ড. আতিউর কিসের শাস্তি পেলেন? by মিজানুর রহমান খান
গত
১৬ মার্চ অনলাইনে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদত্যাগী গভর্নর ড. আতিউর রহমানকে
নিয়ে প্রকাশিত দুটি লেখার একটি মোক্ষম উত্তর দিয়েছেন আওয়ামী লীগের
উপদেষ্টা পরিষদের প্রবীণ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তাঁর পদত্যাগের বিষয়ে
সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, ‘সবাইকে একসঙ্গে খুশি করা যায় না। এটা বিরল
আত্মত্যাগ এটাও যেমন ঠিক আবার তাঁকে গভর্নর রাখা যাবে না, এটাও ঠিক। দুইটা
একসঙ্গে ঠিক হতে পারে না।’
অথচ নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও নূহ-উল-আলম লেনিনের লেখায় একটি অভিন্ন সুর ছিল যে তিনি পদত্যাগ করে একটি ভালো নজির স্থাপন করেছেন। ইউসুফ সাহেব লিখেছেন, তিনি ‘দায়িত্ব’ নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। আমার নিজেরও তেমনই ধারণা ছিল। এবং অনেক উচ্ছ্বাসভরে আমি একটি লেখার মুসাবিদা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু সেই লেখা টেকেনি। আমি যদিও জানতাম যে রিজার্ভ হ্যাকড হওয়ার ঘটনায় ‘গোপনীয়তা’ রক্ষার অজুহাত দেখানোর জন্য অর্থমন্ত্রী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তাকে ‘স্পর্ধা’ (অডাসিটি) বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিবর্তন আসছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনের দিনক্ষণ স্থির করলেন, তখনই ইঙ্গিত পরিষ্কার ছিল। তারপরও আতিউর রহমান যখন সংবাদ সম্মেলনে ‘বীরের মতো’ প্রস্থানের দাবি করলেন, তখন আমি তাঁকে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিতে চেয়েছি। কারণ, তিনি সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন। অবশ্য সংবাদ সম্মেলনে তিনি এবার নিজেই দাবি করেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ২৮ বছর ধরে আমাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন’।
তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন মানুষ তিনি। নিজের মেধা ও যোগ্যতায় সমাজের তলানি থেকে এতটা উঁচুতে উঠেছেন। আমি খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম, যখন এটা জানলাম যে তিনি বড় হয়ে তাঁর গ্রামের সেই বাজারে গিয়েছিলেন, যেখানে একদিন রীতিমতো খুচরা পয়সা ও টাকা জোগাড় করে তাঁর পড়াশোনার তহবিল জোগাড় হয়েছিল। সেই খবরের বিবরণ পড়ে আমি একটি দৃশ্য কল্পনা করেছি এবং আবেগে আপ্লুত হয়েছি। আতিউর রহমানের সই করা কড়কড়ে টাকার নোট। সেই টাকা এবং আতিউরকে ছুঁয়ে দেখে গর্বিত হচ্ছেন গ্রামের কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, যিনি একদিন হয়তো বা একটি সিকি কি আধুলি আতিউর রহমানের জন্য দান করেছিলেন। আমি তাঁকে রোল মডেল ভেবেছি, নিশ্চয় তিনি রোল মডেল!
