আমরা কোথায় আছি, কোথায় যাচ্ছি? by সোহরাব হাসান

‘গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো এই সত্য যে সরকার এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরোধিতা করার অধিকার যে স্বীকার করতে হবে কেবল তা-ই নয়, বিরোধিতা করার এই অধিকারই গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য। এটি বাদে গণতন্ত্রের কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে না। তাই গণতন্ত্রে বিরোধিতা আইনসংগত ও সংবিধানগত। গণতন্ত্রের অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান হচ্ছে সংগঠিত বিরোধিতা।’
১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমিতির বার্ষিক সম্মেলনে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর ইংরেজিতে দেওয়া বক্তৃতা থেকে
গণতন্ত্র নিয়ে অন্য কারও বক্তব্য উদ্ধৃত করলে ক্ষমতাসীনেরা বাঁকা চোখে দেখতে পারেন। কিন্তু মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য। তার আগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশনের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। এই প্রথিতযশা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতন্ত্র সম্পর্কে যে অভিমত প্রকাশ করেছেন, তার অপরিহার্যতা অস্বীকার করার উপায় আছে বলে মনে করি না। তিনি যা বলেছেন তাঁর মর্মার্থ হলো, সরকার কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠের বিরোধিতাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্র মানলে সংখ্যালঘিষ্ঠকে কথা বলতে দিতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে যাঁরাই যখন ক্ষমতায় থাকেন, তাঁরা অন্যদের কথা বলার সমস্ত পথ বন্ধ করতে সচেষ্ট থাকেন। এমনকি নিজ দলের ভেতরেও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাবানেরা নিজেদের রাষ্ট্র ভাবেন আর সরকারের বিরোধিতাকে গণ্য করেন রাষ্ট্রদ্রোহ হিসেবে। তাঁরা ভুলে যান, যে শাসনব্যবস্থায় সরকারের বিরোধিতা বা সমালোচনা করা যায় না, সেটি পরিণত হয় কর্তৃত্ববাদী শাসনে। এখন তাঁদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে দেশকে তাঁরা কোথায় নিয়ে যাবেন? গণতন্ত্রের যে সর্বজনীন রূপ আছে, সেটি গ্রহণ করবেন, না নিজের মতো করে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিতে থাকবেন?
২.
দেশ কেমন চলছে—এই প্রশ্নের উত্তরে একেক মহারথী একেক কথা বলবেন। বিরোধী দলের (অবশ্যই যারা সরকারের শরিক নয়) মতে, দেশ একেবারে উচ্ছন্নে গেছে। অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে। আবার ক্ষমতাসীনদের কাছে এই প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণ বিপরীত। তাঁরা মনে করেন, বর্তমান সরকারের আমলে এমন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা অতীতে হয়নি। দেশের মানুষ এ রকম উন্নয়নও কখনো দেখেনি। অর্থাৎ দুই পক্ষই দুই মেরুতে অবস্থান করছে। কিন্তু সম্ভবত কেউ সত্যের ধারেকাছে নেই। দেশে গণতন্ত্র আছে, আবার গণতন্ত্র নেইও। ক্ষমতাসীনদের জন্য শতভাগ গণতন্ত্র থাকলেও ভিন্নমত পোষণকারীদের জন্য তার ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। কেননা, ক্ষমতাসীনেরা মনেই করেন, তাঁদের সঙ্গে যাঁরা ভিন্নমত পোষণ করেন, তাঁরা দেশের মঙ্গল চাইতে পারেন না। আর যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু তার সুফল কারা ভোগ করছেন, কতটুকু পাচ্ছেন, সেই তত্ত্বতালাশও জরুরি।
গণতন্ত্রের সর্বজনীন সংজ্ঞা হলো সবাইকে নিয়ে চলা। সবার মতামতের সুযোগ থাকা। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা মনে করেন, তাঁরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্রী ও দেশপ্রেমিক। যাঁরা তাঁদের সমালোচনা করেন, তাঁরা হয় নির্বোধ অথবা দেশদ্রোহী। অন্যান্য দেশের রাজনীতিকেরা ভুল করলে স্বীকার করেন। কিন্তু আমাদের রাজনীতিকদের অভিধানে ভুল শব্দটিই অনুপস্থিত। তাঁরা কখনোই ভুল করতে পারেন না। এমনকি কেউ ভুল স্বীকার করলেও তাঁর নিস্তার নেই। এমনই এক অভাবিত ও অপরিণত গণতন্ত্রে আমরা বাস করছি!
