যম যে রাস্তা চিনে গেল! by আনিসুল হক
বাবা
মারা গেছেন, ক্ষতি নেই, কিন্তু যম যে রাস্তা চিনে গেল! এই দেশে প্রচলিত
পুরোনো কৌতুক! বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা অপহারকেরা নিয়ে গেছে ফিলিপাইনে,
শ্রীলঙ্কায়, ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে ঢুকে
অথবা হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে। প্রায় ৮০০ কোটি টাকা, তাতে ওই ৮০০ কোটি টাকাই
কেবল ক্ষতি নয়, মূল সমস্যা হলো, এখানকার ব্যাংকের কম্পিউটার সিস্টেমে ঢোকা
যে সহজ, তা সবাই জেনে গেছে বা হ্যাকাররা রাস্তা চিনে গেছে।
এরপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দরকারে-অদরকারে, কখনোবা নিছক তামাশা করার জন্য, বাংলাদেশ হ্যাকারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। তারা বাংলাদেশের নাম জেনে গেছে, জেনে গেছে যে বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থা ঠুনকো।
হ্যাকাররা হ্যাকিং করতে পারে চারটা কারণে: এক. নিতান্তই মজা করার জন্য। খেলা হিসেবে। তাদের কে বলবে, ওহে বালকবৃন্দ, তোমাদের জন্য যা তামাশা, আমাদের জন্য তা জীবনমরণ সমস্যা। তোমাদের কাছে যা এক ডলার, আমাদের বহু পরিবারের তা এক দিনের আয়।
দুই. নামের জন্য। হ্যাকিং করে অনেকেই খ্যাতিমান হয়।
তিন. লাভের জন্য। যেমন, আমাদের টাকা নাকি চলে গেছে জুয়ার আসরে। ভালোই!
চার. শত্রুতা সাধনের জন্য। কোনো একজন, কোনো একদল মানুষ, কোনো একটা দেশ তো আমাদের ক্ষতি চাইতেই পারে।
কাজেই সদ্য পিতৃহারা ওই সন্তানের মতোই আমি রোদন করব, ৮০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে, বড় ক্ষতি সেটা নয়, বড় ক্ষতি হলো হ্যাকাররা রাস্তা চিনে গেছে।
নইলে আমাদের তো কয়েক হাজার কোটি টাকা হল-মার্কওয়ালারা নিয়ে গেছে, তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই নয়। শেয়ার মার্কেট থেকে চুরি হয়েছে হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ খবর, ছয় বছরে তিতাস গ্যাস লিমিটেড থেকে নয়ছয় হয়েছে ৩ হাজার ১৩৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ভাইরে, আমি নিতান্তই ছা-পোষা লেখক, আমার অবস্থা সেই দুই বৃদ্ধার মতো, যাঁরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন, ‘বল তো, এই সেতু বানাতে কত টাকা খরচ হয়েছে?’ একজন বললেন, ‘এক হাজার টাকা।’ আরেকজন বললেন, ‘তুই একটা ফকিরনি, কম করে হলেও দশ হাজার টাকা।’ কত টাকায় হাজার কোটি টাকা হয়, আমি কল্পনাও করতে পারি না।
কিন্তু আমি চিন্তিত আমাদের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে।
হ্যাকাররা আমার ই-মেইলে একটা মেইল পাঠাতে পারে। হয়তো আমার এক বন্ধুর নামে এল সেটা। বলল, তোমার বইয়ের একটা রিভিউ ছাপা হয়েছে। এই নাও, এই অ্যাটাচমেন্টটা খোলো। বা এই সাইটে গেলেই পাওয়া যাবে। আমি অ্যাটাচমেন্টটা বা সাইটটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমার কম্পিউটারে বা মোবাইল ফোনে স্পাইওয়্যার ঢুকে যেতে পারে। এরপর আমি কী করি, কী লিখি, কী দেখি, সব আরেকজনের কাছে চলে যাবে। এমনকি আমার কম্পিউটারের ক্যামেরা বন্ধ থাকলেও সে সেটা চালু করে নিয়ে আমাকে দেখতে পাবে। হে প্রভু, আমাকে রক্ষা করো।
এরপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দরকারে-অদরকারে, কখনোবা নিছক তামাশা করার জন্য, বাংলাদেশ হ্যাকারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। তারা বাংলাদেশের নাম জেনে গেছে, জেনে গেছে যে বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তাব্যবস্থা ঠুনকো।
হ্যাকাররা হ্যাকিং করতে পারে চারটা কারণে: এক. নিতান্তই মজা করার জন্য। খেলা হিসেবে। তাদের কে বলবে, ওহে বালকবৃন্দ, তোমাদের জন্য যা তামাশা, আমাদের জন্য তা জীবনমরণ সমস্যা। তোমাদের কাছে যা এক ডলার, আমাদের বহু পরিবারের তা এক দিনের আয়।
দুই. নামের জন্য। হ্যাকিং করে অনেকেই খ্যাতিমান হয়।
তিন. লাভের জন্য। যেমন, আমাদের টাকা নাকি চলে গেছে জুয়ার আসরে। ভালোই!
