এই আমাদের পুলিশ! by আব্দুল কাইয়ুম
আমি
তখন সংবাদ-এ। সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত মজার মজার টীকা-টিপ্পনী কেটে আমাদের
সম্পাদকীয় বিভাগ মাতিয়ে রাখতেন। একদিন বললেন, দু কড়ি যোগ + তিন কড়ি = পাঁচ
কড়ি—এই শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় লেখেন! আমরা নিজেদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছি।
কারণ, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কী লিখব আর কেনই-বা লিখব। সন্তোষদা পরে
গল্পটি বললেন। পাঁচ কড়ি নামের এক আসামি ধরার জন্য পুলিশ পাঠানো হয়েছে। দুই
দিন পর দুই শিশুর কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় এনে পুলিশ সদস্য ওসিকে বললেন, ‘এই
যে আসামি।’ ওসি সাহেব তো অবাক। তখন পুলিশ সদস্য বুঝিয়ে বললেন, ‘স্যার, পাঁচ
কড়ি বলে ওই গ্রামে কেউ নেই। তো দুজনকে পেয়েছি, এর নাম দু কড়ি আর ও তিন
কড়ি। দেখলাম, দুই আর তিন যোগ করলে যেহেতু পাঁচ হয়, আর আমার দরকার পাঁচ কড়ি,
তাই একসঙ্গে দুজনকে ধরে আনলাম!’
আমরা সেদিন খুব হেসেছি। ওটা যে নেহাতই গল্প, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ ছিল না। অবশ্য মজার সেই সম্পাদকীয় সেদিন লেখা হয়েছিল। কারণ, ও রকমই একটি কাণ্ড পুলিশ ঘটিয়েছিল। হুবহু এক ছিল না। তাই গল্পটি খাপ খাওয়ানোর জন্য কিছু কসরত করতে হয়েছিল।
আজ প্রায় ২৫ বছর পর হঠাৎ একটি খবর দেখে বুঝলাম, হুবহু ওই রকম ঘটনা এখনো ঘটছে। অপরাধ করেছেন ছোট বোন আর পুলিশ ধরে এনেছে বড় বোনকে। বিনা অপরাধে তাঁকে জেলে আটক থাকতে হয়েছে প্রায় তিন মাস। বড় বোনের নাম লাকি আর ছোট বোনের পাসপোর্টে নাম ছিল লাকি আক্তার মুক্তা। সোনা চোরাচালানের মামলায় আসামি ধরতে গিয়ে পুলিশ বড় বোনকে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকায়। যাত্রাবাড়ী থানার উপসহকারী পরিদর্শক (এএসআই) বলেন, ‘বড় বোনের নাম লাকি। আবার ছোট বোনের নামের এক জায়গায় লাকি রয়েছে। এই দুজনের স্বামীর নামেও কিছু মিল আছে। বড় বোনের স্বামীর নাম হারুন দেওয়ান আর ছোট বোনের হারুন-অর-রশীদ। নামের মিল থাকায় লাকিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান করি (প্রথম আলো অনলাইন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)!’
পরে ছোট বোন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বড় বোন মুক্তি পান, ছোট বোন জেলে যান।
এই আমাদের পুলিশ। এটা পুলিশের ভুল না ভেল্কিবাজি, তা কে জানে।
আজকাল পুলিশের নানা কাণ্ড নিয়ে কাগজে খবর বেরোয়। সেদিন মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদের কাছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে পুলিশ রিকশা থেকে নামিয়ে একটি দোকানে ঢোকায়। দোকানিকে বের করে দিয়ে পুলিশ সেই ছাত্রীকে হেনস্তা করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিচার বিভাগীয় তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এ বিষয়ে আদালত ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন।
এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে চা-দোকানি বাবুল মাতবরকে জ্বলন্ত চুলায় ফেলে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মিরপুরের শাহ আলী থানার তৎকালীন ওসিসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পায় পুলিশেরই গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি।
এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন কি না, তা পুলিশকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেখাতে হবে। আমরা জানি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আমাদের এই পুলিশই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আমরা সব সময় পুলিশের সেই আত্মোৎসর্গ গর্বের সঙ্গে স্মরণ করি। তাদের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল রণাঙ্গনে আমাদের প্রেরণার উৎস।
স্বাধীন বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময় পুলিশকে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। বিশেষভাবে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশ ছিল গণ-আন্দোলনের পক্ষে। ছাত্ররা তখন প্রায়ই পথসভা করতেন এবং পত্রিকায় কর্মসূচি ঘোষণা করে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হতো কোথা থেকে কোন সময়ে পথসভা শুরু হবে। পত্রিকার খবর দেখে কর্মীরা সেই সব স্থানে সমবেত হতেন, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে রাজপথে মিছিল বের করতেন।
কিন্তু মুশকিল হলো, মিছিলের স্থান ও সময় শুধু আন্দোলনের কর্মীরাই নন, পুলিশও পেয়ে যেত। ছাত্ররা দেখতেন কর্মীদের আগে পুলিশ এলাকা ঘিরে ফেলেছে। প্রায়ই পুলিশের ধাওয়ার মুখে মিছিল পণ্ড হতো। পরে পুলিশই একটি বুদ্ধি বাতলে দিল। তারা ছাত্রদের পরামর্শ দিল, পত্রিকায় মিছিলের স্থান সদরঘাট উল্লেখ করে যেন বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে মিছিল শুরু করা হয়। কর্মীদের যেন গোপনে পরিবর্তিত স্থান জানিয়ে দেওয়া হয়। তা হলে পুলিশ যাবে সদরঘাটে আর গরম মিছিল বের হবে বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে। আন্দোলনও বেগবান হবে, পুলিশেরও চাকরিতে অসুবিধা হবে না।
এই বুদ্ধিটি পুলিশই দিয়েছিল। ফলে অনেক মিছিল-মিটিং সেই সময় নির্বিঘ্নে করা সম্ভব হতো।
মুশকিল হলো, আমাদের সমাজ এখনো স্বতঃস্ফূর্ততায় বেশি প্রভাবিত। ঝোঁকের মাথায় কাজ করা মানুষের অভ্যাস। ১৬ কোটি মানুষের ছোট এই দেশে শৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন। তাই বিচ্যুতি সহজাত। এখানেই আমাদের চ্যালেঞ্জ।
১৯৭৭ সালে একবার রাজনৈতিক কারণে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করতে আসে। কিন্তু প্রথমে সেই কর্মকর্তা গ্রেপ্তারের কথা না বলে কৌশলে থানায় নিয়ে যেতে চান। আমি সরল মনে তাঁর সঙ্গে থানায় যেতে চাই। কিন্তু লক্ষ করি, সঙ্গের একজন পুলিশ সদস্য চোখের ইশারায় থানায় যেতে মানা করছেন। সেই পুলিশের সহযোগিতামূলক মনোভাব আমি বুঝতে পারিনি। তাই থানায় গিয়ে বিপদে পড়ি। কিছু সময় আটক ছিলাম। পরে সেই পুলিশ সদস্য আমাকে বললেন, ‘চোখের ইশারা বোঝেন না? আমি আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আপনি রাজনীতি করেন, দেশের জন্য কাজ করেন, আপনাকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম।’