যে পরিবেশে একজন নাগরিক সাহস করে সত্য কথা বলবেন, সেই পরিবেশ বর্তমানে বিরাজ করছে, সে কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। অতীতের ঘটনা নিয়ে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্ফুজ আনামকে যেভাবে ক্ষমতাবানেরা অপমান ও হয়রানি করে চলেছেন, তাতে বর্তমান নিয়ে সত্য কথা বলা আরও অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তিনি সম্ভবত প্যান্ডোরার বাক্সটি খুলে দিয়েছেন। এ কারণেই ক্ষমতাসীন মহলে হইহই রইরই পড়ে গেছে। আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা মাহ্ফুজ আনামকে সেই সময়ের তথ্যদাতাদের বিরুদ্ধে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু তিনি তা না করে যদি যাঁরা দলীয় নেত্রীর বিরুদ্ধে সে সময়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তাঁদের এই সুপরামর্শটি দিতেন, সেটিই উত্তম হতো।
৩.
ক্ষমতাসীনেরা কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির কথা বলেন। কিন্তু তাঁদের কাজকর্মে তার ন্যূনতম প্রতিফলন লক্ষ করি না। মুক্তিযুদ্ধের মূল কথাই ছিল গণতন্ত্র ও সমতা। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও রাজনীতিকেরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের নামে যা হচ্ছে, তা দলতন্ত্র। আরও স্পষ্ট করে বললে ব্যক্তিতন্ত্র। বর্তমানের চেয়ে অতীত ভালো ছিল কি না, সেই বিতর্কের চেয়েও জরুরি হলো ভবিষ্যতে কী হবে? আমরা কোথায় যাচ্ছি? অতীত খারাপ হলে সেই অতীতকে আঁকড়ে ধরে রাখার কোনো যুক্তি নেই। বরং অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েই সামনে এগোতে হবে। বাংলাদেশের মানুষ সুখী না হলেও প্রচণ্ডভাবে আশাবাদী। তারা বারবারই রাজনীতিকদের কথায় আস্থা রেখে ভোট দিয়ে তাঁদের ক্ষমতায় এনে নিজের ভাগ্যের পরিবর্তন চেয়েছেন। কিন্তু রাজনীতিকেরা নিজেদের ভাগ্য নিয়ে যত চিন্তিত, জনগণের ভাগ্য নিয়ে ততটাই উদাসীন।
ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে প্রায়ই একটি কথা বলা হয় যে গত সাত বছরে বাংলাদেশে যা উন্নতি হয়েছে, তা নাকি গত ৩৭ বছরেও হয়নি। কিন্তু উন্নতি কিংবা অধোগতি—দুটিরই ভিত্তি লাগে। অতীতের ওপরই বর্তমান দাঁড়িয়ে থাকে। বর্তমানের ওপর নির্মিত হবে ভবিষ্যৎ। ১০ বছর ধরেই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশ বা তার অধিক হারে বেড়ে চলেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রধান যে ভিত্তি বিনিয়োগ, সে ক্ষেত্রে আমরা বেশ পিছিয়ে আছি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে গালমন্দ করা যত সহজ, ততই কঠিন বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। তার চেয়েও কঠিন গণতান্ত্রিক কাঠামো বির্নিমাণ। গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আসে না—এ কথা যেমন সত্য, তেমনি অসত্য নয়, নির্বাচন বর্জনেও গণতন্ত্র আসে না। গণতন্ত্র থাকে ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠীর রাজনৈতিক চেতনায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই চেতনার ধারেকাছেও তাঁরা যেতে পারেননি।
কয়েক দিন আগে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একটি সমাবেশে বলেছিলেন, ‘সাদাকে সাদা বলুন। কালোকে কালো বলুন।’ কিন্তু আজকের বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, সাদাকে সাদা বলতে পারলেও কালোকে কালো বলা যায় না। কেন যায় না, সেই প্রশ্নের উত্তর কি ক্ষমতাবানেরা দিতে পারবেন?