কিন্তু আমি অনেক আগেই অস্বস্তির সঙ্গে আতিউর রহমানের একটা পরিবর্তন দেখেছিলাম। আমি আগেকার শেরাটন–সংলগ্ন ভবনে তাঁর দপ্তরে অনেকবার গিয়েছি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তবে সেটা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার কথা। তখন তিনি উজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন এবং দেখাতেন। এবং আমার ভালো লাগত যে তিনি রাজনীতি–সচেতন। কিন্তু কোনো দলের অন্যায্য কোনো বিষয়কে প্রশ্রয় দিতেন না। একজন শিক্ষাবিদের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর মধ্যে অবশ্যই খুঁজে পেতাম। আর সেটাই ছিল ভরসার জায়গা। গভর্নর হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে মাত্র একবার এক মিনিট কথা হয়েছিল। গভর্নরের পদে থেকে তিনি এমন সব বিষয় নিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়েছেন যা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাঁর কাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। ওই কাজ করার লোকের কোনো আকালও পড়েনি। অথচ তিনি গভর্নর পদের যে নির্দলীয় কৌলীন্য সেটা বজায় রাখতে বা জনগণের চোখে দৃশ্যমান করে তুলতে আগ্রহী ছিলেন না। পদমর্যাদার সঙ্গে বেমানান কাজ কতটা স্বেচ্ছায় আর কতটা চাপে পড়ে করেছেন, তা বলতে পারব না। অবশ্য একজন অর্থনীতিবিদ, আতিউর যাঁর স্নেহভাজন, আমাকে বলেছেন, ওই পদে তিনি তাঁর নিয়োগ পছন্দ করেননি। কারণ, গভর্নরের পদে এমন ব্যক্তির যাওয়া উচিত নয়, যিনি কোনো একটি দলের রাজনীতি বিষয়ে প্রগল্ভ।
আরও বহু কারণে আশাভঙ্গ ঘটলেও আমি ভাবতে প্রস্তুত ছিলাম যে একটা ন্যূনতম নৈতিকতার জোর না থাকলে আতিউর রহমান জাতির সামনে অনেকটা হলফ করেই নৈতিক সাহস প্রদর্শন করতেন না। কারণ, যা নয় তা বাস্তবের মতো জনসমক্ষে ফুটিয়ে তোলাটা একশ্রেণির রাজনীতিকের অভ্যাসগত। মানুষ তাঁদের হাসি ও কান্নাকে সেভাবেই দেখে থাকে। কিন্তু আতিউর রহমান শিক্ষক। তিনি কখনো পল্টনে বক্তৃতা করেননি। এখন আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে তাঁকে পদত্যাগের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল এবং তারপরও তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। যখন তিনি বুঝলেন তাঁকে আর কেউ রক্ষা করবে না, তখন তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। আমি অবশ্য একটি মিডিয়ায় আতিউর রহমানের দিল্লি সফরের ঔচিত্য নিয়ে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন দেখেও বাতাস ঘুরে যাওয়াটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। মন্ত্রীদের চাপের মুখে পদত্যাগ করানো একটা শাস্তি। সেই খবরের শিরোনাম হয়ে থাকে ‘মন্ত্রী অপসারিত’। কিন্তু মিডিয়ায় এই শিরোনাম আসেনি যে ‘গভর্নর অপসারিত’। যদিও ড. আতিউর মন্ত্রীদের মতোই প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ‘রীতিবহির্ভূত’ পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন।