এই পুলিশ আমাদেরই কাছের মানুষ। সব পেশায়ই এদিক-ওদিক কিছু হয়। তার মানে সবাইকে এক কাতারে ফেলে দেখতে হবে, তা নয়।
কয়েক বছর আগে আমার ঘনিষ্ঠ একজন বিসিএস দিয়ে পুলিশ বিভাগে চাকরিতে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স, এরপর আবার এমবিএ করে তিনি পুলিশে যান। কেন? জিজ্ঞেস করলে বলেন, তিনি লক্ষ করেছেন যে পুলিশে ভালো ও উন্নত মানের দক্ষ কর্মকর্তা গড়ে তুলতে আমেরিকা-ইউরোপ উদ্যোগী হয়েছে। তাই তাঁর বিশ্বাস, ভবিষ্যতে পুলিশ দেশের জন্য খুব মর্যাদাসম্পন্ন একটি শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অবদান রাখার জন্য তিনি পুলিশ ক্যাডার বেছে নিয়েছেন।
এখন পুলিশে অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন, যাঁরা মানবাধিকার ও অন্যান্য বিষয়ে বিলাত-আমেরিকার নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে এসেছেন। আমাদের পুলিশ নিয়ে গর্ব করার মতো অনেক কিছুই আছে। তবে অনেক ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়।
বিশ্বের উন্নত অনেক দেশেও পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কিন্তু পুলিশের যেকোনো বিচ্যুতির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে ওই সব দেশের মানুষ পুলিশের ওপর আস্থা হারায় না। যেকোনো পেশায় কোনো সদস্য ভুল করতে পারেন। অথবা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু এসব বিচ্যুতির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা কতটা দৃঢ়, সেটাই বিচার্য। যদি ফাঁকফোকর বন্ধ করার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে কিছু সদস্যের জন্য একটি পুরো প্রতিষ্ঠানের মুখে চুনকালি পড়ে না।
আমাদের দেশে এখন এদিকে জোর দিতে হবে। পুলিশের প্রশিক্ষণ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। আমাদের পুলিশ প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো গর্ব করার মতো। সেখানে নিয়মিত প্রশিক্ষণ হয়। দক্ষ ও আধুনিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
কিন্তু মুশকিল হলো, আমাদের সমাজ এখনো স্বতঃস্ফূর্ততায় বেশি প্রভাবিত। ঝোঁকের মাথায় কাজ করা মানুষের অভ্যাস। ১৬ কোটি মানুষের ছোট এই দেশে শৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন। তাই বিচ্যুতি সহজাত। এখানেই আমাদের চ্যালেঞ্জ। মানুষই ঘুষ দিয়ে অবৈধ গ্যাসলাইন নেয়, আবার পুলিশ দিয়ে সেই অবৈধ লাইন কেটে দেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় পুনরায় অবৈধ সংযোগ চালু হয়ে যায়।
এখানে আইনের সঠিক প্রয়োগও বেশ কঠিন। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই আমাদের করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
আমরা সেদিন খুব হেসেছি। ওটা যে নেহাতই গল্প, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ ছিল না। অবশ্য মজার সেই সম্পাদকীয় সেদিন লেখা হয়েছিল। কারণ, ও রকমই একটি কাণ্ড পুলিশ ঘটিয়েছিল। হুবহু এক ছিল না। তাই গল্পটি খাপ খাওয়ানোর জন্য কিছু কসরত করতে হয়েছিল।
আজ প্রায় ২৫ বছর পর হঠাৎ একটি খবর দেখে বুঝলাম, হুবহু ওই রকম ঘটনা এখনো ঘটছে। অপরাধ করেছেন ছোট বোন আর পুলিশ ধরে এনেছে বড় বোনকে। বিনা অপরাধে তাঁকে জেলে আটক থাকতে হয়েছে প্রায় তিন মাস। বড় বোনের নাম লাকি আর ছোট বোনের পাসপোর্টে নাম ছিল লাকি আক্তার মুক্তা। সোনা চোরাচালানের মামলায় আসামি ধরতে গিয়ে পুলিশ বড় বোনকে গ্রেপ্তার করে জেলে ঢোকায়। যাত্রাবাড়ী থানার উপসহকারী পরিদর্শক (এএসআই) বলেন, ‘বড় বোনের নাম লাকি। আবার ছোট বোনের নামের এক জায়গায় লাকি রয়েছে। এই দুজনের স্বামীর নামেও কিছু মিল আছে। বড় বোনের স্বামীর নাম হারুন দেওয়ান আর ছোট বোনের হারুন-অর-রশীদ। নামের মিল থাকায় লাকিকে গ্রেপ্তার করে আদালতে চালান করি (প্রথম আলো অনলাইন, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬)!’
পরে ছোট বোন আদালতে আত্মসমর্পণ করলে বড় বোন মুক্তি পান, ছোট বোন জেলে যান।
এই আমাদের পুলিশ। এটা পুলিশের ভুল না ভেল্কিবাজি, তা কে জানে।
আজকাল পুলিশের নানা কাণ্ড নিয়ে কাগজে খবর বেরোয়। সেদিন মোহাম্মদপুরের শিয়া মসজিদের কাছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে পুলিশ রিকশা থেকে নামিয়ে একটি দোকানে ঢোকায়। দোকানিকে বের করে দিয়ে পুলিশ সেই ছাত্রীকে হেনস্তা করেছে বলে অভিযোগ ওঠে। বিচার বিভাগীয় তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এ বিষয়ে আদালত ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেন।
এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মিরপুরে চা-দোকানি বাবুল মাতবরকে জ্বলন্ত চুলায় ফেলে পুড়িয়ে মারার ঘটনায় মিরপুরের শাহ আলী থানার তৎকালীন ওসিসহ পাঁচ পুলিশ সদস্যের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পায় পুলিশেরই গঠিত দুটি তদন্ত কমিটি।
এসব ঘটনা বিচ্ছিন্ন কি না, তা পুলিশকেই প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দেখাতে হবে। আমরা জানি, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আমাদের এই পুলিশই হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। আমরা সব সময় পুলিশের সেই আত্মোৎসর্গ গর্বের সঙ্গে স্মরণ করি। তাদের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল রণাঙ্গনে আমাদের প্রেরণার উৎস।
স্বাধীন বাংলাদেশেও বিভিন্ন সময় পুলিশকে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। বিশেষভাবে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় পুলিশ ছিল গণ-আন্দোলনের পক্ষে। ছাত্ররা তখন প্রায়ই পথসভা করতেন এবং পত্রিকায় কর্মসূচি ঘোষণা করে সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হতো কোথা থেকে কোন সময়ে পথসভা শুরু হবে। পত্রিকার খবর দেখে কর্মীরা সেই সব স্থানে সমবেত হতেন, স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান দিয়ে রাজপথে মিছিল বের করতেন।
কিন্তু মুশকিল হলো, মিছিলের স্থান ও সময় শুধু আন্দোলনের কর্মীরাই নন, পুলিশও পেয়ে যেত। ছাত্ররা দেখতেন কর্মীদের আগে পুলিশ এলাকা ঘিরে ফেলেছে। প্রায়ই পুলিশের ধাওয়ার মুখে মিছিল পণ্ড হতো। পরে পুলিশই একটি বুদ্ধি বাতলে দিল। তারা ছাত্রদের পরামর্শ দিল, পত্রিকায় মিছিলের স্থান সদরঘাট উল্লেখ করে যেন বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে মিছিল শুরু করা হয়। কর্মীদের যেন গোপনে পরিবর্তিত স্থান জানিয়ে দেওয়া হয়। তা হলে পুলিশ যাবে সদরঘাটে আর গরম মিছিল বের হবে বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে। আন্দোলনও বেগবান হবে, পুলিশেরও চাকরিতে অসুবিধা হবে না।
এই বুদ্ধিটি পুলিশই দিয়েছিল। ফলে অনেক মিছিল-মিটিং সেই সময় নির্বিঘ্নে করা সম্ভব হতো।
মুশকিল হলো, আমাদের সমাজ এখনো স্বতঃস্ফূর্ততায় বেশি প্রভাবিত। ঝোঁকের মাথায় কাজ করা মানুষের অভ্যাস। ১৬ কোটি মানুষের ছোট এই দেশে শৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন। তাই বিচ্যুতি সহজাত। এখানেই আমাদের চ্যালেঞ্জ।
১৯৭৭ সালে একবার রাজনৈতিক কারণে পুলিশ আমাকে গ্রেপ্তার করতে আসে। কিন্তু প্রথমে সেই কর্মকর্তা গ্রেপ্তারের কথা না বলে কৌশলে থানায় নিয়ে যেতে চান। আমি সরল মনে তাঁর সঙ্গে থানায় যেতে চাই। কিন্তু লক্ষ করি, সঙ্গের একজন পুলিশ সদস্য চোখের ইশারায় থানায় যেতে মানা করছেন। সেই পুলিশের সহযোগিতামূলক মনোভাব আমি বুঝতে পারিনি। তাই থানায় গিয়ে বিপদে পড়ি। কিছু সময় আটক ছিলাম। পরে সেই পুলিশ সদস্য আমাকে বললেন, ‘চোখের ইশারা বোঝেন না? আমি আপনাকে বাঁচাতে চেয়েছিলাম। আপনি রাজনীতি করেন, দেশের জন্য কাজ করেন, আপনাকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম।’
এই পুলিশ আমাদেরই কাছের মানুষ। সব পেশায়ই এদিক-ওদিক কিছু হয়। তার মানে সবাইকে এক কাতারে ফেলে দেখতে হবে, তা নয়।
কয়েক বছর আগে আমার ঘনিষ্ঠ একজন বিসিএস দিয়ে পুলিশ বিভাগে চাকরিতে যোগ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স ও মাস্টার্স, এরপর আবার এমবিএ করে তিনি পুলিশে যান। কেন? জিজ্ঞেস করলে বলেন, তিনি লক্ষ করেছেন যে পুলিশে ভালো ও উন্নত মানের দক্ষ কর্মকর্তা গড়ে তুলতে আমেরিকা-ইউরোপ উদ্যোগী হয়েছে। তাই তাঁর বিশ্বাস, ভবিষ্যতে পুলিশ দেশের জন্য খুব মর্যাদাসম্পন্ন একটি শক্তি হিসেবে দাঁড়াবে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অবদান রাখার জন্য তিনি পুলিশ ক্যাডার বেছে নিয়েছেন।
এখন পুলিশে অনেক কর্মকর্তা রয়েছেন, যাঁরা মানবাধিকার ও অন্যান্য বিষয়ে বিলাত-আমেরিকার নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে এসেছেন। আমাদের পুলিশ নিয়ে গর্ব করার মতো অনেক কিছুই আছে। তবে অনেক ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন দেখা দেয়।
বিশ্বের উন্নত অনেক দেশেও পুলিশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। কিন্তু পুলিশের যেকোনো বিচ্যুতির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে ওই সব দেশের মানুষ পুলিশের ওপর আস্থা হারায় না। যেকোনো পেশায় কোনো সদস্য ভুল করতে পারেন। অথবা অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু এসব বিচ্যুতির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা কতটা দৃঢ়, সেটাই বিচার্য। যদি ফাঁকফোকর বন্ধ করার ব্যবস্থা থাকে, তাহলে কিছু সদস্যের জন্য একটি পুরো প্রতিষ্ঠানের মুখে চুনকালি পড়ে না।
আমাদের দেশে এখন এদিকে জোর দিতে হবে। পুলিশের প্রশিক্ষণ এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করে। আমাদের পুলিশ প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো গর্ব করার মতো। সেখানে নিয়মিত প্রশিক্ষণ হয়। দক্ষ ও আধুনিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলার বিকল্প নেই।
কিন্তু মুশকিল হলো, আমাদের সমাজ এখনো স্বতঃস্ফূর্ততায় বেশি প্রভাবিত। ঝোঁকের মাথায় কাজ করা মানুষের অভ্যাস। ১৬ কোটি মানুষের ছোট এই দেশে শৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন। তাই বিচ্যুতি সহজাত। এখানেই আমাদের চ্যালেঞ্জ। মানুষই ঘুষ দিয়ে অবৈধ গ্যাসলাইন নেয়, আবার পুলিশ দিয়ে সেই অবৈধ লাইন কেটে দেওয়ার কয়েক দিনের মাথায় পুনরায় অবৈধ সংযোগ চালু হয়ে যায়।
এখানে আইনের সঠিক প্রয়োগও বেশ কঠিন। কিন্তু এই কঠিন কাজটিই আমাদের করতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com
No comments