৪.
নব্বই-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেসব মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে, তার অন্যতম হলো যত জনপ্রিয় দলই হোক না কেন, এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। নব্বই-পূর্ব রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যথাক্রমে ৯৭ শতাংশ এবং ৭০ শতাংশ আসন পেত। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে সাতটি পদে সব আসনই লাভ করেছিল, যার মধ্যে জোরজবরদস্তির ঘটনাও কম ছিল না। ১৯৭৯ সালে সামরিক সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি ২০৭টি আসন পায়। কিন্তু পরবর্তী রাজনীতিতে যে মেরুকরণ ঘটেছে, তাতে এককভাবে কেউ ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করতে পারে না। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি এই হিসাবে আনছি না। কেননা, এটি কোনোভাবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন ছিল না। কিন্তু ২০০১ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতার প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কী করেছে, তা আমাদের অজানা নয়। এমনকি ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি যে নির্বাচনটি হওয়ার কথা ছিল, বিএনপির গোঁয়ার্তুমি না দেখালে সেটি হতো এবং ক্ষমতার ভিন্ন সমীকরণ ঘটত, তা এখন অনেকের কাছেই অবাস্তব মনে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার দলটি সেদিন খেলাফত মজলিসের সঙ্গে পাঁচ দফা চুক্তি করেছিল। সেই না হওয়া নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সহযাত্রী ছিল বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিকল্পধারা, অলি আহমদের এলডিপি, ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি। অন্যরা এখন সরকারের চোখে বৈরী ঘোষিত হলেও এরশাদ সরকারের সঙ্গেই আছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও রাষ্ট্রধর্মের আশ্চর্য সহ–অবস্থান! আওয়ামী লীগের নেতারা আজ যাঁদের স্বাধীনতাবিরোধী কিংবা গণতন্ত্র হন্তারক বলে চিহ্নিত করেছেন, তাঁদের অনেকেই ২০০৭ সাল পর্যন্ত মিত্র ছিলেন।
৫.
দেশের অর্থনীতি যত সমৃদ্ধির সোপান রচনা করুক না কেন, আমাদের রাজনীতিটা ক্রমেই অসুস্থ ও অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছে। সামাজিক মূল্যবোধে এতটাই অবক্ষয় ঘটেছে যে একের পর এক শিশুহত্যা ও অপহরণের ঘটনাও আমাদের বিচলিত করে না। শিক্ষাঙ্গন মানেই এখন সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনটির দৌরাত্ম্য। সেখানে প্রতিপক্ষ ছাত্রদল তো বটেই, ছোট ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের মেরে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর ওপর নির্যাতনের ঘটনাও বেড়েছে।
রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা কী ভয়ংকর রূপ নিতে পারে, তা অন্তত চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগদলীয় সাংসদ এম এ লতিফ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। তিনি চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা এবং চেম্বারের সাবেক সভাপতি। তিনি কোনো ভুল করে থাকলে সাংগঠনিকভাবে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেত। টাঙ্গাইলের লতিফ সিদ্দিকী দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাঁর ক্ষেত্রে যেমনটি হয়েছে। কিন্তু তাই বলে জনসমক্ষে একজন সাংসদকে এভাবে অপমান, তাঁর ছবিতে জুতা মারা কী ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি? যে দলের নেতা-কর্মীরা একজন দলীয় সাংসদকে অপমান করতে পারেন, সেই দলের কাছে সাধারণ মানুষ বা সাংবাদিক সম্মান পাবেন, সেটি আশা করি না। পত্রিকান্তরে আরও যে উদ্বেগজনক খবর হলো, সাংসদ লতিফের ওপর সংঘবদ্ধ আক্রমণের কারণ বন্দরের কর্তৃত্ব। একসময় চট্টগ্রাম বন্দরে সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর একাধিপত্য থাকলেও হালে সেটি আর নেই। এখন কথায় কথায় কেউ দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন বলে পরিচিত চট্টগ্রাম বন্দরকে অচল করতে পারেন না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.