চার. শত্রুতা সাধনের জন্য। কোনো একজন, কোনো একদল মানুষ, কোনো একটা দেশ তো আমাদের ক্ষতি চাইতেই পারে।
কাজেই সদ্য পিতৃহারা ওই সন্তানের মতোই আমি রোদন করব, ৮০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে, বড় ক্ষতি সেটা নয়, বড় ক্ষতি হলো হ্যাকাররা রাস্তা চিনে গেছে।
নইলে আমাদের তো কয়েক হাজার কোটি টাকা হল-মার্কওয়ালারা নিয়ে গেছে, তখন আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন, হাজার কোটি টাকা কোনো টাকাই নয়। শেয়ার মার্কেট থেকে চুরি হয়েছে হাজার কোটি টাকা। সর্বশেষ খবর, ছয় বছরে তিতাস গ্যাস লিমিটেড থেকে নয়ছয় হয়েছে ৩ হাজার ১৩৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। ভাইরে, আমি নিতান্তই ছা-পোষা লেখক, আমার অবস্থা সেই দুই বৃদ্ধার মতো, যাঁরা হার্ডিঞ্জ ব্রিজের নিচে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন, ‘বল তো, এই সেতু বানাতে কত টাকা খরচ হয়েছে?’ একজন বললেন, ‘এক হাজার টাকা।’ আরেকজন বললেন, ‘তুই একটা ফকিরনি, কম করে হলেও দশ হাজার টাকা।’ কত টাকায় হাজার কোটি টাকা হয়, আমি কল্পনাও করতে পারি না।
কিন্তু আমি চিন্তিত আমাদের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে।
হ্যাকাররা আমার ই-মেইলে একটা মেইল পাঠাতে পারে। হয়তো আমার এক বন্ধুর নামে এল সেটা। বলল, তোমার বইয়ের একটা রিভিউ ছাপা হয়েছে। এই নাও, এই অ্যাটাচমেন্টটা খোলো। বা এই সাইটে গেলেই পাওয়া যাবে। আমি অ্যাটাচমেন্টটা বা সাইটটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমার কম্পিউটারে বা মোবাইল ফোনে স্পাইওয়্যার ঢুকে যেতে পারে। এরপর আমি কী করি, কী লিখি, কী দেখি, সব আরেকজনের কাছে চলে যাবে। এমনকি আমার কম্পিউটারের ক্যামেরা বন্ধ থাকলেও সে সেটা চালু করে নিয়ে আমাকে দেখতে পাবে। হে প্রভু, আমাকে রক্ষা করো।
চোর
পালালে বুদ্ধি বাড়ে। ৮০০ কোটি টাকার বিনিময়েও যদি আমরা বাংলাদেশের সাইবার
নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার দিকে মন দিতে পারি, তাহলে কাজের কাজ হবে। ব্লেইম
গেইমের চেয়েও সেটা বেশি জরুরি
সত্যি
কথা বলতে কি, নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুসারে বছর ছয়েক আগে দালাই
লামার কম্পিউটারে এবং দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক দেশের
রাষ্ট্রীয় বা সরকারি কম্পিউটারে এই ধরনের স্পাইওয়্যার ঢুকে গিয়েছিল। দক্ষিণ
এশিয়ার দেশ বাংলাদেশে ঢুকেছিল কি না, সরকার আমাদের জানায়নি। আমরা জানি না।
এই দেশের অনেক দায়িত্বশীল কর্তার কম্পিউটারজ্ঞান কেমন? এই বিষয়ে যে কৌতুকটা জানি, তা আগে বলে নিই। কর্মচারী তাঁর কর্মকর্তাকে বললেন, স্যার, আমার বেতন তো ১০ হাজার টাকা। পে স্লিপে এসেছে ১ লাখ। আমি ৯০ হাজার টাকা ফেরত দিতে এসেছি।
‘না, না, আপনার টাকা নেওয়া হবে না। পে স্লিপ বানিয়েছে কম্পিউটার। কম্পিউটার কখনো ভুল করতে পারে না। যান।’
আপনারা ভাবছেন, দূর, তাও কি হয়?