তাঁর ‘সাহসী পদত্যাগ’ বিষয়ে ইউসুফ ও লেনিন সাহেবেরা যা বলেছেন, তাকে নির্বিবাদে মেনে নেওয়া যায় না। অবশ্য লেনিনের একটি মূল্যায়ন অনবদ্য। তিনি জনগণের মনের কথা বলেছেন। সেটা হলো, ‘ঘটনার জন্য যে-ই দায়ী হোক না কেন, প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তিনি পদত্যাগ করে যে নজির স্থাপন করলেন, অন্যান্য ক্ষেত্রেও যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।’ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম যে রাষ্ট্রীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রে এ রকম ‘নতুন মাত্রা’ যুক্ত করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আর্থিক খাতে এই ধরনের চাপ প্রয়োগ এবং তা থেকে এ রকম ত্বরিত ফল আশা করব।
কিন্তু এটা বাস্তবে ঠিক এভাবে ঘটতে পারে তা হলফ করে বলা যাবে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যদিও বলেছেন যে দুটি বিষয় একসঙ্গে সত্য হতে পারে না। কিন্তু তদুপরি আমি বলব, আতিউর রহমানের জন্য একটি পয়েন্ট টিকে যাবে। সেটা হলো, এ রকম আরও অন্য ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে চাপ দেওয়া হবে না, আর যদি দেওয়াও হয়, তাহলে তাতে ত্বরিত ফল মিলবে তা বলা যাবে না।
আমার মনে হয়, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ‘দলীয় বিবেচনায়’ কোনো নির্দলীয় অবস্থানে তুলনামূলক কম দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্নকে বসাতে নেই। আতিউর রহমানকে আমরা জনস্বার্থের বিপরীতে ‘দলীয় উদ্দেশ্য’ পূরণ করে চলতে দেখেছি। অস্ফুটে এক-আধটু আপত্তি তোলার সঙ্গে আমরা তাঁকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনাকে গা-সওয়া ব্যাপারে পরিণত করতে দেখেছি। এবং আমাদের কাছে এ রকম কোনো খবর নেই যে তিনি ওই লুটপাট ঠেকাতে ‘বীরের মতো’ কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিংবা কখনো পদত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছিলেন।
অবশ্য আমাদের দেশে পদত্যাগ কে কবে করেছে বা দেখেছে। অথচ এটা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অক্সিজেন। তবে দেখার বিষয় হলো, এটা একটা মন্দের ভালো ঘটনা। কারণ, শুধু চাপে কিংবা আধা চাপ বা আধা নৈতিকতায় জাতি একটি ‘ত্যাগ’ দেখেছে। একে একটা বড় রূপান্তরের আগমনী বার্তা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। সেটা হলো, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে বাধ্য হওয়া। বিএনপি বা বিরোধীদের কেউ সেভাবে পদত্যাগ চায়নি, কেউ হরতাল ডাকেনি। অথচ অঘটনটা ঘটেছে। আর আমরা এখন তা নিয়ে সম্ভবত একটা অনাবশ্যক তর্কে নেমেছি।
আতিউর রহমানের ‘তিলে তিলে রিজার্ভ’ গড়ার বিষয়ে লেনিন ঠিকই উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এর সমস্যাটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। আমার পানি, আমার পাখি, আমার মানুষ এসব বলা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আছে। ব্যক্তির বন্দনা করে অহরহ বক্তৃতা দেওয়া তার প্রমাণ। তবে লেনিন বলেছেন রিজার্ভ চুরির বিষয়ে শুধু ‘গোপনীয়তার কারণেই’ তাঁকে আতিউর রহমানের পদত্যাগ চাইতে হয়েছে। কিন্তু এই টাকাটা যদি পুরোটা উদ্ধার হতো বা গত ৫ ফেব্রুয়ারি চুরির দিনটিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানাতেন, তাহলেও তো প্রমাণিত হতো যে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। তাহলে কি আর তাঁকে পদত্যাগ করতে হতো না? আতিউর রহমান তাহলে কেবল গোপনীয়তা রক্ষার ভুল কৌশল, নির্বুদ্ধিতা কিংবা ‘স্পর্ধা’ দেখানোর শাস্তি পেয়েছেন! তদন্তের পরও কি আমরা স্পষ্ট ধারণা পাব? ‘গোপনীয়তার’ বিষয়ে আমরা এখন যা জানি, সেটাই কি সবটুকু?
