উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও পরিবেশ by হায়দার আকবর খান রনো
সর্বমানবের
কল্যাণের জন্য উন্নয়ন যে দরকার, এ কথা নিশ্চয়ই কেউ অস্বীকার করবেন না। আর
আধুনিক যুগে বিদ্যুৎ ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়। এমনকি বিশ শতকের গোড়ার দিকে
যখন সারা বিশ্বে বিদ্যুতের প্রচলন এতটা হয়নি, তখনই নতুন শোষণহীন
সমাজব্যবস্থার প্রবর্তক লেনিন কমিউনিজমকে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন
এভাবে—সোভিয়েত প্লাস ইলেকট্রিসিটি। সোভিয়েত ছিল শ্রমিকশ্রেণির নতুন ধরনের
সমাজব্যবস্থা। কিন্তু শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনই যথেষ্ট নয়। পার্থিব উন্নয়নও
দরকার। সে জন্য দরকার বিদ্যুৎ।
কিন্তু যে কথাটি এখন এসেছে, এমনকি সেই এক শ বছর আগেও কমবেশি এসেছিল, তা হলো উন্নয়ন কি প্রকৃতিকে ধ্বংস করে? মানবজীবনের অস্তিত্বের জন্য যে প্রাকৃতিক পরিবেশ একান্তভাবেই প্রয়োজনীয়, তাকে ধ্বংস করে কি প্রকৃত উন্নয়ন হতে পারে?
গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে সোভিয়েত সরকার বিদ্যুৎ, ভারী শিল্প তথা উন্নয়নের যে বিশাল কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছিল, তার তুলনা এখনো ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। অনেক সোভিয়েতবিরোধী লেখক বলছেন, তখনকার সোভিয়েত সরকার ব্যাপকভাবে পরিবেশ ধ্বংস করেছিল। কথাটা সত্য নয়। এ কথা ঠিক যে তখনো আজকের মতো পরিবেশসচেতনতা তৈরি হয়নি। কিন্তু সেই সময় বনাঞ্চল, জলস্রোত ইত্যাদি রক্ষার জন্য সোভিয়েত সরকারের যে ধরনের তাগিদ ছিল, তা তখনকার পৃথিবীতে অন্য কোথাও দেখা যাবে না। ২০১০ সালে মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টিফেন ব্রেইন ‘স্তালিনের পরিবেশবাদিতা’ শীর্ষক এক গবেষণা নিবন্ধে দেখিয়েছেন, স্তালিন প্রশাসন বড় ও ভারী শিল্পের ওপর জোর দিলেও পরিবেশ রক্ষার চিন্তাটাও একই সঙ্গে ছিল। সে জন্য বন বিভাগের দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে বন শ্রমিকদের ইউনিয়নের ওপর দেওয়া হয়েছিল।
বরং অন্যদিকে দেখা যায় যে সমাজতন্ত্রীদের আদি তাত্ত্বিক গুরু ও দার্শনিক কার্ল মার্ক্স অভিযোগ করেছেন যে পুঁজিপতিরা কেবল মুনাফার লালসায় প্রকৃতির ধ্বংসসাধন করে থাকে। মার্ক্সের বিখ্যাত রচনা পুঁজি গ্রন্থে (প্রথম খণ্ডে) বলা হয়েছে, ‘পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটায় এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে যুক্ত করে...(কিন্তু) ধ্বংস করে সকল সম্পদের আদি উৎস—মাটি ও শ্রমিককে।’ তিনি মাটি ধ্বংসের বিষয়টিও উল্লেখ করছেন।
আমরা এখনো দেখছি, তাৎক্ষণিক মুনাফা ও সর্বোচ্চ মুনাফার তাগিদে করপোরেট পঁুজি প্রকৃতিকে কীভাবে ধ্বংস করছে, যা মানবজাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে। অতীত ইতিহাস এবং বিশ্ব পরিসর ছেড়ে আসা যাক বর্তমান সময়ে এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। আমরা দেখেছি কীভাবে কিছু দুর্বৃত্তের লোভ ও দখলদারি মনোবৃত্তির কারণে নদী দখল হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক জলাশয় (অথবা স্থায়ীভাবে জলমগ্ন থাকছে বিস্তীর্ণ জনপদ) দূষিত হচ্ছে বাতাস, মাটি, পানি। এসব বিষয় রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সেসব বিষয় নিয়েও আপাতত আলোচনায় যাচ্ছি না। আজকের বিষয়বস্তু সুন্দরবনের গা ঘেঁষে রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প।
এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে। কয়েকটি বামপন্থী দল প্রতিবাদ হিসেবে ১০ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা থেকে রামপাল অভিমুখে লংমার্চ করেছে। তাদের দাবি, তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প রামপাল থেকে সরাও, কারণ সুন্দরবন ধ্বংস হবে। ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ নামে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী পরিবেশবাদী ও সমাজকর্মীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি সংগঠন। তঁাদেরও একই দাবি।