তাহলে আমি আমার সেই অভিজ্ঞতাটা আরেকবার বলি। দুই যুগ আগের কথা। আমি বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে গিয়েছি ঢাকার একটা স্কুলে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রেই সঠিক উত্তরে পেনসিল দিয়ে গোল্লা দিতে হয়, এটা পরে কম্পিউটারে পরীক্ষা করানো হয়। তো ওই উত্তরপত্রে পরীক্ষার্থীর স্বাক্ষরের একটা ঘর আছে। আমি তাতে বাংলায় স্বাক্ষর দিলাম, কারণ আমার স্বাক্ষর বাংলাতেই। একজন স্কুলশিক্ষক পরীক্ষক এসে আমাকে বললেন, নাম স্বাক্ষর ইংরেজিতে করতে হবে।
আমি বললাম, আমার সই তো বাংলা। ইংরেজি দেব কী করে।
তিনি বললেন, ইংরেজিতেই দিতে হবে, কারণ এই উত্তরপত্র দেখবে কম্পিউটার। আর কম্পিউটার বাংলা পড়তে পারে না।
আমি বললাম, প্রথম কথা কম্পিউটার বাংলা-ইংরেজি কিছুই পড়তে পারে না, আমরা রোল নম্বরটাও গোল্লা পূরণ করে লিখে দিয়েছি, সে সেটাই পড়বে। দুই নম্বর কথা, স্বাক্ষরের বাংলা-ইংরেজি কোনো কিছুই ব্যাপার না, বিদেশেও আমি এই সাইনই দিয়েছি।
তিনি বললেন, আপনার খাতা আমি জমা নেব না।
আমি বললাম, আপনাকে নিতেই হবে।
তিনি তখন পুলিশ ডেকে আনলেন, হলে একজন সন্ত্রাসী ঢুকে পড়েছে। যে পরিদর্শকের কথা শুনছে না।
আমার মনে হয়, দুই যুগ পরেও বহু বিভাগে বহু জায়গায় এই ধরনের কর্তাই নিয়োজিত আছেন, যাঁরা কম্পিউটার স্টার্ট দিতেও জানেন না।
আমার আশঙ্কা, হ্যাকিং করে বিমান ভুল পথে নেওয়া সম্ভব, সম্ভব ট্রেন আটকে দেওয়া, সবগুলো ব্যাংক লন্ডভন্ড করে দেওয়া, রাস্তার ট্রাফিক সংকেত উল্টাপাল্টা করে দেওয়া, আণবিক বোমার সুইচ টিপে দেওয়া। কাজেই সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। ৮০০ কোটি টাকার বিনিময়েও যদি আমরা বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার দিকে মন দিতে পারি, তাহলে কাজের কাজ হবে। ব্লেইম গেইমের চেয়েও সেটা বেশি জরুরি।
তা না হলে আমাদের ঘরে ঘরে ক্যামেরা চালু করে দেবে হ্যাকাররা, সব তথ্য নিয়ে যাবে, নিয়ে যাবে সব টাকাকড়ি। বিপন্ন করে তুলবে আমাদের দেশ ও রাষ্ট্রকে।
তখন এই গান গেয়ে কোনো লাভ হবে কি—খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়, ধরতে পারলে ‘লোহার বেড়ি’ দিতাম পাখির পায়!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
এই দেশের অনেক দায়িত্বশীল কর্তার কম্পিউটারজ্ঞান কেমন? এই বিষয়ে যে কৌতুকটা জানি, তা আগে বলে নিই। কর্মচারী তাঁর কর্মকর্তাকে বললেন, স্যার, আমার বেতন তো ১০ হাজার টাকা। পে স্লিপে এসেছে ১ লাখ। আমি ৯০ হাজার টাকা ফেরত দিতে এসেছি।
‘না, না, আপনার টাকা নেওয়া হবে না। পে স্লিপ বানিয়েছে কম্পিউটার। কম্পিউটার কখনো ভুল করতে পারে না। যান।’
আপনারা ভাবছেন, দূর, তাও কি হয়?
