স্বৈরশাসন আসবে ও যাবে by হানিফ খন্দকার
উইন্সটন
স্মিথ একজন নিরীহ নাগরিকের নাম। স্বৈরশাসনে তাঁর জীবন দলিত-মথিত। তিনি
ওসেনিয়া নামের দেশটির আমজনতার একজন। যারা স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পড়েছেন ।
কিন্তু তা থেকে মুক্তির উপায় খুঁজে পাচ্ছেন না। জর্জ অরওয়েল তাঁর কালজয়ী
উপন্যাস নাইনটিন এইটি ফোরে দেখিয়েছেন, জীবন থেমে থাকে না। প্রচণ্ড
প্রতিকূলতার মধ্যেও তা বহমান থাকে। সেখানে প্রেম আসে। স্বল্প সময়ের জন্য
হলেও জুলিয়া তাঁকে কিছুটা স্বস্তি দিয়েছিলেন। উইন্সটন সামনে আশার আলো
দেখেছিলেন। ভবিষ্যতে তিনি আশার দেখেছিলেন। কিন্তু অরওয়েল নিশ্চিত ছিলেন যে,
স্বৈরশাসনের শেষ দৃশ্যটি সুখের হয় না। সেখানকার চিত্রনাট্যে হ্যাপি এন্ডিং
রাখা যায় না। এটা সাধারণত প্রলয়ঙ্ককরী হয়ে থাকে।
জর্জ অরওয়েল একালের সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফি, আনোয়ার সাদতদের পতন দেখে যাননি। কিন্তু তিনি কল্পনা করতে পেরেছিলেন বিশ্বে যুগে যুগে স্বৈরশাসকরা আসবেই। আর তাদের হাতে উইন্সটনের মতো দেশপ্রেমিকদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হবে। সে পরীক্ষায় উইন্সটনরা অবশ্যই হারবে। কারণ, তাদের না হারালে স্বৈরশাসকদের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করা যায় না। অরওয়েল তাই বোধগম্যকারণেই উইন্সটনকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন। গ্রেপ্তার, রিমান্ড ও নির্যাতন দিয়ে তাঁর কণ্ঠকে স্তব্ধ করেছেন। অরওয়েল কারাগার থেকে উইন্সটনকে পালাতে দেননি। কারণ, তিনি জানেন স্বৈরতান্ত্রিকতাবাদকে পরাস্ত করতে চান। যদি উইন্সটনকে তিনি চূড়ান্তভাবে জয়ী করতে চান, তাহলে স্বৈরাচারের মৃত্যুঘণ্টা আপতত আর বাজালে চলবে না।
পাঠকরা সহজেই উইন্সটনকে চিনতে পারছেন। তাকে আপন করে তোলা হয়েছে। তাঁর আত্মমর্যাদা আছে। মানুষের মমতা আছে। একটি সভ্য সমাজের বাসিন্দা হিসাবে কতগুলো মূল্যেবোধ নিয়ে তাকে চলতে হয়। সেটা সম্ভব না হলে কোনো ব্যক্তি নিজেকে দায়িত্বশীল নাগরিক ভাবতে পারেন না।
গণতন্ত্র, শাস্তি, স্বাধীনতা, ভালোবাসা ও শালীনতা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অরওয়েল যখন তাকে ধ্বংস করে দিলেন তখন তার সঙ্গে এসব মূল্যবোধও ধ্বংস হয়ে গেল। তবে এটা দোখানো হয়েছে যে এসব নৈতিক মূল্যোবোধ অপরাজিত। এর কোনো মৃত্যু নেই। আর এ সবই একজনকে গুণাবলী সম্পন্ন মানুষে পরিণত করে। মানুষ হিসেবে ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে । সুতরাং এর সারকথা হলো, মানবজাতির ইতিহাসে যখন যেখানে যে জনগোষ্ঠী একনায়কের কবলে পড়বে, সেখানে বসবাসরতদের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের একটি বিষয় থাকবে। বিনা প্রতিবাদে তাকে যেতে দেয়া যাবে না। নাগরিক সমাজের জন্য এটা বিকল্প নয়। অবশ্য কর্তব্য।
উইন্সটন তাই আমজনতার একজন প্রতিনিধি, যাঁর কাজ হচ্ছে শুভ আর অশুভ শক্তির মধ্যে লড়াইকে টিকিয়ে রাখা। আর এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য যে খুবই স্পষ্ট, সে বিষয়ে অরওয়েল কোনো সন্দেহ সৃষ্টি রাখতে চাননি।
শেষ পর্যন্ত উইন্সটন তাঁর চেতনা ও তার মানবিকতা হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু পাঠক দেখেছে এ দুটো বিষয়কে রক্ষার জন্য তিনি কঠিন পরিশ্রম করেছেন। লেখক দেখাতে চেয়েছেন উইন্সটনের ভাগ্য যে কোনো নাগরিকের জীবনে ঘটতে পারে। আর সেকারণেই গল্পের একেবারেই শেষে তিনি তাকে বাঁচিয়ে রাখেননি। অদৃশ্য আততায়ীর হাত দিয়ে তাকে হত্যা করেছেন। লেখকের উদ্দেশ্য হলো মানবজাতিকে সতর্ক করে দেয়া ১৯৮৪ সালটি আসবে এবং চলে যাবে কিন্তু এতে যে সমাজের চিত্র তিনি এঁকেছেন তা কখনো শেষ হবে না।
জুলিয়ার চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তার প্রতি তার ভালোবাসার স্বার্থ আছে। এবং বিগ ব্রাদারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনায় তাকে মৃত্যু হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। জুলিয়ার ভিতরের লেখক যেসব মানবিক উপাদান দেখিয়েছেন সেসব আবার নায়কের মধ্যে দেননি। জুলিয়ার মানবিক উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকৃত যৌনতা, ধূর্ততা এবং জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা। নায়ক যখন কেবল সাদামাটা জীবন বেছে নিয়েছে নায়িকা তখন যেকোনো মূল্যে জীবনকে উপভোগ্য করতে চেয়েছেন। দুজনেই ক্ষমতাসীন দলের সদস্য।
উইন্সটন যেখানে যৌনতা ও অন্তরঙ্গতা উপভোগ করেছেন, সেখানে জুলিয়া সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়ে ও যৌনতা দিয়ে চারপাশের জগৎকে কব্জায় রাখতে চেয়েছেন। তাকে দেখা গেছে তিনি নিয়মিতভাবে পার্টির সদস্যদের সঙ্গে শয্যাশায়ী হয়েছেন। অন্তত উইন্সটনের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে এরকম গোপন অভিসারে মগ্ন থাকতে দেখা গেছে। তবে জুলিয়া পার্টিকে ধ্বংস করার জন্য একাজ করেননি। এটা তিনি করেছিলেন নিজের ইচ্ছার প্রাধান্য বাজায় রাখতে। আর সেটাই এ দুজনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য।
দুজনেই বিদ্রোহী। একজনের বিদ্রোহ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মঙ্গলের জন্য। আরেজনের বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে দুর্ঘটনাবশত, যা তার নিজের জৈবিক চাহিদাকে বাস্তবে রূপদানের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা হয়েছে। চলবে।
জর্জ অরওয়েল একালের সাদ্দাম হোসেন, মুয়াম্মার গাদ্দাফি, আনোয়ার সাদতদের পতন দেখে যাননি। কিন্তু তিনি কল্পনা করতে পেরেছিলেন বিশ্বে যুগে যুগে স্বৈরশাসকরা আসবেই। আর তাদের হাতে উইন্সটনের মতো দেশপ্রেমিকদের দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হবে। সে পরীক্ষায় উইন্সটনরা অবশ্যই হারবে। কারণ, তাদের না হারালে স্বৈরশাসকদের পতনকে অবশ্যম্ভাবী করা যায় না। অরওয়েল তাই বোধগম্যকারণেই উইন্সটনকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন। গ্রেপ্তার, রিমান্ড ও নির্যাতন দিয়ে তাঁর কণ্ঠকে স্তব্ধ করেছেন। অরওয়েল কারাগার থেকে উইন্সটনকে পালাতে দেননি। কারণ, তিনি জানেন স্বৈরতান্ত্রিকতাবাদকে পরাস্ত করতে চান। যদি উইন্সটনকে তিনি চূড়ান্তভাবে জয়ী করতে চান, তাহলে স্বৈরাচারের মৃত্যুঘণ্টা আপতত আর বাজালে চলবে না।
পাঠকরা সহজেই উইন্সটনকে চিনতে পারছেন। তাকে আপন করে তোলা হয়েছে। তাঁর আত্মমর্যাদা আছে। মানুষের মমতা আছে। একটি সভ্য সমাজের বাসিন্দা হিসাবে কতগুলো মূল্যেবোধ নিয়ে তাকে চলতে হয়। সেটা সম্ভব না হলে কোনো ব্যক্তি নিজেকে দায়িত্বশীল নাগরিক ভাবতে পারেন না।
গণতন্ত্র, শাস্তি, স্বাধীনতা, ভালোবাসা ও শালীনতা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। অরওয়েল যখন তাকে ধ্বংস করে দিলেন তখন তার সঙ্গে এসব মূল্যবোধও ধ্বংস হয়ে গেল। তবে এটা দোখানো হয়েছে যে এসব নৈতিক মূল্যোবোধ অপরাজিত। এর কোনো মৃত্যু নেই। আর এ সবই একজনকে গুণাবলী সম্পন্ন মানুষে পরিণত করে। মানুষ হিসেবে ব্যক্তিকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে । সুতরাং এর সারকথা হলো, মানবজাতির ইতিহাসে যখন যেখানে যে জনগোষ্ঠী একনায়কের কবলে পড়বে, সেখানে বসবাসরতদের জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের একটি বিষয় থাকবে। বিনা প্রতিবাদে তাকে যেতে দেয়া যাবে না। নাগরিক সমাজের জন্য এটা বিকল্প নয়। অবশ্য কর্তব্য।
উইন্সটন তাই আমজনতার একজন প্রতিনিধি, যাঁর কাজ হচ্ছে শুভ আর অশুভ শক্তির মধ্যে লড়াইকে টিকিয়ে রাখা। আর এ দুয়ের মধ্যে পার্থক্য যে খুবই স্পষ্ট, সে বিষয়ে অরওয়েল কোনো সন্দেহ সৃষ্টি রাখতে চাননি।
শেষ পর্যন্ত উইন্সটন তাঁর চেতনা ও তার মানবিকতা হারিয়ে ফেললেন। কিন্তু পাঠক দেখেছে এ দুটো বিষয়কে রক্ষার জন্য তিনি কঠিন পরিশ্রম করেছেন। লেখক দেখাতে চেয়েছেন উইন্সটনের ভাগ্য যে কোনো নাগরিকের জীবনে ঘটতে পারে। আর সেকারণেই গল্পের একেবারেই শেষে তিনি তাকে বাঁচিয়ে রাখেননি। অদৃশ্য আততায়ীর হাত দিয়ে তাকে হত্যা করেছেন। লেখকের উদ্দেশ্য হলো মানবজাতিকে সতর্ক করে দেয়া ১৯৮৪ সালটি আসবে এবং চলে যাবে কিন্তু এতে যে সমাজের চিত্র তিনি এঁকেছেন তা কখনো শেষ হবে না।
জুলিয়ার চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় তার প্রতি তার ভালোবাসার স্বার্থ আছে। এবং বিগ ব্রাদারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম পরিচালনায় তাকে মৃত্যু হিসেবে পাওয়া গিয়েছে। জুলিয়ার ভিতরের লেখক যেসব মানবিক উপাদান দেখিয়েছেন সেসব আবার নায়কের মধ্যে দেননি। জুলিয়ার মানবিক উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রকৃত যৌনতা, ধূর্ততা এবং জীবন সংগ্রামে টিকে থাকা। নায়ক যখন কেবল সাদামাটা জীবন বেছে নিয়েছে নায়িকা তখন যেকোনো মূল্যে জীবনকে উপভোগ্য করতে চেয়েছেন। দুজনেই ক্ষমতাসীন দলের সদস্য।
উইন্সটন যেখানে যৌনতা ও অন্তরঙ্গতা উপভোগ করেছেন, সেখানে জুলিয়া সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়ে ও যৌনতা দিয়ে চারপাশের জগৎকে কব্জায় রাখতে চেয়েছেন। তাকে দেখা গেছে তিনি নিয়মিতভাবে পার্টির সদস্যদের সঙ্গে শয্যাশায়ী হয়েছেন। অন্তত উইন্সটনের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে এরকম গোপন অভিসারে মগ্ন থাকতে দেখা গেছে। তবে জুলিয়া পার্টিকে ধ্বংস করার জন্য একাজ করেননি। এটা তিনি করেছিলেন নিজের ইচ্ছার প্রাধান্য বাজায় রাখতে। আর সেটাই এ দুজনের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য।
দুজনেই বিদ্রোহী। একজনের বিদ্রোহ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মঙ্গলের জন্য। আরেজনের বিদ্রোহ সম্পূর্ণরূপে দুর্ঘটনাবশত, যা তার নিজের জৈবিক চাহিদাকে বাস্তবে রূপদানের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে দেখা হয়েছে। চলবে।
No comments