সুন্দরবনের গা ঘেঁষে রামপালে ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা পিডিবি ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সব রকম ন্যায্য প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করেই সরকার এই প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। এর প্রাথমিক পুঁজির ১৫ শতাংশ করে দেবে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিটি ও বাংলাদেশের পিডিবি (মোট ৩০ শতাংশ)। বাকিটা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করা হবে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, তার বড় অংশ আসবে ভারত থেকে চড়া হারে সুদে ঋণ আকারে। সুদের হার হবে ১৪ শতাংশ। অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি ও সরবরাহকারীর কাজও পাবে ভারতের বিভিন্ন কোম্পানি। যাই হোক, আমরা এখানে অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানের চেয়ে বেশি করে দেখব পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি।
রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হবে সুন্দরবনের একেবারেই গা ঘেঁষে ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে। বাফার জোন ধরলে এই দূরত্ব আরও কম হবে। একই ভারতীয় কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চেয়েছিল। ভারত সরকার অনুমতি দেয়নি। ভারতের ‘তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন-সংক্রান্ত গাইডলাইন ১৯৮৭’, ভারতের ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট ১৯৭২’ এবং ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘পরিবেশ সমীক্ষা (ইআইএ) গাইডলাইন ম্যানুয়াল ২০১০’ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য, জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান, জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি এলাকার ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ নির্মাণ করা যাবে না। একই কারণে ভারত সরকার তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশে এ ধরনের তিনটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। ভারতের এনটিপিটি সুন্দরবনের গা ঘেঁষে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যাচ্ছে জেনে পরিবেশসচেতন নরওয়ে সরকার ২০১৪ সালেই ওই কোম্পানির জন্য দেয় ৪৩০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
শুধু রামপালই নয়। ওরিয়ন নামে একটি দেশীয় কোম্পানি সুন্দরবনের আরও কাছে অনুরূপ আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণ করতে চলেছে, যেখান থেকে ৬৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে জানানো হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলবর্তী বাঁশখালী উপজেলায় একটি ঘনবসতি এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের কাজ চলছে। এতে জনবসতি উচ্ছেদ হবে। পরিবেশও দূষিত হবে। সেখানকার মানুষ প্রতিবাদ-সংগ্রাম গড়ে তুলেছে। কিন্তু তা নীতিনির্ধারকের কানে প্রবেশ করছে না।
আবার মূল প্রশ্নে ফিরে আসি। তাহলে কি আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু তা যেন কোনোভাবেই পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়। দ্বিতীয়ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিকল্প কি নেই? অবশ্যই আছে। বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞরা, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা বলছেন আছে। দুটো প্রশ্নই বিবেচনা করা যাক।
সরকার বলছে, রামপালে এমন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হবে যাতে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কথাটা সত্য নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আধুনিক প্রযুক্তি বড়জোর ১০ শতাংশ ক্ষতি কমাতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে সিলেটের সিমেন্ট কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিয়েছে, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় যে ছাই ছিটকে পড়বে তা সিমেন্ট তৈরির কাজে ব্যবহার করা যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে যদি সিমেন্ট পাওয়া যায়, সে তো ভালো কথা। কিন্তু ছাই দিয়ে সিমেন্ট করা গেলেও তা সুন্দরবনের গাছ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য যে মারাত্মক ক্ষতিকর হবে, সে কথা কি ভুলে যেতে হবে?