তাহলে আমি আমার সেই অভিজ্ঞতাটা আরেকবার বলি। দুই যুগ আগের কথা। আমি বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা দিতে গিয়েছি ঢাকার একটা স্কুলে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রেই সঠিক উত্তরে পেনসিল দিয়ে গোল্লা দিতে হয়, এটা পরে কম্পিউটারে পরীক্ষা করানো হয়। তো ওই উত্তরপত্রে পরীক্ষার্থীর স্বাক্ষরের একটা ঘর আছে। আমি তাতে বাংলায় স্বাক্ষর দিলাম, কারণ আমার স্বাক্ষর বাংলাতেই। একজন স্কুলশিক্ষক পরীক্ষক এসে আমাকে বললেন, নাম স্বাক্ষর ইংরেজিতে করতে হবে।
আমি বললাম, আমার সই তো বাংলা। ইংরেজি দেব কী করে।
তিনি বললেন, ইংরেজিতেই দিতে হবে, কারণ এই উত্তরপত্র দেখবে কম্পিউটার। আর কম্পিউটার বাংলা পড়তে পারে না।
আমি বললাম, প্রথম কথা কম্পিউটার বাংলা-ইংরেজি কিছুই পড়তে পারে না, আমরা রোল নম্বরটাও গোল্লা পূরণ করে লিখে দিয়েছি, সে সেটাই পড়বে। দুই নম্বর কথা, স্বাক্ষরের বাংলা-ইংরেজি কোনো কিছুই ব্যাপার না, বিদেশেও আমি এই সাইনই দিয়েছি।
তিনি বললেন, আপনার খাতা আমি জমা নেব না।
আমি বললাম, আপনাকে নিতেই হবে।
তিনি তখন পুলিশ ডেকে আনলেন, হলে একজন সন্ত্রাসী ঢুকে পড়েছে। যে পরিদর্শকের কথা শুনছে না।
আমার মনে হয়, দুই যুগ পরেও বহু বিভাগে বহু জায়গায় এই ধরনের কর্তাই নিয়োজিত আছেন, যাঁরা কম্পিউটার স্টার্ট দিতেও জানেন না।
আমার আশঙ্কা, হ্যাকিং করে বিমান ভুল পথে নেওয়া সম্ভব, সম্ভব ট্রেন আটকে দেওয়া, সবগুলো ব্যাংক লন্ডভন্ড করে দেওয়া, রাস্তার ট্রাফিক সংকেত উল্টাপাল্টা করে দেওয়া, আণবিক বোমার সুইচ টিপে দেওয়া। কাজেই সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টাকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে। ৮০০ কোটি টাকার বিনিময়েও যদি আমরা বাংলাদেশের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্ছিদ্র করার দিকে মন দিতে পারি, তাহলে কাজের কাজ হবে। ব্লেইম গেইমের চেয়েও সেটা বেশি জরুরি।
তা না হলে আমাদের ঘরে ঘরে ক্যামেরা চালু করে দেবে হ্যাকাররা, সব তথ্য নিয়ে যাবে, নিয়ে যাবে সব টাকাকড়ি। বিপন্ন করে তুলবে আমাদের দেশ ও রাষ্ট্রকে।
তখন এই গান গেয়ে কোনো লাভ হবে কি—খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়, ধরতে পারলে ‘লোহার বেড়ি’ দিতাম পাখির পায়!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments