তেলের দাম না কমানোর সিদ্ধান্ত আর কত দিন? by মইনুল ইসলাম
সম্প্রতি
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর প্রসঙ্গ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান
অর্থনীতিবিদ ও প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা মহোদয়ের মধ্যে এক
সেমিনারে বেশ তর্ক জমে ওঠার খবর পত্রপত্রিকায় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত
হয়েছে। ওই বিতর্কে সেমিনারে উপস্থিত বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞও দাম কমানোর
পক্ষে-বিপক্ষে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন। এর জের টেনে বাংলাদেশ ব্যাংকের
প্রধান অর্থনীতিবিদ প্রথম আলোতে স্বনামে একটি কলাম লেখায় ধারণা হচ্ছে যে
ইস্যুটি নিয়ে সরকারের মধ্যে এখনো টানাপোড়েন চলছে। সরকার যে আসলেই
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ব্যাপারটা নিয়ে বহুদিন ধরেই দ্বিধাদ্বন্দ্বে
ভুগছে, সেটা অবশ্য বোঝা যাচ্ছিল এ ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী মহোদয়ের নানা রকম
বক্তব্য ও মন্তব্য থেকে। কিন্তু দীর্ঘ দেড় বছর ধরে ক্রমাগতভাবে বিশ্বের
জ্বালানি তেলের বাজারে দাম কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের
জনগণকে এই বিশাল দরপতনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত রাখাটা আর কোনো যুক্তিতেই আমার
কাছে সমর্থনযোগ্য মনে না হওয়ায় এবারের কলামে আমি বিষয়িট প্রথম আলোর
পাঠকদের জানানোর জন্য বিবেকের তাড়না অনুভব করছি।
আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দর প্রায় দেড় শ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, তখন বাংলাদেশে ওই দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন ধরনের পেট্রোলিয়ামজাত জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়নি। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিদ্ধান্তকে ভুল বলা যাবে না, কারণ জ্বালানি তেল মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনীতির উৎপাদনশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘স্ট্র্যাটেজিক’ অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে প্রচুর লোকসানের ধকল সামলাতে হয়েছিল। একপর্যায়ে ভর্তুকি দিয়ে এই লোকসানের কিয়দংশ মেটাতে গিয়ে সরকারকেও বিশাল বাজেট ঘাটতির কবলে পড়তে হয়েছিল। ওই সময় বাজেট ঘাটতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানির দাম কয়েক দফায় বাড়ানো সত্ত্বেও ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত প্ল্যান্টগুলোর বিদ্যুতের উৎপাদন ক্যাপাসিটি অব্যবহৃত রেখে ঘনঘন লোডশেডিং করে উৎপাদন ও জনজীবনকে বিপর্যস্ত করা হয়েছে প্রায় এক বছর। দাম বৃদ্ধির পরও ওই সময় পেট্রল ও অকটেন ছাড়া অন্য ধরনের তেলের প্রকৃত খরচ মেটানো যায়নি, যার ফলে ডিজেল, কেরোসিন ও ফার্নেস অয়েলের মতো জ্বালানি পণ্যের দামের সঙ্গে খরচের পার্থক্য মেটাতে সরকারের ভর্তুকিও বন্ধ করা যায়নি, আবার পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের লোকসানও তেমন কমানো যায়নি।
এরপর যখন তেলের আন্তর্জাতিক দামে ধস নামতে শুরু করেছে, তখন সরকার তেলের দাম বর্তমান পর্যায়ে অপরিবর্তিত রাখায় সরকারি ভর্তুকি কমতে কমতে শূন্য হয়ে যায় এবং পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের লোকসানের অঙ্কও দ্রুত কমতে কমতে শূন্য হয়ে উল্টো তাদের মুনাফার অঙ্ক দ্রুত স্ফীত হতে থাকে। অর্থমন্ত্রী ও জ্বালানি উপদেষ্টা দুজনই যাবতীয় দাবির মুখে তেলের দাম না কমানোর পক্ষে নানা যুক্তি দিয়ে তাঁদের ওই সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। একপর্যায়ে তেলের দাম না কমানোর পক্ষে উত্থাপিত তাঁদের যুক্তিগুলো দুর্বল হতে হতে এখন খোঁড়া যুক্তির রূপ পরিগ্রহ করেছে।
তর্কের খাতিরে ওই যুক্তিগুলোর পুনরুল্লেখ করছি। জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী নিজেই অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনকারী মেধাবী অর্থনীতিবিদ এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের কাছে আলোকবর্তিকাস্বরূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। অর্থমন্ত্রী ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। সিএসপি হওয়ার পর তিনিও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাস্টার্স করেছেন এবং তাঁর সুদীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক ক্যারিয়ারে বেশির ভাগ সময় তিনি অর্থনৈতিক নীতি–সংক্রান্ত নানা নীতিনির্ধারক পদে দায়িত্ব পালনের কারণে তাঁকেও একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ঝানু অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি। তেলের দাম না কমানোর পক্ষে তাঁদের যুক্তিগুলো আমিও গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। গত দেড় বছরে যেভাবে তাঁরা সরকারের একটা বিশাল ঘাটতির বোঝা হালকা করে ফেলেছেন, সেটাকেও আমি ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করার পক্ষে। কিন্তু এক ব্যারেল অশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক দাম ৩০ ডলারের কাছাকাছি নেমে আসার পরও তেলের অভ্যন্তরীণ দাম আকাশচুম্বী রেখে শুধু পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মুনাফা ফাঁপানোর লক্ষ্যে এবং সরকারের রাজস্ব খাতে সুবিধা আদায় করে নেওয়ার অবস্থানকে আরও দীর্ঘকাল ধরে রাখাকে অর্থনীতির একজন ছাত্র হিসেবে আর সমর্থনযোগ্য মনে করতে পারছি না। কারণ, জ্বালানি তেল তো আর ১০টি পণ্যের মতো পণ্য নয়, এটা অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিকে এত মৌলিকভাবে প্রভাবিত করে যে তেলের দাম না কমানোর নীতিটা এখন পুরো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে জোয়ার আনার বিশাল একটা সুযোগ থেকে দেশকে বঞ্চিত করে চলেছে। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এ বছর সাড়ে ৮ শতাংশ অতিক্রম করে গেছে, কিন্তু আমরা এখনো ৭ শতাংশই ছুঁতে পারলাম না। ভারতে জ্বালানি তেলের অভ্যন্তরীণ দামকে যেভাবে ধাপে ধাপে কমিয়ে অর্থনীতিতে এর সুফলগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে কি আমাদের কিছুই শিক্ষণীয় নেই?
উল্লিখিত ওই সেমিনারে জ্বালানি উপদেষ্টা কিছু বাস্তবতা উল্লেখ করে তেলের দাম কমানোর পক্ষে ড. বিরূপাক্ষ পালের উত্থাপিত যুক্তিগুলো নাকচ করার প্রয়াস নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ দেশে দাম বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হলে বিক্রেতারা যত দাম বাড়ানো যৌক্তিক, তার কয়েক গুণ দাম বাড়িয়ে মুনাফাবাজিতে মেতে ওঠেন, অথচ বিশ্ববাজারে কোনো পণ্যের দাম কমে গেলে এ দেশে ওই পণ্যের দাম যৌক্তিকভাবে কমিয়ে ক্রেতাদের তাঁরা দাম কমার ফায়দাটা পাওয়ার সুযোগ দেন না। উদাহরণ ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, মসলাপাতি ইত্যাদি পণ্যের আন্তর্জাতিক দাম সম্প্রতি বেশ কমে গেলেও বাংলাদেশের ভোক্তারা এর সুবিধা পাননি। তিনি আরও বলেছেন, কোনো অজুহাত পেলেই পরিবহনমালিকেরা ভাড়া বাড়ানোর মওকা নিতে মোটেও দেরি করেন না, অথচ এখন যদি ডিজেলের দাম সরকার কমিয়ে দেয়, তাহলেও তাঁরা পরিবহনের ভাড়া কমাবেন না। বরং ভাড়া না কমানোর জন্য নানা ওজর দেখিয়ে তাঁদের খরচ সাশ্রয়ের ফলে উদ্ভূত মুনাফাটুকু নিজেদের ভাগেই টেনে নেবেন। ভাড়া একবার বাড়াতে পারলে আবার বাড়ানোর সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন এ দেশের বিক্রেতারা, এটাই এ দেশের বাজার-সংস্কৃতি। এই যুক্তিগুলো আসলে এ দেশের সরকার ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতারই পরিচায়ক। বাজার-শাসন বা মার্কেট-গভর্নেন্স যে মুক্তবাজার অর্থনীতির সাফল্যের প্রাণভোমরা ধারণ করে রয়েছে, সেটা বুঝতে অনেক দিন লাগবে আমাদের শাসক মহলের। যৌক্তিক মুনাফা করা আর মুনাফাবাজি করা এক কথা নয়। আর মুনাফাবাজির সুযোগ করে দেওয়া লুটপাটকে মেনে নেওয়া বৈকি! অন্যদিকে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ও দাম ব্যবস্থা চালু করার জন্য ভোক্তাস্বার্থ রক্ষার যে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়, তার ধারেকাছেও যাইনি আমরা। (এ দেশে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের নেতা বনে যান মন্ত্রী, অযোগ্য চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ খুনের ক্রিমিনাল অপরাধ করলেও তাঁদের যথাযোগ্য শাস্তি দেওয়ার বিপক্ষে সংঘ-শক্তি জয়ী হয়ে যায়। অতএব এ দেশে ক্রেতাস্বার্থ অবহেলিত থাকাটাই স্বাভাবিক।)
উপদেষ্টা মহোদয় যুক্তি দেখিয়েছেন যে তেলের দাম কমানো হলে বিনিয়োগ বাড়বে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা সত্য নয়। তেলের দাম কমানোর যুক্তি প্রদর্শনের সময় এসব বাস্তবতা বিবেচনা করাই সমীচীন হবে। তাঁর যুক্তি উপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু জ্বালানি তেলের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ভোগ্যপণ্য, মূলধিন পণ্যের ক্ষেত্রে এর ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজেস এতই সুদূরপ্রসারী যে দাম কমানোর সম্ভাব্য প্রভাবকে তিনি অবমূল্যায়ন করছেন বলে মনে হচ্ছে। এত দিন ধরে শুধু পেট্রল ও অকটেনের দাম বেশি রেখে মুনাফা করে ডিজেল এবং কেরোসিনে প্রদত্ত ভর্তুকি কিঞ্চিৎ মেটানো হতো। কিন্তু এখন তো ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিনেও মুনাফা করছে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন—এর কী অর্থনৈতিক যুক্তি থাকতে পারে? এই তিনটি পণ্য ধনীদের ভোগ্যপণ্য নয়। কেরোসিন তো সমাজের দরিদ্র জনগণের জ্বালানি, তাই এখানে তো সব সময় ভর্তুকি দেওয়াই সমীচীন। ডিজেল থেকে মুনাফা করাও ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ। অন্ততপক্ষে ভর্তুকি না দিলেও যা উৎপাদন খরচ, তার বেশি দাম নেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। আর ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের দাম কমলে বিদ্যুতের দাম কমানোর যুক্তি শক্তিশালী হবে। তাই আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, পেট্রল ও অকটেনে লিটারপ্রতি ১০ টাকা মুনাফা রেখে দাম নির্ধারণ করা হোক, যার ফলে পেট্রলের দাম ৬০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৭০ টাকায় নামিয়ে আনা যাবে। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের দাম ৪০ টাকায় নামিয়ে আনলেও পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কিছু মুনাফা থাকবে। কেরোসিনে কিছু ভর্তুকি অব্যাহত রাখার সুপারিশ করছি, ২০ টাকার নিচে কেরোসিনের লিটারপ্রতি দাম নির্ধারণ করলেই চলবে।
বণিক বার্তায় প্রকাশিত হয়েছে যে অশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক দাম ৪০ ডলারের কমে (বর্তমানে ৩০ ডলার) কয়েক মাস ধরে স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন নাকি ৬১ ডলারে এক ব্যারেল তেল কিনে চলেছে তাদের মান্ধাতা আমলের ক্রয়নীতির কারণে। অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে দুজন মেধাবী ও ঝানু অর্থনীতিবিদের দীর্ঘ নেতৃত্ব সত্ত্বেও এটা কীভাবে চলছে? পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উচ্চ বেতনের অতিরিক্ত কত ধরনের ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, সে সম্পর্কে দেশবাসী কি সঠিকভাবে অবগত আছেন? আমার মনে হয় না। এদিকে একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন নয় কি? আর সরকার যে তেল আমদানির ওপর শুল্ক, ভ্যাট ও কর বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আহরণ করে থাকে, তা কি আমরা ভালোভাবে জানি?
পুরো তেল আমদানি, পরিশোধন, বিপণন ক্ষেত্রে যে মুনাফাবাজি চলছে, সেটা কি বন্ধ হবে না?
ড. মইনুল ইসলাম, অধ্যাপক: অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দর প্রায় দেড় শ ডলারের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, তখন বাংলাদেশে ওই দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন ধরনের পেট্রোলিয়ামজাত জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়নি। অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সিদ্ধান্তকে ভুল বলা যাবে না, কারণ জ্বালানি তেল মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনীতির উৎপাদনশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ‘স্ট্র্যাটেজিক’ অনুঘটক হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এর ফলে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনকে প্রচুর লোকসানের ধকল সামলাতে হয়েছিল। একপর্যায়ে ভর্তুকি দিয়ে এই লোকসানের কিয়দংশ মেটাতে গিয়ে সরকারকেও বিশাল বাজেট ঘাটতির কবলে পড়তে হয়েছিল। ওই সময় বাজেট ঘাটতিকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানির দাম কয়েক দফায় বাড়ানো সত্ত্বেও ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলচালিত প্ল্যান্টগুলোর বিদ্যুতের উৎপাদন ক্যাপাসিটি অব্যবহৃত রেখে ঘনঘন লোডশেডিং করে উৎপাদন ও জনজীবনকে বিপর্যস্ত করা হয়েছে প্রায় এক বছর। দাম বৃদ্ধির পরও ওই সময় পেট্রল ও অকটেন ছাড়া অন্য ধরনের তেলের প্রকৃত খরচ মেটানো যায়নি, যার ফলে ডিজেল, কেরোসিন ও ফার্নেস অয়েলের মতো জ্বালানি পণ্যের দামের সঙ্গে খরচের পার্থক্য মেটাতে সরকারের ভর্তুকিও বন্ধ করা যায়নি, আবার পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের লোকসানও তেমন কমানো যায়নি।
এরপর যখন তেলের আন্তর্জাতিক দামে ধস নামতে শুরু করেছে, তখন সরকার তেলের দাম বর্তমান পর্যায়ে অপরিবর্তিত রাখায় সরকারি ভর্তুকি কমতে কমতে শূন্য হয়ে যায় এবং পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের লোকসানের অঙ্কও দ্রুত কমতে কমতে শূন্য হয়ে উল্টো তাদের মুনাফার অঙ্ক দ্রুত স্ফীত হতে থাকে। অর্থমন্ত্রী ও জ্বালানি উপদেষ্টা দুজনই যাবতীয় দাবির মুখে তেলের দাম না কমানোর পক্ষে নানা যুক্তি দিয়ে তাঁদের ওই সিদ্ধান্তকে সঠিক প্রমাণ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। একপর্যায়ে তেলের দাম না কমানোর পক্ষে উত্থাপিত তাঁদের যুক্তিগুলো দুর্বল হতে হতে এখন খোঁড়া যুক্তির রূপ পরিগ্রহ করেছে।
তর্কের খাতিরে ওই যুক্তিগুলোর পুনরুল্লেখ করছি। জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী নিজেই অর্থনীতিতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনকারী মেধাবী অর্থনীতিবিদ এবং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আমাদের কাছে আলোকবর্তিকাস্বরূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। অর্থমন্ত্রী ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের মেধাবী ছাত্র ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। সিএসপি হওয়ার পর তিনিও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে মাস্টার্স করেছেন এবং তাঁর সুদীর্ঘ আমলাতান্ত্রিক ক্যারিয়ারে বেশির ভাগ সময় তিনি অর্থনৈতিক নীতি–সংক্রান্ত নানা নীতিনির্ধারক পদে দায়িত্ব পালনের কারণে তাঁকেও