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সবচেয়ে বেশি দূষিত বর্জ্য তৈরি করে। পরিবেশকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। কয়লা থেকে উদ্গিরণ হয় কার্বন-ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোড্রাইড, সালফার-ডাই অক্সাইড ইত্যাদি যা গাছপালা, জীবজন্তুকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কার্বন-ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে এক শ বছর টিকে থাকে এবং তা ভূ–প্রকৃতিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। এখন যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিশ্বে কয়লাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়, তবু উন্নত বিশ্বে কয়লা থেকে সরে আসার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। শিল্পোন্নত জার্মানিতে বাতাসের গতির ওপর নির্ভরশীল ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রচলন খুব বেশি মাত্রায় দেখা যাচ্ছে। এ কথা সত্য যে পাশ্চাত্যের করপোরেট পুঁজিই সর্বোচ্চ মুনাফার লোভে পরিবেশ বিনষ্ট করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও সত্য যে সেই দেশের মানুষও অধিক পরিবেশসচেতন হয়ে উঠেছে। ইউরোপ, আমেরিকায় এমনকি ভারতেও কিছুতেই জনগণ সুন্দরবনের মতো বন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হতে দিত না।
পরিবেশবাদীরা নিশ্চিত যে এই প্রকল্প সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে। কয়লার ছাই ও ধোঁয়ায় গাছপালা, জীবজন্তুর ক্ষতি হবে। নদীর পানি দূষিত হবে। মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যাবে। আমাদের ভুললে চলবে না যে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে জাহাজডুবিতে নদীর পানি কী পরিমাণ দূষিত হয়েছিল। বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাইরে থেকে জাহাজে করে কয়লা আসবে। সেই কয়লা কি নদীতে পড়বে না? ২০১৪ সালের মতো দুর্ঘটনা কি আরও হতে পারে না? এত ঝুঁকি নিয়ে রামপালে বা মংলায় বিদ্যুৎ প্রকল্প না করে দূরে কোথাও করলে অসুবিধা কী? হয়তো পরিবহন খরচ বাড়বে।
খরচ বাঁচানোর জন্য, কোম্পানির লাভের জন্য কি সুন্দরবন তথা পরিবেশের এত বড় ক্ষতিসাধন করতে হবে? হায়রে মুনাফা! মার্ক্স যথার্থই বলেছিলেন, পুঁজিপতিরা ৩ শতাংশ হারে মুনাফার সন্ধান পেলে এমন কাজ করতে বিরত হবে না, যে কাজে তার ফাঁসি হওয়ার আশঙ্কা পর্যন্ত থাকে! (পুঁজি প্রথম খণ্ড)।
দ্বিতীয়ত কয়লার বিকল্প কি নেই? বাংলাদেশ সরকারের পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক এনার্জি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমতউল্লাহ্ বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে কয়লার বিকল্প আছে। এবং সেগুলো তাঁর মতে ‘টেকসই ও সাশ্রয়ী’। অন্যদিকে রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নানা পদার্থ সৃষ্টি হবে। কয়লা থেকে আর্সেনিক দ্বারা ভূমি ও জলে আর্সেনিক দূষণ বৃদ্ধি পাবে এবং ‘বাংলাদেশ অচিরেই পরিবেশদূষণকারী দেশ হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হবে।’
এত বড় সর্বনাশ কেন আমরা করব? সরকারেরও এভাবে জেদ ধরে থাকা কি উচিত হবে? বিকল্প যখন আছে, তখন সেই চেষ্টা করা হোক। সুন্দরবন বা লোকালয় থেকে দূরে কোথাও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হোক।
এখনো সময় আছে। সরকারের প্রতি আহ্বান রইল, জনমত ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত নিয়ে বিকল্প বিদ্যুৎ প্রকল্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। বিদ্যুৎ অবশ্যই চাই, কিন্তু পরিবেশ ও মনুষ্য জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়। পরিবেশবান্ধব এনার্জি ও বিদ্যুৎ তৈরির জন্য যখন উপায় আছে, তখন সেটাই গ্রহণ করা হোক।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
কিন্তু যে কথাটি এখন এসেছে, এমনকি সেই এক শ বছর আগেও কমবেশি এসেছিল, তা হলো উন্নয়ন কি প্রকৃতিকে ধ্বংস করে? মানবজীবনের অস্তিত্বের জন্য যে প্রাকৃতিক পরিবেশ একান্তভাবেই প্রয়োজনীয়, তাকে ধ্বংস করে কি প্রকৃত উন্নয়ন হতে পারে?