বাংলাদেশ পদ-পদবির দেশ, পদত্যাগের দেশ নয়। অথচ গণতন্ত্র চাইলে পদত্যাগ লাগবে। কারণ, পদ শূন্য না হলে নবাগতরা ঢুকবে কোন পথে। তাহলে প্রশ্ন থাকল, আমরা কবে একজন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পাব? ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী শাস্ত্রী এক রেল দুর্ঘটনার পর পদত্যাগ করেছিলেন। ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’, এই বিখ্যাত কবিতার কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো কে কবে লিখবেন, ‘পদত্যাগ, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো।’
অথচ নাসির উদ্দীন ইউসুফ ও নূহ-উল-আলম লেনিনের লেখায় একটি অভিন্ন সুর ছিল যে তিনি পদত্যাগ করে একটি ভালো নজির স্থাপন করেছেন। ইউসুফ সাহেব লিখেছেন, তিনি ‘দায়িত্ব’ নিয়ে পদত্যাগ করেছেন। আমার নিজেরও তেমনই ধারণা ছিল। এবং অনেক উচ্ছ্বাসভরে আমি একটি লেখার মুসাবিদা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু সেই লেখা টেকেনি। আমি যদিও জানতাম যে রিজার্ভ হ্যাকড হওয়ার ঘটনায় ‘গোপনীয়তা’ রক্ষার অজুহাত দেখানোর জন্য অর্থমন্ত্রী তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে তাকে ‘স্পর্ধা’ (অডাসিটি) বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকে পরিবর্তন আসছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনের দিনক্ষণ স্থির করলেন, তখনই ইঙ্গিত পরিষ্কার ছিল। তারপরও আতিউর রহমান যখন সংবাদ সম্মেলনে ‘বীরের মতো’ প্রস্থানের দাবি করলেন, তখন আমি তাঁকে ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দিতে চেয়েছি। কারণ, তিনি সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন। অবশ্য সংবাদ সম্মেলনে তিনি এবার নিজেই দাবি করেছেন, ‘আওয়ামী লীগের সভানেত্রী ২৮ বছর ধরে আমাকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন’।
তৃণমূল থেকে উঠে আসা একজন মানুষ তিনি। নিজের মেধা ও যোগ্যতায় সমাজের তলানি থেকে এতটা উঁচুতে উঠেছেন। আমি খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম, যখন এটা জানলাম যে তিনি বড় হয়ে তাঁর গ্রামের সেই বাজারে গিয়েছিলেন, যেখানে একদিন রীতিমতো খুচরা পয়সা ও টাকা জোগাড় করে তাঁর পড়াশোনার তহবিল জোগাড় হয়েছিল। সেই খবরের বিবরণ পড়ে আমি একটি দৃশ্য কল্পনা করেছি এবং আবেগে আপ্লুত হয়েছি। আতিউর রহমানের সই করা কড়কড়ে টাকার নোট। সেই টাকা এবং আতিউরকে ছুঁয়ে দেখে গর্বিত হচ্ছেন গ্রামের কোনো বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষ, যিনি একদিন হয়তো বা একটি সিকি কি আধুলি আতিউর রহমানের জন্য দান করেছিলেন। আমি তাঁকে রোল মডেল ভেবেছি, নিশ্চয় তিনি রোল মডেল!
কিন্তু আমি অনেক আগেই অস্বস্তির সঙ্গে আতিউর রহমানের একটা পরিবর্তন দেখেছিলাম। আমি আগেকার শেরাটন–সংলগ্ন ভবনে তাঁর দপ্তরে অনেকবার গিয়েছি। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। তবে সেটা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের গোড়ার কথা। তখন তিনি উজ্জ্বল বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন এবং দেখাতেন। এবং আমার ভালো লাগত যে তিনি রাজনীতি–সচেতন। কিন্তু কোনো দলের অন্যায্য কোনো বিষয়কে প্রশ্রয় দিতেন না। একজন শিক্ষাবিদের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর মধ্যে অবশ্যই খুঁজে পেতাম। আর সেটাই ছিল ভরসার জায়গা। গভর্নর হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে মাত্র একবার এক মিনিট কথা হয়েছিল। গভর্নরের পদে থেকে তিনি এমন সব বিষয় নিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়েছেন যা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাঁর কাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ ছিল না। ওই কাজ করার লোকের কোনো আকালও পড়েনি। অথচ তিনি গভর্নর পদের যে নির্দলীয় কৌলীন্য সেটা বজায় রাখতে বা জনগণের চোখে দৃশ্যমান করে তুলতে আগ্রহী ছিলেন না। পদমর্যাদার সঙ্গে বেমানান কাজ কতটা স্বেচ্ছায় আর কতটা চাপে পড়ে করেছেন, তা বলতে পারব না। অবশ্য একজন অর্থনীতিবিদ, আতিউর যাঁর স্নেহভাজন, আমাকে বলেছেন, ওই পদে তিনি তাঁর নিয়োগ পছন্দ করেননি। কারণ, গভর্নরের পদে এমন ব্যক্তির যাওয়া উচিত নয়, যিনি কোনো একটি দলের রাজনীতি বিষয়ে প্রগল্ভ।
আরও বহু কারণে আশাভঙ্গ ঘটলেও আমি ভাবতে প্রস্তুত ছিলাম যে একটা ন্যূনতম নৈতিকতার জোর না থাকলে আতিউর রহমান জাতির সামনে অনেকটা হলফ করেই নৈতিক সাহস প্রদর্শন করতেন না। কারণ, যা নয় তা বাস্তবের মতো জনসমক্ষে ফুটিয়ে তোলাটা একশ্রেণির রাজনীতিকের অভ্যাসগত। মানুষ তাঁদের হাসি ও কান্নাকে সেভাবেই দেখে থাকে। কিন্তু আতিউর রহমান শিক্ষক। তিনি কখনো পল্টনে বক্তৃতা করেননি। এখন আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে তাঁকে পদত্যাগের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল এবং তারপরও তিনি টিকে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। যখন তিনি বুঝলেন তাঁকে আর কেউ রক্ষা করবে না, তখন তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। আমি অবশ্য একটি মিডিয়ায় আতিউর রহমানের দিল্লি সফরের ঔচিত্য নিয়ে তীক্ষ্ণ প্রশ্ন দেখেও বাতাস ঘুরে যাওয়াটা আঁচ করতে পেরেছিলাম। মন্ত্রীদের চাপের মুখে পদত্যাগ করানো একটা শাস্তি। সেই খবরের শিরোনাম হয়ে থাকে ‘মন্ত্রী অপসারিত’। কিন্তু মিডিয়ায় এই শিরোনাম আসেনি যে ‘গভর্নর অপসারিত’। যদিও ড. আতিউর মন্ত্রীদের মতোই প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি ‘রীতিবহির্ভূত’ পদত্যাগপত্র দাখিল করেছেন।
তাঁর ‘সাহসী পদত্যাগ’ বিষয়ে ইউসুফ ও লেনিন সাহেবেরা যা বলেছেন, তাকে নির্বিবাদে মেনে নেওয়া যায় না। অবশ্য লেনিনের একটি মূল্যায়ন অনবদ্য। তিনি জনগণের মনের কথা বলেছেন। সেটা হলো, ‘ঘটনার জন্য যে-ই দায়ী হোক না কেন, প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তিনি পদত্যাগ করে যে নজির স্থাপন করলেন, অন্যান্য ক্ষেত্রেও যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তাহলে আমাদের রাষ্ট্রীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।’ এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ কম যে রাষ্ট্রীয় জীবনের বহু ক্ষেত্রে এ রকম ‘নতুন মাত্রা’ যুক্ত করাটা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আর্থিক খাতে এই ধরনের চাপ প্রয়োগ এবং তা থেকে এ রকম ত্বরিত ফল আশা করব।