একজন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ঝানু অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি শ্রদ্ধা করি। তেলের দাম না কমানোর পক্ষে তাঁদের যুক্তিগুলো আমিও গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। গত দেড় বছরে যেভাবে তাঁরা সরকারের একটা বিশাল ঘাটতির বোঝা হালকা করে ফেলেছেন, সেটাকেও আমি ইতিবাচকভাবে মূল্যায়ন করার পক্ষে। কিন্তু এক ব্যারেল অশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক দাম ৩০ ডলারের কাছাকাছি নেমে আসার পরও তেলের অভ্যন্তরীণ দাম আকাশচুম্বী রেখে শুধু পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের মুনাফা ফাঁপানোর লক্ষ্যে এবং সরকারের রাজস্ব খাতে সুবিধা আদায় করে নেওয়ার অবস্থানকে আরও দীর্ঘকাল ধরে রাখাকে অর্থনীতির একজন ছাত্র হিসেবে আর সমর্থনযোগ্য মনে করতে পারছি না। কারণ, জ্বালানি তেল তো আর ১০টি পণ্যের মতো পণ্য নয়, এটা অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিকে এত মৌলিকভাবে প্রভাবিত করে যে তেলের দাম না কমানোর নীতিটা এখন পুরো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নে জোয়ার আনার বিশাল একটা সুযোগ থেকে দেশকে বঞ্চিত করে চলেছে। ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার এ বছর সাড়ে ৮ শতাংশ অতিক্রম করে গেছে, কিন্তু আমরা এখনো ৭ শতাংশই ছুঁতে পারলাম না। ভারতে জ্বালানি তেলের অভ্যন্তরীণ দামকে যেভাবে ধাপে ধাপে কমিয়ে অর্থনীতিতে এর সুফলগুলো ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, তা থেকে কি আমাদের কিছুই শিক্ষণীয় নেই?
উল্লিখিত ওই সেমিনারে জ্বালানি উপদেষ্টা কিছু বাস্তবতা উল্লেখ করে তেলের দাম কমানোর পক্ষে ড. বিরূপাক্ষ পালের উত্থাপিত যুক্তিগুলো নাকচ করার প্রয়াস নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ দেশে দাম বাড়ানোর সুযোগ সৃষ্টি হলে বিক্রেতারা যত দাম বাড়ানো যৌক্তিক, তার কয়েক গুণ দাম বাড়িয়ে মুনাফাবাজিতে মেতে ওঠেন, অথচ বিশ্ববাজারে কোনো পণ্যের দাম কমে গেলে এ দেশে ওই পণ্যের দাম যৌক্তিকভাবে কমিয়ে ক্রেতাদের তাঁরা দাম কমার ফায়দাটা পাওয়ার সুযোগ দেন না। উদাহরণ ভোজ্যতেল, চিনি, পেঁয়াজ, মসলাপাতি ইত্যাদি পণ্যের আন্তর্জাতিক দাম সম্প্রতি বেশ কমে গেলেও বাংলাদেশের ভোক্তারা এর সুবিধা পাননি। তিনি আরও বলেছেন, কোনো অজুহাত পেলেই পরিবহনমালিকেরা ভাড়া বাড়ানোর মওকা নিতে মোটেও দেরি করেন না, অথচ এখন যদি ডিজেলের দাম সরকার কমিয়ে দেয়, তাহলেও তাঁরা পরিবহনের ভাড়া কমাবেন না। বরং ভাড়া না কমানোর জন্য নানা ওজর দেখিয়ে তাঁদের খরচ সাশ্রয়ের ফলে উদ্ভূত মুনাফাটুকু নিজেদের ভাগেই টেনে নেবেন। ভাড়া একবার বাড়াতে পারলে আবার বাড়ানোর সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন এ দেশের বিক্রেতারা, এটাই এ দেশের বাজার-সংস্কৃতি। এই যুক্তিগুলো আসলে এ দেশের সরকার ও শাসনব্যবস্থার দুর্বলতারই পরিচায়ক। বাজার-শাসন বা মার্কেট-গভর্নেন্স যে মুক্তবাজার অর্থনীতির সাফল্যের প্রাণভোমরা ধারণ করে রয়েছে, সেটা বুঝতে অনেক দিন লাগবে আমাদের শাসক মহলের। যৌক্তিক মুনাফা করা আর মুনাফাবাজি করা এক কথা নয়। আর মুনাফাবাজির সুযোগ করে দেওয়া লুটপাটকে মেনে নেওয়া বৈকি! অন্যদিকে প্রতিযোগিতামূলক বাজার ও দাম ব্যবস্থা চালু করার জন্য ভোক্তাস্বার্থ রক্ষার যে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হয়, তার ধারেকাছেও যাইনি আমরা। (এ দেশে পরিবহনমালিক ও শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নের নেতা বনে যান মন্ত্রী, অযোগ্য চালক দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষ খুনের ক্রিমিনাল অপরাধ করলেও তাঁদের যথাযোগ্য শাস্তি দেওয়ার বিপক্ষে সংঘ-শক্তি জয়ী হয়ে যায়। অতএব এ দেশে ক্রেতাস্বার্থ অবহেলিত থাকাটাই স্বাভাবিক।)