গত শতাব্দীর তিরিশের দশকে সোভিয়েত সরকার বিদ্যুৎ, ভারী শিল্প তথা উন্নয়নের যে বিশাল কর্মকাণ্ড হাতে নিয়েছিল, তার তুলনা এখনো ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। অনেক সোভিয়েতবিরোধী লেখক বলছেন, তখনকার সোভিয়েত সরকার ব্যাপকভাবে পরিবেশ ধ্বংস করেছিল। কথাটা সত্য নয়। এ কথা ঠিক যে তখনো আজকের মতো পরিবেশসচেতনতা তৈরি হয়নি। কিন্তু সেই সময় বনাঞ্চল, জলস্রোত ইত্যাদি রক্ষার জন্য সোভিয়েত সরকারের যে ধরনের তাগিদ ছিল, তা তখনকার পৃথিবীতে অন্য কোথাও দেখা যাবে না। ২০১০ সালে মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টিফেন ব্রেইন ‘স্তালিনের পরিবেশবাদিতা’ শীর্ষক এক গবেষণা নিবন্ধে দেখিয়েছেন, স্তালিন প্রশাসন বড় ও ভারী শিল্পের ওপর জোর দিলেও পরিবেশ রক্ষার চিন্তাটাও একই সঙ্গে ছিল। সে জন্য বন বিভাগের দায়িত্ব শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে সরিয়ে বন শ্রমিকদের ইউনিয়নের ওপর দেওয়া হয়েছিল।
বরং অন্যদিকে দেখা যায় যে সমাজতন্ত্রীদের আদি তাত্ত্বিক গুরু ও দার্শনিক কার্ল মার্ক্স অভিযোগ করেছেন যে পুঁজিপতিরা কেবল মুনাফার লালসায় প্রকৃতির ধ্বংসসাধন করে থাকে। মার্ক্সের বিখ্যাত রচনা পুঁজি গ্রন্থে (প্রথম খণ্ডে) বলা হয়েছে, ‘পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রযুক্তির বিকাশ ঘটায় এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন প্রক্রিয়াকে যুক্ত করে...(কিন্তু) ধ্বংস করে সকল সম্পদের আদি উৎস—মাটি ও শ্রমিককে।’ তিনি মাটি ধ্বংসের বিষয়টিও উল্লেখ করছেন।
আমরা এখনো দেখছি, তাৎক্ষণিক মুনাফা ও সর্বোচ্চ মুনাফার তাগিদে করপোরেট পঁুজি প্রকৃতিকে কীভাবে ধ্বংস করছে, যা মানবজাতির অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলে। অতীত ইতিহাস এবং বিশ্ব পরিসর ছেড়ে আসা যাক বর্তমান সময়ে এবং বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। আমরা দেখেছি কীভাবে কিছু দুর্বৃত্তের লোভ ও দখলদারি মনোবৃত্তির কারণে নদী দখল হচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে প্রাকৃতিক জলাশয় (অথবা স্থায়ীভাবে জলমগ্ন থাকছে বিস্তীর্ণ জনপদ) দূষিত হচ্ছে বাতাস, মাটি, পানি। এসব বিষয় রাজনৈতিক বিতর্কের ঊর্ধ্বে। সেসব বিষয় নিয়েও আপাতত আলোচনায় যাচ্ছি না। আজকের বিষয়বস্তু সুন্দরবনের গা ঘেঁষে রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প।
এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছে। কয়েকটি বামপন্থী দল প্রতিবাদ হিসেবে ১০ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা থেকে রামপাল অভিমুখে লংমার্চ করেছে। তাদের দাবি, তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প রামপাল থেকে সরাও, কারণ সুন্দরবন ধ্বংস হবে। ‘সুন্দরবন বাঁচাও’ নামে বিভিন্ন বুদ্ধিজীবী পরিবেশবাদী ও সমাজকর্মীর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি সংগঠন। তঁাদেরও একই দাবি।
সুন্দরবনের গা ঘেঁষে রামপালে ভারতের ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সংস্থা পিডিবি ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সব রকম ন্যায্য প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করেই সরকার এই প্রকল্পের প্রাথমিক কাজ শুরু করেছে। এর প্রাথমিক পুঁজির ১৫ শতাংশ করে দেবে ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিটি ও বাংলাদেশের পিডিবি (মোট ৩০ শতাংশ)। বাকিটা আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সংগ্রহ করা হবে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, তার বড় অংশ আসবে ভারত থেকে চড়া হারে সুদে ঋণ আকারে। সুদের হার হবে ১৪ শতাংশ। অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি ও সরবরাহকারীর কাজও পাবে ভারতের বিভিন্ন কোম্পানি। যাই হোক, আমরা এখানে অর্থনৈতিক লাভ-লোকসানের চেয়ে বেশি করে দেখব পরিবেশগত ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি।
রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মিত হবে সুন্দরবনের একেবারেই গা ঘেঁষে ১৪ কিলোমিটারের মধ্যে। বাফার জোন ধরলে এই দূরত্ব আরও কম হবে। একই ভারতীয় কোম্পানি পশ্চিমবঙ্গের সুন্দরবনের কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চেয়েছিল। ভারত সরকার অনুমতি দেয়নি। ভারতের ‘তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন-সংক্রান্ত গাইডলাইন ১৯৮৭’, ভারতের ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট ১৯৭২’ এবং ভারতের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় প্রণীত ‘পরিবেশ সমীক্ষা (ইআইএ) গাইডলাইন ম্যানুয়াল ২০১০’ অনুযায়ী সংরক্ষিত বনাঞ্চল, বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য, জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান, জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি এলাকার ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ নির্মাণ করা যাবে না। একই কারণে ভারত সরকার তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও মধ্যপ্রদেশে এ ধরনের তিনটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। ভারতের এনটিপিটি সুন্দরবনের গা ঘেঁষে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে যাচ্ছে জেনে পরিবেশসচেতন নরওয়ে সরকার ২০১৪ সালেই ওই কোম্পানির জন্য দেয় ৪৩০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
শুধু রামপালই নয়। ওরিয়ন নামে একটি দেশীয় কোম্পানি সুন্দরবনের আরও কাছে অনুরূপ আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণ করতে চলেছে, যেখান থেকে ৬৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে বলে জানানো হয়েছে। একইভাবে চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূলবর্তী বাঁশখালী উপজেলায় একটি ঘনবসতি এলাকায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের কাজ চলছে। এতে জনবসতি উচ্ছেদ হবে। পরিবেশও দূষিত হবে। সেখানকার মানুষ প্রতিবাদ-সংগ্রাম গড়ে তুলেছে। কিন্তু তা নীতিনির্ধারকের কানে প্রবেশ করছে না।
আবার মূল প্রশ্নে ফিরে আসি। তাহলে কি আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন নেই? অবশ্যই আছে। কিন্তু তা যেন কোনোভাবেই পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়। দ্বিতীয়ত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিকল্প কি নেই? অবশ্যই আছে। বিশিষ্ট বিশেষজ্ঞরা, প্রকৌশলী ও বিজ্ঞানীরা বলছেন আছে। দুটো প্রশ্নই বিবেচনা করা যাক।
সরকার বলছে, রামপালে এমন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার হবে যাতে পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। কথাটা সত্য নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই আধুনিক প্রযুক্তি বড়জোর ১০ শতাংশ ক্ষতি কমাতে পারে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে সিলেটের সিমেন্ট কোম্পানিগুলো বিজ্ঞাপন দিয়েছে, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় যে ছাই ছিটকে পড়বে তা সিমেন্ট তৈরির কাজে ব্যবহার করা যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বাই প্রোডাক্ট হিসেবে যদি সিমেন্ট পাওয়া যায়, সে তো ভালো কথা। কিন্তু ছাই দিয়ে সিমেন্ট করা গেলেও তা সুন্দরবনের গাছ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য যে মারাত্মক ক্ষতিকর হবে, সে কথা কি ভুলে যেতে হবে?