কিন্তু এটা বাস্তবে ঠিক এভাবে ঘটতে পারে তা হলফ করে বলা যাবে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যদিও বলেছেন যে দুটি বিষয় একসঙ্গে সত্য হতে পারে না। কিন্তু তদুপরি আমি বলব, আতিউর রহমানের জন্য একটি পয়েন্ট টিকে যাবে। সেটা হলো, এ রকম আরও অন্য ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে চাপ দেওয়া হবে না, আর যদি দেওয়াও হয়, তাহলে তাতে ত্বরিত ফল মিলবে তা বলা যাবে না।
আমার মনে হয়, এটা প্রমাণিত হয়েছে যে ‘দলীয় বিবেচনায়’ কোনো নির্দলীয় অবস্থানে তুলনামূলক কম দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্নকে বসাতে নেই। আতিউর রহমানকে আমরা জনস্বার্থের বিপরীতে ‘দলীয় উদ্দেশ্য’ পূরণ করে চলতে দেখেছি। অস্ফুটে এক-আধটু আপত্তি তোলার সঙ্গে আমরা তাঁকে কয়েক হাজার কোটি টাকা লুটপাটের ঘটনাকে গা-সওয়া ব্যাপারে পরিণত করতে দেখেছি। এবং আমাদের কাছে এ রকম কোনো খবর নেই যে তিনি ওই লুটপাট ঠেকাতে ‘বীরের মতো’ কোনো উদ্যোগ নিয়েছিলেন কিংবা কখনো পদত্যাগ করতে উদ্যত হয়েছিলেন।
অবশ্য আমাদের দেশে পদত্যাগ কে কবে করেছে বা দেখেছে। অথচ এটা গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য অক্সিজেন। তবে দেখার বিষয় হলো, এটা একটা মন্দের ভালো ঘটনা। কারণ, শুধু চাপে কিংবা আধা চাপ বা আধা নৈতিকতায় জাতি একটি ‘ত্যাগ’ দেখেছে। একে একটা বড় রূপান্তরের আগমনী বার্তা হিসেবেও দেখা যেতে পারে। সেটা হলো, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে বাধ্য হওয়া। বিএনপি বা বিরোধীদের কেউ সেভাবে পদত্যাগ চায়নি, কেউ হরতাল ডাকেনি। অথচ অঘটনটা ঘটেছে। আর আমরা এখন তা নিয়ে সম্ভবত একটা অনাবশ্যক তর্কে নেমেছি।
আতিউর রহমানের ‘তিলে তিলে রিজার্ভ’ গড়ার বিষয়ে লেনিন ঠিকই উষ্মা প্রকাশ করেছেন। এর সমস্যাটা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে। আমার পানি, আমার পাখি, আমার মানুষ এসব বলা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে আছে। ব্যক্তির বন্দনা করে অহরহ বক্তৃতা দেওয়া তার প্রমাণ। তবে লেনিন বলেছেন রিজার্ভ চুরির বিষয়ে শুধু ‘গোপনীয়তার কারণেই’ তাঁকে আতিউর রহমানের পদত্যাগ চাইতে হয়েছে। কিন্তু এই টাকাটা যদি পুরোটা উদ্ধার হতো বা গত ৫ ফেব্রুয়ারি চুরির দিনটিতেই তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানাতেন, তাহলেও তো প্রমাণিত হতো যে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়েছে। তাহলে কি আর তাঁকে পদত্যাগ করতে হতো না? আতিউর রহমান তাহলে কেবল গোপনীয়তা রক্ষার ভুল কৌশল, নির্বুদ্ধিতা কিংবা ‘স্পর্ধা’ দেখানোর শাস্তি পেয়েছেন! তদন্তের পরও কি আমরা স্পষ্ট ধারণা পাব? ‘গোপনীয়তার’ বিষয়ে আমরা এখন যা জানি, সেটাই কি সবটুকু?
বাংলাদেশ পদ-পদবির দেশ, পদত্যাগের দেশ নয়। অথচ গণতন্ত্র চাইলে পদত্যাগ লাগবে। কারণ, পদ শূন্য না হলে নবাগতরা ঢুকবে কোন পথে। তাহলে প্রশ্ন থাকল, আমরা কবে একজন লাল বাহাদুর শাস্ত্রী পাব? ভারতের সাবেক রেলমন্ত্রী শাস্ত্রী এক রেল দুর্ঘটনার পর পদত্যাগ করেছিলেন। ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’, এই বিখ্যাত কবিতার কবি নির্মলেন্দু গুণের মতো কে কবে লিখবেন, ‘পদত্যাগ, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো।’
No comments