উপদেষ্টা মহোদয় যুক্তি দেখিয়েছেন যে তেলের দাম কমানো হলে বিনিয়োগ বাড়বে বলে যে দাবি করা হচ্ছে, তা সত্য নয়। তেলের দাম কমানোর যুক্তি প্রদর্শনের সময় এসব বাস্তবতা বিবেচনা করাই সমীচীন হবে। তাঁর যুক্তি উপেক্ষা করা যাবে না। কিন্তু জ্বালানি তেলের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ ভোগ্যপণ্য, মূলধিন পণ্যের ক্ষেত্রে এর ব্যাকওয়ার্ড ও ফরওয়ার্ড লিংকেজেস এতই সুদূরপ্রসারী যে দাম কমানোর সম্ভাব্য প্রভাবকে তিনি অবমূল্যায়ন করছেন বলে মনে হচ্ছে। এত দিন ধরে শুধু পেট্রল ও অকটেনের দাম বেশি রেখে মুনাফা করে ডিজেল এবং কেরোসিনে প্রদত্ত ভর্তুকি কিঞ্চিৎ মেটানো হতো। কিন্তু এখন তো ডিজেল, ফার্নেস অয়েল ও কেরোসিনেও মুনাফা করছে পেট্রোলিয়াম করপোরেশন—এর কী অর্থনৈতিক যুক্তি থাকতে পারে? এই তিনটি পণ্য ধনীদের ভোগ্যপণ্য নয়। কেরোসিন তো সমাজের দরিদ্র জনগণের জ্বালানি, তাই এখানে তো সব সময় ভর্তুকি দেওয়াই সমীচীন। ডিজেল থেকে মুনাফা করাও ন্যায়বিচারের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ। অন্ততপক্ষে ভর্তুকি না দিলেও যা উৎপাদন খরচ, তার বেশি দাম নেওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। আর ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের দাম কমলে বিদ্যুতের দাম কমানোর যুক্তি শক্তিশালী হবে। তাই আমার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব, পেট্রল ও অকটেনে লিটারপ্রতি ১০ টাকা মুনাফা রেখে দাম নির্ধারণ করা হোক, যার ফলে পেট্রলের দাম ৬০ টাকা এবং অকটেনের দাম ৭০ টাকায় নামিয়ে আনা যাবে। ডিজেল ও ফার্নেস অয়েলের দাম ৪০ টাকায় নামিয়ে আনলেও পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কিছু মুনাফা থাকবে। কেরোসিনে কিছু ভর্তুকি অব্যাহত রাখার সুপারিশ করছি, ২০ টাকার নিচে কেরোসিনের লিটারপ্রতি দাম নির্ধারণ করলেই চলবে।
বণিক বার্তায় প্রকাশিত হয়েছে যে অশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক দাম ৪০ ডলারের কমে (বর্তমানে ৩০ ডলার) কয়েক মাস ধরে স্থিতিশীল থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন নাকি ৬১ ডলারে এক ব্যারেল তেল কিনে চলেছে তাদের মান্ধাতা আমলের ক্রয়নীতির কারণে। অর্থনৈতিক নীতি প্রণয়নে দুজন মেধাবী ও ঝানু অর্থনীতিবিদের দীর্ঘ নেতৃত্ব সত্ত্বেও এটা কীভাবে চলছে? পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা উচ্চ বেতনের অতিরিক্ত কত ধরনের ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন, সে সম্পর্কে দেশবাসী কি সঠিকভাবে অবগত আছেন? আমার মনে হয় না। এদিকে একটু নজর দেওয়া প্রয়োজন নয় কি? আর সরকার যে তেল আমদানির ওপর শুল্ক, ভ্যাট ও কর বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আহরণ করে থাকে, তা কি আমরা ভালোভাবে জানি?
পুরো তেল আমদানি, পরিশোধন, বিপণন ক্ষেত্রে যে মুনাফাবাজি চলছে, সেটা কি বন্ধ হবে না?
ড. মইনুল ইসলাম, অধ্যাপক: অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments