শিক অসঙ্গতির মধ্যে৷
সর্বোপরি জামায়াতে ইসলামি এবং এরকম ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো দাবি করে যে , সকল ‘মনুষ্য -তৈরি মতাদর্শ’ এবং ধর্ম ব্যর্থ হবে ; কারণ সেগুলো মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলোর (অসাম্য ও অবিচার ) কোনও সমাধান দিতে পারে না, কিন্ত্ত ‘মুক্তিদায়ী মতাদর্শ’ হিসেবে ইসলাম সকল সমাধান দিতে পারে৷ মওদুদি বলতেন ইসলামপন্থা সমাজতন্ত্রও নয় পুঁজিবাদও নয় বরং মধ্যপন্থা৷ কিন্ত্ত মইদুল দেখতে পান , ‘মধ্যপন্থা ’ বলে তিনি এবং অন্যান্য তাত্ত্বিকরা যে ইসলামি রাষ্ট্রকল্প খাড়া করেছেন তা বস্ত্তত পুঁজিবাদেরই অধীন , যাকে বড়োজোর কল্যাণমূলক ‘নিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ ’ আখ্যা দেওয়া চলে৷ মার্কেট হবে নিয়ন্ত্রিত , কিন্ত্ত কিছুতেই পুঁজিবাদের বিরুদ্ধ নয়৷ ব্যক্তিমালিকানা ও মজুরি শ্রম সমান ভাবেই সচল থাকবে৷ সুদের বিরুদ্ধে কথা বললেও লভ্যাংশ নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই জামায়াতের৷ কিন্ত্ত মার্কস আমাদের দেখিয়ে গেছেন , সুদ ও লভ্যাংশ দুইই উদ্বৃত্ত তৈরি করে --- যা পুুঁজিবাদের প্রাণভোমরা৷ উপরন্ত্ত নিরঙ্কুশ আধিপত্যবাদী সেই রাষ্ট্রে নারী , বিধর্মী এবং অন্যান্য অপরদের অবস্থান আবশ্যিক ভাবেই দ্বিতীয় কাতারে৷ এও এক গুরুতর অসঙ্গতি বটে৷
জামায়াতে ইসলামির মতাদর্শগত সীমাবদ্ধতা , বাংলাদেশ ও ভারতে দলটির রাজনৈতিক শত্রু ও মিত্রপক্ষ নির্ধারণের বৈপরীত্য এবং বিশেষত ভারতে নয়া উদারবাদের বিরোধিতা অথচ বাংলাদেশে সহচরী ভূমিকা মইদুল যথার্থই শনাক্ত করতে পেরেছেন৷ তবে , জামায়াতে ইসলামির মতাদর্শ ও কর্মকাণ্ড বিচার করেই বিশ্বব্যাপী বৈচিত্রময় ইসলামপন্থী রাজনীতির সীমানা দেগে দেওয়া যায় কি ? বইটির শিরোনামের প্রথম অংশে সেই রকম প্রস্তাবনা থাকলেও আমরা উত্তর পাই কেবল জামায়াতে ইসলামি প্রসঙ্গে৷ তা ছাড়া , সীমানাভাঙা বর্তমানে কেবল ইসলামপন্থা না , সঙ্কটে আছে সর্বজনমান্যতা দাবিকারি সকল মতাদর্শই, এমনকী ‘রাজনীতি ’ বলে এত কাল আমরা যে ধারণাটি চিনতাম তাও৷ মইদুল ইসলাম বার বার ‘প্রগতিশীল ’ রাজনীতির কথা বলেছেন , যা বইটির শেষভাগে স্পষ্ট হয় : পশ্চিমের বিপরীতে প্রতিবাদী মতাদর্শ হিসেবে ইসলামপন্থাকে অনেকেই উদ্যাপন করেন৷ কিন্ত্ত এই বিপরীত ক্যাম্পের কোনও একটিকে আস্থা রাখার বদলে বরং আমাদের উচিত এমন এক সমালোচনাত্মক বুদ্ধিবৃত্তিক ডিসকোর্স গড়ে তোলা যা একইসঙ্গে প্রাচ্যবাদ , নয়াউদারবাদ , এবং সর্বোপরি ইসলামপন্থার আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে৷ কারণ , মুক্তিদায়ী আদর্শের কথা বললেও ইসলামপন্থা এমন এক রাজনৈতিক প্রকল্প খাড়া করে যা বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চলমান শোষণ -পীড়নকেই ভিন্ন নামে সচল রাখতে চায়৷
কিন্ত্ত সেই সমালোচনাত্মক ডিসকোর্স গড়ে ওঠার জন্য বোধ হয় আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে৷ বাংলাদেশের শাহবাগ আন্দোলন , ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন কিংবা আরব বসন্ত বিচার করলে আমরা বলতে পারি , পুরাতন সকল রাজনৈতিক মতাদর্শই ‘এমটি সিগনিফায়ার ’ হয়ে উঠেছে , যেমন অর্থহীন হয়ে উঠেছে খোদ গণতন্ত্র ধারণা৷ আমরা এমন এক সময়ে এসে দাঁড়িয়েছি যার রাজনৈতিক ভাষা এখনও অঙ্কুরোদগমের অপেক্ষায়৷
লেখক বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকইসলামপন্থা কি দিতে পারে নয়া উদারবাদের বিকল্প রাজনৈতিক মতাদর্শ? উত্তরের খোঁজে একটি বই৷ পড়লেন আ -আল মামুনলিমিট্স অফ ইসলামিজম : জামায়ত -ই-ইসলামি ইন কনটেম্পোরারি ইন্ডিয়া অ্যান্ড বাংলাদেশমইদুল ইসলামকেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস৷ ৬২০ টাকাইসলামপন্থী বা ইসলামিস্ট বলে মইদুল ইসলাম তাঁদেরকেই চিহ্নিত করেছেন যাঁরা মনে করেন ইসলাম পৃথিবীর তাবত্ মানুষের জন্যই একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান এবং দাবি করেন যে , এটি এমনই এক রাজনৈতিক মতাদর্শ যার উদ্দেশ্য শরিয়তভিত্তিক ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম৷
সুত্রঃ এই সময়
No comments