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সবচেয়ে বেশি দূষিত বর্জ্য তৈরি করে। পরিবেশকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করে। কয়লা থেকে উদ্গিরণ হয় কার্বন-ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোড্রাইড, সালফার-ডাই অক্সাইড ইত্যাদি যা গাছপালা, জীবজন্তুকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কার্বন-ডাই অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে এক শ বছর টিকে থাকে এবং তা ভূ–প্রকৃতিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে। এখন যদিও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বিশ্বে কয়লাই সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়, তবু উন্নত বিশ্বে কয়লা থেকে সরে আসার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। শিল্পোন্নত জার্মানিতে বাতাসের গতির ওপর নির্ভরশীল ছোট ছোট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রচলন খুব বেশি মাত্রায় দেখা যাচ্ছে। এ কথা সত্য যে পাশ্চাত্যের করপোরেট পুঁজিই সর্বোচ্চ মুনাফার লোভে পরিবেশ বিনষ্ট করতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও সত্য যে সেই দেশের মানুষও অধিক পরিবেশসচেতন হয়ে উঠেছে। ইউরোপ, আমেরিকায় এমনকি ভারতেও কিছুতেই জনগণ সুন্দরবনের মতো বন ঘেঁষে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প হতে দিত না।
পরিবেশবাদীরা নিশ্চিত যে এই প্রকল্প সুন্দরবনকে ধ্বংস করবে। কয়লার ছাই ও ধোঁয়ায় গাছপালা, জীবজন্তুর ক্ষতি হবে। নদীর পানি দূষিত হবে। মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যাবে। আমাদের ভুললে চলবে না যে ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে জাহাজডুবিতে নদীর পানি কী পরিমাণ দূষিত হয়েছিল। বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বাইরে থেকে জাহাজে করে কয়লা আসবে। সেই কয়লা কি নদীতে পড়বে না? ২০১৪ সালের মতো দুর্ঘটনা কি আরও হতে পারে না? এত ঝুঁকি নিয়ে রামপালে বা মংলায় বিদ্যুৎ প্রকল্প না করে দূরে কোথাও করলে অসুবিধা কী? হয়তো পরিবহন খরচ বাড়বে।
খরচ বাঁচানোর জন্য, কোম্পানির লাভের জন্য কি সুন্দরবন তথা পরিবেশের এত বড় ক্ষতিসাধন করতে হবে? হায়রে মুনাফা! মার্ক্স যথার্থই বলেছিলেন, পুঁজিপতিরা ৩ শতাংশ হারে মুনাফার সন্ধান পেলে এমন কাজ করতে বিরত হবে না, যে কাজে তার ফাঁসি হওয়ার আশঙ্কা পর্যন্ত থাকে! (পুঁজি প্রথম খণ্ড)।
দ্বিতীয়ত কয়লার বিকল্প কি নেই? বাংলাদেশ সরকারের পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক এনার্জি বিশেষজ্ঞ বিডি রহমতউল্লাহ্ বেশ কয়েকটি গবেষণাপত্রে দেখিয়েছেন যে কয়লার বিকল্প আছে। এবং সেগুলো তাঁর মতে ‘টেকসই ও সাশ্রয়ী’। অন্যদিকে রামপালের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নানা পদার্থ সৃষ্টি হবে। কয়লা থেকে আর্সেনিক দ্বারা ভূমি ও জলে আর্সেনিক দূষণ বৃদ্ধি পাবে এবং ‘বাংলাদেশ অচিরেই পরিবেশদূষণকারী দেশ হিসেবে কালো তালিকাভুক্ত হবে।’
এত বড় সর্বনাশ কেন আমরা করব? সরকারেরও এভাবে জেদ ধরে থাকা কি উচিত হবে? বিকল্প যখন আছে, তখন সেই চেষ্টা করা হোক। সুন্দরবন বা লোকালয় থেকে দূরে কোথাও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হোক।
এখনো সময় আছে। সরকারের প্রতি আহ্বান রইল, জনমত ও বিশেষজ্ঞদের অভিমত নিয়ে বিকল্প বিদ্যুৎ প্রকল্পের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন। বিদ্যুৎ অবশ্যই চাই, কিন্তু পরিবেশ ও মনুষ্য জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়। পরিবেশবান্ধব এনার্জি ও বিদ্যুৎ তৈরির জন্য যখন উপায় আছে, তখন সেটাই গ্রহণ করা হোক।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
No comments